Sunday 28 March 2021

সবার জন্য স্যাটেলাইট - পর্ব ৮

 



অষ্টম অধ্যায়

স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে

 

কক্ষপথে স্থিত হবার পর মাধ্যাকর্ষণের টানে স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর চারপাশে নির্দিষ্ট কৌণিক বেগে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই স্যাটেলাইটকে সব কাজ করতে হয়। স্যাটেলাইটের প্রথম কাজ হচ্ছে স্টেশন কিপিং। কক্ষপথ থেকে যেন বের হয়ে না পড়ে সেজন্য স্যাটেলাইটকে সারাক্ষণই তার গতি, দিক এবং উচ্চতা ঠিক রাখার জন্য কাজ করে যেতে হয়। এই কাজকে বলা হয় স্টেশন কিপিং।

          কক্ষপথে নিজের অবস্থান বজায় রেখে স্যাটেলাইটগুলো তার জন্য নির্দিষ্ট কাজ - যেমন কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট হলে - গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে পাঠানো সিগনাল রিসিভ করে তা পৃথিবীতে নির্দিষ্ট রিসিভারে সম্প্রচার করে দেয়া বা পাঠিয়ে দেয়া; আবহাওয়া স্যাটেলাইট হলে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে ঘুরে আবহাওয়া সংক্রান্ত যেসব সূচক থাকে তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করা এবং প্রয়োজনীয় ছবি তুলে তা গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠানো। দিক নির্দেশক বা জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো - অনেকগুলো স্যাটেলাইট মিলে নিজেদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে এবং পৃথিবীতে জিপিএস রিসিভারে সিগনাল পাঠায়। বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটগুলোর জন্য খুবই সুনির্দিষ্ট কাজ ঠিক করে দেয়া থাকে। তারা সেগুলো করে। বিভিন্ন স্যাটেলাইট বিভিন্নভাবে কাজ করলেও কাজের ধরন মোটামুটি এক রকম। স্যাটেলাইটগুলো মূলত পৃথিবীপৃষ্ঠের অনেক উপর থেকে পৃথিবীর অ্যান্টেনার কাজ করে। এই অধ্যায়ে আমরা বিভিন্ন স্যাটেলাইট কীভাবে কাজ করে তা আলোচনা করবো।

 

স্টেশন কিপিং

 কক্ষপথে স্থাপনের পর স্যাটেলাইটের সোলার প্যানেলগুলো পুরোপুরি খুলে যায়। সোলার সেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে থাকে এবং স্যালেটাইটের সবগুলো যন্ত্রপাতি কাজ শুরু করে দেয়। সোলার প্যানেলগুলোকে সবসময় সূর্যের দিকে করে রাখার ব্যবস্থা করা হয় যেন সোলার সেলগুলো প্রচুর সূর্যালোক পায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সময় স্যাটেলাইটের সোলার সেলগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। তখন স্যাটেলাইট ব্যাটারি থেকে চার্জ নিয়ে কাজ অব্যাহত রাখে।

          জিওস্টেশনারি অরবিটের মোট পরিসীমা প্রায় দুই লক্ষ ৬৬ হাজার কিলোমিটার। এই পরিসীমাকে চারপাশে ৩৬০ কোণে ভাগ করলে প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের মধ্যে দূরত্ব থাকে প্রায় ৭৪০ কিলোমিটার। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে দ্রাঘিমাংশের পার্থক্য যদি মাত্র ০.০১-ও হয় তাহলে একটি স্যাটেলাইট থেকে অন্য স্যাটেলাইটের মধ্যবর্তী দূরত্ব থাকবে প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলো কক্ষপথে ঘন্টায় প্রায় ১১ হাজার কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। সেখানে মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার দূরত্ব কিছুই না। কিন্তু স্যাটেলাইটগুলো যেহেতু সবগুলো একই দিকে একই বেগে ঘুরছে তাদের মধ্য সংঘর্ষ ঘটার সম্ভাবনা অনেক কম। কিন্তু কক্ষপথে প্রবেশ করার সময় যদি নির্দিষ্ট অবস্থানের ০.০১ পার্থক্যও ঘটে তাহলে অন্য স্যাটেলাইটের গায়ের ওপর গিয়ে পড়তে পারে। সারণি-৪ থেকে দেখা যায় জিওস্টেশনারি অরবিটে স্যাটেলাইটগুলোর দ্রাঘিমাংশ কত কাছাকাছি। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের দ্রাঘিমাংশ ১১৯. পূর্ব - যার কাছাকাছি আরো ২০-২৫টি কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট আছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক দ্রাঘিমাংশ প্রায় ৯৪ পূর্ব। কিন্তু সেই দ্রাঘিমাংশে জিওস্টেশনারি অরবিটে কোন জায়গা খালি না পাওয়ায় বাংলাদেশের স্যাটেলাইট হংকং ও চীনের কাছাকাছি ১১৯. পূর্ব দ্রাঘিমাংশে পাঠানো হয়েছে।

          এই স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথে নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে হয় ১৫ বছর ধরে। মহাশূন্যে প্রচন্ড বেগে ঘুরতে ঘুরতে এই অবস্থান ধরে রাখা খুব সহজ নয়। পৃথিবীর ঘনত্ব সব জায়গায় সমান না হওয়ার কারণে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণও সব জায়গায় সমান নয়। ফলে যে মাধ্যাকর্ষণের টানে স্যাটেলাইট জিওস্টেশনারি অরবিটে থাকে - সেই টানের মান মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে স্যাটেলাইট কক্ষপথ থেকে নড়ে যেতে পারে। এটাকে ঠিক রাখার জন্য স্যাটেলাইটে অ্যাটিচিউড অ্যান্ড অরবিট কন্ট্রোল থ্রাস্টার ব্যবহার করা হয়। স্যাটেলাইটের তরল জ্বালানি ব্যবহার করে এই থ্রাস্টারগুলো স্যাটেলাইটকে নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখে।

 

সারণি ৪: জিওস্টেশনারি কক্ষপথে দ্রাঘিমাংশের বিন্যাস ও স্যাটেলাইটের সংখ্যা

জিওস্টেশনারি অরবিটে দ্রাঘিমাংশ বিন্যাস

দ্রাঘিমাংশের পরিসর

স্যাটেলাইটের সংখ্যা

এই দ্রাধিমাংশে প্রধান শহর

১৮০ পশ্চিম - ১৬৫ পশ্চিম

আডাক, আলাস্কা

১৬৫ পশ্চিম - ১৫০ পশ্চিম

হনলুলু, হাওয়াই

১৫০ পশ্চিম - ১৩৫ পশ্চিম

ফেয়ারব্যাংকস, আলাস্কা

১৩৫ পশ্চিম - ১২০ পশ্চিম

১২

সানফ্রান্সিসকো

১২০ পশ্চিম - ১০৫ পশ্চিম

২০

লস আঞ্জেলেস

১০৫ পশ্চিম - ৯০ পশ্চিম

৩৬

মিনিয়াপোলিস

৯০ পশ্চিম - ৭৫ পশ্চিম

১৫

শিকাগো

৭৫ পশ্চিম - ৬০ পশ্চিম

১৯

নিউইয়র্ক

৬০ পশ্চিম - ৪৫ পশ্চিম

১০

ব্রাসিলিয়া, ব্রাজিল

৪৫ পশ্চিম - ৩০ পশ্চিম

১৪

রিও ডি জেনেরিও, ব্রাজিল

৩০ পশ্চিম - ১৫ পশ্চিম

১২

ডাকার, সেনেগাল

১৫ পশ্চিম - ০

২৪

লন্ডন

- ১৫ পূর্ব

২২

প্যারিস

১৫ পূর্ব - ৩০ পূর্ব

২৮

অ্যাথেন্স, গ্রিস

৩০ পূর্ব - ৪৫ পূর্ব

১৯

মস্কো, রাশিয়া

৪৫ পূর্ব - ৬০ পূর্ব

২০

তেহরান, ইরান

৬০ পূর্ব - ৭৫ পূর্ব

২০

কাবুল, আফগানিস্তান

৭৫ পূর্ব - ৯০ পূর্ব

২৪

দিল্লী, ভারত

৯০ পূর্ব - ১০৫ পূর্ব

২০

সিঙ্গাপুর, ঢাকা

১০৫ পূর্ব - ১২০ পূর্ব

২৪

হং কং, চীন

১২০ পূর্ব - ১৩৫ পূর্ব

১২

সাংহাই, চীন

১৩৫ পূর্ব - ১৫০ পূর্ব

১৩

টোকিও, জাপান

১৫০ পূর্ব - ১৬৫ পূর্ব

সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

১৬৫ পূর্ব - ১৮০ পূর্ব

ক্রাইস্টচার্চ, নিউজিল্যান্ড

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীতে সিগনাল পাঠাতে হয়। পৃথিবী থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার দূরের এই স্যাটেলাইটগুলো থেকে পুরো পৃথিবীর কৌণিক বিস্তার হয় মাত্র ১৭.। স্যাটেলাইটের অ্যান্টেনাগুলো যে সিগনাল পাঠায় তার কৌণিক বিস্তার রাখা হয় ১৪ বা তার চেয়েও কম। স্যাটেলাইটগুলোর অবস্থানের সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই এই সিগনালগুলো পৃথিবীর অ্যান্টেনায় ঠিকমত এসে পৌঁছাতে পারবে না। তখন স্যাটেলাইটের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।

          জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটগুলোকে বাতাসের বেগ সামলাতে হয় না, কারণ সেই উচ্চতায় বাতাস নেই। কিন্তু লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কাছাকাছি থাকে বলে তাদেরকে বাতাসের বেগের সাথেও যুদ্ধ করতে হয়। বাতাসের ঘনত্ব খুবই ক্ষীণ হলেও লো আর্থ অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোর প্রচণ্ড বেগের কারণে স্যাটেলাইটগুলো বাতাসের বাধা অনুভব করে এবং সে কারণে তাদের গতি ক্রমাগত কমে যেতে থাকে। গতি খুব বেশি কমে যাবার বিপদ ভয়াবহ। গতি অনেক কমে গেলে তারা পৃথিবীর ঘন বায়ুমন্ডলে ঢুকে যেতে পারে - আর একবার সেখানে ঢুকে গেলে বাতাসের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে স্যাটেলাইটে আগুন ধরে যাবে। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে প্রায়ই থ্রাস্টার দিয়ে উপরের দিকে তুলে দিতে হয়। তাই লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলোতে অনেক বেশি জ্বালানি খরচ হয় - এবং সে কারণে তাদের আয়ু হয় মাত্র কয়েক বছর।

          স্যাটেলাইটে কী হচ্ছে, যন্ত্রপাতিগুলো কেমন আছে ইত্যাদির খবর গ্রাউন্ড স্টেশনে পৌঁছে যায়। স্যাটেলাইটের ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি অ্যান্ড কমান্ড (TT&C) সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশন খবর পেয়ে যায় স্যাটেলাইটে কী হচ্ছে। গ্রাউন্ড স্টেশন আপলিংক সিগনালের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠায় - এবং স্টেশন কিপিং-এর সব কাজ সম্পন্ন হয়।

গ্রাউন্ড স্টেশন

স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য দরকার গ্রাউন্ড স্টেশন। স্যাটেলাইটের প্রস্তুতির সময় গ্রাউন্ড স্টেশনও তৈরি করা হয়। স্যাটেলাইট ডাউনলিংক সিগনাল পাঠায় এবং সেই সিগনাল পৃথিবীর গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার মাধ্যমে গ্রাউন্ড স্টেশনের রিসিভারে ধরা পড়ে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের জন্য দুটো গ্রাউন্ড স্টেশন কাজ করছে এখন।

          রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালি উপজেলার বেতবুনিয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন। এই ভূ-কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সালে। স্বাধীনতার পর এই কেন্দ্র অন্য কোন জায়গায় শিফ্‌ট করার কথা উঠেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চাননি এই উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র অন্য কোথাও স্থানান্তর হোক। এই ভূকেন্দ্রের সাথে অন্য দেশের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচারে বিপ্লব এসেছিল।

          বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর কার্যক্রমের জন্য বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রকে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ করে নতুনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। একই সাথে গাজিপুরের জয়দেবপুরে আরেকটি নতুন উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ এখন এই গ্রাউন্ড স্টেশন দুটো থেকে ডাটা গ্রহণ ও সম্প্রচার শুরু করেছে।

 

চিত্র ৫৩: গাজিপুর উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র

 

স্যাটেলাইট ঠিকমত কাজ করার জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন অপরিহার্য। স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছে কি না তা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয় TT&C সিস্টেমের মাধ্যমে। গ্রাউন্ড স্টেশনের ট্র্যাকিং, টেলিমেট্রি অ্যান্ড কমান্ড (TT&C) সিস্টেম স্যাটেলাইটের গতির উপর নজর রাখে। টেলিমেট্রি সিস্টেমের মাধ্যমে নিয়মিত জানতে পারে স্যাটেলাইটের যন্ত্রপাতিগুলো কেমন আছে, সোলার প্যানেলগুলো ঠিকমত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে কি না, ব্যাটারিগুলো চার্জ হচ্ছে কি না, তরল জ্বালানি কতটুকু আছে, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ঠিকমত কাজ করছে কি না ইত্যাদি। TT&C সিস্টেমের রিপোর্ট অনুসারে স্যাটেলাইটে প্রয়োজনীয় নির্দেশ পাঠানো হয়। যন্ত্রপাতিগুলোর ছোটখাট সমস্যা গ্রাউন্ড স্টেশনের ইঞ্জিনিয়াররা সিগনাল পাঠিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারেন। কক্ষপথ থেকে স্যাটেলাইটের অতি সামান্য বিচ্যুতিও ধরা পড়ে গ্রাউন্ড স্টেশনে পাঠানো তথ্য থেকে। তখন প্রয়োজনীয় কমান্ড পাঠিয়ে থ্রাস্টার চালু করে স্যাটেলাইটের প্রয়োজনীয় দিক পরিবর্তন করে ফেলা হয়।

          গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনা, ট্রান্সমিটার, রিসিভার, সিগনাল প্রসেসিং, রাউটিং ইত্যাদি সবকিছুকে একসাথে বলা হয় টেলিকমিউনিকেশান পোর্ট বা টেলিপোর্ট। এই টেলিপোর্টের মাধ্যমেই গ্রাহকদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন সেবা প্রদান করা হয়। স্যাটেলাইট থেকে যে সিগনাল পৃথিবীতে আসে তা এত দূর থেকে আসতে আসতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল সিগনালগুলোকে ফিল্টার করার পর অ্যামপ্লিফাই করা হয়। তারপর সেগুলোকে ব্যবহারকারীর গ্রাহকযন্ত্রে পাঠানো হয়।

         

চিত্র ৫৪: ডিশ অ্যান্টেনা

  

গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার আকার মূলত নির্ভর করে স্যাটেলাইটের কাজের উপর। ইন্টেলস্যাট স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার ব্যাস ৩০ মিটার। বেশিরভাগ সাধারণ কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড অ্যান্টেনার ব্যাস ৭ থেকে ১২ মিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। ডাইরেক্ট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস প্রদানকারী স্যাটেলাইটগুলো গ্রাহকদের বাড়ির ডিশ অ্যান্টেনায় টেলিভিশন সিগনাল পৌঁছে দেয়। এই ডিশ অ্যান্টেনাগুলোর ব্যাস মাত্র ৭০ সেন্টিমিটার।

          চিত্র ৫৫ স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের প্রধান কাজগুলো নির্দেশ করছে। গ্রাউন্ড স্টেশনের অ্যান্টেনার গঠন এমন হয়ে থাকে যে স্যাটেলাইট থেকে যে সিগনাল আসে তা অ্যান্টেনার কেন্দ্রে এসে পড়ে। অ্যান্টেনার কাছাকাছি ইলেকট্রনিক মডিউল হলো ডাইপ্লেক্সার। ডাইপ্লেক্সার অ্যান্টেনার আপলিংক ও ডাউনলিংক ফ্রিকোয়েন্সিকে আলাদা করে যার যার নির্দিষ্ট মডিউলে পাঠিয়ে দেয়। স্যাটেলাইট যে সিগনাল পৃথিবীর অ্যান্টেনায় পাঠায় তাকে বলা হয় ডাউনলিংক এবং পৃথিবী থেকে যে সিগনাল গ্রহণ করে তাকে বলা হয় আপলিংক। গ্রাউন্ড স্টেশনের ডাইপ্লেক্সার ডাউনলিংক সিগনালগুলোকে লো নয়েজ এমপ্লিফায়ারে (LNA) পাঠিয়ে দেয় আর আপলিংক সিগনালগুলোকে অ্যান্টেনার মাধ্যমে স্যাটেলাইটে পাঠিয়ে দেয়।

  

চিত্র ৫৫: স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের প্রধান কাজ

  

স্যাটেলাইট থেকে আসা ডাউনলিংক সিগনাল অ্যান্টেনায় গৃহীত হবার পর তা LNA-র ভেতর দিয়ে যাবার সময় বিবর্ধিত হয়। তারপর সেই বিবর্ধিত সিগনাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়ার ডিভাইডারে প্রবেশ করে। পাওয়ার ডিভাইডারের আউটপুট রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ডাউন কনভার্টারের (DC) সাথে যুক্ত থাকে। DC রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিকে ইন্টারমিডিয়েট ফ্রিকোয়েন্সিতে (IF) রূপান্তরিত করে। এই IF ফ্রিকোয়েন্সিগুলো যুক্ত হয় ডি-মডিউলেটরের সাথে। ডি-মডিউলেটর মডিউলেটেড ইন্টারমিডিয়েট ফ্রিকোয়েন্সি থেকে তথ্য আলাদা করে নেয়। এই সিগনালগুলো মাল্টিপ্লেক্সড সিগনাল - অর্থাৎ অনেকগুলো সিগনাল একসাথে মিশ্রিত অবস্থায় থাকে। এই সিগনালগুলোকে আলাদা করার জন্য ডি-মাল্টিপ্লেক্সার ব্যবহার করা হয়। ডি-মাল্টিপ্লেক্সার সিগনালগুলোকে আলাদা করে তাদের ধরন অনুযায়ী আলাদা আলাদা লাইনে পাঠিয়ে দেয়। ভয়েস বা শব্দ পাঠানো হয় ইলেকট্রনিক প্রাইভেট অটোম্যাটিক প্রাইভেট এক্সচেঞ্জে (EPABX), আর ডাটা পাঠানো হয় কম্পিউটারের মাধ্যমে লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্কে (LAN)। যদি তথ্যগুলোর গন্তব্য স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশন না হয়ে অন্য কোথাও হয়ে থাকে - তাহলে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে সেগুলো বিভিন্ন লিংকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যেমন মাইক্রোওয়েভ লিংক, অপটিক্যাল ফাইবার লিংক ইত্যাদি। স্যাটেলাইটের কাজের উপর নির্ভর করে কোন্‌ লিংকে কোন্‌ সিগনাল পাঠানো হবে।

         

কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের সেবাগুলো 

যোগাযোগ উপগ্রহ বা কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব ব্যবস্থাপনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যে সেবাগুলো গ্রাহকরা সরাসরি গ্রহণ করে তাদের মধ্যে আছে - স্যাটেলাইট টেলিভিশন, মোবাইল টেলিভিশন, স্যাটেলাইট রেডিও, স্যাটেলাইট বিজনেস, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট টেলিফোন, স্যাটেলাইট ডিজাস্টার রিকভারি ইত্যাদি।

 

স্যাটেলাইট টেলিভিশন: বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। প্রধানত দুই ধরনের স্যাটেলাইট সার্ভিস ব্যবহার করা হয় এই কাজে - ডাইরেক্ট ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট (DBS) এবং ফিক্সড সার্ভিস স্যাটেলাইট (FSS)।

          ডাইরেক্ট ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটগুলো খুবই ছোট ছোট অ্যান্টেনার সাহায্যে  সরাসরি ভোক্তাদের বাসার টেলিভিশনে অনুষ্ঠানমালা পৌঁছে দেয়। এই আন্টেনাগুলোকে বলা হয় ভেরি স্মল অ্যাপারচার টার্মিনাল বা ভিস্যাট (VSAT)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানি এখন এধরনের ডাইরেক্ট টু হোম (DTH) টেলিভিশন সার্ভিস দিচ্ছে।

          ফিক্সড সার্ভিস স্যাটেলাইট সার্ভিসগুলো সাধারণত স্থানীয় টেলিভিশন স্টেশনে সিগনাল পৌঁছে দেয়। টেলিভিশন স্টেশনগুলো তাদের ট্রান্সমিশান সার্ভিসের মাধ্যমে ঐ এলাকায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। যে কোন দেশের ফ্রি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এই পদ্ধতিতেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এই সার্ভিসের জন্য টেলিভিশন স্টেশনগুলোতে অনেক বড় আকারের অ্যান্টেনা থাকে।

 

মোবাইল টেলিভিশন:চলন্ত গাড়িতে, ট্রেনে, প্লেনে বা জাহাজে সরাসরি টেলিভিশন অনুষ্ঠান পৌঁছে দেয়ার জন্য এই সার্ভিস ব্যবহার করা হয়। স্যাটেলাইটে এজন্য খুবই শক্তিশালী অ্যান্টেনা থাকে যেগুলো জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলমান গাড়ি, ট্রেন, প্লেন বা জাহাজের আন্টেনাতে সিগনাল পৌঁছে দেয়। যে কোন অনুষ্ঠানের লাইভ কভারেজ দেয়ার জন্য সংবাদ মাধ্যমের গাড়িতে অ্যান্টেনা যুক্ত থাকে। সেই অ্যান্টেনার সাথে স্যাটেলাইটের অ্যান্টেনার সংযোগ ঘটে। আমাদের বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এই পদ্ধতিতে চার হাজার বিদেশী জাহাজ এবং ৩৫ হাজার দেশী জাহাজে টেলিকমিউনিকেশান সার্ভিস প্রদান করবে।

 

স্যাটেলাইট রেডিও: রেডিও স্টেশনের সম্প্রচার তরঙ্গের শক্তি সাধারণত খুব বেশি হয় না। কিন্তু স্যাটেলাইট থেকে যে ডিজিটাল রেডিও সিগনাল সম্প্রচার করা হয় তা ইচ্ছে করলে পুরো পৃথিবীতেই ছড়িয়ে দেয়া যায়। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে রেডিও রিসিভারের মাধ্যমে সেই রেডিও সম্প্রচার শোনা যাবে। দুর্গম এলাকাতেও এই পদ্ধতিতে রেডিও বার্তা পৌঁছে দেয়া যায়।

 

স্যাটেলাইট বিজনেস:সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা যায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। ব্যাংকগুলোর এক শাখার সাথে অন্য শাখার বা এক ব্যাংকের সাথে অন্য ব্যাংকের লেনদেনের যোগাযোগব্যবস্থা করা হচ্ছে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। যেখানে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে যে ইন্টারনেট ব্যবস্থা আছে তা কোন কারণে খুব সামান্য সময়ের জন্যও বিঘ্নিত হলে বিরাট ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে - সেখানে স্যাটেলাইটের যোগাযোগ অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।

 

স্যাটেলাইট ইন্টারনেট: পৃথিবীব্যাপী ইন্টারনেটের গতি এখন ক্রমশ বাড়ছে। ইন্টারনেটের সংযোগ এখন বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে। টেলিফোনের তারের মাধ্যমে, অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে, সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। মানুষের ঘরে বাইরে এখন ওয়াই-ফাই সিস্টেম। এই সিস্টেমে ইন্টারনেটের ল্যাটেন্সি বা সময়ক্ষেপণ খুবই কম - মাত্র ৩০ মিলিসেকেন্ড। কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা নিতে গেলে সবচেয়ে বড় অসুবিধা তা হলো সময়ক্ষেপণ। কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে যে দূরত্বে থাকে - কোন সিগনাল পৃথিবী থেকে সেই দূরত্বে গিয়ে আবার পৃথিবীতে আসতে গেলে - আলোর বেগে ছুটলেও - প্রায় ২৫০ মিলিসেকেন্ড লেগে যায়। তাই যেখানে ক্যাবল কানেকশান আছে সেখানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সার্ভিস খুব একটা লাভজনক নয়।

          কিন্তু সাবমেরিন ক্যাবল বা অন্যান্য সংযোগ যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ - ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় - তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া যায়। জাপানে ভূমিকম্পের কারণে প্রায়ই ইন্টারনেট সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন জাপানের প্রত্যেকটি ডাকঘরে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা চালু করা হয়েছে। চলন্ত উড়োজাহাজে এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ চালু করা হয়েছে। যাত্রীরা উড়োজাহাজে বসে টাকায় বিনিময়ে এই সেবা নিতে পারেন।

 

স্যাটেলাইট টেলিফোন: আমাদের বেশিরভাগ টেলিফোনবার্তাগুলো যায় ল্যান্ড লাইন ও সাবম্যারিন ক্যাবলের মাধ্যমে। মোবাইল ফোনের কলগুলো যায় বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে স্থানীয় রিলে সেন্টার বা মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারের অ্যান্টেনার মাধ্যমে। ল্যান্ড ফোন কিংবা মোবাইল ফোন সার্ভিসের জন্য দরকার হয় সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো। যেখানে এই অবকাঠামো নেই - সেখানে টেলিফোন সার্ভিস দেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক বড় বড় দেশের অনেক এলাকায় তেমন কেউ বাস করে না। যেমন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ বা দক্ষিণ আমেরিকা বা কানাডার অনেক দুর্গম জায়গায় তেমন কেউ থাকে না। সেখানে তাই কোন টেলিফোন অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সেসব জায়গায় প্রচলিত টেলিফোন বার্তা পাঠানো সম্ভব নয়। কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সহজেই পৃথিবীর যে কোন জায়গায় টেলিফোন বার্তা পাঠানো যায়। সেই সব জায়গায় কিছু পাবলিক ফোনবুথ থাকে যেগুলোর সাথে স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশনের সংযোগ থাকে। এই পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক টেলিফোন কলগুলো পাঠিয়ে দেয় স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশনে। সেখান থেকে সেই কল চলে যায় স্যাটেলাইটে। স্যাটেলাইট সেই কল রিসিভ করে ডাউনলিংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয় সুনির্দিষ্ট স্যাটেলাইটে যেখান থেকে সেই কল চলে যাবে সেই স্যাটেলাইটের গ্রাউন্ড স্টেশনে। সেই গ্রাউন্ড স্টেশন সেই কল পাঠিয়ে দেবে নির্দিষ্ট পাবলিক বুথে।

 

স্যাটেলাইট ডিজাস্টার রিকভারি: প্রাকৃতিক বা অন্য কোন ভয়ংকর দুর্যোগের সময় যখন স্বাভাবিক সব বার্তা যোগাযোগের মাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ বন্ধ হয়ে যায় - তখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেই জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে ইন্টারনেট সংযোগ, টেলিফোন সংযোগ ইত্যাদি চালু করা যায়।

 

আবহাওয়া স্যাটেলাইট 

আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলো কমিউনিকেশান স্যাটেলাইটের চেয়ে ভিন্ন। এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন, তাই এদের পে-লোডও ভিন্ন। আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোতে থাকে রেডিওমিটার। রেডিওমিটারের মাধ্যমে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীকে স্ক্যান করতে থাকে এবং সেখান থেকে সংগৃহীত ডাটাগুলো ছবির রূপ নেয়। পে-লোডে আরও থাকে রেডিওমিটারকে সহায়তা করার জন্য উপযুক্ত অ্যান্টেনা, স্ক্যানিং সিস্টেম, টেলিস্কোপ, ডিটেক্টর ইত্যাদি। এই টেলস্কোপিক ডিটেক্টরগুলো স্বাভাবিক আলোতে তো কাজ করেই, অবলোহিত কিংবা মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশানও শনাক্ত করতে পারে। তাই দিন রাত যে কোন সময় পৃথিবীকে স্ক্যান করতে কোন অসুবিধা হয় না এই স্যাটেলাইটগুলোর। পে-লোড যে তথ্য সংগ্রহ করে তা ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল থেকে ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তরিত হয়ে স্যাটেলাইটের সংশ্লিষ্ট গ্রাউন্ড স্টেশনে চলে যায়। সেখান থেকে তথ্যগুলো চলে যায় পৃথিবীর বিভিন্ন আবহাওয়া দপ্তরে এবং ইন্টারনেটে তাদের ওয়েবসাইটে।

 

চিত্র ৫৬: আবহাওয়া স্যাটেলাইট

 

আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি অরবিটেও থাকতে পারে, আবার পোলার অরবিটেও থাকতে পারে। জিওস্টেশনারি অপারেশনাল এনভাইরনমেন্টাল স্যাটেলাইট (GOES) পশ্চিম গোলার্ধের অনেকটাই কভার করে। জিওস্টেশনারি অরবিটের আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোকে যেহেতু অনেক দূর থেকে পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করতে হয় - তাদের টেলিস্কোপের ক্ষমতা হতে হয় অনেক বেশি। এগুলো থেকে পৃথিবীর মাত্র কিছু অংশে নজর রাখা যায়। এদের স্ক্যানিং থেকে যে ছবি পাওয়া যায় তাদের পরিস্ফূটন ক্ষমতা (রেজ্যুলেশান) খুব ভালো হয় না। সাধারণ এক কিলোমিটারের চেয়ে ছোট জায়গার ছবি এরা তৈরি করতে পারে না।

          পোলার অরবিটের আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোর ক্ষমতা অনেক বেশি। এগুলো পৃথিবীর খুব কাছে থেকে (৮০০ কিমি) পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে প্রচন্ড বেগে। এগুলো প্রতি ১০০ মিনিটে পৃথিবীকে একবার উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুর দিকে প্রদক্ষিণ করে। মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে এরা মেঘের ভেতরের তাপমাত্রা, জলীয়বাষ্প, গতি ইত্যাদি পরিমাপ করে আবহাওয়া, ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস নিখুঁতভাবে দিতে পারে। এরা সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাপতে পারে, সমুদ্রের উপরিতলে বায়ুপ্রবাহের গতি ও তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের চোখের ওপর নজর রাখতে পারে সারাক্ষণ। সুনির্দিষ্ট বিশ্বাসযোগ্য পূর্বাভাসের কারণে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

 

মহাকাশের আবর্জনা

মহাকাশে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য আবর্জনা। এই মহাকাশ-আবর্জনাগুলো মূলত মহাকাশে মানুষের পাঠানো স্যাটেলাইটের ধ্বংসাবশেষ। যে রকেটগুলোতে করে স্যাটেলাইট পাঠানো হয় - সেই রকেটের শুধুমাত্র নিচের অংশটা পৃথিবীতে ফিরে আসে, কিংবা পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে সংঘর্ষে ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু রকেটের দ্বিতীয় অংশ যেটা স্যাটেলাইটকে ট্রান্সফার অরবিটে পৌঁছে দেয় - সেই অংশগুলো মহাকাশে ওজনহীন অবস্থায় ভাসতে থাকে।

 

চিত্র ৫৭: মহাকাশের আবর্জনা

 

তারপর যে স্যাটেলাইটগুলো ঠিকমত কক্ষপথে পৌঁছাতে পারে না তারাও সেখানে ঘুরতে থাকে। মহাকাশে স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ হলে যেসব ধ্বংসাবশেষ তৈরি হয় সেগুলোও সেখানে ভাসতে থাকে। যে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর চারপাশে বছরের পর বছর ধরে অনবরত ঘুরছে তাদের গা থেকে প্রায়ই খসে পড়ছে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদার্থ - হতে পারে রঙের আস্তরণ, সোলার সেলের আবরণ ইত্যাদি। হিসেব করে দেখা গেছে মহাকাশে প্রায় এক কোটির মতো ধাতব আবর্জনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলোর বেশিরভাগেরই আকার আধ-ইঞ্চির চেয়েও ছোট। এই যে অসংখ্য ছোট ছোট আবর্জনা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্যাটেলাইটের কক্ষপথের কাছাকাছি - সেগুলো স্যাটেলাইটের গায়ে লেগে - বিশেষ করে সেন্সরগুলোতে, বা টেলিস্কোপে লেগে গিয়ে তাদের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে পারে।

          লো আর্থ অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোকে আরো বড় বড় আকারের ধাতব আবর্জনার সাথে সংঘর্ষের ঝুঁকিতে থাকতে হয়। এই অরবিটের স্যাটেলাইটগুলোর গতি জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের চেয়ে অনেক বেশি। বড় বড় ধাতব টুকরোগুলোও প্রায় একই বেগে ঘুরে। এগুলোর সাথে স্যাটেলাইটের সংঘর্ষ হলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে স্যাটেলাইটের।

          মাঝে মাঝে দুটো স্যাটেলাইটের মধ্যেও প্রচন্ড সংঘর্ষ ঘটতে পারে। ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ইরিডিয়াম-৩৩ ও কসমস-২২৫১ স্যাটেলাইট দুটোর মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সাইবেরিয়ার ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭৯০ কিলোমিটার উপরে এই সংঘর্ষ ঘটেছিল। সংঘর্ষের সময় এই স্যাটেলাইট দুটোর গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ৪২ হাজার কিলোমিটার। এই সংঘর্ষের ফলে প্রায় ২১৪০টি ধাতব খন্ড মহাকাশের আবর্জনায় যুক্ত হয়। আমেরিকার স্পেস সার্ভেইলেন্স নেটওয়ার্ক এই আবর্জনাগুলোর অবস্থান ও গতির দিকে নজর রাখছে। দেখা যাচ্ছে মহাকাশে স্যাটেলাইট স্থাপন করতে পারলেই সেটা সারাজীবন কাজ করতে থাকবে এমন কোন নিশ্চয়তা নেই।


স্যাটেলাইটের মৃত্যু 

কোন ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটলেও নির্দিষ্ট সময় পরে স্যাটেলাইটগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।  স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল মূলত নির্ভর করে তারা কোন কক্ষপথে থাকে তার উপর।

 

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল সাধারণত ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে হয়ে থাকে। এই জীবনকাল মূলত নির্ভর করে স্যাটেলাইটের থ্রাস্টারের জন্য জ্বালানির পরিমাণ, রিচার্জ্যাবল ব্যাটারিগুলোর জীবনকাল এবং সোলার প্যানেলের সোলার সেলগুলোর কার্যকারিতার উপর।

          কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে এবং স্যাটেলাইটের সব যন্ত্রপাতি ঠিক থাকলে জিও স্যাটেলাইটগুলোর ব্যাটারি ও সোলার সেল গড়ে ১৫ বছর ধরে কাজ করে। সেই হিসেব করে স্টেশন কিপিং-এর থ্রাস্টারগুলোর জন্য তরল জ্বালানি ভরে দেয়া থাকে স্যাটেলাইটের ফুয়েল ট্যাংকে। থ্রাস্টারগুলো ব্যবহার করতে করতে এই ফুয়েল ক্রমশ কমতে থাকে। শেষ পর্যায়ে কিছু জ্বালানি অবশিষ্ট থাকতে থাকতে স্যাটেলাইটকে সার্ভিস থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

          এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে এত দূরে থাকে যে সার্ভিস শেষে এগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা যায় না। আর কক্ষপথের জায়গা যেহেতু সীমিত সেহেতু সেখানে একটি অকার্যকর স্যাটেলাইট বসিয়ে রাখাও যায় না। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে তখন শেষ জ্বালানিটুকু ব্যবহার করে থ্রাস্টারের মাধ্যমে জিও-স্টেশনারি অরবিট থেকে ঠেলে আরো উপরের দিকে সুপার-সিঙ্ক্রোনাস অরবিটে তুলে দেয়া হয়। এখানে স্যাটেলাইটগুলো থাকে কোটি কোটি বছর।

          কিন্তু যদি এই অরবিটে ঠেলে দেয়ার মত যথেষ্ট জ্বালানি অবশিষ্ট না থাকে, কিংবা ঠেলে দেয়ার আগেই তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় - তাহলে অকার্যকর এই স্যাটেলাইটগুলো আস্তে আস্তে সরতে সরতে কক্ষপথ থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার উপরে উঠে স্ট্যাবল ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্টে চলে যায়। দ্রাঘিমাংশের ১০৫ পশ্চিম এবং ২৮৫ পশ্চিম বিন্দুতে এই ইকুইলিব্রিয়াম পয়েন্ট দুটোকে বলা হয় স্যাটেলাইটের কবরস্থান।

 

মিডল আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের তুলনায় পৃথিবীর অনেক কাছে থাকে বলে পুরো পৃথিবীকে স্যাটেলাইট সেবার আওতায় নিয়ে আসার জন্য ৮ থেকে ১৮টি স্যাটেলাইটের গুচ্ছ তৈরি করা হয় যারা একত্রে কাজ করে। এই স্যাটেলাইটগুলোও আবহাওয়ামন্ডল থেকে অনেক উপরে থাকে বলে বাতাসের বেগ নিয়ে কোন সমস্যা হয় না, এবং পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টানও তত তীব্র নয়। ফলে মোটামুটি ১২ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জীবনকাল পায় এই স্যাটেলাইটগুলো।

          জীবনকাল শেষে এই স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে অনেক বেগ পেতে হয়। এই কক্ষপথ জিওস্টেশনারি কক্ষপথের মত অত উপরে নয়, ফলে সহজে এই স্যাটেলাইটগুলোকে সুপার সিঙ্ক্রোনাস অরবিটে ঠেলে দেয়া সহজ নয়। আবার এগুলো পৃথিবীর তত কাছেও থাকে না যে সহজে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ভেতর নিয়ে এসে ধ্বংস করে ফেলা যাবে। তাই এই স্যাটেলাইটগুলোকে জীবনকাল শেষে কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেয়ার জন্য তরল জ্বালানির কমপক্ষে ৪০% রেখে দিতে হয়। এই জ্বালানি খরচ করে জীবনকাল শেষে এগুলোকে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে নিয়ে এসে সমুদ্রে ফেলা হয়। পরে সেখান থেকে সেটাকে উদ্ধার করে রিসাইকেল করা হয়।

 

লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইট: এই স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবীর খুব কাছাকাছি থাকে বলে পুরো পৃথিবীকে সারাক্ষণ স্যাটেলাইটের সেবার আওতায় রাখতে হলে ৪৮ থেকে ৭০টি এধরনের স্যাটেলাইটের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে গুচ্ছ তৈরি করতে হয়। এই কক্ষপথে স্যাটেলাইটগুলোকে অনেক বেশি শক্তি ব্যয় করতে হয় স্টেশন কিপিং-এ। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কাছাকাছি হওয়াতে তার একটা তীব্র টান তো আছেই, তার ওপর আছে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান। পৃথিবী পৃষ্ঠের ৫০০ থেকে ১২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থাকে বলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ও মাধ্যাকর্ষণ বল স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীর দিকে টেনে কক্ষপথ থেকে বের করে দিতে চায়। ফলে স্টেশন কিপিং-এ প্রচুর জ্বালানি খরচ হয়ে যায়। তাই লো আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল হয় মাত্র ৫ থেকে ১০ বছর। জীবনকাল শেষে এই স্যাটেলাইটগুলোকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে খুব বেশি জ্বালানি খরচ হয় না। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার সময় এগুলোর বেশিরভাগ অংশই পুড়ে যায়। বাকিটা সমুদ্রে ফেলে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয় ধ্বংসাবশেষ।


ভবিষ্যতের স্যাটেলাইট

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে স্যাটেলাইট কমিউনিকেশানের আধুনিকায়ন ঘটেই চলেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমশ স্যাটেলাইটনির্ভর হয়ে উঠছে। স্যাটেলাইট সিস্টেম এবং গ্রাউন্ড সিস্টেম উভয় ক্ষেত্রেই কারিগরী দক্ষতা বাড়ছে। স্যাটেলাইট ব্যবহারের ক্ষেত্র বৃদ্ধির সাথে সাথে স্যাটেলাইটের খরচ কমানোর দিকেও মনযোগ দেয়া হচ্ছে। স্যাটেলাইট পে-লোডের অপটিক্যাল সেন্সর, অডিও সেন্সর, র‍্যাডার, ইনফ্রারেড সেন্সর, আলট্রা-ভায়োলেট সেন্সর, টেলিকমিউনিকেশান সিস্টেম ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। স্যাটেলাইট 'বাস'-এর উন্নতি হচ্ছে সলিড স্টেট ডিজাইন এবং সোলার সেল টেকনোলজির ক্রমাগত উন্নতির ফলে। ফুয়েল টেকনোলজির উন্নতির সাথে সাথে ব্যাটারি ও তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারও উন্নতি হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটের জীবনকাল এবং ক্ষমতা আরো অনেক বৃদ্ধি পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভবিষ্যতে স্যাটেলাইটগুলোকে কক্ষপথে অবস্থানকালে মহাকাশ স্টেশন থেকে রোবটের মাধ্যমে স্টেশন কিপিং-এর জন্য জ্বালানি সরবরাহ করার চেষ্টা চলছে। সেটা করতে পারলে কক্ষপথের স্যাটেলাইটগুলোর জীবনকাল অনেক বেড়ে যাবে এবং স্যাটেলাইটের বাৎসরিক খরচ অনেক কমে যাবে।


তথ্যসূত্র 

1.         C. Robert Welti, Satellite Basics for Everyone,   iUniverse, Bloomington, 2012.

2.         Scott L. Montgomery, Moon A tribute to Earth's nearest neighbour, The Five Mile Press, Sydney, 2009.

3.         Joseph N. Pelton, Satellite Communications, Springer,    New York, 2012.

4.         Peter Bond, Space Recognition Guide, Colins, London,   2008.

5.      Joseph N. Pelton, Scott Mardy, Sergio Camacho-Lara   (ed), Handbook of Satellite Applications, 2nd Edition Springer, Switzerland, 2017.

6.         Robert M. Gagliardi, Satellite Communications, 2nd   Edition, Van Nostrand Reinhold, New York, 1991. 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts