Sunday 28 March 2021

সবার জন্য স্যাটেলাইট - পর্ব ৭

 


সপ্তম অধ্যায়

স্যাটেলাইট কীভাবে পাঠানো হয় 

পৃথিবী থেকে যে কোন বস্তুকে উপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে তা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। পৃথিবী থেকে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য এই মাধ্যাকর্ষণের টানকে অতিক্রম করে যেতে পারে এরকম বেগে স্যাটেলাইটকে ছুটে যেতে হবে পৃথিবী থেকে। এরকম বেগ হলো মুক্তিবেগ, যা আমরা এই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে দেখেছি। আমরা দেখেছি পৃথিবীর মুক্তিবেগ ঘন্টায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটারের বেশি। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইট পাঠাতে হলে সেই স্যাটেলাইটকে ছুটে যেতে হবে ঘন্টায় প্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটার বেগে। এত বেশি বেগ পাওয়া সম্ভব রকেটের মাধ্যমে।

          ১২ মে ২০১৮, বাংলাদেশ সময় রাত দুটো ১৫ মিনিটে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ মহাকাশের উদ্দেশ্যে আমেরিকার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। আমেরিকান প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স (SpaceX)-এর ফ্যালকন-৯ (FALCON-9) রকেটের সাহায্যে এই স্যাটেলাইটটি জিওস্টেশনারি কক্ষপথে স্থাপন করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে আমরা দেখবো মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর প্রধান ধাপগুলো কী কী।

          স্যাটেলাইট স্থাপন করার প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর  বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হয় - যেখানে স্যাটেলাইটের উদ্দেশ্য অনুযায়ী পে-লোড নির্ধারিত হয়। স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। তারপর স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে হয় - কোন্‌ রকেটের মাধ্যমে কোন্‌ উড্ডয়ন স্থান থেকে স্যাটেলাইট পাঠানো হবে সব ঠিক করার পর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশান ইউনিয়ন (আই-টি-ইউ)-এ অনুমোদনের জন্য দরখাস্ত করতে হয়। দরখাস্ত করার পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে স্যাটেলাইট মহাকাশে স্থাপন করতে হয়। আই-টি-ইউ'র অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি এই বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে।

 


নির্মাতা প্রতিষ্ঠান

স্যাটেলাইট যুগের শুরু থেকে ১৯৮০র দশকের শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলেই ছিল স্যাটেলাইট প্রস্তুত ও উৎক্ষেপণের সবগুলো প্রতিষ্ঠান। মূলত এই দুই পরাশক্তির বিমান বাহিনীই নিয়ন্ত্রণ করতো মহাকাশের সবগুলো স্যাটেলাইট। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বড় বড় কারিগরী প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক ভিত্তিতে স্যাটেলাইট প্রস্তুত করার অনুমতি পায়। গঠিত হয় অনেকগুলো প্রাইভেট কোম্পানি। এদের মধ্যে আছে ইওরোপের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস, আমেরিকার বোয়িং ডিফেন্স স্পেস অ্যান্ড সিকিউরিটি, লকহিড মার্টিন, অরবিটাল এ-টি-কে, রাশিয়ার জে-এস-সি ইনফরমেশান স্যাটেলাইট সিস্টেম, এবং ফ্রান্স  ও ইতালির থালিস-আলেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইওরোপে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হলো থালিস-আলেনিয়া। ২০০৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার চৌদ্দটি কারখানায় এই প্রতিষ্ঠান স্যাটেলাইট প্রস্তুত করে। ফ্রান্সের কান মানডেলিউ স্পেস সেন্টারে থালিস-আলেনিয়ার হেড কোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট নির্মাণের দায়িত্ব পায় থালিস-আলেনিয়া। স্যাটেলাইট নির্মাণে খরচ হয় ১৯৫২ কোটি টাকা বা প্রায় ২৪৪ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার।


চিত্র ৪৪: থালিস-আলেনিয়ার কারখানায় বঙ্গবন্ধু-১

         

২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশান রেগুলেটরি কমিশন (বি-টি-আর-সি)-র সাথে থালিস-আলেনিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী দুই বছর ধরে চলে স্যাটেলাইট নির্মাণ কাজ। পরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু-১ এর পে-লোড ২৬টি Ku ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার এবং ১৪টি C ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার ফিট করা হয় নিউ জেনারেশান স্পেস-বাস 4000B2 প্লাটফরমে। স্যাটেলাইটের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬ কিলোওয়াট। নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। মহাকাশে পাঠানোর জন্য উড্ডয়ন প্রতিষ্ঠান ঠিক করা ছিল আমেরিকার স্পেস-এক্স। ফ্রান্সের কান স্পেস সেন্টারের কারখানা থেকে প্রস্তুত হবার পর স্যাটেলাইটটিকে ২০১৮ সালের ২৮ মার্চ পাঠিয়ে দেয়া হয় ফ্লোরিডার কেপ কানাভিরাল লঞ্চিং সাইটে।  বিশেষভাবে তৈরি কার্গো বিমানে করে স্যাটেলাইটটি পাঠানো হয়। ২৯ মার্চ সেটা বস্টনে পৌঁছে। সেখানে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি করে ৩০ মার্চ ফ্লোরিডায় স্পেস-এক্স এর নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় বঙ্গবন্ধু-১। এবার স্পেস-এক্স এর দায়িত্ব স্যাটেলাইটটিকে মহাকাশে পাঠানোর।



উড্ডয়নকারী প্রতিষ্ঠান

মহাকাশ যুগের শুরুতে আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মহাকাশ সংস্থা তাদের নিজেদের রকেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইট পাঠাতো। এরপর আস্তে আস্তে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা গঠিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ভারত, জাপান, ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন সবার স্পেস এজেন্সি আছে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য এদের অনেকেরই রকেট তৈরির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা আছে। আবার সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রাইভেট কোম্পানি বিভিন্ন দেশের জন্য স্যাটেলাইট পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান কোম্পানি স্পেস-এক্স মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের রকেট তৈরি করে এবং স্যাটেলাইটকে মহাকাশের নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেয়।

          বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানোর জন্য দায়িত্ব পেয়েছিল স্পেস-এক্স। রকেট নির্মাণ এবং স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাবদ বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা বা ৬২ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার। স্পেস-এক্স তাদের আধুনিক ফ্যালকন-৯ রকেটের সাহায্যে আমাদের স্যাটেলাইটকে তার কক্ষপথে স্থাপন করে দিয়েছে।

          রকেটে স্থাপন করার আগে স্যাটেলাইট ঠিকমত কাজ করবে কি না তা পরীক্ষা করে নেয়া হয়।

 

প্রাক-উড্ডয়ন পরীক্ষা

আধুনিক ব্যবহারিক স্যাটেলাইটগুলো খুবই জটিল যন্ত্রপাতিতে ভর্তি যন্ত্র - যা মহাকাশে নিজে নিজেই চলবে ১৫ বছর ধরে। মহাকাশে পাঠানোর জন্য রকেটে স্থাপন করার আগে স্যাটেলাইটের সবগুলো যন্ত্র ঠিকমত কাজ করছে কি না তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হয়। এই পরীক্ষার দুটো প্রধান উদ্দেশ্য হলো:

 

  • স্যাটেলাইটের জ্বালানি সরবরাহ, ডাউন লিংক, ফিল্টার, অ্যামপ্লিফায়ার ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ঠিকমত কাজ করছে কি না পরীক্ষা করে দেখা।
  • স্যাটেলাইটের পুরো জীবনকাল (১৫ বছর) এই যন্ত্রগুলো কাজ করবে এবং গ্রহণযোগ্য মানের পে-লোড ডেলিভারি দেবে। অর্থাৎ যে কাজের জন্য স্যাটেলাইটটি পাঠানো হচ্ছে সেই কাজ অবিরত করে যাবে - সেটা নিশ্চিত করা।

 

পরীক্ষাগারে মহাকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করে সেখানে স্যাটেলাইটের কর্মক্ষমতা এবং দক্ষতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। ল্যাবরেটরিতে শেইকার টেবিল (shaker table) বা ধাক্কা দেয়া টেবিলে কৃত্রিম ধাক্কা দেয়া হয় স্যাটেলাইটকে - যে ধাক্কা ভূমি থেকে রকেট উৎক্ষেপণের সময় স্যাটেলাইটটি পাবে। তারপর থার্মাল ভ্যাকুয়াম টেস্ট করা হয়। এই টেস্টে মহাকাশের শূন্যতায় প্রচন্ড ঠান্ডায় স্যাটেলাইটটি বছরের পর বছর থাকতে পারবে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। কয়েক দিন ধরে স্যাটেলাইটটিকে পরীক্ষাগারে সৃষ্ট মহাশূন্যের পরিবেশে রেখে এই টেস্ট করা হয়। অবশ্য এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই পরিবেশ দুই তিন দিন ঠিকমত সহ্য করতে পারলেই যে পনের বছর সহ্য করতে পারবে তার কোন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু এই পরীক্ষার অন্য কোন বিকল্পও নেই।

          রিচার্জ্যাবল ব্যাটারিগুলোর স্থায়িত্ব পরীক্ষা করে দেখা হয়। ট্রান্সপন্ডার, অ্যান্টেনা, হিট পাইপ, থ্রাস্টার, মোমেন্টাম হুইল, পাওয়ার কনভার্টার - সবগুলোর স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখা হয়। সোলার সেলগুলোকেও পরীক্ষা করে দেখা হয়। স্যাটেলাইট কোন্‌ কক্ষপথে পাঠানো হবে তার উপর নির্ভর করে কোন কোন সোলার সেলকে রেডিয়েশানের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত নিরাপত্তা-আবরণ দিতে হয়। যেমন যে স্যাটেলাইট মিডিয়াম আর্থ অরবিটে থাকবে - সেগুলো ভ্যান অ্যালেন বেল্টের খুব কাছে থাকে বলে অনেক বেশি বিকিরণ শোষণ করে। তখন সোলার সেলগুলোকে হতে হয় অনেক বেশি বিকিরণসহ। সেজন্য সোলার সেলগুলোর উপর একটি অতিরিক্ত কাচের আস্তরণ দেয়া হয়। 

          সবকিছু ঠিক থাকার পরেও স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতি মহাকাশে গিয়ে বা যাওয়ার পথে বিকল হয়ে যেতে পারে। শতকরা দশ ভাগ স্যাটেলাইটের ক্ষেত্রে কোন না কোন কারিগরী সমস্যা হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এবং কক্ষপথে স্থাপন সফল হলে তা যেমন উদ্‌যাপন করার মত ব্যাপার, তেমনি যদি কোন সমস্যা দেখা দেয় - তা মেনে নেয়াটাও স্বাভাবিক।

          প্রাক-উড্ডয়ন পরীক্ষায় সবকিছু ঠিক থাকলে স্যাটেলাইটকে উড্ডয়ন রকেটের সামনে পে-লোড রাখার নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে স্থাপন করা হয়। এই বিশেষ প্রকোষ্ঠকে রকেটের লঞ্চ শ্রাউড (launch shroud) বলা হয়।


 

উড্ডয়ন রকেট 

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য যে বিশেষ ধরনের রকেটের দরকার হয় - পৃথিবীর অনেক দেশের সরকারি-বেসরকারি রকেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তা প্রস্তুত করে। আমেরিকা, রাশিয়া, ইওরোপ, ভারত, চীন, জাপান, ইসরায়েল, ইউক্রেন প্রভৃতি দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান রকেট প্রস্তুত করে এবং সেই রকেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইট পাঠায় মহাকাশের বিভিন্ন কক্ষপথে।

          মহাকাশ যুগের ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে এরকম কয়েকটি রকেটের মধ্যে আছে: ইওরোপের আরিয়ান-১, আরিয়ান-২, আরিয়ান-৩, আরিয়ান-৪, ইওরোপা; আমেরিকার অ্যাটলাস-১, অ্যাটলাস-২, অ্যাটলাস-৩, রেডস্টোন, স্যাটার্ন-১বি, স্যাটার্ন-৫, স্কাউট, থর, টাইটান-১, টাইটান-২, টাইটান-৩, টাইটান-৪, ভ্যানগার্ড; ইংল্যান্ডের ব্ল্যাক অ্যারো; ফ্রান্সের দিয়ামন্ট; সোভিয়েত ইউনিয়নের এনার্জিয়া, এন-১, ভস্তক, জাপানের জে-১, এম-৫, এন-১, এন-২। আমেরিকার স্যাটার্ন-৫ রকেটের সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। এই রকেট চাঁদের সবগুলো অভিযানের নভোচারীদের পাঠিয়েছে চাঁদের কক্ষপথে।

          বর্তমানের রকেটগুলোর কারিগরী দক্ষতা আরো অনেক বেড়েছে। এখন যেসব রকেট দক্ষতার সাথে মহাকাশে মহাকাশযান ও স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রকেট হলো: রাশিয়ার আংগারা, কসমস-৩এম, প্রোটন, রোকট, সয়ুজ, স্টার্ট-১, স্ট্রেলা, ভল্‌না, জেনিথ; ইওরোপের আরিয়ান-৫, ভেগা; আমেরিকার অ্যাটলাস-৫, ডেল্টা-২, ডেল্টা-৪, ফ্যালকন-৫, ফ্যালকন-৯; ভারতের জিওস্টেশনারি লঞ্চ ভেহিকল (ভি-এস-এল-ভি), পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভ্যাহিকল (পি-এস-এল-ভি); জাপানের এইচ-২এ; ইসরায়েলের সাবিত; চীনের লং মার্চ-৩বি।

          আমেরিকার প্রাইভেট কোম্পানি স্পেস-এক্স যথাসম্ভব কম খরচে মহাকাশে স্যাটেলাইট ও অন্যান্য মহাকাশযান পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। স্পেস-এক্স এর রকেট ফ্যালকন-৯ হলো সবচেয়ে আধুনিক রকেট। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশের কক্ষপথে পৌঁছেছে ফ্যালকন-৯ রকেটে চড়ে। সব রকেটই একই রকম প্রক্রিয়ায় স্যাটেলাইট পাঠায়। আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এবং ফ্যালকন-৯ রকেটের আলোকে বিভিন্ন ধাপগুলো ব্যাখ্যা করছি।

 

চিত্র ৪৫: ফ্যালকন-৯ রকেট

 

নতুন প্রজন্মের রকেটের মধ্যে ফ্যালকন-৯ রকেট হলো সবচেয়ে আধুনিক রকেট। ৭০ মিটার উচ্চতা ও ৩.৭ মিটার ব্যাসের এই রকেট দুই ধাপে কাজ করে। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য খুবই বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য রকেট ফ্যালকন-৯। ফ্যালকন-৯ এর প্রথম ধাপে আছে নয়টি মারলিন ইঞ্জিন। স্পেস-এক্স রোল্‌স রয়েস ইঞ্জিনের ডিজাইনে রকেটের জন্য প্রস্তুত করেছে এই মারলিন ইঞ্জিন।

 

চিত্র ৪৬: ফ্যালকন-৯ এর প্রথম ধাপ - ৯টি মারলিন ইঞ্জিন        


প্রচন্ড শক্তিশালী নয়টি মারলিন ইঞ্জিন একসাথে কাজ করে রকেটের প্রথম ধাপে - যেই ধাপের প্রচন্ড ধাক্কায় রকেট পৌঁছে যায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে। এই নয়টি ইঞ্জিনের মধ্যে কোন কারণে দুইটি ইঞ্জিনও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলেও বাকি সাতটি ইঞ্জিন দিয়ে রকেটটি মহাকাশে পৌঁছে যেতে পারে।

          রকেট কাজ করে নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে: প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

 

চিত্র ৪৭: রকেট মূলনীতি - নিউটনের তৃতীয় সূত্র

 

ফ্যালকন-৯ এর প্রথম ধাপের নয়টি ইঞ্জিনের অ্যালুমিনিয়াম-লিথিয়াম ট্যাংকে তরল অক্সিজেন ও রকেট-গ্রেড কেরোসিন থাকে। রকেটের সবগুলো ইঞ্জিন যখন চালু হয়ে যায় তখন দুই মিনিট ৪২ সেকেন্ডের মধ্যে প্রায় ৮০ লক্ষ নিউটন বল প্রয়োগ করে নিচের দিকে ধাক্কা দেয়। পাঁচটি বোয়িং ৭৪৭ বিমান একসাথে যে পরিমাণ ধাক্কা দিতে পারবে - এই রকেটের ধাক্কার পরিমাণ তার সমান। এই ধাক্কার প্রতিক্রিয়ায় রকেট উপরের দিকে উঠতে থাকে। রকেট যতই উপরের দিকে উঠতে থাকে এই ধাক্কার প্রতিক্রিয়া ততই বাড়তে থাকে। রকেটের গতিও সেই সাথে বাড়তে থাকে।


উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া 

প্রাক-উড্ডয়ন পরীক্ষা শেষে স্যাটেলাইটের সবকিছু ঠিক থাকলে স্যাটেলাইটটিকে রকেটের লঞ্চ শ্রাউডে ফিট করা হয়। ফ্যালকন রকেটের সামনের অংশে ১৩.১ মিটার উঁচু এবং ৫.২ মিটার ব্যাসের বড় চেম্বার থাকে - যাকে কম্পোজিট ফেয়ারিং বলা হয়। কক্ষপথে স্থাপন করার আগপর্যন্ত স্যাটেলাইটটি গুটানো অবস্থায় থাকে (চিত্র ৪৮)। স্যাটেলাইটকে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়। উৎক্ষেপণের দিন স্যাটেলাইটসহ রকেটকে উড্ডয়ন প্লাটফরমে বসানো হয়। ফ্যালকন-৯ রকেট উৎক্ষেপণ করার নির্দিষ্ট স্থান হলো ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল স্টেশন।

 

চিত্র ৪৮: কক্ষপথে স্থাপনের আগে স্যাটেলাইট (ডানে), কক্ষপথে স্যাটেলাইট (বামে)


উৎক্ষেপণের দিন এবং সময় নির্ধারণ করতে হয় অনেক আগে থেকে। দিনের কোন সময়ে উৎক্ষেপণ করা হবে তা ঠিক করা হয় আবহাওয়া এবং বাতাসের বেগ ইত্যাদির পূর্বাভাস দেখে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ২০১৭ সালের বিজয় দিবসে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা ছিল শুরুতে। কিন্তু সেই সময় ফ্লোরিডাতে হ্যারিকেনের কারণে উৎক্ষেপণের তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়। তারপর ২০১৮ সালের ১১ মে উৎক্ষেপণের তারিখ ঠিক করা হয়। উৎক্ষেপণের দিন ঠিক করার সময় একটি বিকল্প দিনও ঠিক করে রাখা হয় - কোন কারণে প্রথম দিনে উৎক্ষেপণ করা না গেলে দ্বিতীয় দিন আবার চেষ্টা করা হয়। ১১ মে নির্দিষ্ট সময়ে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখার পর কন্ট্রোল যখন স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটারের হাতে যায় তখন উৎক্ষেপণ সময়ের মাত্র কয়েক সেকেন্ড আগে সিস্টেমের কোথায় কিছু একটা ত্রুটি ধরা পড়ে। তখন উৎক্ষেপণ একদিনের জন্য পিছিয়ে যায়। ১২ মে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়।

 

চিত্র ৪৯: রকেট উৎক্ষেপণের কয়েক সেকেন্ড পরের চিত্র

        

উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপে লঞ্চিং প্লাটফরমে রকেট বসানোর পর রকেটের ইঞ্জিনে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ভর্তি করা হয়। প্রথম ধাপের নয়টি ইঞ্জিনের জ্বালানি ভর্তি হওয়ার পর দ্বিতীয় ধাপের একটি ইঞ্জিনের জ্বালানি - তরল অক্সিজেন ভর্তি করা হয়। তারপর কম্পিউটার সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবকিছু চেক করে দেখে। সব ঠিক থাকার পর কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যায়। উৎক্ষেপণ পরিচালক সবকিছু ঠিক আছে কি না নিশ্চিত করেন। ইঞ্জিন কন্ট্রোলার ইঞ্জিন চালু করার নির্দেশ দেন। নির্দিষ্ট সময়ে ইঞ্জিন চালু হয়। ইঞ্জিন চালু হবার দুই মিনিট ৪২ সেকেন্ডের মধ্যেই প্রথম ধাপের জ্বালানি থেকে প্রায় ৮০ লক্ষ নিউটন বলে ধাক্কা খেয়ে রকেট প্রায় ৭০ কিলোমিটার উপরে উঠে যায়। তারপর রকেট থেকে প্রথম ধাপের নয়টি ইঞ্জিনসহ প্লাটফরমটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রকেটের প্রথম ধাপটি পৃথিবীতে ফিরে আসে। রকেটটি যে স্ট্যান্ডের উপর বসে থাকে সেই স্ট্যান্ডটি সাগরের পানিতে একটি বিশেষ প্লাটফরমের উপর  নেমে আসে। ওটাকে পরবর্তী কোন রকেটে আবার ব্যবহার করা যায়।

 

চিত্র ৫০: রকেট থেকে ১ম ধাপ বিচ্ছিন্ন হয় এবং ২য় ধাপের ইঞ্জিন চালু হয়ে যায়।

 

ফ্যালকন-৯ রকেটের দ্বিতীয় ধাপে থাকে একটি ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের জ্বালানি তরল অক্সিজেন। প্রায় ছয় মিনিটে এই ইঞ্জিন ৯ লক্ষ ৩৪ হাজার নিউটন বলে ধাক্কা দিয়ে রকেটের বাকি অংশকে সামনের দিকে নিয়ে যায়। উৎক্ষেপণের ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে রকেটটি স্যাটেলাইটের ট্রান্সফার অরবিটে পৌঁছে যায়। এখানে দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি বন্ধ হয়ে যায় এবং রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রকেটের এই অংশটি মহাকাশেই ভাসতে থাকে।


চিত্র ৫১: রকেটের ২য় ধাপ বিচ্ছিন্ন হয়, স্যাটেলাইট মহাকাশে খুলতে শুরু করে


পৃথিবী থেকে উৎক্ষিপ্ত হবার পর রকেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে চলতে স্যাটেলাইটের জন্য নির্ধারিত ট্রান্সফার অরবিটে এসে পৌঁছায়। এই কাজ করার জন্য স্যাটেলাইটে ইন্টারন্যাল গাইড্যান্স সিস্টেম (আই-জি-এস) থাকে। আই-জি-এস রকেটের জায়রোস্কোপ ও এক্সিলারোমিটার ব্যাবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রকেটের দিক নিয়ন্ত্রণ করে।

          এই পর্যায়ে এসে রকেটের সামনের অংশের আবরণ খুলে স্যাটেলাইট বের হয়ে আসে মহাকাশে। শুরু হয় নির্দিষ্ট কক্ষপথের নির্দিষ্ট জায়গায় স্যাটেলাইট প্রবেশ করার কাজ। এই কাজটি স্যাটেলাইট নিজে নিজেই করে থাকে তার স্বয়ংক্রিয় থ্রাস্টারের মাধ্যমে।


কক্ষপথে স্থাপন প্রক্রিয়া

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে পৃথিবীর গতির সাথে গতি মিলিয়ে ঘুরে। জিওস্টেশনারি অরবিটে আরো অনেকগুলো স্যাটেলাইট আছে। তাই সেই কক্ষপথে প্রবেশ করার সময় খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। স্যাটেলাইটের গতি এবং দিকের হিসেব হতে হয় নিখুঁত।

          বঙ্গবন্ধু-১ এর নির্ধারিত স্থান হলো ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। রকেট জিওস্টেশনারি কক্ষপথ পর্যন্ত আসে না। স্যাটেলাইটকে তার কাছাকাছি একটা জায়গায় পৌঁছে দেয়ার পর রকেটের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। রকেটের সাথে স্যাটেলাইটের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইটগুলো যখন মহাকাশে পাঠানো হয় শুরুতে তারা একটি উপবৃত্তাকার পথে যায়। সূর্যের চারপাশে গ্রহগুলো যেমন উপবৃত্তাকার পথে যায় - এগুলোও সেরকম। এই প্রাথমিক উপবৃত্তাকার কক্ষপথগুলো LEO MEO হতে পারে। কিন্তু যদি স্যাটেলাইটটি GEO-তে স্থাপন করার জন্য পাঠানো হয়ে থাকে, তখন প্রাথমিক কক্ষপথটি খুবই উপবৃত্তাকার হয়ে থাকে। এটাকে ট্রান্সফার অরবিট বলে। এই অরবিটের অ্যাপোজি বা অপভূ বিন্দু প্রায় ৩৫,৭০০ কিলোমিটার আর অনভূ বা পেরিজি হয়ে থাকে মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার।

 

চিত্র ৫২: ট্রান্সফার অরবিট থেকে স্যাটেলাইটের জিও-অরবিটে যাওয়ার গতিপথ

 

এই উপবৃত্তাকার ট্রান্সফার অরবিট থেকে বৃত্তাকার GEO-তে পাঠানোর জন্য আগে apogee kick motor ব্যবহার করা হতো। এখন রকেটগুলো 2nd stage রকেট ফায়ার করে - তারপর স্যাটেলাইটের অ্যাপোজি থ্রাস্টার চালু হয়ে যায়। এই থ্রাস্টারগুলো ছোট ছোট ধাক্কা দিয়ে ট্রান্সফার অরবিট থেকে স্যাটেলাইটকে বৃত্তাকার GEO-তে নিয়ে যায়। স্যাটেলাইটের সোলার প্যানেলগুলো তখনো পুরোপুরি খোলে না। থ্রাস্টারগুলো স্যাটেলাইটের প্রপেল্যান্ট ট্যাংকের জ্বালানি ব্যবহার করে থ্রাস্টার চালু রাখার জন্য। থ্রাস্টারগুলো ক্ষুদ্রাকৃতি রকেটের মতো নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী কাজ করে। ট্রান্সফার অরবিট থেকে জিওস্টেশনারি কক্ষপথে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রবেশ করতে স্যাটেলাইটের কয়েকদিন সময় লেগে যায়। কক্ষপথে বসার পর মাধ্যাকর্ষণের টানে ঘন্টায় প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার বেগে কক্ষপথে ঘুরতে থাকে - যা পৃথিবীর কক্ষপথের গতির সাথে সমন্বিত। স্যাটেলাইটের সোলার প্যানেলগুলো তখন পুরোপুরি খুলে যায় এবং বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয় এবং পৃথিবীতে সংকেত পাঠাতে শুরু করে।

          আমরা এবার দেখবো স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে।


স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে >>>>>>>>>>

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts