Friday 7 August 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৪২

42


‘গাড়িবারান্দা’ শব্দটি নীহাররঞ্জন গুপ্ত কিংবা ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রায়ই দেখা যায়। বড়লোকদের বাড়ির গাড়িবারান্দায় গাড়ি এসে থামে। তারপর নায়ক কিংবা নায়িকা গাড়ি থেকে অভিজাত কায়দায় নামে। অনেক সময় দেখা যায় নায়িকা ধনী হলে নায়ক হয় হতদরিদ্র, অথবা ধনী নায়কের দরিদ্র নায়িকা ইত্যাদি। এসব গল্প পড়ার সময় গাড়িবারান্দার যে চিত্র মাথার ভেতর ফুটে উঠে – তার সাথে এখন যে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি তার কোন মিল নেই। শাহীন কলেজের ঝকঝকে নতুন ভবনের গাড়িবারান্দায় কোন গাড়ি নেই। কিন্তু তার বদলে একটা পুরনো মলিন রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। এই রিকশাটি কি কলেজের জন্য কেনা হয়েছে, নাকি ভাড়া নেয়া হয়েছে – তা জানি না। এই রিকশাটি এখন নতুন ও পুরনো ভবন পারাপারের অফিসিয়াল যানবাহন।

নতুন ভবনে সব ক্লাসের জায়গা হয়নি এখনো। পুরনো ভবনে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত রয়ে গেছে। সিক্স থেকে টুয়েল্ভ চলে এসেছে এই বিল্ডিং-এ। যাদের সিক্সের নিচে ক্লাস নিতে হয় না, তাদের এই রিকশায় না চড়লেও চলে। কিন্তু আমার রুটিন অনুযায়ী সপ্তাহে পাঁচ দিন যাওয়া-আসা করতে হবে পুরনো বিল্ডিং-এ। সুতরাং এই রিকশা এবং তার চালকের সাথে আমার একটা ভালো বোঝাপড়া হওয়া উচিত। কিন্তু চালককে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

রিকশার গায়ের রঙিন চিত্রকর্মগুলির রঙ জ্বলে গেছে। পেছনে আঁকা দুইটি নারীমুখের মাঝখানে একটি পুরুষের মুখ। মনে হচ্ছে কোন সিনেমার পোস্টার দেখে আঁকা হয়েছে মোটা তুলি দিয়ে। নারীমুখ দুটি শাবানা ববিতা শাবনুর কিংবা মৌসুমী যে কারো হতে পারে। পুরুষের মুখটিকে মনে হচ্ছে রাজ্জাক আর ফারুকের সংকর। তাদের মাথার উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আল্লাহ ভরসা’।

“স্যার কি পুরান বিল্ডিং-এ যাবেন?” – আমাকে বারান্দায় সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিয়ন মিজান প্রশ্ন করলেন।

“হ্যাঁ। রিকশাওয়ালা কোথায় গেছে জানেন?”

“আমি খুঁজে দেখছি স্যার। মনে হয় উপরে – ভাইস প্রিন্সিপাল ম্যাডামের রুমের সামনে।“

শিরিন ম্যাডাম ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল। কিন্তু সবাই তাঁকে এখনো ভাইস-প্রিন্সিপাল ম্যাডামই বলেন।

অনেক দিন পর কলেজে আসায় এখনো সবকিছু নতুন নতুন লাগছে। মেডিকেল লিভের দরখাস্ত জমা দিয়েছিলাম গতকাল। আজ একাউন্ট্যান্ট কাদের সাহেব বললেন, “স্যার এক মাসের লিভ অ্যাপ্রুভ হয়েছে, বাকি সাতদিন উইথ-আউট পে হবে।“

“ঠিক আছে। কলেজের যা নিয়ম – তাই তো হবে।“

কাদের সাহেব দক্ষ হিসাবরক্ষক। আবার আমাদের কীভাবে উপকার করা যায় সেদিকেও খেয়াল রাখেন। তিনি বললেন, “আপনি স্যার এই সাতদিনের চিকিৎসা-ছুটি মঞ্জুর করার জন্য একটা দরখাস্ত দেন। শিরিন ম্যাডাম ফরোয়ার্ড করে দিলে ও-সি-এডমিন এপ্রুভ করে দেবেন।

আমি কাদের সাহেবের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম। তিনি বললেন, আমি জানতাম স্যার, আপনি দরখাস্ত করবেন না। তবুও একটু বলে দেখলাম। সাত দিনের সি-এল নিতে পারেন তো স্যার। আপনার বেতন কেটে বিল করতে আমার ভালো লাগছে না স্যার।“

“আমার বেতন কেটে বিল আপনি আগেও করেছেন। হরতালের সময় অনেক বেতন কেটেছেন। আপনি আপনার কাজ করেন, আমার কোন সমস্যা নেই।“

নতুন বিল্ডিং-এ এসে অফিস স্টাফদের জন্য আলাদা বড় রুম হয়েছে প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের রুমের মাঝখানে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাম দিকে গেলে প্রিন্সিপালের অফিস, তার পাশে প্রশাসনিক অফিস – কাদের সাহেব, নূর মোহাম্মদ সাহেব, নুরুদ্দিন সাহেব, গাউস সাহেব সবার ডেস্ক এই রুমে। তার পাশের রুমে দুই ভাইস-প্রিন্সিপাল। উপাধ্যক্ষ {প্রশাসন) নাসির স্যার এই রুমে বসেন। আর শিরিন ম্যাডাম প্রিন্সিপালের ভারপ্রাপ্ত হয়ে প্রিন্সিপালের রুমে বসেন।

সিঁড়ির ডান দিকে বারান্দার শেষ প্রান্তের বিশাল রুমে ম্যাডামদের সবার বসার জায়গা। আমাদের বসার জায়গা হয়েছে নিচের তলায়। দোতলায় ভাইস-প্রিন্সিপাল ও অফিস স্টাফদের রুমের ঠিক নিচে। রুমে আলো-বাতাস প্রচুর। বারান্দার একপ্রান্তে হওয়াতে শিক্ষার্থীরা দরকার না হলে আমাদের রুমের সামনে দাঁড়ায় না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে – পুরনো বিল্ডিং-এ আমাদের জন্য আলাদা বাথরুম ছিল। এখানে আমাদের জন্য আলাদা বাথরুম নেই। আমাদের রুমের সামনে বাথরুম আছে। ছাত্রদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। ওটাই ব্যবহার করতে হচ্ছে আমাদের। তাতে মাঝে মাঝে অপ্রস্তুত হতে হয়।

“স্যার কি যাইবেন ঐ বিল্ডিং-এ?”

রিকশাওয়ালাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়াবহ রকমের অপুষ্টিতে ভুগছে। কাঠির মত হাত-পা। বয়স যাই হোক শরীরের গঠন দেখে ২০-২১ এর বেশি হবে বলে মনে হচ্ছে না। পরনে হাফশার্ট আর লুঙ্গি। এই বিল্ডিং-এর ঝকঝকে পরিবেশের সাথে মলিন রিকশা এবং মলিনতর রিকশাওয়ালা – কোনটাকেই মানাচ্ছে না।

“যাবো বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি। চলেন।“

রিকশায় উঠে বসলাম। ওই বিল্ডিং-এ আমার ক্লাস আছে ক্লাস ফাইভের দুই সেকশানে দুটো – পর পর। থার্ড ও ফোর্থ পিরিয়ড।

রিকশাওয়ালা রিকশাটা একটু পেছনে নিয়ে সিটে উঠে বসলো। প্যাডেল মারার আগেই শুনতে পেলাম নাহার ম্যাডামের গলা – “এই ইসে, থামো থামো, আমিও যাবো।“

সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নিচে নামার সময়েই তিনি ডাক দিয়েছেন। বেশ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন তিনি রিকশার কাছে। তিনি রিকশায় উঠার আগেই আবার ডাক – “নাহার আপা, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমিও যাবো।“

দেখলাম পূর্ণিমা ম্যাডাম ছুটে আসছেন হাতে একগাদা খাতা নিয়ে। এখন কী উপায়? তিন জন তো এক রিকশায় যাওয়া যাবে না। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস হলে অন্য কথা ছিল। অবশ্য এই তালপাতার সেপাই রিকশাওয়ালার পক্ষে তিনজনকে নিয়ে রিকশা টানা কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি রিকশা থেকে নেমে গেলাম। পূর্ণিমা ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন, “প্রকু, আপনিও কি ঐ বিল্ডিং-এ যাচ্ছেন? ক্লাস আছে?”

“হ্যাঁ, থার্ড আর ফোর্থ পিরিয়ড।“

“আমারও থার্ড পিরিয়ড। আমরা গিয়েই রিকশা পাঠিয়ে দিচ্ছি। শাহ্‌ আলম – চলো।“

থার্ড পিরিয়ড শুরু হবার আর মাত্র পনেরো মিনিট আছে। সেকেন্ড পিরিয়ড আজ অফ ছিল। তাই এতক্ষণ অপেক্ষা করা গেছে। আগামীকাল এখানে সেকেন্ড পিরিয়ড করে ঐ বিল্ডিং-এ গিয়ে থার্ড আর ফোর্থ পিরিয়ড করতে হবে। রিকশার জন্য যদি দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাহলে কীভাবে করবো জানি না। শাহ-আলমের পক্ষে এই পনের মিনিটের মধ্যে ঐ বিল্ডিং-এ দু’বার আসা-যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

রুটিন করার সময় ম্যানেজমেন্ট এই যাতায়াত সমস্যাটি ভেবে দেখেছেন বলে মনে হয় না। পারতপক্ষে আমি ক্লাসে দেরি করে ঢোকার পক্ষপাতী নই। হেঁটেই যেতে হবে। এক কিলোমিটার পথ – দশ মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে।

চৈত্র মাসের সূর্য এই সাড়ে ন’টাতেই তেতে উঠেছে। রিক্রুটরা তাদের ট্রেনিং শেষ করে ফ্যালকন আর ঈগল হাউজে ঢুকে গেছে একটু আগে। মাঠ এখন খালি। ঠা ঠা রোদ্দুরে চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। কলেজের পুরনো ভবনের গেটের সামনে শাহ-আলমের রিকশা থেমে আছে। এসেই রিকশা পাঠিয়ে দেয়ার কথা ছিল। শাহ-আলমকে হয়তো বলা হয়েছিল ফিরে যেতে। কিন্তু রিকশা ফেলে শাহ-আলমই চলে গেছে কোথাও। কর্তব্যবোধের ব্যাপারটা মানুষের ভেতরে কীভাবে জাগানো যায়?

মিনিট পাঁচেক হাতে আছে। টিচার্স রুমে এসে দেখি বেশ কিছু নতুন মুখ। কৃষিবিজ্ঞানের মোরশেদ স্যার চলে গেছেন। তাঁর শুটকি মাছের ঘুষ বেশ কাজ দিয়েছে মনে হচ্ছে। তিনি নাকি সরকারি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। মোরশেদ স্যারের জায়গায় এসেছেন আবুল কাশেম স্যার। আরেকজন কাশেম স্যার আছেন – আমাদের দাদাভাই। তাই নতুন কাশেম স্যারের নাম হয়েছে কৃষি-কাশেম। কেমিস্ট্রির ডেমোনেস্ট্রেটর পদে যোগ দিয়েছেন আজিজুর রহমান স্যার। তাঁকে বেশিরভাগ ক্লাস দেয়া হয়েছে স্কুলের নিচু ক্লাসের। আজিজুর রহমান স্যারের পোশাক পরিচ্ছদ পুরোদস্তুর তাবলিগি।

আমার ক্লাস শেষ হবার পর ফিরে আসার জন্য রিকশার দেখা আর পাই না। এই বিল্ডিং থেকে নতুন বিল্ডিং-এ টেলিফোন করার ব্যবস্থাও কি নেই? থাকা তো উচিত। ক্লাস চলাকালীন এই বিল্ডিং-এর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন হোসনে আরা ম্যাডাম। টিফিন আওয়ারে দেখলাম তিনি একে ওকে টুকটাক ধমকও দিচ্ছেন। টিচার্স রুমে পরিচয় হলো পরিসংখ্যানের সিরাজ স্যারের সাথে। সিরাজ স্যার পরিসংখ্যানের অনার্স মাস্টার্স করে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। খুবই হাসিখুশি মানুষ। তাঁর মুখে চট্টগ্রামের ভাষা শুনে আমি বুঝতেই পারিনি যে তিনি অরিজিনালি চট্টগ্রামের নন। সাধারণত অনেক বছর চট্টগ্রামে থাকার পরেও অনেকে চট্টগ্রামের ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহী হন না। কিন্তু সিরাজ সাহেব ব্যতিক্রমী। তাঁর আরো একটি ব্যাপার জেনে ভালো লাগলো। তিনিও প্রচুর সিনেমা দেখেন। দিলীপ বিশ্বাসের আসামী সিনেমার গান সংলাপ সব হুবহু বলতে পারেন। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ সিনেমা সম্পর্কিত কথাবার্তা বললাম।

টিফিন আওয়ারের পরে পরপর দুটো ক্লাস আছে ফার্স্ট ইয়ারের সাথে। শাহ-আলমের দেখা নেই। গেটে দাঁড়িয়ে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ছুটোছুটি দেখছিলাম। এটাকে এখন পরিপূর্ণ প্রাইমারি স্কুল মনে হচ্ছে। ক্লাস ফাইভের ছেলে-মেয়েরা নিজেদেরকে সবার সিনিয়র ভেবে আনন্দ পাচ্ছে। নতুন বিল্ডিং-এ যাবার সাথে সাথেই এই বিল্ডিং-এ নিজেকে কেমন যেন অতিথি বলে মনে হচ্ছে। টিচার্স রুমে সবাই টিফিন খাচ্ছেন। আমার টিফিনের ব্যবস্থা নতুন বিল্ডিং-এ। জন্ডিজ থেকে সেরে ওঠার পর আপাতত বাইরের তৈলাক্ত মশলাদার টোটাল ফুড – সিঙ্গারা খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে।

অবশেষে শাহ-আলমের রিকশার দেখা পাওয়া গেল। নাসির স্যারকে নিয়ে এসেছে। এখন এস-এস-সি পরীক্ষা চলছে। এই বিল্ডিং-এর সাথে লাগানো দোতলা অংশে পরীক্ষা দিচ্ছে আমাদের পরীক্ষার্থীরা। আমাদের বিতার্কিক নাজমুল এবার পরীক্ষা দিচ্ছে। তত্ত্বীয় পরীক্ষার মাঝখানেই তাকে বিতর্ক করতে যেতে হবে। পরীক্ষার পাশাপাশি বিতর্কের প্রস্তুতিও নিতে হচ্ছে তাকে।

শাহ-আলমের রিকশায় ফিরে এলাম নতুন ভবনের গাড়িবারান্দা তথা রিকশাবারান্দায়। টিফিন আওয়ার শেষ হতে এখনো মিনিট দশেক বাকি। রিকশা থেকেই দেখলাম বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ডাস্ট গ্যাং-এর চার লিডার। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে একটু পরেই তারা কোন একটা অভিযানে যাবে। ‘ডাস্ট’ সম্পর্কে আমি প্রথম শুনি সুব্রত আর আবদুল আলীম লিটনের কাছে। তারা অনেকটা অভিযোগের সুরে বলেছিল ডাস্ট খুব ঝামেলা করছে তাদের। আমি ভেবেছিলাম ডাস্ট মানে ধুলার কথা বলছে তারা। অনেকটা ধমক দিয়ে বলেছিলাম, এখানে ঝামেলা করার মত ডাস্ট কোথায় পেলে তোমরা? শাহীন কলেজ অনেক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন ।

 “এই ডাস্ট ডি ইউ এস টি নয়, ডি এ এস টি।“

“ডি এ এস টি – মানে কী?”

“ওরা চারজন – দিঠি, অ্যালেন, শিমু, টুম্পা।“

“দিঠি, শিমু, টুম্পা – রেহনুমা, ফেরদৌসী, পার্সা। কিন্তু অ্যালেন কে?”

“কানিজ নাইমা”

“তোমাদের কী ঝামেলা করছে তারা?”

“প্রত্যক্ষ ঝামেলা না, তবে পরোক্ষ ঝামেলা।“

“আমাকে কী করতে বলো?”

“কিছু না স্যার। এমনি জানিয়ে রাখলাম।“

“ওদেরকে কি বলবো যে তোমরা তাদের ভয় পাচ্ছো?”

“না স্যার। ভয় পাচ্ছি বলার দরকার নেই।“

এই চারজন যে একটা শক্ত গ্রুপ তৈরি করেছে তা বোঝা যাচ্ছে। কলেজে এই চারজনকে সবসময় এক সাথে দেখা যায়। এখনো চারজন এক সাথেই দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। টুম্পা পকেট থেকে কিছু একটা বের করে মুখে দিলো।

আমাকে রিকশা থেকে নামতে দেখে তারা চারজন একসাথে সরে গেলো এক পাশে। আমি আমার ডেস্কে এসে বসতে না বসতেই “স্যার, ভেতরে আসবো?”

তাকিয়ে দেখলাম শিমু তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানালার ওপাশে। আমি নিয়ম করে দিয়েছি আমার কাছে যারা আসবে তারা কেউই রুমে ঢুকবে না। জানালা দিয়েই কথাবার্তা বলবে যা বলার। দেখলাম ডাস্টের বাকি তিন জন দাঁড়িয়ে আছে শিমুর পেছনে। টুম্পা এখনো পকেট থেকেই খাচ্ছে।

“তুমি পকেট থেকে কী খাচ্ছো এভাবে?”

“টিফিন খাচ্ছি স্যার। পকেটে রাখি। তাতে হাত ফ্রি থাকে।“– টুম্পার নির্বিকার উত্তর।

টুম্পা টিফিনের সময় বাটারবান কিনে জামার পকেটে রাখে। তারপর সেখান থেকে হাত দিয়ে ছিড়ে ছিড়ে খায়। এভাবে বাটারবান খেতে আমি আর কাউকে দেখিনি।

“স্যার, একটু ভেতরে আসি?” – শিমু আবার প্রশ্ন করলো।

“ভেতরে আসতে হবে না। কী বলবে এখান থেকে বলো।“

“একটু সালাম করতাম স্যার।“

“সালাম করতে হবে না। আমি এমনিতেই খুব খুশি হয়েছি। অন্য স্যারদের সালাম করো।“

“সবাইকে করেছি স্যার, আপনি বাকি আছেন।“

“আমাকে কখনোই সালাম করতে হবে না। তোমাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা সবসময় থাকবে।“

দেখলাম তাদের পেছনে সুব্রত আর লিটনও উঁকি মারছে। এরা সবাই এবার জুনিয়র বৃত্তি পেয়েছে। কখন যে এরা ক্লাস সেভেন থেকে টুপ করে ক্লাস নাইনে উঠে গেল! শাহীন কলেজে আমার দু’বছরের বেশি সময় চলে গেলো এর মধ্যেই!

>>>>>>>>>>>>>>> 

১৯৯৫ সালের টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হলো ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৪ সালের চ্যাম্পিয়ন হবার কারণে আমাদেরকে আর বাছাই-পর্বে বিতর্ক করতে হলো না। ফার্স্ট রাউন্ডেও যেতে হলো না। সরাসরি সেকেন্ড রাউন্ডে বিতর্ক করার সুযোগ পেলো শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম। আমাদের প্রথম বিতর্ক প্রতিযোগিতা ভিকারুননিসা নুন স্কুলের সাথে। আমাদের চ্যাম্পিয়ন টিমের নাজমুলই শুধু আছে। সেও পরীক্ষা দিচ্ছে এবার। প্রিন্সিপাল মজিদ স্যারও নেই। চ্যাম্পিয়ন হবার পর যতটুকু মোমেন্টাম তৈরি হয়েছে সেই উৎসাহে ভর করেই আমাদের প্রস্তুতি। নতুন দল গঠন করা হলো। প্রথম বক্তা ক্লাস নাইনের রেহনুমা নাসিম, দ্বিতীয় বক্তা ক্লাস টেনের আরজুম সায়রা বানু, আর দলনেতা সৈয়দ নাজমুল কবীর। অতিরিক্ত চতুর্থ বক্তা হিসেবে নেয়া হলো সুব্রত দাসকে। বেশ শক্ত একটা দল তৈরি হলো। আমাদের বিতর্কের বিষয় দেয়া হয়েছে, “গৃহ নয়, শিক্ষাঙ্গনই চরিত্র গঠনের সূতিকাগার”। আমরা বলবো বিপক্ষে। বিতর্কের বিষয়বস্তু অনেকটাই আমাদের পক্ষে। প্রচুর মনোবিজ্ঞান এবং শিক্ষা-সম্পর্কিত বইপত্র ঘেঁটে স্ক্রিপ্ট তৈরি করলেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম। প্রচুর অনুশীলন করানো হলো। সুব্রতকে তিনটা স্ক্রিপ্টই মুখস্থ করতে হলো। দরকার হলে যে কারো প্রক্সি দেবে সে।

এয়ারফোর্স অফিসার্স মেসে আমাদের আসা-যাওয়া অনেকটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে এতদিনে। পুরো টিম নিয়ে আমরা হাজির হলাম ঢাকায় রেকর্ডিং-এর আগের দিন। লাঞ্চের পর একটু বিশ্রাম করে সন্ধ্যায় আবার অনুশীলন করার কথা। সুব্রত তিনটা স্ক্রিপ্ট নিয়েই রেডি। এর মধ্যে সে বেশ কিছু যুক্তিও রেডি করে রেখেছে – যা পক্ষের বক্তারা বলতে পারে। এমন সময় দরজায় টোকার শব্দ। সুব্রত দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিল।

“কেমন আছো সুব্রত?’ – বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন একজন তরুণী। অপরিচিতের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “প্রদীপদা ভালো আছেন?”

আমার মানুষের নাম মনে থাকে না, কিন্তু চেহারা মনে থাকে। এই তরুণীকে আমি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু তিনি আমাকে কীভাবে চিনলেন? আমি যে তাঁকে চিনতে পারছি না সেটা তিনি ঠিকই বুঝেছেন, কিন্তু মনে হচ্ছে তাতে তাঁর বিন্দুমাত্র কিছু যায় আসে না। তাঁর কথাবার্তা কিংবা আচরণে তিলমাত্র জড়তা নেই। তিনি ডাক দিলেন – দিঠি, রাকা। রিফাৎ আরা ম্যাডামের বড় মেয়ে রাকাও আমাদের সাথে এসেছে আজ। তার ছোটবোন টিভিতে বিতর্ক করবে – সেই ঘটনা সরাসরি দেখার আলাদা একটা আনন্দ আছে।

“মলি এসেছিস? এখানে চলে আয়।“ – রিফাৎ আরা ম্যাডামের গলা শোনা গেল।

“আসছি।“ – বলে ম্যাডামের রুমে ঢুকলেন মলি।

আমি সুব্রতকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে?’

সুব্রত ততোধিক ফিসফিস করে জবাব দিলো, ‘ইনি মলি।‘

এটুকু তথ্য মনে হয় আমি নিজেও এতক্ষণে জোগাড় করতে পেরেছি।

একটু পরেই বুঝতে পারলাম মলি কে। রিফাৎ আরা ম্যাডামের যে এত প্রাণবন্ত একটি ছোটবোন আছে সেই তথ্য আমি জানতামই না।

বাবুভাই – মলির স্বামী- এলেন একটু পর। ইনিও খুব চমৎকার হাসিখুশি মানুষ। প্রথম পরিচয়েই যে কাউকে আপন করে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে বাবু-মলির।

অল্প কিছুক্ষণ গল্প করলাম আমরা। অথচ মনে হলো সন্ধ্যাটা কেমন আনন্দময় হয়ে উঠলো। তারপর রাকাকে নিয়ে চলে গেলেন তাঁরা।

পরদিন বিতর্কে আমাদের বক্তাদের যুক্তি ও উপস্থাপনার কাছে তেমন শক্ত কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলো না। বিতর্কের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডক্টর হামিদা আক্তার বেগম। পাঁচজন বিচারকের একজন ছিলেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। গৃহ নয় শিক্ষাঙ্গনই চরিত্র গঠনের সূতিকাগার – এর বিপক্ষে আমাদের পক্ষের যুক্তিগুলো ছিল অখন্ডনীয়। যেমন রেহনুমা যুক্তি দিলো – শুধু শিক্ষাঙ্গন যদি চরিত্র গঠন করে তাহলে শুধু শিক্ষিতরাই চরিত্রবান। তাহলে অশিক্ষিতরা কি সবাই চরিত্রহীন? আমাদের বক্তারা বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থার কথা বললো, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কথা বললো, মনোবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে চরিত্র গঠন কোথায় হয় তা বললো, প্রচুর তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন করলো। আর সবশেষে নাজমুল যখন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ হামিদা আলীর উদ্ধ্বৃতি দিলো – আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নতুন কোন দিকনির্দেশনা তো দিতে পারছেই না বরং যা কিছু ভালো তাও নষ্ট করে দিচ্ছে – তখন ভিকারুননিসার বিতার্কিকদের আর কিছুই করার রইলো না। শাহীন কলেজ জিতে গেলো। নাজমুল শ্রেষ্ঠ বক্তা হলো।

এরপর আমরা সবাই মিলে মলিদের বাসায় গেলাম। অনেক গল্প হলো, অনেক খাওয়া-দাওয়া হলো। জয়ের আনন্দ বেড়ে গেল বহুগুণ।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts