Wednesday 2 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৮

 



ঘরে ফেরা

 সকাল ১১টায় রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কাউন্টারে হিসেবপত্তর মিটিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম আমার ট্যাক্সি এসেছে কিনা। পাশের রুম থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলো জেনি। সকালে সে-ই আমার জন্য ট্যাক্সি বুক করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার এই হাসিখুশী তরুণীর নাম Xenowien। ইংরেজি উচ্চারণে জেনোওয়েইন বা জেনোবিন হবার কথা কিন্তু সে বললো তার নামের উচ্চারণ ওরকম নয় তারপর নিজে যা উচ্চারণ করলো তা অনেকটা গলার ভেতর থেকে কফ পরিষ্কার করতে গেলে যেরকম শব্দ হয় সেরকম একটা শব্দ দিয়ে শুধু করতে হবে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম। মুখে থুথু উঠে এলো, কিন্তু সঠিক শব্দ উচ্চারিত হলো না। তখন সে বললো, ইউ ক্যান কল মি জেনি।

     ইওর কার ইজ রেডি স্যার

          লিকলিকে এক কিশোর বেলবয় এগিয়ে এলো আমার ব্যাগ নেয়ার জন্য। বাধা দিলাম না। এদেশে শ্রমের দাম এখনো অনেক কম। তাই অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাদের। কিছু টিপস তাদের আকাঙ্খিত পাওনা।

          হোটেলের নিজস্ব পরিবহন লুপের ঝকঝকে গাড়ি। এয়ারপোর্টে ড্রপ করার জন্য চার্জ নেবে ৩৫০ র‍্যান্ড।

          কালো স্যুট-টাই পরা ড্রাইভারকে ভি-আই-পি-দের নিরাপত্তারক্ষীর মতো লাগছে।

          বিদায় কেইপ টাউন। শহরটার সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়েছি। কিছু কিছু শহর থেকে চলে আসার সময় কেমন যেন হালকা লাগে। মনে হয় একটা কাজ শেষ হলো, আর আসতে হবে না এখানে। আবার কিছু জায়গা আছে যেখান থেকে চলে আসার সময় মনে হয় - আবার আসতে হবে এখানে। কেইপ টাউন তেমনি একটা শহর।





 * * *

সাউথ আফ্রিকান এয়ারওয়েজের চেকইন কাউন্টারগুলোর সামনে লম্বা লাইন। অনেকক্ষণ লাগলো কাউন্টারে পৌঁছাতে।

          যে কাউন্টারে গেলাম- একজন মাঝবয়সী রাগী রাগী চেহারার আফ্রিকান মহিলা। হাত বাড়িয়ে আমার পাসপোর্ট নেবার সময় খেয়াল করলাম তাঁর দুটো আঙুলে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো।

     মেলবোর্ন?

     ইয়েস

          আনুষঙ্গিক রুটিন প্রশ্নমালা শেষে তিনটি বোর্ডিং পাস বুঝিয়ে দিলেন কেইপ টাউন টু জোহানেসবার্গ, জোহানেসবার্গ টু পার্থ, অ্যান্ড পার্থ টু মেলবোর্ন।

          পাসপোর্ট আর বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, আপনার আঙুলে কী হয়েছে?

          দেখলাম তাঁর গম্ভীর মুখে একটা স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। বললেন, রান্না করতে গিয়ে পুড়ে গেছে। মনে হলো হাত পুড়ে যাওয়াতে তাঁর কষ্টের চেয়ে আনন্দই বেশি। প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করতে গিয়েই হয়তো তাঁর এই কষ্টের আনন্দ।

 

* * *

 

জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে প্রচন্ড ভিড়। সিকিউরিটি চেকিং-এর দীর্ঘলাইন পেরিয়ে আসতে ঘন্টাখানেক লাগলো। ইমিগ্রেশান অফিসাররা প্রচন্ড ব্যস্ত। তাদের সবাইকে অতিরিক্ত সতর্ক বলে মনে হচ্ছে।

          দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাবার পরেও, সারা পৃথিবীর শ্বেতাঙ্গ জগৎ কৃষ্ণাঙ্গদের এখনো প্রায়ই কৃতদাস বলেই মনে করে। বর্নিল পৃথিবী বড়ই বর্ণবাদী। তাই ইউরোপ আমেরিকায় এখনো কেষ্টা ব্যাটাই চোর ভাবার লোকের অভাব নেই। সেজন্য আফ্রিকার যে কোন এয়ারপোর্ট থেকে ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাওয়ার ফ্লাইটগুলোতে অতিরিক্ত রকমের সতর্কতা।

          আমার ফ্লাইট গেট A16. গেটে এসে দেখি সেখানে আরেকটা নিরাপত্তাবেষ্টনী। অন্য গেটের ওয়েটিং এরিয়ায় অপেক্ষা করছে সবাই

     আপনার কি কয়েক মিনিট সময় হবে?

          চোখ তুলে তাকালাম লিকলিকে সুপারি গাছের মতো লম্বা এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ, কাঁধে ঝোলানো ছোট্ট ব্যাগ আর হাতে আই-প্যাড

     কী ব্যাপার?

     বসি?

     বসেন

বসলো পাশের চেয়ারে। গলায় ঝুলানো আইডি দেখিয়ে বললো, আমার নাম বেদেল। আমি দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটন কর্তৃপক্ষের হয়ে জরিপ করছি।

          দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটনশিল্পকে আরো উন্নত করার জন্য পর্যটকদের মতামতের গুরুত্ব অনেক। তাই বেদেলদের কাজ হলো বিভিন্ন প্রশ্ন করে জেনে নেয়া - কেমন লাগলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

          প্রশ্নমালা শেষে ব্যাগ থেকে একটা স্যুভেনির বের করে গিফট করলো বেদেল। জানতে চাইলাম, এটাই আপনার ফুল টাইম জব?

     না, এটা পার্ট টাইম। আমি ফুল টাইম স্টুডেন্ট।

          বেদেল ইন্টারন্যশনাল স্টুডেন্ট। এসেছে কঙ্গো থেকে। খন্ডকালীন কাজ করে থাকাখাওয়ার পয়সা জোগাড় করে। এক ধরনের একাত্মতা অনুভব করি বেদেলের সাথে। বিভিন্ন রকমের খন্ডকালীন কাজ করে একসময় আমাকেও জোগাড় করতে হয়েছে পড়াশোনার খরচ।

          আমি বাংলাদেশি শুনে বেদেল খুব প্রশংসা করলো বাংলাদেশিদের। জাতিসংঘের হয়ে অনেক বাংলাদেশি সৈনিক কঙ্গোতে কাজ করছেন সুনামের সাথে। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের সুনাম শুনতে কী যে ভালো লাগে, গর্বে বুক ফুলে যায়।

          আমাদের গেটের চেকিং শুরু হবার আগে পরের গেটের কার্যক্রম শুরু হলো। নিউইয়র্কের ফ্লাইট। মনে হচ্ছে যুদ্ধকালীন অবস্থা সেখানে। সবাই যার যার জুতো খুলে হাতে নিয়ে যাচ্ছেন এক একটা টেবিলের কাছে যেখানে ব্যাগ খুলে তন্ন তন্ন করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা আর কোন কিছু অর্জন না করতে পারলেও সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াতে পারছে সারা দুনিয়াজুড়ে।

          একটু পরে আমাদের প্লেনের চেকিং শুরু হলো। আমাদের অবশ্য জুতা খুলতে হলো না। আমার সিট প্লেনের পেছনের দিকে জানালার পাশে।

          যথাসময়ে প্লেন উড়লো আকাশে। দশ ঘন্টা পরেই অস্ট্রেলিয়া।

__________

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts