Monday 31 August 2020

ম্যান্ডেলার দেশে - পর্ব ৩

 


কেইপ টাউনে স্বাগতম

 

কেইপ টাউন এয়ারপোর্ট টার্মিনাল জোহানেসবার্গের চেয়ে কিছুটা ছোট - কিন্তু অনেক বেশি উজ্জ্বল। ব্যাগের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ব্যবস্থাপনাও খুব ভালো বলে মনে হলো।

          টার্মিনাল থেকে বাইরে আসার প্যাসেজের দেয়ালজুড়ে লেখা আছে, Welcome to the Home of the Protea.

          জানতাম দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের ডাকনামপ্রোটিয়াজ প্রোটিয়া আসলে দক্ষিণ আফ্রিকার ফুলগাছ যাদেরকে আফ্রিকান ভাষায় সুগার বুশ বলেও ডাকা হয়। প্রোটিয়া গোত্রের অনেকরকম ফুল অস্ট্রেলিয়ায়ও বেশ জনপ্রিয়। প্রোটিয়া ফুলের নানারকম ছবি লাগানো পুরো প্যাসেজে। দেখতে দেখতে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এবার গন্তব্য হোটেল।

          টার্মিনাল থেকে বেরোবার মুখেই শাটল ট্যাক্সির বুকিং অফিস। ট্যাক্সি নিয়ে একটা অপরিচিত জায়গায় একা যাওয়ার চেয়ে শাটল ট্যাক্সিতে আরো কয়েকজন যাত্রীর সাথে যাওয়াটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হবে বলে মনে হলো। আফ্রিকায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব অনেকটা নিজের।

          শাটল ট্যাক্সির বুকিং অফিসে কোন ভিড় নেই। একটা কিশোরী মেয়ে বসে আছে সেখানে। সে-ই কি বুকিং নেবে? নাকি তার মা বা বাবা? কাছে গিয়ে দেখলাম মেয়েটাকে যতটা বাচ্চা বলে মনে হয়েছিল ততটা সে নয়। বেশ করিৎকর্মা। আমার হোটেলের ঠিকানা দেখে জানালো যে তাদের ট্যাক্সি আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবে। আর পাঁচ মিনিট পরেই ট্যাক্সি আসবেভাড়া দিতে হবে ২৫০ র‍্যাল্ড। অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় বেশ সস্তা বলেই মনে হলো। মেয়েটি বললো ট্যাক্সি এলে সে আমাকে ডেকে নেবে।

          মিনিট পাঁচেক সময় পাওয়া গেলো। একটু সামনে যেতেই কেইপ টাউন ট্যুরিজম-এর ভিজিটরস ইনফরমেশন সেন্টার। সেখান থেকে কেইপ টাউনের একটা ফ্রি অফিশিয়াল ভিজিটরস গাইড নিয়ে নিলাম।

          কেইপ টাউনে ট্যুরিস্টের সংখ্যা প্রচুর। সারা পৃথিবীর মানুষ বেড়াতে আসে এখানে। আর ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তার ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি রাখছে না কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ শুরুতেই বলে দিচ্ছে যে কেইপ টাউন নিরাপদ শহর নয়। এখানে নিরাপদে থাকতে হলে অনেক সাবধানে থাকতে হবে। ভিজিটরস গাইডের প্রথম দিকেই সাতটি প্র্যাকটিকেল সেফটি-টিপস দিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

 

  • সাথে নগদ টাকা পয়সা বেশি রাখবেন না। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে বেড়াবেন না। নিজের জিনিসপত্র সাবধানে রাখবেন।
  • কোথাও যাবার আগে আপনার হোস্ট ও গাইডের পরামর্শ মেনে চলুন। বিপদজনক জায়গায় যাবেন না।
  • নির্জন ও অন্ধকার জায়গায় রাতের বেলা যাবেন না।
  • এ-টি-এম ব্যবহার করার সময় কেউ সাহায্য করতে চাইলে তার সাহায্য নেবেন না।
  • রাস্তায় বাচ্চা ছেলে-মেয়েরা ভিক্ষা চাইলে তাদের হাতে কোন টাকা পয়সা দেবেন না। যদি সাহায্য করতে চান তাহলে তাদের কিছু খাবার কিনে দিন। আর টাকা-পয়সা দিতে চাইলে কোন রেজিস্টার্ড দাতব্য সংস্থায় দিতে পারেন।
  • রাতের বেলায় গাড়ি পার্ক করতে হলে আলোকিত জায়গায় গাড়ি পার্ক করুন। পার্কিং পুলিশের সাহায্য নিন।
  • পাসপোর্টসহ অন্যান্য সব দরকারি কাগজপত্র ফটোকপি করে কোন নিরাপদ স্থানে রাখুন।

         

          এই টিপসগুলো সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু আর কোন দেশেই সরকারিভাবে এরকম প্রচার করতে দেখিনি। পাকিস্তান বা আফগানিস্তানও নিজেদের নিরাপদ দেশ হিসেবে প্রচার চালায়।

          ছয়-সাত মিনিট পরে কালো পাজামা-পাঞ্জাবি পরা টুপি-দাড়িওয়ালা এক মৌলভী সাহেব আমার কাছে এসে মোলায়েমভাবে জ্ঞিজ্ঞেস করলেন, আর ইউ মিস্টার দেব?

     ইয়েস

     গোয়িং টু প্রোটিয়া হোটেল?

     ইয়েস

     কাম উইথ মি

          আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। এই আফ্রিকান মৌলভী সাহেব আমার নাম, হোটেলের নাম জানলেন কীভাবে? আর আমিই বা তাঁর সাথে যাবো কেন?

          বললাম, আমি তো শাটল ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি।

          মৌলভী বললেন, ট্যাক্সি এসে গেছে। আমি ড্রাইভার।

          টার্মিনালের বাইরে শাটল ট্যাক্সিস্ট্যান্ডটা নিরিবিলি। মৌলভী সাহেবের পিছু পিছু একটা মাইক্রোবাসে গিয়ে উঠলাম। আমি ছাড়া আরো দুজন যাত্রী আছেন। বারো সিটের মাইক্রোবাসে মাত্র তিনজন যাত্রী নিয়ে কি যথাসময়ে রওনা দেবে? নাকি অপেক্ষা করবে আরো যাত্রীর জন্য? মিনিট দুয়েক একেবারে নিঃশব্দে বসে থাকার পর হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করলো গাড়ি।

          এই রাস্তায় সবোর্চ্চ গতিবেগ ১০ কিলোমিটার। মূল রাস্তায় ওঠার ঠিক আগে ড্রাইভারের মোবাইল বেজে উঠলো। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্য হাতে মোবাইল রিসিভ করলেন ড্রাইভার। এদেশে কি গাড়ী চালানোর সময় এভাবে কথা বলা বৈধ? মনে হয় না। গাড়ি ইউ-টার্ন নিয়ে ফিরে এলো আগের জায়গায়।

          আবার নিঃস্তব্ধতা। মিনিট দুয়েক বাদে কাউন্টারের কিশোরী মেয়েটির মুখ দেখা গেলো গাড়ির কাছে। তার পেছনে আরো দুজন যাত্রী। তাদের নিয়ে আমরা পাঁচজন হলাম। এবার দ্রুতবেগে রাস্তায়।

          হাইওয়েতে উঠে মনে হলো অস্ট্রেলিয়ার কোন রাস্তায় উঠে পড়েছি। বেশ প্রশস্ত রাস্তা। গতিবেগ ১০০। রাস্তার দুপাশে অনেক খালি জায়গা। কিন্তু মিনিট দশেক পরেই দৃশ্যপট কিছুটা বদলে গেলো। রাস্তার দুপাশে সারি সারি বস্তির মতো ঘরদোর দেখা গেলো। খুবই ছোটছোট ঘর হলেও মনে হচ্ছে কিছুটা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এগুলো। দারিদ্র্যের চিহ্ন স্পষ্ট কিন্তু আবার ঘরে ঘরে ছোট ছোট ডিশ অ্যান্টেনাও দেখা যাচ্ছে।

          নেলসন ম্যান্ডেলা বুলেভার্ড থেকে মিনিট বিশেকের মধ্যেই ডাউন টাউনের আকাশচুম্বী অট্টালিকা চোখে পড়তে শুরু করলো। খুব কাছেই সাগর। সাগর নয়, মহাসাগর। আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে হওয়াতে একপাশে ভারত মহাসাগর, অন্যপাশে আটলান্টিক।

          উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার গতিতে ছুটছে গাড়ি।

চোখে পড়লো কনভেনশান সেন্টারের বিশাল কমপ্লেক্স। তার মানে গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হোটেল বুকিং দেয়ার সময় কনভেনশান সেন্টারের কাছাকাছি দূরত্বের হোটেল দেখেছিলাম যেন হেঁটেই আসা যায় কনফারেন্সে।

          কেইপ টাউন সিটির ভেতরে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। খুবই পরিচ্ছন্ন ছিমছাম শহর দেখতে পাচ্ছি। ব্রিটিশরা এই সেদিনও শাসন করেছে এই দেশ। ১৯৩১ সালের ১১ ডিসেম্বর ব্রিটিশরাজ থেকে আলাদা দেশ হিসেবে স্বাধীনতা পেলেও মূল ক্ষমতা শ্বেতাঙ্গদের হাতেই ছিলো ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। গণতন্ত্রের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ, কষ্টের এবং গৌরবের। শহরটা এত পরিচ্ছন্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে গৌরবের পাশাপাশি দায়িত্ব পালনও করছে তারা।

 

নেলসন ম্যান্ডেলা বুলেভার্ড



গাড়ি ওয়াটারফ্রন্টে ঢুকে পড়লো। সাগরের কাছে খুবই সাজানো গোছানো আলাদা একটা শহর বলে মনে হচ্ছে। প্রচুর ট্যুরিস্ট এখানে। ছোট ছোট টিলার উপর সুন্দর ঝকঝকে নতুন স্থাপনা। আরো অনেক নির্মাণ কাজ চলছে। তার মানে এই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা গতিশীল।

          বেশ কিছু উঁচুদরের হোটেল এখানে। হোটেল 'রেডিসন ব্লু  ওয়াটারফ্রন্ট'-এ ঢুকে গেলো গাড়ি। দুজন যাত্রী নামলেন এখানে। আমার হোটেলটাও আশেপাশে কোথাও হবার কথা। কিন্তু গাড়ি অনেক অলিগলি ঘুরছে। ভালোই লাগছে। যা দেখছি সবকিছুই সুন্দর এখানে। ঘন সবুজ গাছের সারি আর ঘন নীল সাগর এত কাছাকাছি চারপাশ এমনিতেই সুন্দর হয়ে গেছে।

          একটু পরেই খোলা বাজার; ফার্মারস মার্কেট। বিরাট ব্যানারে লেখা আছে প্রতি শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এ বাজার বসে। মূলত ট্যুরিস্টদের দেখানোর জন্যই শহরের কেন্দ্রে গ্রাম্য বাজার বসানো হয়।

          মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চোখে পড়লো হোটেল প্রোটিয়া ওয়াটারফ্রন্ট। হোটেলের সামনে গাড়ি থামার পর মৌলভী সাহেব ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আমার সুটকেস নামিয়ে দিলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ আর ২০ র‍্যান্ড টিপস দিলাম। তিনি টাকা নিলেন এবং নিঃশব্দে গাড়ি নিয়ে প্রস্থান করলেন। তবে কি টিপস কম হয়ে গেল!

          রিসেপশান কাউন্টারে একজন ছেলে আর একজন মেয়ে কাজ করছে। হোটেলটা খুবই ছিমছাম পরিচ্ছন্ন। মনে হচ্ছে বিশাল এক জাহাজের ডেকে ঢুকে পড়েছি। হোটেলকর্মীদের সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। এদেশের শ্বেতাঙ্গ নাগরিকদের সবাই কি দেশ ছেড়ে চলে গেছে?

          অনলাইনে বুকিং করা ছিলো। চেক-ইন করে চারতলায় উঠে এলাম। লিফট থেকে বেরিয়ে বাম দিকে তিনটা রুমের পরেই আমার রুম।

          চমৎকার ঘর। জানালাজুড়ে রোদ ঝলমল করছে। রুমের স্ট্যান্ডার্ড আর ভাড়া হিসেব করলে অস্ট্রেলিয়া শুধু নয়, আরো অনেক দেশের তুলনায় এখানে সস্তা বলেই মনে হলো।

          জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। সামনেই রাস্তা আর রাস্তার পর থেকেই বিশাল পাহাড় ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের উপরের ঘরবাড়িগুলোকে এখান থেকে খুবই ছোট দেখাচ্ছে। সবকিছু ছবির মতো সুন্দর। মনে হচ্ছে বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এক অসাধারণ ছবি স্থির হয়ে আছে আমার জানালায়।

          রুমে ফ্রি ওয়াই-ফাই আছে। ল্যাপটপ অন করতে গিয়ে দেখি ব্যাটারির শেষ অবস্থা। চার্জ দেয়া দরকার। সাউথ আফ্রিকান অ্যাডাপ্টর কিনেছিলাম একটা মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের দোকান থেকে। প্যাকেটটা খুলতে খুলতে সেল্‌সগার্লটার কথা মনে পড়লো।

          হাসিখুশি মেয়েটা প্রশ্ন করেছিলো, সাউথ আফ্রিকায় কেন যাচ্ছো?

     শুনেছি দেশটা সুন্দর। তাই দেখতে যাচ্ছি।

     হ্যাঁ দেশটা খুব সুন্দর।

     তুমি কি সাউথ আফ্রিকায় গিয়েছো কোনদিন?

     ইয়েস অ্যান্ড নো।

     কীভাবে?

     আই ওয়াজ বর্ন ইন সাউথ আফ্রিকা। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনে সব ছেড়ে আমাদের চলে আসতে হয়েছে। তারপর আর যাইনি।

          বলতে বলতে মেয়েটার মুখে একটা বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। এতবছরের শ্বেতাঙ্গ দুঃশাসনের অবসানের পর কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন অনেক শ্বেতাঙ্গ পরিবারকেই দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। এই মেয়েটিও হয়তো সেই অবস্থার শিকার।

          খুব টায়ার্ড লাগছে। দুপুর আড়াইটা বাজে। মেলবোর্নে রাত সাড়ে দশটা। বাংলাদেশে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা। বাসা থেকে বেরিয়েছি ৩২ ঘন্টা হয়ে গেছে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আগে খাবো নাকি ঘুমাবো? সবচেয়ে আগে দরকার একটা দীর্ঘ হট শাওয়ার। 

পর্ব ৪

No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts