Friday 18 September 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪৮

 48

সকাল দশটা থেকে পরীক্ষা। বলা হয়েছিল ন’টার মধ্যে পৌঁছে যেতে। আমি ন’টার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছি নেভি কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিসে। এইচএসসি পরীক্ষায় ডিউটি করার জন্য পালাক্রমে আমাদের কলেজ থেকে কয়েকজনকে এই কলেজে আসতে হচ্ছে, আবার এই কলেজ থেকে কয়েকজন আমাদের কলেজে যাচ্ছেন। ভাইস-প্রিন্সিপাল আমাকে বসতে বলে পরীক্ষার খাতা গণনায় মন দিলেন। তাঁকে সাহায্য করছেন এই কলেজের আরো দুজন শিক্ষক। মনে হচ্ছে একটু বেশি আগে চলে এসেছি। সাড়ে ন’টার দিকে এলেও হতো।

নৌবাহিনী কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি হবে না। নেভি অফিসারদের ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগই আমাদের কলেজে পড়ে। আমাদের লেখাপড়ার মান নিশ্চয় এদের চেয়ে ভালো। নইলে নৌবাহিনীর নিজস্ব কলেজ ফেলে কেউ বিমান বাহিনীর কলেজে পড়তে যায়!

“মিস্টার প্রদীপ, আপনাকে আরো তিন দিন আসতে হবে। কোন্‌দিন কোন্‌দিন আসতে হবে – আজ পরীক্ষার পরে যাবার সময় একটু জেনে যাবেন।“

“ঠিক আছে স্যার।“

পরীক্ষা শুরু হবার পনেরো মিনিট আগে হল খুলে দিলেও চলে। এখানে প্রায় বিশ মিনিট আগে হল খুলে দেয়া হলো। পুরনো ধাঁচের একটি বিল্ডিং-এর দোতলার বেশ বড় একটি রুমে আমার ডিউটি। সাথে আছেন নেভি কলেজের আরেকজন শিক্ষক। মোটাসোটা মানুষ হাসিখুশি টাইপ হয় বলে শুনেছি। কিন্তু শোনা কথা যে সবসময় সত্যি হয় না তার প্রমাণ পেলাম। ইনি প্রচন্ড গম্ভীর। এই গাম্ভীর্য সবার জন্য প্রযোজ্য, নাকি সিলেকটিভ বুঝতে পারছি না। ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিস থেকে হল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় তাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাক্য যত ব্যয় হলো, বিনিময় ততো হলো না। অনেক উৎসাহ নিয়ে “আমার নাম প্রদীপ, আমি শাহীন কলেজে ফিজিক্স পড়াই” বলার পর আশা করেছিলাম তিনি তাঁর নাম বলবেন, সাবজেক্ট বলবেন। কিন্তু তাঁর গলা থেকে ‘ঘোঁৎ’ টাইপের একটা শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হলো না। ‘ঘোঁৎ’ নিশ্চয় তাঁর নাম নয়, কিন্তু আপাতত তিনি ‘ঘোঁৎ’ সাহেব।

কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। ঘন্টা বাজার পর প্রশ্ন হাতে পেয়েই ছেলেরা লিখতে শুরু করেছে। সিগনেচার ফর্মে সাইন নিতে নিতে অনেকক্ষণ চলে গেলো। ঘোঁৎ সাহেব চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছেন। আমি সিগনেচার ফর্মগুলি টেবিলে রেখে ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।‘ তিনি গম্ভীরভাবে মাথাটা ইষৎ কাৎ করে মৃদুস্বরে ‘ঘোঁৎ’ করলেন।

বেশ বড় বারান্দা। কোমর-সমান দেয়ালের উপর কোন গ্রিল নেই। চারদিক সুনশান। এই রুমটা বিল্ডিং-এর একপাশে। ছাত্রদের টয়লেট এদিকে। টয়লেটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকালাম। পাশেই বেশ প্রশস্ত নালা। চট্টগ্রামের নালায় সাধারণত উপচে পড়া ময়লা থাকে। কিন্তু এই নালার পানি ঘোলা হলেও কোন ময়লা ভেসে বেড়াচ্ছে না। টয়লেটে ঢুকলাম। টয়লেট পরিচ্ছন্ন, কিন্তু বাতাস ইউরিয়াসমৃদ্ধ। ইউরিনালের কয়েক ফুট উপরে ভেন্টিলেটারের খোপে চোখ আটকে গেল। একটা মোটা বইয়ের কোণাটুকু বের হয়ে আছে। হাত বাড়াতেই হাতে চলে এলো। উচ্চমাধ্যমিক রসায়ন প্রথম পত্র। টয়লেটে বই রাখার উদ্দেশ্য বোঝার জন্য খুব বেশি ঘিলু লাগে না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই টয়লেটের বিভিন্ন খোপ থেকে যতগুলি কেমিস্ট্রি বই বের হলো তা দিয়ে জলসা সিনেমার সামনের ওভারব্রিজে একটা দোকান দেয়া যায়। পরের কয়েক মিনিটে পাশের নালার পানিতে বেশ কয়েকবার ঝুপ ঝুপ শব্দ হলো। তারপর হাত ধুয়ে নিঃশব্দে রুমে ঢুকলাম। ঘোঁৎ সাহেব এখনো ঘাড় কাৎ করে চেয়ারেই বসে আছেন।

প্রথম ঘন্টা বাজতেই পেছন দিকের বেঞ্চ থেকে একজন হাত তুললো। কাছে যেতেই বললো, “স্যার, টয়লেটে যাবো।“

প্রথম ঘন্টার পর থেকে শেষ ঘন্টা বাজার পনের মিনিট আগপর্যন্ত টয়লেটে যাবার ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই নিষেধ করার প্রশ্নই উঠে না। ছেলেটা চোখেমুখে আনন্দের দীপ্তি নিয়ে গেলেও ফিরে এলো মুখ কালো করে। তারপর একে একে আরো কয়েকজন গেলো আর ফিরে এলো। অন্যদের বুঝতে বাকি রইলো না যে টয়লেটে গিয়ে আর কোন লাভ নেই। কিন্তু তারা সবাই আমার দিকে কঠিন চোখে তাকাতে শুরু করলো। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। পরীক্ষায় নকল করতে না দেবার ‘অপরাধে’ কত শিক্ষককে কে ছাত্রদের হাতে মার খেতে হয় পরীক্ষার সিজনে। এই কলেজে তেমন কিছু হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই অপরাধীদের বেপরোয়া করে তোলে। ডিফেন্সের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই কুপ্রভাব থেকে মুক্ত।

খাতা জমা দিতে ভাইস-প্রিন্সিপালের অফিসের দিকে যাবার সময় হঠাৎ ঘোঁৎ সাহেব বললেন, “টয়লেট সাফ করে আপনি ফার্স্ট ক্লাস কাজ করেছেন।“

আমি অবাক হয়ে গেলাম তাঁর কথায়। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে তাঁর সঙ্গে আছি। এই প্রথম একটি বাক্য তিনি বললেন। এবং তাতেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধ দুটোই প্রবল। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কীভাবে বুঝতে পারলেন?”

তিনি আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। নির্বিকারভাবে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর গলা থেকে শব্দ বের হলো – ঘোঁৎ ঘোঁৎ।

>>>>>>>>>>> 

আজিজুর রহমান স্যারের হাত থেকে বইটা হাতে নিয়ে আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী বলেন? এই দেড় ঘন্টার মধ্যেই আপনি এই বই শেষ করে ফেলেছেন?”

“হ্যাঁ। বইটা ভালো। সত্যেন সেন খুবই চমৎকার লেখেন।“

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম তাঁর দিকে। প্রায় তিনশ পৃষ্ঠার বই আলবেরুনি – গত এক সপ্তাহ ধরে আমার সঙ্গে যাতায়াত করছে। শনিবার ক্লাস এইট পর্যন্ত ছুটি থাকে। তাই আজিজুর রহমান স্যারের আজ ক্লাস ছিল না। তিনি আমার কাছ থেকে বইটা নিয়েছিলেন ফার্স্ট পিরিয়ড শুরুর আগে। আর এখন থার্ড পিরিয়ড শেষ করে রুমে ফিরতেই তিনি আমার ডেস্কের সামনে এসে বইটা এগিয়ে দিয়ে বললেন পড়া শেষ। এত দ্রুত কীভাবে পড়ে মানুষ? অবিশ্বাস্য। এক মিনিটে কমপক্ষে দুই পৃষ্ঠা পড়তে হলে তো জাস্ট চোখ বোলানো হবে। এত দ্রুত পড়লে কি খুঁটিনাটি সব মনে থাকবে? কিন্তু বই খুলে অনেক প্রশ্ন করে দেখলাম বইয়ের প্রতিটি শব্দ পড়েছেন তিনি, সমস্ত ঘটনার খুঁটিনাটি তাঁর মনে আছে। দ্রুত পড়ার এই আশ্চর্য ক্ষমতার কারণে আজিজুর রহমান স্যারকে কেমন যেন অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তাঁর সাথে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলো। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি অনেক বড়।

আমাদের টিচার্স রুমে অনেক বিষয় নিয়েই নিয়মিত চর্চা হয়। সাঈদ স্যার প্রায়ই জীবন সম্পর্কে অনেক দার্শনিক উপদেশ দেন। কিন্তু নিয়মিত জ্ঞানচর্চা বলতে কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে যে ধরনের আলোচনা হবার কথা - সেরকম আলোচনার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। আমাদের শিক্ষকদের সংখ্যা বাড়ছে আস্তে আস্তে। বায়োলজির নতুন স্যার এসেছেন – মোশাব্বের স্যার। ইংরেজির নতুন স্যার – ইন্তেখাব স্যার জয়েন করেছেন। আমার বন্ধু আবুল হোসেন খান কাফ্‌কো স্কুলে চলে গেছে। সে কীভাবে এত নিশ্চিন্ত ছিল তার চাকরির ব্যাপারে তা সে বলেনি। একদিন চুপচাপ চলে গেছে এখান থেকে। যাবার আগে সে যখন বললো, “আমাকে ভুলে যাইয়েন না” – সাঈদ স্যার বলেছিলেন, “মানুষ মানুষকে কখন মনে রাখে জানেন? আপনি যখন কোন মানুষকে খুব কষ্ট দেবেন, তখন সে আপনাকে কোনদিন ভুলবে না। যদি কষ্ট না দেন, তাহলে সে ভুলে যাবে।“ ভেবে দেখলাম – ব্যাপারটা আসলেই ঠিক। আনন্দের কথা আমাদের যতটুকু মনে থাকে, তার চেয়ে বেশি মনে থাকে দুঃখের কথা। মানুষের ভালো ব্যবহার আমাদের মনে থাকে না। কিন্তু কেউ খারাপ ব্যবহার করলে তা আমরা কিছুতেই ভুলি না।

“আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।“ – হাফিজ স্যার কথা বলেন খুব নিচুস্বরে। ফিরে তাকালাম তাঁর দিকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জানালায় মুখ বাড়িয়ে ইশারা করছেন বাইরে যাবার জন্য। নিশ্চয় এমন কোন কথা যা সবার সামনে বলতে চাচ্ছেন না। বাইরে বের হয়ে একটু সামনে নিয়ে গিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে কি আপনার কিছু হয়েছে?”

“কেন? আপনি কি কিছু শুনেছেন?”

“প্রিন্সিপাল স্যার বলছিলেন আপনার সম্পর্কে।“

“কী বলছিলেন?”

“বলছিলেন – পাগলরাও নিজের ভালোটা বোঝে। আপনি নাকি সেটাও বোঝেন না।“

“হা হা হা”

“আপনি হাসছেন? কী হয়েছে?”

“আগে বলেন, তিনি আপনাকে কেন আমার সম্পর্কে বলেছেন?”

“আমাকে ঢাকা পাঠাচ্ছেন ডিজি অফিসে। এমপিও-র কাজে।“

“যান। এবার আপনি যান। ঘুষ দিয়ে আসেন। টাকা দেখে নিয়ে যাবেন, যেন ছেঁড়া না থাকে। ওখানে ছেঁড়ানোট বদলে দিতে বলে।“

প্রিন্সিপাল স্যার খুবই ধুরন্ধর মানুষ। যাদেরকে একটু সহজ-সরল টাইপের বলে মনে করছেন, তাদেরকে নিজের দলে টানার চেষ্টা করছেন। ডিজি অফিস থেকে ফিরে এসে আমি তাঁকে সরাসরি বলেছি যে আমার হাত দিয়ে ঘুষ পাঠানোর ব্যাপারটা আমার ভালো লাগেনি। তিনি কিছুই বলেননি। এখন হাফিজ স্যারকে ধরেছেন। কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি চলছে। ভর্তি ফর্ম দেয়া হচ্ছে। ৬৫০ এর কম পেয়েছে এমন কাউকে ফর্ম দেয়া হচ্ছে না। কিছু কিছু অভিভাবক আছেন যাঁরা মনে করেন টাকা পয়সা দিলে যে কোন নিয়মই ভাঙা যায়। শোনা যাচ্ছে সেরকম অভিভাবকরা নাকি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে যোগাযোগ করছেন। এসব শুনে লজ্জা লাগে আমার। একজন মুক্তিযোদ্ধা কেন এরকম হবেন?

>>>>>>>>>> 

“নওশীন শারফুদ্দিন, তুমি কি শারমিন শারফুদ্দিনের বোন?”

টেবিলের উপর ক্লাসটেস্টের খাতাগুলি রেখে আমার দিকে তাকালো নওশীন। তাদের ক্লাস টেস্ট নিয়েছি আজ। ক্লাসটেস্টের খাতাগুলি অনেক মোটা মোটা। অতগুলি খাতা একা মৌসুমী রিজিয়ার পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। নওশীনও এসেছে মৌসুমীর সাথে বেশ কিছু খাতা নিয়ে।

“জ্বি স্যার। শারমিন শারফুদ্দিন নওশীন শারফুদ্দিনের বোন। কিন্তু স্যার নওশীন শারফুদ্দিন নিজের পরিচয়ে পরিচিত।“

নওশীনের পাশে দাঁড়িয়ে মৌসুমী চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে নওশীনের মুখের দিকে। আমি নওশীনের আত্মবিশ্বাস আর শব্দচয়নে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আসলেই তো, তার বোনের পরিচয়ে তাকে চিনবো কেন?

“অবশ্যই। তোমাকে সবাই তোমার নিজের পরিচয়েই চিনবে নওশীন। তুমি কার কে সেটা আসবে পরে। ভেরি গুড।“

মৌসুমী আর নওশীন বের হয়ে গেল। বারান্দায় তাদের আরো দুজন বন্ধু ক্রিস্টিন আর সাদিয়া অপেক্ষা করছিলো তাদের জন্য। চারজন এক সাথে প্রায় দৌড়ে চলে গেল ক্লাসের দিকে।

এবার ক্লাস ফাইভের ব্যাচটা তুখোড়। বিশেষ করে প্রথম মেয়াদী পরীক্ষার পর যখন দুই সেকশানের সবচেয়ে ভালোগুলিকে এক সেকশানে নিয়ে আসা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য, তখন তাদের ক্লাস নিতে গিয়ে আমি সত্যি অবাক হয়ে যাই। এদের মেধা আর নিষ্ঠা দুটোই প্রচুর পরিমাণে আছে। অংক করাতে গিয়ে মনে হয় এরা সবাই একশ’র মধ্যে একশ’ পাবে। তাদের ক্লাস টেস্টের খাতা দেখতে আমার খুব একটা সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। প্রায় সবার অংকই নির্ভুল।

“স্যার, আপনাকে ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকছেন, আর্জেন্ট।“ – পিয়ন ইদ্রিস এসে খবর দিলেন।

ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডেকেছেন মানেই হলো জরুরি কিছু। সেখানে আর্জেন্ট – মানে কী সাংঘাতিক বিষয় অপেক্ষা করছে কে জানে। এর আগে একবার আমাকে জরুরি ভিত্তিতে ক্লাস থেকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তার দু’দিন আগে বিজ্ঞানমেলা হয়েছিল নেভি কলেজে। আমাদের স্কুলের ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে গিয়েছিল। কিছু পুরষ্কারও পেয়েছিল। কিন্তু তাতে কতৃপক্ষের মন ভরেনি। একজন সহকর্মী ভাইস-প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, “প্রদীপ যদি একটু সিরিয়াস হতো তাহলে আমরা আরো অনেক ভালো করতে পারতাম।“ সেদিন আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে এনে সিরিয়াস বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল সেই সহকর্মীর সামনে। বলাবাহুল্য তাতে আমার শ্রদ্ধাভাজন সহকর্মী খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তারপর থেকে ভাইস-প্রিন্সিপাল ডাকছেন শুনলেই আমার সিরিয়াসলি সিরিয়াসনেস বেড়ে যায়।

“প্রদীপবাবু, এখন তো আপনার কোন ক্লাস নেই।“ – ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কন্ঠ আজ আশ্চর্যরকমের মোলায়েম।

“না ম্যাডাম। কেন?”

“একজন অফিসার আপনার সাথে একটু দেখা করতে চান। মোস্তাফিজ সাহেব। আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি বলেছি আপনি ফ্রি থাকলে যাবেন। তিনি গাড়ি পাঠাচ্ছেন।“

“ওকে ম্যাডাম।“

“ইদ্রিস, নিচে দেখো, প্রদীপ স্যারের জন্য গাড়ি এলে স্যারকে খবর দিও।“

হঠাৎ এরকম মোলায়েমত্ব অস্বাভাবিক লাগছে। রুম থেকে বের হয়ে এলাম। প্রায় দৌঁড়ে প্রিন্সিপাল স্যারের রুম পার হবার সময় দেখলাম রুম বন্ধ। প্রিন্সিপাল স্যারকে ইদানীং আমি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে প্রিন্সিপাল স্যারের বিশেষ অনুগ্রহপ্রাপ্ত কেউ নেই তা আমি হলপ করে বলতে পারবো না।

সিঁড়ির কাছে যেতে না যেতেই দেখলাম ইদ্রিস ভাই ছুটে আসছেন।

“আপনার জন্য গাড়ি এসেছে স্যার।“

বিমানবাহিনীর একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে গাড়িবারান্দায়। উর্দিপরা ড্রাইভার নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি আমাকে চেনেন না। কিন্তু ইদ্রিস ভাইয়ের কথা তিনি শুনেছেন। আমি কাছে যেতেই সামরিক কায়দায় স্যালুট দিলেন।

জিপ চলছে কলেজের পুরনো বিল্ডিং-এর দিকে। অফিসারের গাড়িতে বসে চেনা পরিবেশকেও অচেনা লাগতে শুরু করেছে। পুরনো কলেজ বিল্ডিং পার হয়ে দুপাশে বিশালাকৃতির শিরিষ গাছের নিচে দিয়ে গিয়ে গাড়ি বামে ঘুরে একটা দোতলা বিল্ডিং-এর সামনে থামলো। গাড়ি থেকে নামতেই একজন লম্বা সুপুরুষ অফিসার এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। “আমি মুস্তাফিজ। সরি আপনাকে কষ্ট দিলাম। আমি নিজেই যেতাম। কিন্তু কলেজে বসে কথা বলার চেয়ে আমার অফিসে বসে অনেক নিরিবিলিতে কথা বলতে পারবো। তাই আপনাকে কষ্ট দিলাম।“

অফিসার এত বেশি ভদ্রতা দেখাচ্ছেন যে আমার কেমন যেন সংকোচ লাগছে। আমাকে কীজন্য ডেকেছেন এখনো জানি না।

তাঁর অফিসটা বেশ বড়, গোছানো সুন্দর। বসার একটু পরেই চা আর সিঙাড়া নিয়ে এলেন একজন। সম্ভবত আগেই বলে রেখেছিলেন।

“আমি কিন্তু এখনো জানি না আমাকে কেন আসতে বলেছেন।“

“আপনার সাথে ফিজিক্স নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই। আমার ফিজিক্স সাবজেক্টটা খুবই প্রিয়। একাডেমিক ব্যাপারটাতে কন্টিনিউটি না থাকলে অনেক সময় অনেক সায়েন্টিফিক এডভান্সমেন্টের খবর পাওয়া যায় না।“

এরপর প্রায় এক ঘন্টা সময় কীভাবে কেটে গেল টেরই পেলাম না। আমরা ফিজিক্স নিয়ে কথা বললাম, স্টিফেন হকিং-এর বই ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম নিয়ে কথা বললাম, থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে আমার মাস্টার্সের কাজ নিয়ে কথা বললাম, আমার সুপারভাইজার প্রামাণিক স্যারের প্রসঙ্গেও কথা বললাম। শাহীন কলেজে আমার এই প্রায় চার বছরের কর্মজীবনে উচ্চতর ফিজিক্স গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করার এরকম সুযোগ আর পাইনি। সুযোগ পেলে এরকম আলোচনা আরো হবে এই আশ্বাস নিয়ে আমাকে আবার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন তিনি।

গাড়ি থেকে এক লাফে কলেজের সিঁড়িতে উঠে প্রায় লাফাতে লাফাতে দোতলায় উঠতেই হুমায়রা ম্যাডামের সাথে দেখা হয়ে গেল।

“অফিসারের গাড়ি করে এলেন দেখলাম।“

“মোস্তাফিজ সাহেব ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।“

“তাই? উনার মেয়েরা তো আপনার ক্লাসে পড়ে।“

“উনার মেয়ে?”

“চেনেন না? মুশতারি রিজিয়া, মৌসুমী রিজিয়া। একজন ইলেভেনে, একজন ফাইভে।“

“হ্যাঁ চিনি তো।“

হুমায়রা ম্যাডাম চলে গেলেন প্রিন্সিপালের রুমের দিকে। আমি আমাদের রুমে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম - প্রায় ঘন্টাখানেক কথা বললাম মুস্তাফিজ সাহেবের সাথে। অথচ একবারও তিনি বললেন না যে তাঁর দুটি কন্যা আমার ক্লাসে পড়ে। মেয়েরা তাদের নিজেদের যোগ্যতাতেই বড় হবে এই নীতিতে বিশ্বাস করেন বলেই তিনি বলেননি, যেন ব্যক্তিগত পরিচয়ের পক্ষপাতিত্বের ছায়াটুকুও তাদের স্পর্শ করতে না পারে। আহা, সবাই যদি এমন হতো।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts