Thursday 30 July 2020

সত্যেন্দ্রনাথ বসু - পর্ব ১০



সত্যেন্দ্রনাথ বসু: বোসন কণার জনক

দশম অধ্যায়

বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন ও ঘনীভবন

সত্যেন বসু তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র 'Planck's Law and the Light-Quantum Hypothesis' লিখেছিলেন ১৯২৪ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে। তার কয়েক দিনের মধ্যে লিখেছিলেন আরেকটি পেপার 'Thermal Equilibrium in the Radiation Field in the Presence of Matter'। প্রথম পেপারটি লন্ডনের বিখ্যাত সায়েন্স জার্নাল ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারা তা প্রকাশের যোগ্য বলে মনে করেনি। আমরা অষ্টম ও নবম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি তারপর কীভাবে তাঁর আইনস্টাইনের সাথে যোগাযোগ হলো এবং আইনস্টাইনের সহযোগিতায় পেপারটি জার্মান ভাষায় জার্মান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

          সত্যেন বসু আইনস্টাইনকে প্রথম পেপারটি পাঠিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের ৪ জুন, এবং দ্বিতীয় পেপারটি পাঠিয়েছিলেন ১৫ জুন। আইনস্টাইন প্রথম পেপারটি অনুবাদ এবং প্রকাশের ব্যবস্থা করে সত্যেন বসুর চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন জুলাই মাসের ২ তারিখ। দ্বিতীয় পেপারটি যে প্রকাশিত হয়েছে তা অনেকদিন জানতেও পারেননি সত্যেন বসু। প্যারিসে গিয়ে দ্বিতীয় পেপারের ব্যাপারে আইনস্টাইনকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন ২৬ অক্টোবর। আইনস্টাইন সে চিঠির উত্তর দেন ৩ নভেম্বর। সেটা পেয়েই সত্যেন বসু জানতে পেরেছিলেন যে তাঁর দ্বিতীয় পেপারটিও প্রকাশিত হয়েছে। তারপর আরেকটি পেপার তিনি লিখেছিলেন ১৯২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে। কিন্তু সেই পেপারটি কোথাও প্রকাশিত হয়নি কারণ আইনস্টাইন কোন আগ্রহ দেখাননি সেটার ব্যাপারে। সত্যেন বসু এরপর তাঁর নিজের এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে আর কোন গবেষণা করেননি। অনেক বছর পর তিনি এ ব্যাপারে স্বীকারোক্তি করেছিলেন যে - তিনি যা কিছু গবেষণা করেছেন নিজে বোঝার জন্য করেছেন। বোঝা হয়ে গেলে সেটার ব্যাপারে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।[1] বিভিন্ন সময়ে তাঁর এই কথার সত্যতা আমরা পেয়েছি।

          এখন আমাদের প্রশ্ন হলো বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্‌স কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো? কীভাবে সৃষ্টি হলো বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট থিওরি? বোসন কণার নামই বা কীভাবে হলো? সত্যি কথা হলো এই ব্যাপারগুলো প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য সর্বাত্মক ভূমিকা যিনি রেখেছেন তিনি আইনস্টাইন। সত্যেন বসুর প্রথম পেপারটি হাতে পাওয়ার পর আইনস্টাইন বুঝতে পেরেছিলেন এই নতুন ভাবনার সুদূর-প্রসারী গুরুত্ব। তাই তিনি সত্যেন বসুকে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি পাইয়ে দিয়েছেন। চলুন দেখি সেটা কীভাবে হলো।

          আইনস্টাইন সত্যেন বসুর প্রথম পেপারটি পেয়েছিলেন জুন মাসের মাঝামাঝি কোন এক সময়। তারপর দ্রুত তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছেন। পেপারের শেষে তাঁর একটি মন্তব্য ছাপানো হয়েছে। যেখানে আইনস্টাইন বলেছেন, "আমার মতে প্ল্যাংকের সূত্রের নির্ণয় যেভাবে বোস করেছেন তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা থেকে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নির্ধারণ করা যায়। অন্যত্র আমি তা বিস্তারিত দেখাবো।"

          তারপর আইনস্টাইন কিন্তু এক মুহূর্তও দেরি করেননি। তিনি আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব নিয়ে তিনটি গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে। বার্লিনের প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমিতে প্রথম পেপারটি উপস্থাপন করেন ১৯২৪ সালের ১০ জুলাই। সত্যেন বসু তখন মাত্র আইনস্টাইনের পাঠানো প্রশংসা সম্বলিত পোস্টকার্ডটি পেয়েছেন। আইনস্টাইন প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমিতে দ্বিতীয় গবেষণাপত্র পাঠান ১৯২৫ সালের ৮ জানুয়ারি এবং তৃতীয়টি পাঠান ১৯২৫ সালের ২৯ জানুয়ারি। সত্যেন বসু যেখানে তাঁর নিজের তত্ত্বের দ্বিতীয় পেপারটি প্রকাশিত হওয়ার সংবাদ জানতে পারেননি সেখানে বার্লিনে আইনস্টাইন যে এতগুলো পেপার লিখে ফেলেছেন তাঁর ছোট্ট পেপারের মূলনীতি থেকে তা কীভাবে জানবেন। সেই সময় বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে ডাকযোগে গবেষণাপত্রের আদান-প্রদান করতেন। ইওরোপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে সেই যোগাযোগটা ছিল। কিন্তু সত্যেন বসুর তা ছিল না। আরো একটা ব্যাপার হলো - সত্যেন বসুর মূল কাজটি থেকে যে আরো অনেক কাজ করা যাবে সেই ইংগিত আইনস্টাইন দেয়ার পরেও সত্যেন বসু সে ব্যাপারে কিছু করার জন্য তৎপরতা দেখাননি।

          আইনস্টাইন প্রুশিয়ান অ্যাকাডেমিতে যে আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্বের যে তিনটি পেপার প্রকাশ করেছিলেন সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বিইসি তত্ত্ব, এবং তারপর বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্‌টিক্স। আইনস্টাইনের সেই তিনটি পেপারের রেফারেন্স হলো:

  • Einstein, Quantentheorie des einatomigen idealen Gases, S. B. preuss. Akad. Wiss., Phys.-math. Kl. (Berlin), [10 July 1924], 261-267 (1924);
  • Einstein, Quantentheorie des einatomigen idealen Gases. II, S. B. preuss. Akad. Wiss., Phys.-math. Kl. (Berlin) [8 January 1925], 3-14 (1925);
  • Einstein, Zur Quantentheorie des idealen Gases, S. B. preuss. Akad. Wiss., Phys.-math. Kl. (Berlin) [29 January 1925], 18-25 (1925).

 

তারপর আইনস্টাইন অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সত্যেন বসু যখন তাঁর তৃতীয় পেপারটি আইনস্টাইনের কাছে পাঠিয়েছিলেন ১৯২৫ সালের জানুয়ারির শেষের দিকে, ততদিনে আইনস্টাইনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। তাই ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে সত্যেন বসু যখন বার্লিনে গিয়ে আইনস্টাইনের সাথে দেখা করেন, ততদিনে গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্বের কাজ আইনস্টাইনের কাছে পুরনো হয়ে গেছে।

          তাহলে এক্ষেত্রে সত্যেন বসুর অবদান আসলে কী? তাঁর ছোট্ট পেপারটা ছিল গণিতের বড় বড় সমীকরণে ভর্তি। সেখান থেকে বিজ্ঞানের মূল ব্যাপারটা বুঝতে হলে শুরুতে আমাদের বুঝতে হবে সম্ভাবনার সূত্র।

          খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন আপনার কাছে একটি পাঁচ টাকার মুদ্রা আছে। মুদ্রার এক পিঠে আছে শাপলা, অপর পিঠে আছে যমুনা সেতু। এখন এই মুদ্রাটি যদি টস করেন তাহলে শাপলা উঠার সম্ভাবনা কত?

 

চিত্র: পাঁচ টাকার কয়েন


এখানে হয় শাপলা উঠবে, নয় যমুনা সেতু উঠবে। তার মানে মোট সম্ভাবনার সংখ্যা ২। সেখান থেকে শাপলা বা যমুনা সেতু উঠার সম্ভাবনা হবে ১/২। এখন মনে করুন আপনি আরেকটি দুই টাকার কয়েন নিলেন যার এক পিঠে আছে শাপলা, অন্যপিঠে আছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। এখন এই কয়েনটা টস করলে শাপলা উঠার সম্ভাবনা কত? এটারও ১/২।

 

চিত্র: দুই টাকার কয়েন


এখন মনে করুন আপনি দুই টাকার কয়েন আর পাঁচ টাকার কয়েন এক সাথে টস করলেন। একসাথে দুটো শাপলা উঠার সম্ভাবনা কত? এটা বলার জন্য আমাদের আগে দেখতে হবে মোট কত ধরনের সম্ভাবনা আছে।

 

সম্ভাবনা ১৫ টাকার শাপলা + ২ টাকার বঙ্গবন্ধু


 

সম্ভাবনা ২৫ টাকার শাপলা + ২ টাকার শাপলা


 

সম্ভাবনা ৩: ৫ টাকার সেতু + ২ টাকার শাপলা


 

সম্ভাবনা ৪: ৫ টাকার সেতু + ২ টাকার বঙ্গবন্ধু


 

তাহলে দেখা যাচ্ছে দুই টাকার কয়েন ও পাঁচ টাকার কয়েন এক সাথে টস করলে মোট চার ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। সেখানে দুইটি শাপলা উঠার সম্ভাবনা ৪ এর মধ্যে ১ = ১/৪। যেহেতু কয়েন দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের, সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সম্ভাবনা ভিন্ন ভিন্ন রকমের। এখন মনে করুন আপনি দুটো পাঁচ টাকার কয়েন একই সাথে টস করলেন। তাহলে দুটো শাপলা এক সাথে উঠার সম্ভাবনা কত? দেখা যাক কী কী সম্ভাবনা আছে।

 

সম্ভাবনা ১: সেতু + শাপলা



 

সম্ভাবনা ২: সেতু + সেতু

 

সম্ভাবনা ৩: শাপলা + সেতু


সম্ভাবনা ৪: শাপলা + শাপলা


এখন আপনাকে একটু ভাবতে হবে। পাঁচ টাকার কয়েন দুটোকে যদি আপনি আলাদা করে চিনতে পারেন, তাহলে এই চারটি সম্ভাবনাই ঠিকভাবে ঘটবে। তখন দুটো শাপলা একসাথে পড়ার সম্ভাবনা হবে ১/৪। কিন্তু যদি আপনার পাঁচ টাকার কয়েন দুটো দেখতে হুবহু একই রকমের হয়, একই রকম উজ্জ্বল, একই সময়ে বানানো, আপনি যদি কোনভাবেই তাদের আলাদাভাবে চিনতে না পারেন - সেক্ষেত্রে সম্ভাবনা ১ ও সম্ভাবনা ৩ এর মধ্যে আপনি কোন পার্থক্য করতে পারবেন না। তখন মোট সম্ভাবনার সংখ্যা হবে ৩, এবং দুটো শাপলা এক সাথে পড়ার সম্ভাবনা হবে ১/৩।

          সত্যেন বসু এই ব্যাপারটাকেই প্রথম নিয়ে এসেছিলেন আলোর কণার ক্ষেত্রে। তিনি ধারণা দিয়েছেন যে আলোর কণাগুলো, পরে যাদের নাম হয়েছে ফোটন, সব দেখতে একই রকম। তাদের শক্তি যদি সমান হয় তবে একটা থেকে অন্যটাকে আলাদা করা যাবে না। সেক্ষেত্রে একই শক্তিস্তরে অনেকগুলো ফোটন একটার ওপর আরেকটা বসে পড়লেও কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু একই শক্তিস্তরের  ইলেকট্রনগুলোকে একটি থেকে অন্যটি আলাদা করা যায়। তাই কোন পরমাণুতে যতগুলো ইলেকট্রন থাকে তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কোয়ান্টাম সংখ্যা থাকে। কিন্তু ফোটনগুলোর কোয়ান্টাম সংখ্যা অভিন্ন। পরে এই ধরনের ধর্ম বিশিষ্ট অর্থাৎ যেসব কণাকে একটি থেকে অন্যটি আলাদা করা যায় না তাদেরকে 'বোসন' নাম দেয়া হয়েছে।

          ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইনস্টাইন যখন পেপারগুলোর কাজ শেষ করেন, তখন মৌলিক কণা বলতে শুধুমাত্র ইলেকট্রন, প্রোটন ও ফোটনকেই বোঝানো হতো। তখনো নিউট্রন আবিষ্কৃত হয়নি। প্রোটন যে ভাঙা যায় - সেটাও কারো মাথায় আসেনি তখনো। আইনস্টাইন দেখলেন যে শুধুমাত্র ফোটনই সত্যেন বসুর প্রস্তাবিত পরিসংখ্যান মেনে চলে। ফোটনের নতুন বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। ফোটনের সংখ্যা সংরক্ষিত নয়, এবং ফোটনের কোন স্থিরভর (rest mass) নেই।

            আইনস্টাইন আদর্শ গ্যাসের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে একটি সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তে আসেন যে কোন গ্যাসের তাপমাত্রা একটি সংকট-তাপমাত্রার (critical temperature) নিচে নিয়ে যেতে পারলে গ্যাসের পরমাণুগুলোর গতি প্রায় শূন্যের কাছাকাছি চলে যায়।তখন তারা একে অপরের প্রতি কোন আকর্ষণ অনুভব করে না। তাদের কোন ফ্রি এনার্জি থাকে না। অনেকগুলো পরমাণু তখন একই শক্তিস্তরে চলে আসার ফলে গ্যাসের সেই কণাগুলোকে একটি থেকে অন্যটি আলাদা করে চেনা যায় না। অর্থাৎ তারা বোসন কণার মতো আচরণ করে। তখন মনে হয় যেন সবগুলো পরমাণু ঘনীভূত হয়ে এক জায়গায় এসে গেছে।  এই অবস্থায় গ্যাসের একটি অংশ ঘনীভূত হয়ে যায়, অন্য অংশ সম্পৃক্ত আদর্শ গ্যাস (saturated ideal gas) হিসেবে থেকে যায়। এই অবস্থার নাম হয়েছে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট বা বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন।

            ১৯২৫ সালে প্রকাশিত এই ধারণা আস্তে আস্তে বাস্তবে রূপ নিতে থাকে। ১৯৩৮ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিটজ লন্ডন[2] ধারণা দেন যে সুপারফ্লুইড হিলিয়াম-৪ এর আচরণের মূল কারণ বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেশানের সাথে সম্পর্কিত।[3]

          বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেশানের এর আধুনিক ধারণা অনুসারে উচ্চ তাপমাত্রায় বোসন গ্যাসে কণাগুলোর শক্তির বন্টন বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্‌স মেনে চলে। সংকট তাপমাত্রার নিচে গ্যাসের কণাগুলোর একটা বড় অংশ একই শক্তিস্তরে গিয়ে ঘনীভূত হয়ে যায় এবং বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেট তৈরি করে। এই অবস্থায় গ্যাসের কোয়ান্টাম আচরণ পর্যবেক্ষণ করা যায়, এবং পদার্থের অনেক মৌলিক ধর্মের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব।

         

চিত্র: বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেট। রুবিডিয়াম পরমাণুর গ্যাসে পদার্থের নতুন দশা বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেট।



পরীক্ষাগারে প্রথম বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেট তৈরি করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে। এজন্য ২০০১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান তিন জন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী - এম-আই-টি'র উলফ্‌গ্যাং কেটেরলি, এবং কলরাডোর এরিক কর্নেল ও কার্ল ওয়াইম্যান। প্রমাণিত হয় যে এখন পদার্থের পাঁচ অবস্থা: কঠিন, তরল, বায়বীয়, প্লাজমা এবং বোস-আইনস্টাইন-কনডেনসেট।

          আবার একটু ১৯২৬ সালে ফিরে আসি। ১৯২৪-২৫ সালে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্‌টিক্স যখন প্রকাশিত হয় - তখনো কিন্তু ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্‌টিক্সের জন্ম হয়নি। কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্‌টিক্স বলতে তখনো বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্‌সকেই বোঝানো হতো। (তখনো কিন্তু এর নামকরণ হয়নি)। ১৯২৫ সালের শেষের দিকে উলফগং পাউলি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এক্সক্লুশান প্রিন্সিপাল বা বর্জন নীতি আবিষ্কার করেন। সে নীতি অনুসারে পরমাণুর কোন শক্তিস্তরে একই রকমের ইলেকট্রন একটির বেশি থাকতে পারে না।[4] এর কিছুদিন পরেই ১৯২৬ সালের শুরুতে এনরিকো ফার্মি পাউলির বর্জন নীতি কাজে লাগিয়ে প্রকাশ করেন যেসব কণা পাউলির বর্জন-নীতি মেনে চলে সেসব কণার স্ট্যাটিসটিক্‌স। এই স্ট্যাটিসটিক্‌স আলাদা এবং এর নামও দেয়া হয়নি তখনো। একই বছর পল ডিরাক এই দুই প্রকার স্ট্যাটিস্‌টিক্সের সমন্বয় করে প্রথম প্রকার স্ট্যাটিসটিক্‌স যেসব কণা মেনে চলে সেই কণার নাম দেন 'বোসন', আর দ্বিতীয় প্রকার স্ট্যাটিস্‌টিক্স অর্থাৎ ফার্মির স্ট্যাটিসটিক্স যেসব কণা মেনে চলে তাদের নাম দেন ফার্মিয়ন।[5] কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা এই মত গ্রহণ করেন যে - বোসন কণা মেনে চলে বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স, আর ফার্মিয়ন কণা মেনে চলে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্‌টিক্স। একই কোয়ান্টাম-স্টেটে অসংখ্য বোসন থাকতে পারে, কিন্তু একই কোয়ান্টাম-স্টেটে একটার বেশি ফার্মিয়ন থাকতে পারে না।

          এই ব্যাপারগুলো যখন ঘটছিলো জার্মানি ও ইংল্যান্ডে সত্যেন বসু তখন শারীরিকভাবে ঘটনাস্থলের খুবই কাছে ছিলেন। তিনি তখন জার্মানির বার্লিনে। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এত বড় ভিত্তি গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর প্রথম পেপারটি থাকলেও আর কোন কিছুতে তাঁর বৈজ্ঞানিক অংশগ্রহণ ছিল না। বলা চলে তাঁকে না জানিয়েই তাঁর নামে মৌলিক কণার নামকরণ করা হলো, স্ট্যাটিস্‌টিক্‌সের নামকরণ করা হলো, পদার্থের নতুন অবস্থার নামকরণ করা হলো।



[1] Jagadish Mehra, Satyendra Nath Bose, Biographical Memoirs of Fellows of the Royal Society, Vol 21 (Nov 1975), pp. 116-154.

[2] জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিট্‌জ লন্ডন (৭/৩/১৯০০ - ৩০/৩/১৯৫৪) ম্যাক্স ফন লাউই-র ছাত্র ছিলেন।

[3]           F. London, The A-phenomenon of liquid helium and the Bose-  Einstein degeneracy, Nature, Lond. 141, 643-644 (1938); On   the Bose-Einstein condensation, Phys. Rev. 54, 947-954            (1938).

[4] W. Pauli's work on the Exclusion Principle [tber den Zusammenhang des Abschlusses der Elektronengruppen im Atom mit der       Komplexstruktur der Spektren, Z. Phys. 31, 765-783 (1925)

[5] P. A. M. Dirac, On the theory of quantum mechanics, Proc. R. Soc.   Lond. A 112, 661-77 (1926).


একাদশ অধ্যায়

নবম অধ্যায়

1 comment:

  1. সুন্দর , তরতরে ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা।

    ReplyDelete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts