Monday, 3 August 2020

সত্যেন্দ্রনাথ বসু - পর্ব ১৪



সত্যেন্দ্রনাথ বসু: বোসন কণার জনক

চতুর্দশ অধ্যায়

বিশ্বভারতীর উপাচার্য

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের সাথে ভারতের জ্ঞানের সম্মিলন ঘটানোর লক্ষ্যে শান্তিনিকেতনে স্থাপন করেছিলেন বিশ্ব-ভারতী ১৯২১ সালে। তারপর তিনি সেখানে নিজের মত করে বাধাবন্ধনহীন শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিণত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর বা আচার্য। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য। ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বভারতীর উপাচার্য ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী মৃত্যুবরণ করলে পদটি খালি হয়। সেই পদের জন্য উপযুক্ত মানুষ পাওয়া গেলো অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। তিনি তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন, ভারতের পদ্মবিভুষণ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন, রাজ্যসভায় রাষ্ট্রপতি মনোনীত সদস্য হয়েছেন - সব মিলিয়ে তাঁর মতো উপযুক্ত আর কেউ নেই তখন বিশ্বভারতীর উপাচার্য পদের জন্য। সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে যখন প্রস্তাবটা দেয়া হলো তিনি সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক সেই ছোটবেলা থেকে।

          প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বন্ধু মানিকলালের সাথে তিনি জোঁড়াসাকোতে ঠাকুরবাড়ির অনুষ্ঠানে যেতেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোন ইচ্ছে তার হয়নি কোনদিন। তারপর অনেকবার দেখেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। কিন্তু আলাপ করেননি। তারপর ১৯২৪ সালে সত্যেন বসু যখন প্যারিসে যান, সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্যারিসে ছিলেন। কিন্তু সত্যেন বসু খুব বেশি বিখ্যাত জনপ্রিয় মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করতে যাননি। ১৯২৬ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, সত্যেন বসু তখন জার্মানিতে ছিলেন।

          ১৯৩১ সালে সত্যেন বসু বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা বেগবান করার লক্ষ্যে বাংলাভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকা 'পরিচয়' প্রকাশ করতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে পরিচয়ে লেখা দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন পরিচয়-এর জন্য। সত্যেন বসুর ছাত্র প্রমথনাথ সেনগুপ্ত শান্তিনিকেতন স্কুলে বিজ্ঞান পড়াতেন। ১৯২৪-২৫ সালের পর সত্যেন বসু বিজ্ঞানের জগতে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছেন। স্নেহের নিদর্শন স্বরূপ রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক বই 'বিশ্ব পরিচয়' উৎসর্গ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:

 

শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু
                     প্রীতিভাজনেষু

এই বইখানি তোমার নামের সঙ্গে যুক্ত করছি। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে এমন বিজ্ঞানসম্পদ নেই যা বিনা সংকোচে তোমার হাতে দেবার যোগ্য। তা ছাড়া, অনধিকারপ্রবেশে ভুলের আশঙ্কা করে লজ্জা বোধ করছি, হয়তো তোমার সম্মান রক্ষা করাই হল না। কয়েকটি প্রামাণ্য গ্রন্থ সামনে রেখে সাধ্যমতো নিড়ানি চালিয়েছি। কিছু ওপড়ানো হল। যাই হোক আমার দুঃসাহসের দৃষ্টান্তে যদি কোনো মনীষী, যিনি একাধারে সাহিত্যরসিক ও বিজ্ঞানী, এই অত্যাবশ্যক কর্তব্যকর্মে নামেন তা হলে আমার এই চেষ্টা চরিতার্থ হবে।

শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথমপরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি এ কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে। তথ্যের যাথার্থ্যে এবং সেটাকে প্রকাশ করবার যাথাযথ্যে বিজ্ঞান অল্পমাত্রও স্খলন ক্ষমা করে না। অল্প সাধ্যসত্ত্বেও যথাসম্ভব সতর্ক হয়েছি। বস্তুত আমি কর্তব্যবোধে লিখেছি কিন্তু কর্তব্য কেবল ছাত্রের প্রতি নয় আমার নিজের প্রতিও। এই লেখার ভিতর দিয়ে আমার নিজেকেও শিক্ষা দিয়ে চলতে হয়েছে। এই ছাত্রমনোভাবের সাধনা হয়তো ছাত্রদের শিক্ষাসাধনার পক্ষে উপযোগী হতেও পারে।

আমার কৈফিয়তটা তোমার কাছে একটু বড়ো করেই বলতে হচ্ছে, তা হলেই এই লেখাটি সম্বন্ধে আমার মনস্তত্ত্ব তোমার কাছে স্পষ্ট হতে পারবে।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো পড়ে সত্যেন বসুর মনে হতো সেরকম একটা শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চয় গড়ে তুলতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শান্তিনিকেতনে। তাই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হবার প্রস্তাব যখন এলো, একটুও ইতস্তত করেননি সত্যেন বসু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে তিনি যোগ দিলেন বিশ্বভারতীতে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী। ইন্দিরা দেবীকে অনেক আগে থেকেই চিনতেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর স্বামী প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিলেন সত্যেন বসু।

          কাজে যোগ দিয়েই তিনি প্রত্যেক বিভাগের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করলেন। শিক্ষার্থীদের সাথেও কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। সবার সাথে কথা বলে এবং ওখানকার কার্যপ্রণালী দেখে তিনি কিছুটা হতাশ হলেন। কারণ তিনি দেখলেন শান্তি নিকেতনে মুক্ত প্রাণ মুক্ত বায়ু বলে যতই বুলি আওড়ানো হোক, সবাই এখানে নিয়মের অনুশাসনে শৃঙ্খলিত। 'গুরুদেব' যেটা যেভাবে করেছিলেন সেই ৩৫ বছর আগে, সবকিছু এখনো ঠিক সেভাবেই করতে হবে। এর একচুল এদিক-ওদিক হবার কোন উপায় নেই। সত্যেন বসুর এত বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি কোন ফর্মালিটির ধার ধারেননি। আর বিশ্বভারতীতে ফর্মালিটির বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই।

 

 

চিত্র: শান্তিনিকেতনে ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীর সাথে সত্যেন বসু

 

সত্যেন বসুর পরিকল্পনা ছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার। কিন্তু 'কর্মীমন্ডলী বা কর্মকর্তাদের ইউনিয়ন তাঁকে কোন পরিবর্তনই করতে দেননি 'গুরুদেব' রবীন্দ্রনাথ ওভাবে করেননি অজুহাত তুলে।

          সত্যেন বসু দেখলেন চারদিকে কাচের ঘেরা দেয়া বিশাল এক মন্দির আছে সেখানে। সপ্তাহে একদিন প্রার্থনা করা হয় সেখানে। আর বাকি ছয়দিন সেটা তালাবদ্ধ থাকে। সত্যেন বসু দেখলেন এই জায়গাটাকে খুব সুন্দর একটা পাঠকক্ষে রূপান্তরিত করা যায়। প্রার্থনার সময় প্রার্থনা করলো, অন্য সময়টাতে এখানে বসে পড়াশোনা করলো। প্রস্তাবটা দিতেই 'কর্মীমন্ডলী' তা 'মন্দির অপবিত্র হবে' বলে নাকচ করে দিলো। কর্মীমন্ডলীর উপর নিয়ম জারি করার ক্ষমতা উপাচার্যের নেই।

          ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনুপস্থিতির কোন রেকর্ড রাখা হয় না। তিনি তা বলতেই বলা হলো, 'গুরুদেব কখনো রেকর্ড রাখেননি দরকারি হলে তিনি নিশ্চয় রাখতেন। তিনি যেহেতু রাখেননি সেহেতু সেটা রাখা অনাবশ্যক।'

 

         

চিত্র: বিশ্বভারতীর শিক্ষার্থী ও কর্মীমন্ডলীর সাথে উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু


          বৃষ্টি হলেই বিশ্বভারতীর সব ক্লাস ছুটি হয়ে যায়। কেন? 'গুরুদেব' তাই করেছিলেন। বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে গুরুদেব বর্ষামঙ্গলের গান করতেন। এখন সবার পক্ষে বর্ষামঙ্গল করা সম্ভব না হলেও ছুটি উপভোগ করা সম্ভব। সত্যেন বসু কাউকেই বোঝাতে পারেন না যে এভাবে একটা বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না।

 

চিত্র: বিশ্বভারতীতে সভা করছেন উপাচার্য সত্যেন বসু



সত্যেন বসু দেখলেন বিশ্বভারতীতে যে বিজ্ঞান পড়ানো হয় তার মান বড়জোর প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের। অথচ চালু আছে ম্যাট্রিকুলেশান এবং  বিএ পাস ডিগ্রি। নিজে বিজ্ঞানী মানুষ, বিজ্ঞান ছাড়া একটা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করবে? এই কি সেই বিশ্ববিদ্যালয় যেটার স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন যে বাকি বিশ্বের সাথে ভারতের যোগসূত্র রচনা করবে? দেখা গেলো এখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই সবাই ব্যবহার করে পরিবর্তনে বাধা দেয়ার সময়।

          সমাবর্তন অনুষ্ঠান করা হয় আম গাছের নিচে। সত্যেন বসু বললেন অনুষ্ঠান ঘরের ভেতর নিয়ে যাও। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যত খুশি আম গাছের নিচে বসে গল্প করো, বা যা খুশি করো। কিন্তু না, তা করা যাবে না। কারণ গুরুদেব আম গাছের নিচে সমাবর্তন করেছিলেন। সত্যেন বসুর মনে হয় এই লোকগুলো মনে হয় সবাই পারলে রবীন্দ্রনাথের মত চুলদাড়ি আর আলখাল্লা পরে ঘোরাঘুরি করতো। তবুও কিছুটা জোর করে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন উত্তরায়নে। সবার তাতে খুব আপত্তি। স্বয়ং আচার্য জওহরলাল নেহেরুও মন্তব্য করলেন - আমাদের আম্রকানন থেকে বেশি দূরে যাওয়া ঠিক হবে না। জওহরলাল নেহেরু রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ছিলেন। তাঁর কন্যা ইন্দিরাকেও তিনি শান্তিনিকেতনে পড়িয়েছিলেন। সত্যেন বসু বোঝাতে চেষ্টা করেন যে - এটাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন স্কুলের পর্যায়েই রেখে দেয়া উচিত ছিল। এটাকে কেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলো।

          বাধা পাবেন জেনেও বিশ্বভারতীর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে একটি বড় প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করলেন সত্যেন বসু। প্রচলিত ম্যাট্রিকুলেশন ও ডিগ্রি (পাস) এর বদলে তিনি তিন পর্যায়ের শিক্ষার প্রস্তাব দিলেন। প্রথম পর্যায় - ৬ থেকে ১১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাইমারি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। দ্বিতীয় পর্যায় - ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। তৃতীয় পর্যায়ে ১৭ থেকে ২২ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার পথ - তিন বছর মেয়াদী বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি। বিজ্ঞানের জন্য আলাদা একটা আধুনিক বিজ্ঞান ভবন স্থাপনের প্রস্তাব দিলেন যেখানে ফিজিক্স ও বায়োলজির মত আধুনিক বিজ্ঞানের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা করানো হবে। সত্যেন বসুর প্রস্তাবের ব্যাপারে বিশ্বভারতী সমাচারে ছাপানো হলো যে কর্মসমিতি (কার্যনির্বাহী পরিষদ) এবং সংসদ (সিন্ডিকেট) যদি প্রস্তাব পাস করে তাহলে কার্যকর হবে।

 

চিত্র: শিক্ষার্থী ও কর্মীমন্ডলীর সাথে আচার্য জওহরলাল নেহেরু ও উপাচার্য সত্যেন বসু




চিত্র: বিশ্বভারতীর সমাবর্তন

 


উচ্চপর্যায়ে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন সত্যেন বসু। বিজ্ঞানের উপকারিতার হাতে হাতে প্রমাণ দেয়ার জন্য সত্যেন বসু একটা ছোট প্রকল্প হাতে নিলেন। রান্নাঘরের বর্জ্যকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি করা হলো। সেই মিথেন গ্যাস দিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণের গ্যাস সাপ্লাই দেয়া হলো। আর বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে যেগুলো পাওয়া গেলো সেগুলো জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা হলো। এই প্রকল্পের জন্য কর্মসমিতি দুই হাজার রুপি অনুমোদন করেছিল।

          সত্যেন বসু দেখলেন বিশ্বভারতীর শিক্ষকমন্ডলী, কর্মীমন্ডলী, ও কর্মসমিতি'র সদস্যদের ধারণা হলো এই যে তাঁদের গুরুদেব বিজ্ঞান পছন্দ করতেন না। কারণ তিনি লিখেছেন সভ্যতার সংকট তৈরি করেছে বিজ্ঞান। আধুনিক বিজ্ঞানের কারণেই নাকি মানুষে মানুষে হানাহানি ইত্যাদি। এরকম জ্ঞানপাপীদের তিনি কীভাবে বোঝাবেন বুঝতে পারেন না।

          সত্যেন বসুর আধুনিকায়ন প্রকল্প বিবেচনার জন্য আচার্য জওহরলাল নেহেরুর কাছে পাঠানো হলো। নেহেরু সেটা মতামতের জন্য পাঠালেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুধী রঞ্জন দাসের কাছে। সুধী রঞ্জন দাস ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম চারজন ছাত্রের একজন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ছাত্র। সুতরাং তিনি তাঁর 'গুরুদেব' কী কী করতেন সব জানেন। তিনি প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। তার পক্ষে আরো কিছু ভোটের জন্য তিনি পাঠালেন লিওনার্ড এলমহার্স্টের কাছে। এলমহার্স্ট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমেরিকান সেক্রেটারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রচারের জন্য তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন অনেক বার। এলমহার্স্ট আরো বেশি গুরুদেবভক্ত। তিনি মত দিলেন যে বিশ্বভারতীতে পদার্থবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান পড়ানোর কোন দরকার নেই। বিজ্ঞান যদি পড়াতেই হয় তাহলে মৃত্তিকাবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও কৃষিবিজ্ঞান পড়ানোই যথেষ্ট।

          এর মধ্যেই বেশ কিছু কাজ করেছেন উপাচার্য সত্যেন বসু। ১৯৫৭ সালের ৩০ জানুয়ারি বিশ্বভারতী গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম প্রেসিডেন্ট চৌ-এন-লাইকে দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু তখন চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর। চৌ-এন-লাই এর ভারত সফর ছিল এরই অংশ।

 

চিত্র: বিশ্বভারতীতে চীনের প্রেসিডেন্ট চৌ-এন-লাই-এর সাথে উপাচার্য সত্যেন বসু



১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন বসুকে সাম্মানিক ডি-এসসি ডিগ্রি প্রদান করে। তার কিছুদিন পরেই এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে। ১৯৫৮ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। লন্ডনে গিয়ে এফ-আর-এস হয়ে ফিরে আসার পর বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সেই সম্বর্ধনা সভায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন যে, আমি জগদীশচন্দ্র বসুর ছাত্র। সারাজীবন বিজ্ঞানসাধনা করেছি। অথচ আজ এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কোন কাজেই লাগতে পারছি না। এখানে বিজ্ঞান পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না এখনো। এটা খুবই দুঃখজনক।

 

চিত্রবিশ্বভারতীর আচার্য জওহরলাল নেহেরু এবং উপাচার্য সত্যেন বসু



শান্তিনিকেতনে উপাচার্যের বাসভবনে সত্যেন বসু তাঁর স্ত্রী ও তিন কন্যা নিয়ে বাস করছিলেন। তাঁর বড় দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ চাকরি করছেন, ছোট ছেলে রমেন্দ্রনাথ বেলুড়ে হোস্টেলে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করছেন।

 

চিত্র: বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে উপাচার্য সত্যেন বসু




চিত্র: শান্তিনিকেতনে সত্যেন বসুর অতিথি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ এবং ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ রোনাল্ড ফিশার

 


কলকাতা বা ঢাকায় সত্যেন বসুর বাড়িতে অতিথির আনাগোনা লেগেই থাকতো। সত্যেন বসুর বন্ধু, ছাত্র, সহকর্মী অনেকেই আসতেন প্রতিদিন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ বলতেন সত্যেন বসুর বাড়িটা হলো শ্যামবাজারের পাঁচ রাস্তার মোড়ের মতো - সারাক্ষণ লোকে গিজগিজ করছে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে আসার পর বাড়িতে অতিথি তেমন কেউ আসেনই না। তবে অন্তরঙ্গ বন্ধু অন্নদাশংকর রায়, লীলা রায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ নিয়মিত এসেছেন।

          সত্যেন বসুকে নিয়ে বিশ্বভারতী এবং রাজ্যসভায় কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে সরকার। এই সমস্যার একটি সম্মানজনক সমাধান করার ব্যবস্থা করলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। তিনি সত্যেন বসুকে জাতীয় অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিলেন। এই পদে তাঁর বেতন হলো মাসিক ২৫০০ রুপি,  উপাচার্যের বেতনের চেয়ে মাসে এক হাজার রুপি বেশি। জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে স্বাধীনভাবে বিজ্ঞানের গবেষণা করতে এখন আর কোন সমস্যা নেই। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সত্যেন বসু বিশ্বভারতীর উপাচার্যের পদ ত্যাগ করলেন। ২৪ ডিসেম্বর থেকে তা কার্যকর হলো।

          সত্যেন বসুর পর বিশ্বভারতীর উপাচার্য হয়েছিলেন সেই সুধী রঞ্জন দাস - যিনি সত্যেন বসুর প্রকল্প প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন। অথচ দেখা গেলো তিনি উপাচার্য হবার পর সত্যেন বসুর প্রস্তাবিত সবগুলো প্রস্তাব নিজের নামে কার্যকর করলেন। বিশ্বভারতীর বিজ্ঞানভবনের খুব সুনাম হলো। সবাই উপাচার্য সুধী রঞ্জনকে গুরুদেবের যোগ্য শিষ্য হিসেবে ধন্য ধন্য করতে লাগলেন।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

James Watson – an extraordinary scientist, but an intolerable racist and misogynist man

  The “Eagle” pub on the Cambridge campus has become as famous as Cambridge University itself, having witnessed hundreds of discoveries, inn...

Popular Posts