Wednesday, 2 September 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ১৪

 


টু ওশ্যান অ্যাকোয়ারিয়াম

বৃষ্টি ঝরছে ওয়াটারফ্রন্টে। শপিং সেন্টারের ভেতর বাইরের বৃষ্টির কোন প্রতিক্রিয়া নেই। লোকে গম গম করছে এদিকটা। সামনের রাস্তাটার পরেই ভাসছে ছোট ছোট নৌকা, স্পিডবোট। এখানে খাবার দোকানগুলোতে অনেক ভিড়। আশিটির মতো খাবারের আউটলেট আছে এখানে।

          ফিশ অ্যান্ড চিপস-এর অর্ডার দিয়ে উঠে বসলাম উঁচু টুল-টেবিলে। মিনিট দশেক পরে সদ্যভাজা মাছ আর আলুর প্লেট এনে রাখলো সামনে। সাথে একটা আফ্রিকান বুনো পেয়ারার জুস। মাছের নাম লাইন। লাইন ফিশের বাংলা কী হবে? রেখা মাছ? আসলে জালের বদলে এগুলোকে বড়শি দিয়ে ধরা হয় বলেই এদের এই নাম। তাজা মাছের একটা চমৎকার স্বাদ আছে। মনে হচ্ছে লেবুর রস দিয়ে কাঁচাও খাওয়া যাবে এগুলো।

          বিশ মিনিট পরেও বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। ভেবে রেখেছিলাম আজ কেইপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাবো। কিন্তু তা আর হলো না।

          এই ভিক্টোরিয়া ও আলফ্রেড ওয়াটার ফ্রন্ট তৈরি হবার পর থেকে এটাই এখন কেইপ টাউনের এক নম্বর দ্রষ্টব্য। পর্যটকরা এখানেই আসে বেশিরভাগ। শপিং এর জন্য এটা এখন পৃথিবীবিখ্যাত। চোখধাঁধানো দামী ব্যান্ডের দোকান সব। আমি অবশ্য পারতপক্ষে সেদিকে পা বাড়াই না। এখন বৃষ্টির কারণে কিছুক্ষণ উইন্ডো শপিং করলাম।

         



ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে গেলাম বইয়ের দোকান - এক্সক্লুসিভ বুকস। বিশাল আয়তনের বইয়ের দোকান। বইয়ের বড় দোকান দেখলে এবং তাতে ক্রেতার ভিড় দেখলে বেশ ভালো লাগে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে বই দেখলাম। বইয়ের দাম তুলনামূলকভাবে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বেশি। আফ্রিকা বিষয়ে দুটো বই কিনলাম সাড়ে পাঁচশো র‍্যান্ড দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ৫০ ডলার। এগুলো অনলাইনে কিনলে আরো কম দামে কেনা যাবে। কিন্তু দোকান থেকে বাছাই করে নিজের হাতে বই কেনার যে আনন্দ আছে তা অনলাইনে ঠিক পাওয়া যায় না।

          বৃষ্টি একটু কমেছে। ভিক্টোরিয়া ওয়ার্ফ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে চলে এলাম। এখানে ঢোকা যাক।

     টু ওশ্যান অ্যাকোয়ারিয়াম। আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগর মিশেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বদক্ষিণ বিন্দু কেইপ পয়েন্টে। কেইপ টাউনের অ্যাকুরিয়ামের নাম তাই দুই মহাসাগর অ্যাকোয়ারিয়াম।

          টিকেটঘরে ভিড় নেই মোটেও প্রবেশমূল্য একশ পঞ্চাশ র‍্যান্ড ট্যুরবাসের টিকেট দেখাতে পারলে ১০ র‍্যান্ড কম আমার পকেটে বাসের টিকেট ছিল দেখালাম টিকেটের পেছনে ছাপানো আছে কোথায় কোথায় মূল্য হ্রাস পাওয়া যাবে কাঁচি দিয়ে অ্যাকোরিয়ামের নামটা কেটে নিলো টিকেট থেকে

          গেটে টিকেটের বারকোড স্ক্যান করার পর কাচের ছোট্ট গেট খুলে গেল টিকেট চেক করছিলো একটা অল্পবয়সী আফ্রিকান মেয়ে। সে আমার হাতের পিঠে একটা রাবার স্ট্যাম্পের ছাপ বসিয়ে দিলো। আমার হাতের চামড়ায় স্ট্যাম্পের কোন চিহ্নই দেখা গেলো না। কালি নেই নাকি? চোখের সামনে হাত এনে দেখার চেষ্টা করছিলাম দেখে মেয়েটি হাসিমুখে বললো, এদিকে আসেন, দেখাই।

          গেটের পাশে একটা ইনফ্রা-রেড স্ক্যানার আছে। তার আলোতে আমার হাত নিয়ে যেতেই দেখা গেলো অ্যাকোয়ারিয়ামের ছাপ। মেয়েটি বললো, এটা দিয়ে তুমি আজকের মধ্যে যতবার খুশি এখানে ঢুকতে পারবে। ভালো ব্যবস্থা তো। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইচ্ছে হলে আবার এসে দেখা যাবে।

          এই অ্যাকোয়ারিয়াম চালু হয়েছে ১৯৯৫ সালের ১৩ নভেম্বর। পুরো বিল্ডিংটি দোতলা। নিচের তলা এবং দোতলা মিলিয়ে পাঁচ-ছয়টি গ্যালারি ও প্রদর্শনী কক্ষ। আফ্রিকান পেঙ্গুইন আছে এক জায়গায়। রুবেন আইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলের আদলে পাথর ও বালির কৃত্রিম সৈকত তৈরি করে পেঙ্গুইন ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের দেখে এসেছি সকালবেলা। এখন এদের দেখে বন্দী বন্দী বলে মনে হচ্ছে।

          ওশ্যান বাস্কেটে রাখা আছে অনেক সামুদ্রিক উদ্ভিদ যেগুলো পানির নিচে গাছের মতো লম্বা হতে থাকে। অনেক মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল এই ডুবো উদ্ভিদগুলো। আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের জলজ প্রাণীর আলাদা আলাদা প্রদর্শনী আছে।

          দক্ষিণ আফ্রিকার সর্ব দক্ষিণে যেখানে আটলান্টিক মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরের স্রোত এসে মিশেছে সেখানে যে প্রচন্ড স্রোত-তার নাম অ্যাগালহ্যাস (agalhas) কারেন্টসেখানে প্রচুর রঙিন মাছ পাওয়া যায় নানা জাতের প্রজাপতির মতো এক ধরনের মাছ আছে - যাদের নাম বাটারফ্লাই ফিশ আছে দেবতার মতো মাছ - অ্যাঞ্জেল ফিশ, আছে ডাক্তার মাছ - সার্জন ফিশ এগুলো সব ভারত মহাসাগরের উষ্ণ স্রোতে থাকে। বিকটদর্শন ঈল মাছ ভারত মহাসাগরের আরেক দ্রষ্টব্য। আটলান্টিক মহাসাগরের অংশে জেলিফিশ, অক্টোপাস, ঘোড়ামাছ, বিশাল মাকড়শার মতো কাঁকড়া।

 

সামুদ্রিক ঈল


আই অ্যান্ড জে ওশ্যান প্রদর্শনী মূলত ১৬ লক্ষ লিটার পানির কাচের ঘরে মহাসাগরের নমুনা রাখা হয়েছে। ছয় মিটার উঁচু, দশ মিটার লম্বা কাচের জানালায় হাঙর, কাছিম, সব একসাথে ভেসে বেড়াচ্ছে।

          এপর্যন্ত যতগুলো অ্যাকোরিয়াম দেখেছি সবগুলো প্রায় একই রকম। এই টু ওশ্যান অ্যাকোরিয়ামের বিজ্ঞাপণে বা প্রচারপত্রে যেভাবে প্রদর্শিত হয়েছে-সে তুলনায় ভেতরে ঢুকে কিছুটা আশাভঙ্গই হয়েছে বলা চলে। সিডনি বা মেলবোর্নের অ্যাকোয়ারিয়ামের সংগ্রহ ও প্রদর্শনীর মান এদের চেয়ে ভালো। তবে এখানে শিশু কিশোররা খুব মজা পাচ্ছে দেখতে পেলাম।

অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ অনেক ফর্সা। হাঁটতে ভালো লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে সমারসেট হাসপাতালের ওদিকে রঙ বেরঙের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম কিছুক্ষণ। এই অংশটা বেশ উঁচু। এখান থেকে কেইপ টাউন স্টেডিয়াম খুবই কাছে।

          হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সি পয়েন্টের দিকে। স্টেডিয়ামটি ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে নতুন বানানো হয়েছিলো। রাস্তাঘাটও এখনো নতুন এদিকে। টেবিল পর্বতের অনেকটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বিচ রোডে। সামনে আটলান্টিক মহাসাগর। বিচে একটুও বালি নেই। সামুদ্রিক পাথরে ভর্তি। সাগর পাড়ে এখন অনেক মানুষ হাঁটছে।

          হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম গ্রিন পয়েন্ট বাতিঘরের কাছে। ১৮২৪ সালে স্থাপিত হয়েছিল এই বাতিঘর। কাছেই একটা পার্ক। মানুষ তাদের কুকুরদের বেড়াতে নিয়ে এসেছে। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ দৌড়াচ্ছে। সূর্য আস্তে আস্তে পানির সমতলে নেমে আসছে। যতই পানির কাছে আসছে ততই রঙিন হচ্ছে। এই রঙিন হবার পেছনে যে বৈজ্ঞানিক রহস্য লুকিয়ে আছে - মানুষ তা ভালো করেই জানে। তবুও এই সূর্যাস্তের রঙ দেখতে ভালো লাগে মানুষের। এই মুহূর্ত প্রতিদিন দেখলেও পুরনো হয় না একটুও। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরে বসে রইলাম যতক্ষণ আকাশের আবির দেখা যায়

 



পর্ব ১৫

No comments:

Post a Comment

Latest Post

FLASH Radiotherapy: A New Possibility in Cancer Treatment

  Cancer is the disease before which humanity feels the most helpless. Every year, the number of cancer patients continues to rise at an ala...

Popular Posts