Sunday, 28 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৯

 



০৯

তুমি চোখের আড়াল হও, কাছে কিবা দূরে রও

মনে রেখো আমিও ছিলাম।

এই মন তোমাকে দিলাম …

সোহরাওয়ার্দী হলের গেটের কাছে রিকশায় বাঁধা মাইকে অনবরত বাজছেন সাবিনা ইয়াসমিন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ষষ্ঠ বারের মতো শুনছি এই গান। সম্ভবত এই একটা ক্যাসেটই আছে মাইকওয়ালার কাছে। শুধু আজ নয়, গত এক সপ্তাহ ধরে  এই অবস্থা চলছে ক্যাম্পাসজুড়ে। জাতীয় ছাত্রসমাজ নবীনবরণ করবে – তার প্রচারণা চলছে। সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়ে আসবে ক্যাম্পাসে নবীনদের গান শোনানোর জন্য। নবীনবরণ নভেম্বরের ২৭ তারিখ। আরো এক সপ্তাহ বাকি। তার মানে আরো সাতদিন ধরে বাজতে থাকবে সাবিনা ইয়াসমিনের শ্রেষ্ঠ সংগীতের ক্যাসেট। তবুও ভালো যে এরশাদের ভাষণ বাজাচ্ছে না।

 

‘বকুলের মালা শুকাবে, রেখে দেবো তার সুরভি

দিন গিয়ে রাতে লুকাবে, মোছো না কো আমারি ছবি …

 

সাবিনা ইয়াসমিনের সুরেলা গলা ছাপিয়ে আরেকটি বেসুরো গলা ভেসে আসছে রুমের ভেতর থেকে। ধুনকরের তুলা ধুনার শব্দে শুরুতে খেয়াল করিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জবাই করার জন্য চেপে ধরলে ছাগল যেরকম চিৎকার করে সেরকম চিৎকার - অ্যাঅ্যামি মিন্নন্ননঅঅঅঅঅতি কঅঅঅরেএএএ গ্যালআম। বাইরে মাইকের আওয়াজ, বারান্দায় তুলা ধুনার শব্দ না থাকলে রুমের ভেতর থেকে আসা শব্দে আশেপাশের রুম থেকে ছুটে আসতো সবাই। ছাত্রসমাজের হল শাখার ‘ডেপুটি এসিস্টেন সেকেটারি’ টিপু ভাইয়ের গলা কর্কশ তা জানি, কিন্তু গান গাইলে যে এমন যন্ত্রনাদায়ক হয়ে ওঠে তা জানা ছিল না।

 

রুমের সামনে বারান্দায় বসে তোষক বানাচ্ছেন মাঝবয়সী ধুনকর। দুপুরে হলের সামনে তাকে দেখে তিনটায় আসতে বলেছিলাম। তিনি পৌনে তিনটায় এসে কাজ শুরু করেছেন। জুলাই থেকে নভেম্বর - আমার হলজীবনের প্রায় তিন মাস কাটিয়ে দিলাম তোষক ছাড়াই। খাটের উপর পাতলা চাদর বিছিয়ে ঘুমাতে এতদিন তেমন কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন শীত পড়তে শুরু করেছে। তোষক নেই শুনে দিদি কড়া নির্দেশ দিয়েছে তোষকের ব্যবস্থা করে নিতে। এখন তোষকের ব্যবস্থা হচ্ছে। অবশ্য এ ব্যাপারে তার নিজেরও কিছু অবদান আছে, যাকে বলা যায় তোষকাবদান। শামসুন্নাহার হলে থাকার সময় তার যে তোষকটি ছিল, সেটি সে দিয়ে গিয়েছিল তার জুনিয়র স্মৃতিকে। স্মৃতি আমাদের গ্রামের মেয়ে, গ্রামতুতো পিসী। স্মৃতিপিসী হল থেকে যাবার সময় তোষকটি দিয়ে গেছে তার আরেকজন জুনিয়রকে। আমাকে বলা হয়েছে তোষকটি তার রুমে ভালোভাবে প্যাকেটবন্দী করে সংরক্ষণ করা আছে। আমি শামসুন্নাহার হলে গেলেই তোষকের প্যাকেটটি আমাকে দিয়ে দেবে।

 

শুনেছি শামসুন্নহার হলে যাওয়াটা অনেকের কাছে খুবই আনন্দের ব্যাপার। কোন উপলক্ষ ছাড়াই নাকি ঐ হলে যাওয়া যায়। কিন্তু আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো হলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। হলের  কলাপসিপল গেট খুব ছোট করে খোলা। খাকি পোশাক পরা এক পক্কশ্মশ্রু দারোয়ান গেটের কাছে একটি লম্বা টুলে বসে আছেন। দুপুরবেলা তেমন কেউ নেই রাস্তায়। আজ শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণে কোন ক্লাস হয়নি। ক্যাম্পাস ফাঁকা বলেই হয়তো এদিকেও কেমন যেন সুনশান। রুম থেকে কেয়া আপাকে ডেকে দিতে বলার পর দারোয়ান  উধাও হয়ে গেলেন। কাকে দিয়ে রুমে খবর পাঠানো হয় আমি জানি না। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ কাউকে সাথে নিয়ে গেলে সুবিধা হতো। রঘুনাথ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু সে চলে গেছে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার বন্ধু প্রদীপ নাথ থাকে আমাদের হলে। আমাদের ব্যাচে মনে হয় প্রদীপের ছড়াছড়ি। এই প্রদীপ নাথ কেমিস্ট্রির। হলে যাবার কথা শুনেই সে রাজি হয়ে গিয়েছিল। সুন্দর জামাকাপড় পরে গায়ে খুশবু মাখতে মাখতে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের ইয়ারে পড়ে?’

“কে?”

“যার কাছে যাচ্ছিস?”

“কেয়া আপা, মাস্টার্সে পড়েন।“

“তুই যা, আমি যাবো না।“

তাকে কিছুতেই আর রাজি করানো গেল না। একাই যেতে হলো আমাকে। আমি কেয়া আপাকে কোনদিন দেখিনি। চিনবো কীভাবে বুঝতে পারছিলাম না। গেট দিয়ে কাউকে বের হতে দেখলেই মনে হচ্ছিল – ইনিই কেয়া আপা। অনেকক্ষণ পর গেটের কাছে এসে একজন ডাকলেন - “প্রদীপ?” 

লম্বা পাতলা কেয়া আপাকে দেখে অনেকটা আমার নিজের দিদির মতোই লাগছে। একটু পরে কেয়া আপা পুরনো খবরের কাগজ মোড়ানো যে প্যাকেটটা দিলেন – তার সাইজ বড়জোর দেড় ফুট বাই এক ফুট বাই এক ফুট। এর ভেতর আস্ত একটা তোষক কীভাবে থাকবে বুঝতে পারছি না। ওজনও খুব একটা বেশি নয়।

 

“দাঁড়াও তোমাকে রিকশা ঠিক করে দিই।“

“লাগবে না আপা, আমি পারবো।“

“রিকশাওয়ালারা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের প্রেফারেন্স বেশি দেয়। তুমি জিজ্ঞেস করলে বলবে ভাড়া আছে।“

এ ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা আগে হয়েছে। ইচ্ছে করছিলো আজকে আবার পরীক্ষা করে দেখি। কিন্তু পরীক্ষা করতে গিয়ে আজকেও যদি সেদিনের মতো এই তোষক মাথায় করে হলে নিয়ে যেতে হয় – ঝামেলা হবে। তাই পরীক্ষা করার ইচ্ছে বাদ দিলাম। হলের সামনে রাস্তায় একটা রিকশা আছে। কেয়া আপা হাত তুলে রিকশাওয়ালাকে ইশারা করতেই তিনি রিকশা নিয়ে চলে এলেন গেটের কাছে। আমি দ্রুত রিকশায় উঠে বসলাম।

 

পৌনে তিনটায় হলে ঢুকার সময় দেখি ধুনকরও ঢুকছেন। তাঁর কাঁধে বিরাট বস্তা, হাতে লম্বা একতারার মতো তুলো ধুনার যন্ত্র। রুমের সামনে বারান্দায় কাপড় বিছিয়ে তৈরি হয়ে বসলেন ধুনকর। আমার প্যাকেটটার দড়ি খুলে যা পাওয়া গেল তাকে কিছুতেই তোষক বলা যাবে না। তার দলা পাকানো তুলা আর ছিন্নভিন্ন জীর্ণ কাপড় দেখে বড়জোর বলা যায় তোষকাশ্ম। জীবের যেমন জীবাশ্ম হয়, সেরকম তোষকেরও যে তোষকাশ্ম হয় তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। স্মৃতিপিসী কী কারণে এই বস্তু দিদির উত্তরসুরীর হাতে তুলে দেবার জন্য কেয়া আপার কাছে গচ্ছিত রেখে গিয়েছিল? কেয়া আপা কি জানতেন এর ভেতরে কী আছে?

 

শার্লক হোমসের মতো মনযোগ দিয়ে প্যাকেটের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে ধুনকর রায় দিলেন,  “এইগুলা ভাল তুলা ছার। পরিমাণে কম আছে। তোষক হইবে না, একখানা বালিশ হইবে।“

একখানা বালিশ তো আমার আছে। আরেকখানা বালিশ দিয়ে আমি কী করবো? দিদির তোষকাশ্ম থেকে আমার আরেকটি তোষকই তৈরি করাতে হবে। ধুনকরের কাছে সব উপাদান আছে। টাকা দিলেই হলো। কাজে লেগে পড়লেন তিনি। গুঁটিপোকার মতো গুটিয়ে যাওয়া তুলা সশব্দে ধুনতে শুরু করলেন।

 

আমি রুমে ঢুকে দেখলাম টিপুভাই তার খাটে লুঙ্গিপরে এলোমেলোভাবে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর মাথায় ও ডানচোখে এখনো মোটা ব্যান্ডেজ। বারান্দায় দাঁড়ালে সাবিনা ইয়াসমিনের গানের শব্দ যতটা শোনা যায়, রুমের ভেতর শোনা যাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। শব্দ তরঙ্গের বেগ ঘন মাধ্যমে বেশি। কিন্তু ডপলারের সমীকরণ অনুসারে রুমের ভেতর তো কম্পাঙ্ক কিছুটা কম হওয়ার কথা। ক্লাসে ক’দিন আগেই সাউন্ড পড়ানো শুরু করেছেন সদ্য কানাডাফেরৎ নুরুল মোস্তফা স্যার। শব্দের বাস্তব অনুভবের সাথে আমার তত্ত্বগত জ্ঞান ঠিকমতো মিলছে না। গন্ডগোলটা কোথায় হচ্ছে পরে ভেবে দেখতে হবে। আমি আমার চেয়ারটা নিয়ে যথাসম্ভব নিঃশব্দে বারান্দায় চলে এলাম। কিন্তু একটু পরেই কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন টিপুভাই, “অ্যাই, বাইরে এত আওয়াজ করছে কে?”

 

বলতে যাচ্ছিলাম – সাবিনা ইয়াসমিন টিপুভাই। কিন্তু বললাম না। আহত বাঘকে যেমন ঘাটাতে নেই, তেমনি আহত টিপুভাইকেও রাগাতে নেই। ঢাকা থেকে আহত হয়ে ফিরে আসার পর থেকে টিপুভাইয়ের মেজাজ খুব খারাপ। দরজা খুলে উগ্রমূর্তিতে বারান্দায় বের হয়ে এলেন টিপুভাই।

“অ্যাই কী হচ্ছে এসব?”

“একটা তোষক বানাতে দিলাম টিপুভাই।“

“অ। অ্যাই, তোষক হয়ে গেলে তুমি আমার বালিশটাতে আরো কিছু তুলা ভরে ঠিক করে দিও তো –“ বলে নিজের চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া ময়লা বালিশটা নিয়ে এসে ছুড়ে মারলেন ধুনকরের দিকে। ধুনকর অভিজ্ঞ মানুষ। আচরণ দেখেই বুঝে নিয়েছেন টিপুভাই রাজার দলের মানুষ। আমি দরজার খোলা অংশ দিয়ে দেখতে পেলাম টিপুভাই আমার বিছানা থেকে আমার বালিশটা টেনে নিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লেন আবার। এই তিন মাসে বালিশ বিছানা লুঙ্গি স্যান্ডেল টুথপেস্ট সাবান ইত্যাদি জিনিস যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি তা প্রায় ভুলতে বসেছি। মাঝে মাঝে টুথব্রাশটাকেও সন্দেহের চোখে দেখি।

 

দরজাটা টেনে দিয়ে আবার চেয়ারে বসে পড়েছি। তখনই শুনতে পেয়েছি ছাগনিনাদ – টিপুভাইয়ের গান। সাবিনা ইয়াসমিনের গানের সাথে টিপুভাই  যেভাবে গর্জন করে গলা মেলাচ্ছেন তাতে গার্জরিত অর্থাৎ গানে গানে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি। এই শব্দদূষণ কখন থামবে জানি না। নবীনবরণ করতে হলে এভাবে চেঁচামেচি করে করতে হয়? আসলে এখানে হলের রাজনীতিতে তো কোলাহলই সার। যারা যত কোলাহল করতে পারে, পেশীর দাপট দেখাতে পারে – তারাই তত শক্তিমান।

 

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশতম ব্যাচ। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে মাত্র চার মাস হলো।  আমরা এখনো নতুন শিক্ষার্থী।  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের অভ্যর্থনার আয়োজন করেনি। আমাদের ভালোমন্দে কর্তৃপক্ষের কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। আমরা এখানে নিজ দায়িত্বে ভর্তি হয়েছি, সব কিছু নিজ দায়িত্বেই করে যেতে হবে। প্রামাণিক স্যার ক্লাসে যেভাবে বলেন, “না জানলে জেনে নেবে, না বুঝলে বুঝে নেবে” – সেটা মনে হয় সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের যে আয়তন – বাংলাদেশের আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের এত জায়গা নেই। সম্পূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার লক্ষ্যেই শহর থেকে এত দূরে এই ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষকদের জন্য আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পাশে। ছাত্রছাত্রীদের সবার জন্য আবাসিক হল তৈরি হবার কথা। সে কারণেই সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি হবার সময়ে কোন না কোন হলের সাথে সংযুক্ত থাকতে হয়। অথচ এখন এই হলগুলি রাজনৈতিক পান্ডাদের আড্ডাখানা। সবগুলি হল কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক দলদ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের সাথে সাথে এই হলগুলিতে ক্ষমতাসীন দলের দলদাস ছাত্রশাখার বাহুবলীদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়।

 

ছাত্রইউনিয়ন প্রগতিশীল রাজনীতি করে। আমাদের ক্যাম্পাসে তারা হারমোনিয়াম পার্টি নামে পরিচিত হলেও বৈরি সময়ে টিকে থাকার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তাদের। রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই থাকুক – ছাত্রইউনিয়নের কিছু নেতা-কর্মী অনবরত সংগ্রাম করে হলেও প্রত্যেক হলে টিকে থাকে। অনেক সময় ছদ্মবেশেও থাকে তারা। এই হলেই আমার পরিচিত কয়েকজন আছেন যারা ছাত্রইউনিয়নের প্রগতিশীল আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু হলে থাকার জন্য ছাত্রসমাজের সাথে সহাবস্থান করছেন। ক্যাম্পাসে এই ছাত্রইউনিয়নই প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান করেছে আমাদের জন্য। রেলস্টেশনের বাইরের চত্বরে হারমোনিয়াম তবলা বাজিয়ে গান গেয়েছে ‘আমরা করবো জয় একদিন।“ অনেকদিন থেকেই শুনছি একদিন জয় করার আশাবাদ – কিন্তু সেইদিন কোন্‌দিন আসবে কেউ জানে না। তবুও আশায় বাঁচে মানুষ, আশায় বাঁচে আদর্শ। আবার মাঝে মাঝে  এমনও দেখা যায় যে প্রগতিশীল নেতাদের কথায় আর কাজে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আশরাফ ভাই আমাকে বলেছিলেন তাঁর মাস্টার্স পরীক্ষা হয়ে যাবার পর তাঁর সিটে গিয়ে উঠতে। আশরাফ ভাই যেদিন যেতে বলেছিলেন সেদিন তাঁর রুমে গিয়ে দেখি তাঁর সিটে ছাত্রশিবিরের এক কর্মী উঠে গেছেন। আশরাফ ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন তিনি আড়াইশো টাকা দিয়ে এই সিট কিনেছেন আশরাফ ভাইয়ের কাছ থেকে। আমার ভেতরটা কেমন যেন ছোট হয়ে গেল। অন্যকে ছোট করার জন্য অনেকে মিথ্যা অপবাদ দেন। ইনিও কি আশরাফ ভাই সম্পর্কে মিথ্যা বলছেন? কিন্তু আশরাফ ভাই যে আমার কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন।

 

হলে ছাত্রলীগ এবং ছাত্রদলও মাঝে মাঝে ছোটখাট মিটিং মিছিল করে। কিন্তু ছাত্রশিবিরের তেমন জোরালো কোন কার্যক্রম এখনো সেভাবে দেখা যায় না। কিন্তু হলের নেতাদের কাছে যেসব খবর শুনি – তাতে বোঝা যায় – ছাত্রসমাজের সবচেয়ে বড় ভয় ছাত্রশিবিরকে নিয়ে। তাই তারা ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগকে যতটুকু ছাড় দেয়, ছাত্রশিবিরকে ততটুকু দেয় না।

 

দিন চলে যায়। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ধর্মঘট শুরু করলেন। তাতে সরকারের কিছু এলো গেলো বলে মনে হয় না, যা ক্ষতি হবার আমাদেরই হচ্ছে। আমাদের কোন ক্লাস হলো না সেপ্টেম্বর মাসে। এরশাদ সরকার তাঁর গায়ের সামরিক পোশাক বদলে গণতান্ত্রিক পোশাক পরার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেলেন। তিনি সামরিক বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিলেন। যে পার্টি তিনি নিজে তৈরি করেছেন সেই পার্টিতে এতদিন যোগ দেননি – কারণ তিনি সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিলেন। আহা, কী আদর্শবান! আমার রুমের এরশাদের শিষ্যদের মুখে তাদের গুরুর গুণগান শুনতে শুনতে মনে হয় এরা গুণগান আর স্টেনগানকে সমার্থক মনে করে। দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেয়া হয়। সামরিকজান্তারা সবাই জনতার দলে মিশে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টি, জামায়াতকেউই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। শোনা যায় এরশাদ টাকাপয়সা দিয়ে আরো পনেরজন প্রেসিডেন্টপ্রার্থী জোগাড় করেছেন নির্বাচনকে বিশ্ববাসীর কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ করার জন্য। এরশাদের বিপরীতে প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়িয়েছেন কর্নেল ফারুক – যিনি বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছেন। এর চেয়ে অপমানের আর কী থাকতে পারে।

 

দুর্গাপূজা, শরৎকালীন ছুটি ইত্যাদি উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলো অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত। ১৫ অক্টোবর এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। নির্বাচনের পর তাঁর সভায় যোগদান করার জন্য চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন রিজার্ভ করে ঢাকায় গিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। আমাদের হলের পাতিনেতা সিকিনেতারাও গিয়েছিলেন। যাবার পথে কোন এক স্টেশনে ট্রেন থামার পর ছাত্রসমাজের এসব নেতারা স্টেশনে নেমে একটু বেশী জোশ দেখিয়ে ফেলেছিল। স্থানীয়দের সাথে মারপিট লেগে গেল। স্থানীয় লোকজন ট্রেন আক্রমণ করলো। সেই আক্রমণে আহত হয়েছেন টিপুভাই। তার মাথায় আর চোখে আঘাত লেগেছে। এখনো ব্যান্ডেজ আছে। এর মধ্যেই ইউনিভার্সিটিতে তাদের ক্ষমতা আরো বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে নবীনবরণের আয়োজন। সাবিনা ইয়াসমিনের গান বাজছে প্রত্যেকটি হলের সামনে রাখা রিকশায়। দিনের বেলা অনেকগুলি মাইক ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্যাম্পাসজুড়ে। জাতীয় ছাত্রসমাজের ইউনিভার্সিটি শাখার প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে নিয়ে অনেকগুলি মটরসাইকেল সহযোগে শোভাযাত্রা হচ্ছে। তবুও ভালো যে এই মটরসাইকেল শোভাযাত্রায় আমাদের যেতে হচ্ছে না।

 

তোষক তৈরি হয়ে গেছে। বিছানায় বিছিয়ে দিলাম। ধুনকর টিপুভাইয়ের চ্যাপ্টা বালিশে নতুন তুলো ভরে নাদুসনুদুস করে দিয়েছেন। সেই বালিশের টাকাটাও আমার কাছ থেকে নিয়ে তিনি বিদায় হয়েছেন। নতুন তোষকে বিছানাটা অন্যরকম লাগছে।

 

এরপর একটা সপ্তাহ দ্রুত কেটে গেল। ইতোমধ্যে এরশাদের ছবিযুক্ত পোস্টারে ক্যাম্পাস ছেয়ে গেছে। হলগুলির দেয়ালে দেয়ালে, ক্যাম্পাসের দেয়ালগুলিতে যতদূর পারা যায় – পোস্টার দিয়ে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রফেসর আবদুল আজিজ খান যখন ভিসি ছিলেন, তখন ক্যাম্পাসে প্রচুর গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। গত চার-পাঁচ বছরে সেই গাছগুলির কান্ড এখন অনেকটাই পুষ্ট হয়েছে। নরম সবুজ পাতার সেসব গাছের গায়ে গায়েও রাতারাতি সেঁটে গেছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। তিনি নাকি এখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। মনে হচ্ছে গণতন্ত্র অনেকটা পানির মতো হয়ে গেছে – যখন যে পাত্রে রাখা হচ্ছে, সেই পাত্রের আকার ধারণ করছে। এখন রেডিও টেলিভিশনের সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ দেখলে মনে হয় এরশাদের মতো প্রকৃত গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সারাপৃথিবীতে আর একটিও নেই।

 

শিক্ষকরা ধর্মঘট আংশিক প্রত্যাহার করেছেন। তাঁরা সকাল দশটা পর্যন্ত কোন ক্লাস নেন না। এরপর ক্লাস নেন। আমাদের প্র্যাকটিক্যাল হচ্ছে নিয়মিত। সাহা স্যার প্র্যাকটিক্যাল করান। প্র্যাকটিক্যালের রাফ খাতায় ডাটা নিয়ে তাঁর দস্তখত নিয়ে হয়। তিনি এক সেট ডাটা নিলে স্বাক্ষর করেন না, কমপক্ষে তিন সেট ডাটা নিতে বলেন। জান বের হয়ে যাবার অবস্থা আমাদের। প্রদীপ নাথ এই অবস্থার নাম দিয়েছে – ফানা হয়ে যাওয়া। সাহা স্যার আমাদের ফানা করে দিচ্ছেন প্রত্যেকটা প্র্যাকটিক্যালে।

 

নভেম্বরের ২৬ তারিখ  সকাল থেকে ক্যাম্পাসে আমরা।  বিকেলে  প্র্যাকটিক্যাল ছিল।  বিকেল পাঁচটায় প্র্যাকটিক্যাল শেষ করে বের হয়ে দেখি পুরো ক্যাম্পাস নিস্তব্ধ। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পারছি। ক্যাম্পাসের সব বাস উধাও। পরদিন নবীনবরণ হবার কথা ছিল। আর্টস ফ্যাকাল্টির সামনে সামিয়ানা টাঙানো হচ্ছিলো। সেগুলির কোন চিহ্নও নেই এখন। চাকসু ভবনের সামনে ছোট ছোট জটলা। এর ওর মুখ থেকে জানা গেলো একটা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটে গেছে সবগুলি হলে। ক্যাম্পাস এখন পুরোটাই ছাত্রশিবিরের দখলে। জাতীয় ছাত্রসমাজের যাকে যেখানে পাওয়া গেছে তলোয়ার দিয়ে কোপানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কাল সকাল ন’টার মধ্যে হল ছাড়তে হবে সবাইকে।

 

ছাত্রসমাজের ব্লকে থাকি আমি। তখনো জানি না হলে আমার রুমের কী অবস্থা। কাটাপাহাড় দিয়ে বন্ধুরা সবাই হেঁটে হেঁটে ট্রেন স্টেশনে এলাম। যারা হলে থাকে – তারা সেদিক দিয়ে হলের দিকে চলে গেলো। হাফিজ, ইকবাল, প্রেমাঙ্কর, আনন্দ, কবীর, জামাল – সবাই। যীশু বললো, ‘তুই শহরে চল আমাদের সাথে।‘ প্রদীপ নাথ বললো, “তুই আমার সাথে চল আমাদের বাড়ি।“ কিন্তু আমি যাই কীভাবে? আমার সব জিনিসপত্র রয়ে গেছে হলে। আমার বইপত্র যা সাথে ছিল তা যীশুকে দিয়ে দিলাম। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন দেরি করছে আজ। অপেক্ষা করছে – কেউ যদি আজকেই হল ছেড়ে চলে যেতে চায় তাদের জন্য। ঘটনা ঘটেছে দুপুরে। মেয়েদের অনেকেই হল ছেড়ে চলে গেছে ইতোমধ্যে। আমরাই প্র্যাকটিক্যাল রুমে ছিলাম বলে কিছুই জানতে পারিনি।

 

হলের দিকে এগোলাম। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। পথে যাদের দেখছি মনে হচ্ছে তাদের আগে কখনো দেখিনি এই ক্যাম্পাসে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে তিন রাস্তার  মাঝখানে একটা বড় জায়গা এলোমেলোভাবে ইট ফেলে ঘিরে রাখা হয়েছে। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। এখানেই কয়েক ঘন্টা আগে জাতীয় ছাত্রসমাজের প্রেসিডেন্ট হামিদকে ইটের উপর ফেলে তলোয়ারের এক কোপে কেটে নেয়া হয়েছে তার ডান হাত, কেটে ফেলা হয়েছে বাম হাতের সবগুলি আঙুল।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Macroscopic Quantum Tunnelling: The Science Behind the 2025 Nobel Prize in Physics

  Even though physicists do not believe in ghosts, they have no way of denying the strange, almost ghost-like behaviour of quantum mechanics...

Popular Posts