পৃথিবীর প্রথম মানবহৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন
স্টুডেন্ট বা স্টাফদের জন্য
ক্যাম্পাস-বাস। আইডি দেখানোর নিয়ম আছে। কিন্তু আমরা তো বহিরাগত। এলিজাবেথকে বললাম, “ড্রাইভারকে তুমিই
জ্ঞিজ্ঞেস করবে আমরা যেতে পারবো কিনা।”
“আমি কেন?”
“আ বিউটিফুল ফেস ইজ দ্যা বেস্ট রেকমেন্ডেশান।”
“কিন্তু সে যদি শ্বেতাঙ্গ পছন্দ না করে?”
"তুমি যদি শ্বেতাঙ্গ পুরুষ হতে
তাহলে হয়তো এ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু শ্বেতাঙ্গ নারী সবাই পছন্দ করে।”
মেডিকেল ক্যাম্পাসে যাবার যাত্রী বেশি
ছিল না। 9C বাসের ড্রাইভার
বেশ হাসিমুখেই কথা বললেন এলিজাবেথের সাথে। মনে হলো ক্যাম্পাস বাসে সবাই চড়তে পারে।
আপার ক্যাম্পাসের চারপাশে
ঘুরে হাইওয়েতে কিছুদূর এসে চারটা স্টপ পর গ্রুট ইশকির হাসপাতালের সামনে নামলাম। পৌনে তিনটা বাজে। হাসপাতালের দুটো
উইং।
পুরনো
ভবনটাকে এখন জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান
হাসপাতালগুলোর একটি হলো গ্রুট ইশকির হাসপাতাল। ডাচ শব্দ গ্রুট ইশকির (GROOTE SCHUUR) এর অর্থ হলো
‘মহান খামার’। ডাচরা এই অঞ্চলের
নাম দিয়েছিলো গ্রুট ইশকির।
১৯৩৮ সালে এই হাসপাতাল স্থাপিত হয়। কেইপ টাউন ইউনিভার্সিটির
মেডিসিন ফ্যাকাল্টির টিচিং হাসপাতাল এটা। এই হাসপাতাল পৃথিবীবিখ্যাত
-
কারণ
এখানেই পৃথিবীর প্রথম মানুষের-হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
গ্রুট ইশকির হাসপাতাল
১৯৮৪ সালে হাসপাতাল
ক্যাম্পাসের মধ্যে আরেকটি নতুন বিল্ডিং-এ নিয়ে যাওয়া হয়। পুরনো ভবনকে রেখে দেয়া হয়
আগের মতোই। ২০০৭ সালে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে পুরনো
হাসপাতাল ভবনের যেখানে অপারেশন হয়েছিল সেই রুমগুলোকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হার্ট অব কেইপটাউন’ মিউজিয়াম। আমরা এখন
সেখানে।
বিকেল তিনটায় গাইডেড ট্যুর শুরু হলো। আমাদের
পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো ইতিহাসের নায়ক ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের সাথে।
বেশ বড় অফিসঘর তাঁর। ১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর
যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখা আছে। হুবহু মূর্তি বানিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে তাঁর চেয়ারে।
মনে হচ্ছে এখুনি জ্ঞিজ্ঞেস করবেন, “কী সমস্যা হচ্ছে আপনার?”
ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের জন্ম ১৯২২ সালের
৮ নভেম্বর, কেইপ টাউনেই। লেখাপড়া করেছন এই ইউনিভার্সিটি অব কেইপ টাউনেই। এখান থেকেই ডাক্তারি
পাস করে গ্রুট ইশকির হাসপাতালের সার্জন হয়েছেন ১৯৫৮ সালে। তাঁর ছোটভাই
মরিস বার্নার্ডও ডাক্তার। জটিল সার্জারিতে ক্রিশ্চিয়ানকে অ্যাসিস্ট করেন মরিস। শরীরের অঙ্গ
প্রতিস্থাপন করে রোগীকে নবজীবন দান করার মহান প্রচেষ্টা ছিল ক্রিশ্চিয়ানের।
১৯৫৩ সালে প্রথম সফল কিডনি প্রতিস্থাপনের
কাজ হয় আমেরিকায়। তারপর বিভিন্ন দেশে কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে সফলভাবে।
ক্রিশ্চিয়ান কিডনি প্রতিস্থাপন করেন কেইপ টাউনে ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে। কিন্তু তখনো
পৃথিবীর কোথাও একজন মানুষের হৃৎপিন্ড খুলে নিয়ে অন্য মানুষের হৃৎপিন্ডের জায়গায়
লাগিয়ে দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা কেউই করেননি। অথচ গবেষণা চলছিলো বিশ্বব্যাপী
বড় বড় বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে। ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড ততদিনে ৫০টারও বেশি কুকুরের
হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপন করেছেন সাফল্যের সাথে। মানুষের হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপনের জন্য
যা যা দক্ষতা, চিকিৎসাসরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি দরকার সবই ছিল তার অপারেশন থিয়েটারে।
দক্ষ সহায়কদলও ছিল। কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।
ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড। (ডানে মিউজিয়ামে রাখা তাঁর মূর্তি)
১৯৬৭ সালে
ডক্টর বার্নার্ডের একজন মরণাপন্ন রোগী ছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি। সিভিয়ার হার্ট
ফেইলিওরের কারণে তাঁর হার্টসার্জারির দরকার ছিল। কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের
ব্যবস্থা করে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। ডক্টর বার্নার্ড দেখলেন হৃৎপিন্ড দান
করার মতো কাউকে পাওয়া গেলে ওয়াশক্যানস্কিকে তিনি বাঁচাতে পারেন। কিন্তু সেরকম দাতা
কোথায় পাবেন? এমন হতে হবে যে দাতার শরীরের মৃত্যু হয়েছে অন্য কোন কারণে, কিন্তু
হৃৎপিন্ড সুস্থ আছে। তখন সেই হৃৎপিন্ড খুলে নিয়ে - যার হৃৎপিন্ড খারাপ হয়ে গেছে
অথচ প্রাণে বেঁচে আছে তাকে বাঁচানো যায় নতুন হৃৎপিন্ড বসিয়ে দিয়ে।
সেই সময় অন্য একটি পরিবারে একটি দুর্ঘটনা
ঘটলো ১৯৬৭ সালের ৩ ডিসেম্বর। পঁচিশ বছর বয়সী উচ্ছল তরুণী ডেনিস ডারভ্যাল তাঁর
বাবা-মার সাথে চায়ের নিমন্ত্রণে যাচ্ছিলো এক পারিবারিক বন্ধুর বাসায়। হাসপাতালের
কাছের সাবার্বের একটি শপিং এরিয়ায় গাড়ি থামিয়ে কেক কেনার জন্য যাচ্ছিলো ডেনিস ও
তার মা। গাড়ি থেকে নেমে দু’জনে রাস্তা
পার হচ্ছিলো। এমন সময় একটা দ্রুতগামী গাড়ী তাদের দু’জনকে চাপা দিয়ে চলে গেলো। ডেনিসের মা মারা
গেলেন তৎক্ষণাৎ রাস্তার ওপর। ডেনিস গাড়ির ধাক্কায় শূন্যে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়লেন
নিজেদেরই গাড়ির চাকার ওপর। প্রচন্ড আঘাতে মাথার খুলি ফেটে গেলো। দ্রুত নিয়ে যাওয়া
হলো গ্রুট ইশকির হাসপাতালে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করা হলো।
কিন্তু রাত ন’টার দিকে
ডেনিস ব্রেনডেথ হয়ে গেলো।
তখনকার মেডিকেল এথিক্স অনুযায়ী ডেনিস
কিন্তু তখনো শারীরিকভাবে মৃত নয়। তার হৃৎপিন্ড তখনো সচল। কিন্তু মস্তিষ্ক যেহেতু
মরে গেছে তাই শরীর অসাড়। এ অবস্থায় ডেনিসের বেঁচে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই।
ডেনিসের বাবার সাথে কথা বললেন ডক্টর বার্নার্ড।
ডেনিসের হৃৎপিন্ড দিয়ে লুইস ওয়াশক্যানস্কির জীবন বাঁচানো যায়। শুধু তাই নয়, ডেনিসের
কিডনি দিয়েও বাঁচানো যায় আরো একটি জীবন।
ডেনিসের বাবা বুঝলেন ব্যাপারটা। তিনি
অনুমতি দিলেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী ডেনিসের হৃৎপিন্ডের ধুকধুক যতক্ষণ সচল- ততক্ষণ
সে মৃত নয়। ক্রিশ্চিয়ানের ভাই ডাক্তার মরিস বার্নার্ডকে পরামর্শ দিলেন। পরামর্শমতো
ডেনিসের হৃৎপিন্ডে ইনজেকশানের সাহায্যে পটাশিয়াম ঢুকিয়ে দেয়া হলো। হৃৎপিন্ড
অবসাদগ্রস্থ হলো।
শুরু হলো পাশাপাশি দুটো থিয়েটারে প্রাণ
দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর কর্মযজ্ঞ।
ডেনিসের
সুস্থ হৃৎপিন্ড খুলে নেয়া হলো। অন্য রুমে ওয়াশক্যানস্কির হৃৎপিন্ডও খুলে নেয়া হলো।
তারপর দীর্ঘ নয় ঘন্টাব্যাপি অপারেশন করে ডেনিসের হৃৎপিন্ড লুইসের বুকে বসিয়ে দেয়া
হলো। পৃথিবীর প্রথম মানব-হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপনের ইতিহাস তৈরি করলেন ডাক্তার
ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড।
শুধু তাই নয়, ডেনিসের কিডনি প্রতিস্থাপন
করে বাঁচানো হলো ১০ বছরের বালক জনাথন ভ্যান ওয়েক-এর জীবন। সেদিনের ঘটনা মানবতার
পক্ষে অনেকগুলো মাইলফলক হয়ে থাকলো।
ডেনিস ছিল খ্রিষ্টান। তার হৃৎপিন্ড নিয়ে
বেঁচে উঠলো ইহুদি পুরুষ লুইস ওয়াশক্যানস্কি। থাকলো না কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ, রইলো না
নারী-পুরুষ বিভাজন। ডেনিস ছিল শ্বেতাঙ্গ। তার কিডনি পেয়ে বেঁচে উঠলো কৃষ্ণাঙ্গ
বালক জনাথন। রইলো না কোন বর্ণভেদ।
কিন্তু মানবই মানবতাবিরোধী কাজকর্ম করে
থাকে। তখনকার অ্যাপারর্টেড বা বিচ্ছিন্নকরণ আইন অনুযায়ী কালো মানুষ সাদা মানুষের
সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে পারে না। তাই বলা হলো সাদা মানুষের কিডনি দিয়ে কালো মানুষ
বাঁচিয়ে অপরাধ করেছেন ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ডের দল।
কিন্তু শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার বার্নার্ড
ছিলেন সত্যিকারের মানবতাবাদী। তাঁর কাছে সাদা-কালোর কোন পার্থক্য ছিল না।
কেইপটাউনের ডিস্ট্রিক্ট সিক্স থেকে সাদা-কালো আলাদা করা হচ্ছিল যেসময়, সেই সময়েই
সাদা-কালো এক করে দিলেন তিনি। ডেনিসের হৃৎপিন্ড আক্ষরিক অর্থে বুকে ধারণ করে ১৮
দিন বেঁচেছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি।
ডেনিস ডারভ্যালের হৃৎপিন্ড নিয়ে প্রাণ পেয়েছিলেন লুইস ওয়াশক্যানস্কি এবং কিডনি নিয়ে বেঁচেছিল জনাথন।
এখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের
উন্নতির সাথে সাথে অনেক উন্নত মানুষের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। যার ফলে অঙ্গ
প্রতিস্থাপনেও সাফল্যের হার বেড়েছে।
১৯৬৭ সালের ৩রা ডিসেম্বর ঠিক যেভাবে সেই
অপারেশন থিয়েটারে হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপিত হয়েছিল সেখানে ঠিক সেইভাবেই সময়কে ধরে
রাখা হয়েছে। সব ডাক্তার, অ্যাসিস্ট্যান্ট, নার্স সবার হুবহু চেহারা ও গেট-আপে
মূর্তি বানিয়ে রাখা হয়েছে মিউজিয়ামে। সভ্যতার এত বড় অর্জনের কথা সবার জানা উচিত।
ফেরার পথে আর বাসে উঠতে ইচ্ছে করলো না।
হাসপাতালের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে উঠে গেলাম। মিটারচালিত ট্যাক্সি -
গন্তব্য বলতেই স্টার্ট। সিটে হেলান দিয়ে “আই অ্যাম সো টায়ার্ড" বলেই চোখ বন্ধ
করে ফেললো এলিজাবেথ। মনে হলো ঘুমিয়েই পড়লো।
হার্ট অব কেইপ টাউন মিউজিয়ামে হার্ট-ট্রান্সপ্লেন্টেশান মডেল
মিনিট খানেক পরে লবিতে এসে দেখি লিফট এর
কাছে দাঁড়িয়ে আছে এলিজাবেথ।
“ওয়েটিং ফর ইউ” -
ক্যাজুয়েলি বললো সে।
“থ্যাংক ইউ”
লিফটে ওঠার পর কয়েক সেকেন্ড নিরবতা।
“হোয়াট অ্যাবাউট ডিনার?” সরাসরি প্রশ্ন তার।
“হোয়াট অ্যাবাউট ইট?”
“লেটস গো আউট”
আমি কোন জবাব দিলাম না।
বুঝতে চেষ্টা করছি তার উদ্দেশ্য কী। ফোর্থ ফ্লোর এসে গেছে। লিফটের দরজা খুললো। আমি
বের হলাম। সেও। করিডোরে দাঁড়ালাম।
“সেভেন ও ক্লক?” আবার
প্রশ্ন করলো সে।
“হোয়াট?”
“ডিনার”
কিছু কিছু প্রস্তাব আছে ‘না’ করতে নেই।
“কোথায় যেতে চাও?”
“ওয়াটারফ্রন্ট। সাতটায় একটা বাস যায় হোটেল থেকে। ওটাতে যাবো।”
“ওকে, সি ইউ দেন।"
“ওয়েট ফর মি হিয়ার। একসাথে যাবো।”
“ঠিক আছে”
“সি ইউ সুন”
No comments:
Post a Comment