Friday 12 March 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ১০

 


১০

 

তারস্বরে কাক ডাকছে। ক্যাম্পাসে এত কাক আজ কোত্থেকে এলো বুঝতে পারছি না। হয়তো এখানেই ছিল গাছে গাছে, এতদিন নিত্যদিনের কোলাহলে  আলাদা করে কানে যায়নি তাদের ডাক। আজ এই স্তব্ধ সন্ধ্যায় বড় বেশি কর্কশ মনে হচ্ছে তাদের। হলের গেটের সামনে রাস্তার উপর কাৎ হয়ে পড়ে আছে একটা দুমড়ানো-মোচড়ানো রিকশা। মনে হচ্ছে এর উপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দেয়া হয়েছে। রিকশার কাছেই চ্যাপ্টা হয়ে শুয়ে আছে একটা মাইকের চতুষ্কোণ বাদামী অ্যামপ্লিফায়ার। আজ সকালেও এই মেশিন সচল ছিল, সাবিনা ইয়াসমিনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতের শব্দ বহুগুণ বিবর্ধিত হচ্ছিলো এর ভেতরের ইলেকট্রনিক্সের মধ্য দিয়ে। সাইক্লোন থেমে যাবার পর প্রকৃতি যেমন কিছু সময়ের জন্য অপ্রকৃতিস্থ রকমের শান্ত হয়ে যায়, হলের সামনে এখন সেরকম পরিস্থিতি। মানুষের চলাচল আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সেই চলায় ছন্দ নেই। এ ওর সাথে কথা বলছে, কিন্তু মনে হচ্ছে সেরকম শব্দ নেই। অদ্ভুত এক ভয় ঢুকে গেছে আমার ভেতর। হল ছাড়তে হবে কাল সকাল ন’টার মধ্যে। কিন্তু তার আগে তো রুমে যেতে হবে। রুমের অবস্থা কী হয়েছে জানি না এখনো।

 

সোহরাওয়ার্দী হলের অফিসের সামনে, বারান্দায় বীরদর্পে হাঁটছে অনেকে। এদের মধ্যে মুখচেনা কয়েকজন কয়েকদিন আগেও মাথা অনেকটা নিচু করে ধীর পায়ে হাঁটতো। তাদের চলন কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই এখন পশুরাজের মতো হয়ে গেছে। ছাত্রশিবিরের এই রূপ আরো একবার দেখেছিলাম আড়াই বছর আগে ১৯৮৪’র এপ্রিলে চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হোস্টেলে। হোস্টেলের রুমের ভেতরই তারা ছুরি দিয়ে জবাই করে ফেলেছিল আমার সহপাঠী বন্ধু শাহাদাতকে। শাহাদাত প্রগতিশীল কথাবার্তা বলতো, যুক্তিবাদী ছিল। ভোরে যখন খবর পেলাম, ছুটে গিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দী হোস্টেলে। তখন দেখেছিলাম হোস্টেলের বারান্দায় শিবিরের দাপুটে তৎপরতা। আজ এখানেও।

 

আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে দেবাশিসদার রুমে টোকা দিলাম। আলো নিভিয়ে অন্ধকারে বসে আছেন তিনি। রুমে ঢুকার পর দেখলাম আরো চার-পাঁচজন আছেন সেখানে। ফিসফিস করে কথা বলছেন সবাই। চুপচাপ বসে তাঁদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে আজ ক্যাম্পাসে কী কী হয়েছে,  তার একটা মোটামুটি ঘটনাচিত্র জানা গেল। ক্যাম্পাসে জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা হামিদ বাহিনীর ভয়ে এতদিন টু শব্দ করতে পারেনি ছাত্রশিবির। বিএনপি, ছাত্রলীগ কিংবা ছাত্রইউনিয়নকে বিভিন্ন হলে কিছুটা ছাড় দিলেও ছাত্রশিবিরকে প্রকাশ্যে কোন ছাড় দেয়নি হামিদ এবং তার ক্যাডাররা। আমানত হলে নাকি ছাত্রশিবিরের সভাপতিকে শিবিরের কর্মীদের সামনে চড় মেরেছিল হামিদ। সেদিনই নাকি হামিদের নাম লেখা হয়ে গেছে শিবিরের হিটলিস্টে। এরশাদ রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করার পর রাজনৈতিক দল করেছেন বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যেই ছাত্রসমাজের এত দাপট তো কোন আদর্শের বলে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা্র জন্য যাদের ত্যাগ ও আদর্শের সংগ্রাম সর্বজনস্বীকৃত, সেই ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের চেয়েও বেশি নেতা-কর্মী এরা জোগাড় করে ফেললো এত সহজেই! এর পেছনে যে কোন আদর্শ কাজ করেনি – তা তো সবাই বোঝে। ছাত্রসমাজ গায়ের জোরে প্রত্যেক হলেই বেশ কিছু রুম দখল করেছে। সেইসব রুমে থাকার জন্য অন্য পার্টির আদর্শে বিশ্বাসীও অনেকে প্রকাশ্যে ছাত্রসমাজের বিরোধিতা করেনি। সুবিধালোভীদের উপর নির্ভর করে কি বেশিদিন টিকে থাকা যায়? জাতীয় ছাত্রসমাজের কোন আদর্শ ছিল না, লক্ষ্য ছিল না। ছিল শুধু ক্ষমতা দেখানো, পেশীর দাপট দেখানো। কিন্তু মাংসপেশীতে টান পড়লে পেশীশক্তির দাপট চলে যায়। ছাত্রশিবিরের পেশীশক্তিও আছে, আবার তাদের আদর্শে বিশ্বাসী বিপুল কর্মীও আছে। গত এক মাস ধরে হামিদ বাহিনী ক্যাম্পাসে নবীনবরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, এ উপলক্ষে বিরাট অংকের চাঁদাবাজি করতে ব্যস্ত ছিল। এর মধ্যে সারাদেশ থেকে শিবিরের ক্যাডাররা যে এসে ক্যাম্পাসের আশেপাশে জড়ো হয়েছে, তা কেউ সেভাবে খেয়ালই করেনি। খেয়াল করবে কীভাবে? জামায়াত-শিবির যেভাবে নিরবে প্রস্তুতি নিতে পারে, অন্যরা কি সেরকম পারে? অন্যরা তো যতটুকু কাজ করে, চিৎকার করে তার চেয়ে বেশি।

 

সবগুলি হলে একযোগে একই সাথে আক্রমণ করা হয়েছে। ছাত্রসমাজের একটা রুমও অক্ষত নেই, একজন নেতাও অক্ষত নেই। হামিদকে ধরেছে সোহরাওয়ার্দীর মোড়ে। ইট দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলে ইটের উপর ডান হাত রেখে তলোয়ার দিয়ে এক কোপে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে কনুইয়ের উপর থেকে। একটা একটা করে কেটে ফেলা হয়েছে বাম হাতের প্রত্যেকটি আঙুল। যে হাত দিয়ে হামিদ একদিন ছাত্রশিবিরের সভাপতির গালে চড় মেরেছিল, সেই হাত কেটে তলোয়ারের আগায় গেঁথে হলের সামনে মিছিল করেছে ছাত্রশিবির। শুনে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। অবশ্য এদের নিষ্ঠুরতা নতুন কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা যেভাবে আমাদের দেশের স্বর্ণসন্তানদের হত্যা করেছিল তার মতো নিষ্ঠুরতা পৃথিবী খুব বেশি দেখেনি।

 

“আমি কি রুমে যেতে পারবো দাদা?” – ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। দেবাশিসদা বললেন, “কেন পারবে না? জানালা দিয়ে দেখো, তোমাদের ব্লকে অনেকেই গেছে তো।“

দেবাশিসদার রুমের জানালা থেকে আমাদের ব্লকের দোতলার বারান্দার কিছুটা অংশ দেখা যায়। বারান্দায় সুসানভাইকে দেখলাম শুকনো মুখে রেলিং-এ ঝুঁকে কিছু একটা দেখছেন। শুনেছি ছাত্রসমাজের সব নেতাই আজ মার খেয়েছে। তবে কি সুসানভাই এখনো মার-খাওয়ার-যোগ্য-নেতা হতে পারেননি? অবশ্য ঘটনার সময় রুমে থাকলে আমিও কি রেহাই পেতাম? জাতীয় ছাত্রসমাজের রুমে থাকি, অথচ আমি তাদের পার্টি সমর্থন করি না এসব বলার সুযোগ পেতাম তলোয়ারের কোপ খাওয়ার অনেক পরে।

 

রুমে ঢুকে কী দেখবো তার একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম দেবাশিসদার রুম থেকে বের হয়ে আমাদের ব্লকের সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময়। কিন্তু রুমে ঢুকে যা দেখলাম তার তুলনায় আমার মানসিক প্রস্তুতি ছিল নগণ্য। মেঝেতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে আমার ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সের বই, খাতাপত্র। টেবিলঘড়িটাকে মনে হয় আছড়ে ভাঙা হয়েছে। পেছনের ডালা খুলে কালো ধাতব স্প্রিং বের হয়ে আছে। মাত্র কয়েকদিন আগে বানানো নতুন তোষক ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে। তোষকের ভেতর কী খুঁজেছে তারা? খাটের নিচে আমার বাক্সটা ছিল। আমার মাথায় চড়ে এসেছিল এই বাক্স এই ক্যাম্পাসে। বাক্সটার তালা ভাঙেনি, তালাশুদ্ধ পুরো হুকটাই কেটে ফেলা হয়েছে। ভেতরের সব জিনিস লন্ডভন্ড। সব টাকা-পয়সা রেখেছিলাম বাক্সে। নিয়ে গেছে। ছাত্রশিবির নাকি আদর্শের জন্য সবকিছু করে। হল আক্রমণ করে টাকা চুরি করার মধ্যে কী আদর্শ কাজ করেছে কে জানে। রুমের একটা জানালার কাচও আস্ত নেই। দেয়ালে টাঙানো এরশাদের ছবিটাকে তলোয়ার দিয়ে যতটা খুঁচিয়েছে তার চেয়ে বেশি খোঁচা মেরেছে শ্রীদেবীর ছবিতে। টেবিলে, মশারির স্ট্যান্ডে, চেয়ারের হাতলে তলোয়ারের কোপের দাগ স্পষ্ট। কতক্ষণ ধরে এই তান্ডব চালিয়েছিল তারা?

 

সুসানভাই আমাকে দেখে একটা কথাও বললেন না, চোখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। এতদিন আমার সামনে যেরকম উদ্ধত নেতৃত্বের একটা ভাব দেখাতেন, আজ সেটা নেই বলেই হয়তো খারাপ লাগছে। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। একটু পরে চার-পাঁচজন টিচার এলেন। হয়তো প্রক্টরের দলবল। কিন্তু তাদের সাথে তো শিবিরের নেতাও আছে বলে মনে হচ্ছে। বারান্দা থেকে উঁকি দিলেন খোলা দরজা দিয়ে। দরজার যা হাল হয়েছে – ওটা আর বন্ধ করা যাবে না। দলের একজন বললেন, “তোমরা সকাল আটটার মধ্যে চলে যেও। হলের সামনে বাস থাকবে। শহর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।“

 

যাক, সকালে কীভাবে শহরে যাবো সেটা নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আপাতত জিনিসপত্র যতটুকু পারি গুছিয়ে রাখি। হলের পাট তো চুকলো। একটু পরে শ্যামলদা এলেন। তাঁর জিনিসপত্র খুব বেশি নেই। ছোট্ট একটা প্যাকেট হলো। সেটা নিয়ে তিনি রাতেই চলে গেলেন। আমার সাথে আবার কখনো দেখা হবে কি না জানি না। একটু পরে অনেক জিনিসপত্র নিয়ে রুমে ঢুকলেন অপরিচিত একজন।

 

“সুসান, আজিয়া আঁত্তু এঁন্ডে থাগা পরিবো। আলাওলর অবস্থা ব্যাশি খারাপ। হেন্ডে স্ট্যানগান দি ব্রাশফায়র গরি চদরভদর গরি ফালাইয়ে।“ – আগন্তুক রুমে ঢুকে হাত থেকে ব্যাগ-বিছানা নামাতে নামাতে হড়বড় করে বলছেন। সুসানভাইয়ের পরিচিত কেউ হবেন। আলাওল হলে কী কী হয়েছে তার বর্ণনা দিচ্ছেন আগন্তুক। ছাত্রসমাজের মূল ঘাঁটি ছিল আলাওল হলে। হামিদ এবং তার ক্যাডাররা থাকতো সেখানে। স্ট্যানগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে সেসব রুম। আমরা তো শুনেছিলাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে স্ট্যানগান সরবরাহ করা হয়েছিল হামিদের ক্যাডারদের। সেসব অস্ত্রও কি এখন শিবিরের হাতে চলে গেছে?

 

সুসানভাইয়ের পরিচিত আগন্তুক টিপু-ভাইয়ের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনবরত কথা বলছেন। সুসানভাই তেমন কোন কথাবার্তা বলছেন না। আমি আমার বইপত্র গোছাতে গোছাতে আগন্তুকের কথা শুনছি। জানা গেলো টিপুভাইও প্রচন্ড মার খেয়েছেন। মাথায় আর চোখে তো আগে থেকেই চোট ছিল, আজ নাকি তার হাত-পাও গেছে। হাত ও পায়ের রগ কেটে দিয়েছে সম্ভবত।

 

ঘুমাতে গিয়ে তোষকের অবস্থা দেখে কেমন যেন লাগছে। শামসুন্নাহার হল থেকে এই তোষক আমার হাতে এসেছিল তোষকাস্ম হয়ে। তারপর তাকে তোষক বানানো হলো। কয়েকদিনের মধ্যেই শিবিরের হাতে এই তোষক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তবুও ভালো যে তোষকের উপর আমি ছিলাম না সেই সময়। রুমের ভেতর প্রচন্ড ঠান্ডা। নভেম্বরের শেষে এমনিতেই শীত। কিন্তু আজ রুমের সব জানালার কাচ ভাঙা। দরজা বন্ধ করা যাচ্ছে না। দরজার পাল্লায় একটা চেয়ার দিয়ে কোন রকমে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। পাল্লার কাঠের একটা অংশ ভেঙে পড়ে গেছে, সেদিক দিয়ে বাতাস ঢুকছে। দরজা ভাঙার জন্য এরা কী এনেছিল কে জানে।

 

ভীষণ ক্লান্তি লাগছে, কিন্তু ঘুম আসছে না। আগন্তুক দরজা খুলে বাইরে গেলেন, হয়তো বাথরুমে। একটু পর সুসানভাই ফিসফিস করে বললেন, “এই ব্যাটা কিন্তু শিবির করে। সাবধান। শিবির সম্পর্কে কোন মন্তব্য করবে না।“

বলে কী? আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম আগন্তুক রুমে ঢুকার পর শিবির সম্পর্কে আমি কিছু বলেছি কি না। মনে করতে পারলাম না।

 

পরদিন সকাল আটটার আগেই বাসে উঠে পড়েছি। টিচার্স বাসে এই প্রথম উঠলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য কী সুন্দর বাসের ব্যবস্থা আছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন যতগুলি বাস ভাড়া করে আনে, সেই ভাড়া দিয়ে অনেক বাস কিনে ফেলা যেতো। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে, বিছানা-বালিশসহ সবকিছু নিয়ে হল ত্যাগ করছি, আর এসময় আমি ভাবছি বিশ্ববিদ্যালয় বাস কিনতে পারতো কি না। মানুষের চিন্তাভাবনার কোন আগামাথা যে থাকে না, তা বুঝতে পারছি।

 

আমার চারটি লাগেজ হয়েছে। তোষকটার তুলা বের হয়ে যাচ্ছে, কাঁথা দিয়ে প্যাঁচাতে হয়েছে। বইপত্র রশি দিয়ে বেঁধেছি। সবচেয়ে ঝামেলা করেছে টিনের বাক্সটি। ওটাকে এমনভাবে কেটে ফেলেছে যে ডালা বন্ধ করা যাচ্ছে না। রশি দিয়ে বাঁধতে হয়েছে ওটাকেও। সব জিনিস একবারে তোলা যায়নি, রুম থেকে বাস পর্যন্ত কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। সব জিনিস বাসে তুলে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে সিটে বসলাম। অনেকগুলি বাস দেয়া হয়েছে, সুতরাং ঠাসাঠাসি ভিড় না করলেও চলে। কিন্তু মনে হচ্ছে সবাই এই বাসেই উঠবে বলে ঠিক করেছে। একটু পরেই বাসে আর জায়গা নেই। আমার মতো ট্রাংক ও বিছানাপত্র নিয়ে যাওয়া লোকের সংখ্যা বেশি নেই। ব্যাগ আর বইপত্র নিয়ে যাচ্ছে সবাই। হল খুললে হয়তো সবাই আবার চলে আসবে হলে। কিন্তু আমার আর হলে ওঠার ইচ্ছে নেই। আমার ভয় হচ্ছে বাবাকে কী বলবো। বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হয় – এই কারণ দেখিয়ে তিনি আমাকে বারবার মানা করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে।

 

“ও, প্রদীপ তুমি এখানে বসেছো?”

চোখ তুলে দেখি হাতে-কাঁধে দুটো ব্যাগ, গুটানো একটা পাটি, আর একটা বেতের ঝুড়ি নিয়ে আমার সিটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন শিবু চৌধুরি – আমাদের শিবুদা। কেমিস্ট্রির অনেক সিনিয়র দাদা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর সব জিনিস এখানে ওখানে সিটের নিচে, উপরের তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে আমার পাশে বসে পড়লেন।

“কী একটা ঝামেলা করে ফেললো বল তো।“ – শিবুদা এমনভাবে কথাটা বললেন ঠিক বুঝতে পারলাম না কোন্‌ ঝামেলার কথা তিনি বোঝাচ্ছেন। শিবিরের আক্রমণ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়া, নাকি এত সকালে হল ত্যাগ করা?

“হায় হায়, পান খাইনি।“ – বলে মুখে এমন একটা হতাশার শব্দ করলেন যেন পরীক্ষার হলে চলে গেছেন প্রবেশপত্র না নিয়ে।

“না, একটু পান খেয়ে আসি। তুমি আমার জিনিসপত্রগুলি একটু দেখিও।“ – বলেই ভীড় ঠেলে বাস থেকে নেমে গেলেন। পাঁচ দশ মিনিট কেটে গেলো। বাসের ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হলো। শিবুদার দেখা নেই। মনে হচ্ছে তিনি পান খাওয়ার জন্য পানের বরজে চলে গেছেন হাটহাজারির দিকে। শিবুদাকে ছাড়াই বাস চলে এলো ক্যাম্পাস ছেড়ে। এখন আমার নতুন ঝামেলা হলো। নিজের এতগুলি লাগেজের সাথে শিবুদার লাগেজও যোগ হলো। কিন্তু তিনি আমাকে কোথায় খুঁজবেন? আমি কোথায় যাবো তা কি তাকে বলেছি?

 

আন্দরকিল্লার মোড়ে আজাদী পত্রিকার অফিসের সামনে বাস থেকে নামলাম। ছাত্রদের কয়েকজন সাহায্য করলেন সবগুলি বোঝা নামাতে। একজন ছাত্রের এতগুলি পোটলা দেখে এই সিরিয়াস সময়েও হাসছে কয়েকজন। একটা রিকশায় সব জিনিস তোলার পর আর আমার বসার জায়গা নেই। দড়ি ছিঁড়ে শিবুদার গুটানো পাটি খুলে লম্বা হয়ে গেছে। রিক্সায় কোনভাবে রাখা যাচ্ছে না ওটা, হাতে নিতে হলো। কাটা-পাহাড় লেন দিয়ে রিকশা টেনে উঠাতে হয়। রিকশার পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে এলাম ঘাট ফরহাদবেগ – দিদির বাসায়। দরজা খুলেই আমার মাথায় দড়িবাঁধা ট্রাংক, গলায় একটা শীতলপাটি ঝুলে আছে দেখে দিদি বুঝতে পারছে না ঘটনা কী। সকালের পেপার তারা তখনো পড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ঘটনা ঘটে গেছে তা তখনো জানে না তারা।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts