Sunday, 5 July 2020

ছিন্ন পাতার সাজাই তরণী - পর্ব ৩৭

37<<<<<<<<<<<<<<


“ডিবেইটিং ইজ অ্যান আর্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি।“

লাইনটা পড়েই অনেকটা আঁৎকে উঠলাম। বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার শৈল্পিক রূপই বিতর্ক? এই যে দিনরাত এত এত বইপত্র পড়ে রেফারেন্স ঘেঁটে স্ক্রিপ্ট তৈরি করে, বিরতিহীন অনুশীলন করে করে আমাদের ছেলেমেয়েরা যে টেলিভিশন জাতীয় স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতার ফাইনাল রাউন্ডে উঠেছে দেশের সবচেয়ে নামী স্কুলগুলির বিতার্কিকদের হারিয়ে – এর সবকিছুই বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা? একমত হতে পারছি না লেখকের সাথে। কে লিখেছেন এটা জানি না। পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখার দায়িত্ব নাকি অনেকেই পালন করেন, তবে দায় বর্তায় সম্পাদকের উপর। এই পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, মালিক – সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করেছিল। অফিসার্স মেসের গেস্টরুমে শুধু এই পত্রিকাই নাকি দেয়া হয়। রিফাৎ আরা ম্যাডাম এই পত্রিকা দেখলেই রেগে যান, ছুঁয়েও দেখেন না। আজও রেগে গেছেন। আমাকে বলেছেন সন্ধ্যায় বের হলে ‘সংবাদ’ কিনে আনতে। এখন মনে হচ্ছে আমারও রিফাৎ আরা ম্যাডামের মত এই পত্রিকা থেকে দূরে থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমার অভ্যাস আবার একটু ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখিবে তাই’ টাইপের। বিপক্ষের লোক কীভাবে চিন্তা করে, কী কী দর্শন ধারণ করে জানা থাকলে তাদের স্ট্র্যাটেজি বুঝতে অনেক সুবিধা হয়। এই স্ট্র্যাটেজি বুঝার জন্যই এই সুনশান দুপুরে এয়ারফোর্সের অফিসার্স মেসের গেস্টহাউজের দোতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে পত্রিকাটির পাতা উল্টাতে শুরু করেছিলাম।

এখানে এসেছি ঘন্টাদেড়েক আগে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার রেলপথের দূরত্ব সড়ক পথের চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে সময় সম্ভবত বাসের চেয়ে কম লাগে। বাসরুটে প্রায়ই জ্যাম লেগে যায়। কমলাপুর থেকে দুটো বেবি টেক্সি নিয়ে চলে এসেছি এখানে।  আমাদের তিনজন বিতার্কিক আর তিনজন শিক্ষকের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এয়ারফোর্সের অফিসার্স মেসে। শাহীন কলেজের শিক্ষক না হলে এখানে থাকা তো দূরের কথা – ঢুকার সুযোগও কখনো হতো না। কমলাপুর স্টেশনের আশেপাশে হাজার হাজার মানুষের কর্মচাঞ্চল্য দেখলে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব সম্পর্কে যেরকম ধারণা হয়, এখানে ঢুকার পর সেই ধারণার বিপরীত একটা চিত্র পাওয়া যায়। কত বড় এরিয়া নিয়ে এখানকার গেস্ট-হাউজগুলি। তাদের মাঝে মাঝে অনেক জায়গা নিয়ে সুন্দর বাগান, বড় বড় সবুজ গাছ। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং তাদের পরিবারের জন্য যে সুযোগ-সুবিধা আছে, সাধারণ নাগরিকদের জন্য সেরকম সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই সিভিলিয়ান হয়ে এরকম একটা জায়গায় ঢোকার সুযোগে পেলেও নিজেকে রাজা-বাদশা বলে মনে হয়।

এখানে থাকা-খাওয়া ইত্যাদি ব্যবস্থা প্রিন্সিপাল স্যারের অনুরোধে ঘাঁটির কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই করা হয়। এবার আমরা ফাইনাল বিতর্ক লড়তে এসেছি এটাও এখানে বলে দেয়া হয়েছে। ফলে গার্ড-রুম থেকে শুরু করে সবকিছুতেই একটু আলাদা মর্যাদা পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য ইউনিফর্ম-পরা কেউ স্যালুট করলেই যে আলাদা মর্যাদা দেয়া হচ্ছে তা না-ও হতে পারে।

এবারের ফ্ল্যাটটা গতবারের চেয়েও বড়। গতবার সেমিফাইনাল ছিল, এবার ফাইনাল – কিছুটা বেশি খাতির তো পেতেই পারি। তিনটি বেডরুমের একরুমে রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন ম্যাডাম, আরেক রুমে রীমা ও অন্তরা, আর এদিকে বারান্দার কাছাকাছি রুমে আমি আর নাজমুল। অফিসারদের ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য নন-অফিসার লোকজন নিয়োজিত আছে। তারা মনে হয় আশেপাশেই থাকে। দরকার লাগলেই পাওয়া যায়। এখানে আসার পরপরই খাবার-দাবারসহ দরকারি সবকিছুর অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন নাসরীন বানু ম্যাডাম। ম্যানেজমেন্টে তিনি দক্ষ এবং কড়া। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার অর্ডার দেয়া হয়েছে। ম্যাডামরা এবং বিতার্কিকরা সবাই এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন – মানে দিবানিদ্রা দিচ্ছেন। সন্ধ্যাবেলা চা খাওয়ার পর শুরু হবে অনুশীলন।

বারান্দাটি অনেক বড়। সামনে বড় বড় এক সারি নারকেল গাছ। পশ্চিম দিক থেকে নারকেল পাতার ছায়া-মাখা রোদ এসে পড়ছে বারান্দায়। বারান্দায় কিছু পাতাবাহারের টবও আছে। পত্রিকাটি নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখ পড়েছে সম্পাদকীয় পাতায়। ডিবেইটিং ইজ অ্যান ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি কথাটি অবশ্য আমাদের বিতর্কের প্রেক্ষিতে বলা নয়। বলা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। লন্ডন আমেরিকা থেকে বড় বড় লোকজন আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য। আমাদের সবকিছুর জন্যই আমরা বিদেশীদের পরামর্শ নিতে পছন্দ করি – সে শারীরিক অসুখ হোক, কিংবা রাজনৈতিক অসুখ। এসব প্রেক্ষিতে লেখা হলেও ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি বা বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা কথাটি মাথার মধ্যে খোঁচা মারছে।

ঠান্ডা মাথায় আরেকবার ভেবে দেখলাম। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় আসলে কী হয়? আসলে দেখা হয় – কে কত যুক্তি দিতে পারে। পক্ষে কিংবা বিপক্ষে। আমরা জানি চুরি করা খারাপ। কিন্তু কেউ যদি অনেক বেশি জোরালো যুক্তি দেখাতে পারে এর বিপক্ষে – তাহলে তো প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিপক্ষেরই জয় হবে। বিতর্কের প্রস্তাবের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যখন বলে আমাদের বক্তারা – তখন তো তারা নিজেদের পছন্দে পক্ষে বা বিপক্ষে বলে না। তাদেরকে আগে থেকেই ঠিক করে দেয়া হয় – কোন্‌ পক্ষে বলবে তারা। তাহলে – এটা তো পরীক্ষার প্রশ্নের মতো উত্তর রেডি করা থাকে। প্রতিপক্ষ কী কী যুক্তি দিতে পারে এবং সেগুলিকে কীভাবে খন্ডন করা হবে – তার প্রস্তুতিও নেয়া হয়ে থাকে। তাহলে এখানে যে বুদ্ধিবৃত্তিক অসততা একেবারেই হচ্ছে না তা তো বলা যাচ্ছে না। একজন তার্কিক ব্যক্তিগতভাবে কী পছন্দ করে, কিংবা কোন্‌ মত সমর্থন করে – তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। বিতর্কে জেতার জন্য কী কী যুক্তি দেয়া যায় – সেটাই দেয়া হয় এখানে। মনে হচ্ছে চিন্তাটা বেশি হয়ে যাচ্ছে।

“স্যার, আপনি ঘুমাননি?”

নাজমুল উঠে এসেছে। তার গলার স্বর এমনিতেই গমগম করে। এখন ঘুম থেকে উঠার পর আরো ভারী মনে হচ্ছে।

“আমরা কি স্যার গতবার এই বিল্ডিং-এ ছিলাম?” – নাজমুল প্রশ্ন করে।

“কী জানি, আমার তো এখানে সব বিল্ডিং-ই একই রকম মনে হয়। একা একা এখানে আসতে হলে দেখা যাবে আমি অন্য কোন বিল্ডিং-এ ঢুকে গেছি।“

আমি কোন হাসির কথা বলিনি, কিন্তু নাজমুল হাহা করে হেসে উঠলো। সে ফিসফিস করে কথা বললেও লাউড স্পিকারের মত শোনা যায়। আর এখন হাহা করে হাসির শব্দ ভেতরে কত জোরে শোনা গেছে জানি না, দেখা গেলো অন্তরা আর রীমা দুজনই দৌড়ে চলে এলো বারান্দায়।

“আমরা কী মিস করলাম?” – রীমা প্রশ্ন করে।

“আমাদের ফেলে সব মজার গল্প করা হয়ে যাচ্ছে।“ – অন্তরাও যোগ দেয়।

“কোন মজার গল্প নয় এখন। উঠে যখন গিয়েছ, স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা কর।“ – আমি একটু গম্ভীর হবার চেষ্টা করি। বলতে ইচ্ছে করছিল যে ‘আর্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি’ প্র্যাকটিস করো। কিন্তু বললাম না। এত কম বয়সে ‘ডিজঅনেস্টি’ শুনলে এদের উদ্যম কমে যাবে।

একটু পরে কলিং-বেল বাজলো। নাজমুল গিয়ে দরজা খুলেই এক পা পিছিয়ে স্যালুট দিলো। শাহীন কলেজের ছেলেমেয়েরা সামরিক কায়দা-কানুন কীভাবে যেন শিখে ফেলে। সে যাকে স্যালুট দিলো তাঁকে দেখে দ্রুত দাঁড়িয়ে গেলাম। স্কোয়াড্রন লিডার আমজাদ হোসেন। সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এই অফিসার খুবই শিক্ষানুরাগী। শাহীন কলেজের এডুকেশান বোর্ডে আছেন তিনি। আমার সাথে এর আগে কলেজে মাত্র একবার কথা হয়েছিল। খুবই ভালো লেগেছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলে।

“আরে প্রদীপ, বসেন বসেন। কেমন আছেন?”

“জ্বি স্যার, ভালো।“

রীমা আর অন্তরা সালাম দিয়ে দ্রুত ভিতরে চলে গেছে ম্যাডামদের খবর দিতে। নাজমুলও ভিতরে চলে গেছে। স্যারকে বারান্দায় বসানো ঠিক হবে না। আমি আর নাজমুল যেখানে থাকছি সেটাই আসলে বসার ঘর। এক সেট সোফা আছে সেখানে। আমজাদ স্যারকে বললাম, “আসেন স্যার, ভেতরে আসেন।“

“না, এখানেই বসি” – বলে বারান্দার একটা টুলে বসে পড়লেন। আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে। অফিসারদের এতটা অমায়িক হলে ঠিক মানায় না।

“আজ আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো?”

“না স্যার।“

“আমি স্টেশনে যাবো ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু লাস্ট মোমেন্টে একটা ইমার্জেন্সি মিটিং পড়ে গেল।“ – তাঁর কন্ঠে স্বাভাবিক আন্তরিকতা।

“ঠিক আছে স্যার, আমাদের কোন সমস্যা হয়নি।“

“মুকুল, তুমি বারান্দায় বসে আছো কেন? ভেতরে এসে বসো।“ – বলতে বলতে বারান্দায় এলেন রিফাৎ আরা ম্যাডাম।

ম্যাডাম এত বড় অফিসারকে ডাকনামে ডাকছেন, তুমি করে বলছেন – দেখে আমার মুখ হা হয়ে গেল। আমার ধারণা ছিল অফিসাররা হচ্ছেন সিভিলিয়ানদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিভিলিয়ানদের সাথে তাঁদের কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে এটাই আমার মনে ছিল না।

“ডোরাপু,” – আমজাদ স্যার উঠে দাঁড়ালেন।

রিফাৎ আরা ম্যাডামের ডাকনাম ডোরা! আমজাদ স্যার ডোরাপু - মানে ডোরা আপু ডাকলেন। ইনি ম্যাডামের ভাই! ম্যাডাম তো কোনদিনই কিছু বলেননি।

“আসো ভেতরে আসো। প্রদীপের সাথে তো তোমার পরিচয় আছে না?”

“হ্যাঁ আছে। ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট শফিক তো প্রদীপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।“

আমি আঁতকে উঠলাম। শফিক আমার নামে বাড়িয়ে বাড়িয়ে কী কী বলেছে কে জানে।  বললাম, “শফিক আমার বন্ধু স্যার। সে আমাকে একটু বেশি পছন্দ করে।“

“আর প্রদীপ” – রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন, “ও স্কোয়াড্রন লিডার আমজাদ – ওটা তার অফিসিয়াল পরিচয়। কিন্তু আমার কাছে সে আমার ভাইয়ের ছেলে – মুকুল।“

বুঝতে পারলাম। আমজাদ স্যার ডোরাপু বলেননি – বলেছেন ডোরাফু – মানে ডোরা ফুফু। বেশ অন্তরঙ্গ আড্ডা জমে গেল। চা দেয়া হয়েছে। আমজাদ স্যার জানালেন আগামী পরশু রেকর্ডিং-এর দিন ঢাকা শাহীন থেকে এক বাস ভর্তি করে স্টুডেন্ট যাবে টিভি ভবনে। প্রতিবার যতজন যায় – এবার তার চেয়েও বেশি যাবে। কয়েকজন শিক্ষক যাবেন স্টুডেন্টদের গাইড করার জন্য। আর অনেক অফিসার যাবেন। চট্টগ্রাম ঘাঁটি থেকে ওসি-অ্যাডমিনসহ আরো কয়েকজন অফিসার আসবেন। এসব শুনে রীমা বললো, “টেনশান হচ্ছে স্যার। যদি জিততে না পারি?”

আমি বলতে যাচ্ছিলাম “না জিতলে নাই, টেনশান করার দরকার নাই।“ – কিন্তু রিফাৎ আরা ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আমার কথা হজম করে ফেললাম। কারণ এর আগে এধরনের কথা একবার বলে বকা খেয়েছি। তিনি না জেতার কথা একদম পছন্দ করেন না। তিনি বলেন জেতার জন্যই লড়তে হবে। আগে থেকে হার মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকলে জেতা যায় না। কিন্তু সারাক্ষণ জিততে হবে জিততে হবে করতে থাকলে মনের উপর একটা আলাদা চাপ পড়ে না? কী জানি। মনের ব্যাপারে তাঁর অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে বেশি হবার কথা।

অনেকক্ষণ গল্পের পর আমজাদ স্যার চলে যাবার জন্য উঠলেন। রিফাৎ আরা ম্যাডাম আমাকে বললেন, “কিরণকে ফোন করতে হবে। গার্ডরুম থেকে করতে পারবেন। জেনে নিতে হবে পরশুদিন রেকর্ডিং ক’টায়। আর আমাদের কতটা পাস লাগবে সে-ব্যাপারেও কথা বলতে হবে।“

টেলিভিশন কেন্দ্রে ঢুকার জন্য পাস লাগে। আমাদের সাথে যতজন যাবে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা পাস লাগবে। কিরণ অর্থাৎ হাসান আহমেদ চৌধুরি কিরণ টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতার একজন কর্মকর্তা। তিনি বিতর্কের টিমের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন, আর সার্বিক ব্যবস্থা করেন। সেমিফাইনালের সময় কিরণ সাহেবের সাথে কথা বলেছি। এবারও বলতে হবে।

আমজাদ স্যারের সাথে রিফাৎ আরা ম্যাডামও নিচে নামলেন। নিচে দাঁড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর আমজাদ স্যারকে বিদায় দিয়ে ম্যাডাম উপরে উঠে গেলেন। আমি স্যারের সাথে গার্ডরুমের দিকে চললাম।

এখান থেকে গার্ডরুম বেশ কিছুটা দূরে। বড় বড় গাছের পাশে ইলেকট্রিক লাইটপোস্ট। সেই আলোতে গাছের ছায়া নড়ছে রাস্তায়। দূর থেকে দেখলাম গার্ডরুমের সামনে ডেকসি-মাথায় দাঁড়িয়ে আছে তিনজন মানুষ। এরা কি সেই তিনজন যাদেরকে আজ বিকেলে আসার সময় দেখেছিলাম? এই চার-পাঁচ ঘন্টা এক জায়গায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছেন? কী হয়েছে? আমজাদ স্যারের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গিয়েছি এতক্ষণ কথাবার্তা বলে। জিজ্ঞেস করলাম, “এদের কী হয়েছে?”

“এদেরকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।“

“কেন? এরা কারা?”

“মাথার উপর ডেকসি আছে। বুঝা যাচ্ছে মেসের কুক। হয়তো রান্না ভালো হয়নি। কোন কোন অফিসার আছেন – খুব বদমেজাজি। রান্না পছন্দ না হলে যে রেঁধেছে তাকে শাস্তি দেয়। একদম রাস্তায় এনে এভাবে দাঁড় করিয়ে রাখে।“

আমার হঠাৎ খুব খারাপ লাগতে শুরু করেছে। এরকম অপমানজনক শাস্তি কেন পেতে হবে কাউকে? শুধুমাত্র রান্না ভালো হয়নি এ অপরাধে? রান্না ভালো-খারাপের তো কোন বস্তুনিষ্ঠ মাপকাঠি নেই। এটা তো পুরোটাই ব্যক্তিনির্ভর। অন্যের কাছে যে রান্না অখাদ্য, আমার কাছে হয়তো সেটা অমৃততুল্য। আমজাদ স্যারকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, “এই শাস্তি কতক্ষণ চলবে?”

“কোন টাইম লিমিট নেই। যিনি শাস্তি দিয়েছেন তিনি যদি তাদের চলে যেতে বলেন তাহলে শাস্তি শেষ। অথবা যিনি শাস্তি দিয়েছেন তাঁর চেয়ে উঁচু পদের কেউ এই শাস্তি রদ করতে পারবেন। আমি আসার সময় খবর নিয়েছি। এদের শাস্তি দিয়েছেন একজন উইং কমান্ডার। আমি তো এই শাস্তি রদ করতে পারবো না। এখন অন্য একজন উইং কমান্ডারও এদের চলে যেতে বলতে পারবে না। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কারণে পারবে না। এখন একজন গ্রুপ ক্যাপ্টেন যদি এদিকে এসে এদের দেখে দয়া হয় – তাহলে মাফ করে দিতে পারবেন।“

“আর যদি সারা রাত কোন বড় অফিসার এদিকে না আসেন? তাহলে এরা সারা রাত এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?”

“না, এতক্ষণ তো সাধারণত থাকে না। আসলে হয় কি – অফিসাররা শাস্তি দিয়ে চলে যান। তারপর হয়তো ভুলেই যান। গার্ডরুমে যারা থাকে তারা কিছুক্ষণ পর অফিসারকে ফোন করে মাফ করে দিতে বলে। তখন অফিসার মাফ করে দেন। এদের সঙ্গে গার্ডরুমে প্রভোস্ট বা এরকম যারা থাকে তাদের যদি ভালো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে শাস্তির মেয়াদ এভাবে লম্বা হয়ে যায়।“

গার্ডরুমের ফোন থেকে কিরণ সাহেবের নম্বরে ফোন করে জানা গেল কিরণ সাহেব এখনো বাসায় ফেরেননি। নম্বরটা কিরন সাহেবের বাসার। রাতে আরেকবার এসে ফোন করতে হবে।

আমজাদ স্যার গাড়ি পার্ক করেছিলেন গার্ড রুমের পাশে। তিনি গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন। আমি ফেরার সময় তাকিয়ে দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মানুষের দিকে। রাস্তার আলোতে তাদের ছায়া তাদের চেয়ে দীর্ঘ, তাদের চেয়ে শীর্ণ। তাদের মুখ শুকিয়ে গেছে – ক্ষুধায় তৃষ্ণায় যতটা, তার চেয়েও বেশি অপমানের লজ্জায়। উঁচু পদ পেলেই যারা নিচু পদের মানুষকে অপমান করতে আনন্দ পায় – তারা কেমন মানুষ!

>>>>>>>>>>>>> 

 

খস্‌খস শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। রিফাৎ আরা ম্যাডামের কড়া নির্দেশে রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে হয়েছে সবাইকে। জার্নি করে এসেছে সবাই, বিশ্রাম নেয়া দরকার। দশটায় রাতের খাবার খাওয়ার পর আরেকবার রিহার্সাল করা হয়েছে। তারপর ঘুম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। রুমে অন্ধকার। খসখস শব্দটা আসছে পাশের বিছানা থেকে। বুঝতে পারছি নাজমুল যথাসম্ভব নিশব্দে মশারি তুলে খাট থেকে নামলো। একটু পরে খুট করে শব্দ হলো। বাথরুমের লাইট জ্বললো। নাজমুল বাথরুমে ঢুকলো। আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার ঘুম ভেঙে গেলো। নাজমুল আবার বাথরুমে যাচ্ছে। অসুখ করলো নাকি নাজমুলের। হায় হায়। এখন আমার টেনশান হচ্ছে। একদিন পরেই রেকর্ডিং। অসুখ-বিসুখের কথা চিন্তা করে একদিন হাতে রেখে ঢাকায় এসেছি এবার। কিন্তু তিনজন বিতার্কিকের একজনও যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমাদের বিকল্প কোন বিতার্কিক নেই। কী উপায় হবে তখন? আমরা এই দিকটি কেন ভাবিনি? তিন জনের বদলে আমাদের তো ছয় জন রেডি করা উচিত ছিল।

নাজমুল একটু পরেই ফিরে এসেছে। চুপচাপ শুয়ে পড়লো। জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ঠিক আছো নাজমুল?”

“জ্বি না স্যার, খুব টেনশান হচ্ছে।“

“শুধু টেনশান হচ্ছে, নাকি আরো কিছু হচ্ছে?”

“আরো কিছু হচ্ছে স্যার।“

“তরল?”

“জ্বি স্যার।“

“ক’বার হলো?”

“তিন বার।“

প্রাথমিক কিছু ওষুধ-পত্র সাথে থাকার কথা। জিজ্ঞেস করলাম, “ওষুধ আছে?”

“জ্বি স্যার।“

“খেয়েছো?”

“না স্যার।“

“ওষুধ কি খাবার জন্য আছে, নাকি সাথে রাখার জন্য?”

“খাবার জন্য স্যার।“

“তাহলে খেয়ে ফেলো।“

মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে ছেলেটা। বাসায় থাকলে হয়তো সে তার মা-কে বলতো কেমন লাগছে। এখানে সংকোচের কারণে বলতে পারছে না কিছু। অতিরিক্ত টেনশানের কারণেই হয়তো নার্ভাস-ডায়রিয়া হয়ে গেছে। এর নার্ভাসনেস কাটাতে হবে। বিতর্ক যে শুধুমাত্র একটা খেলা এবং এই খেলায় হারজিত থাকবে। জিতলে যেমন সহজভাবে নিতে হয়, হারলেও সহজভাবে নিতে হবে। এই জাতীয় কথাবার্তা বললে কি কাজ হবে? নাকি এরকম দার্শনিক কথাবার্তা শুধুমাত্র হেরে যাবার পর বলতে হয়? এখন বললে হয়তো আরো নার্ভাস হয়ে পড়তে পারে। তার চেয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা যাক।

“ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা কত জানো নাজমুল?”

“এক কোটির উপরে হবে স্যার।“

“এই এক কোটি লোকের জন্য কয়টা টয়লেট আছে বলতে পারো?” – প্রশ্নটা করেই মনে হলো আবার টয়লেটের কথা মনে করিয়ে দেয়াটা কি উচিত হচ্ছে? মূল সমস্যা থেকে অন্যদিকে যাওয়া যে কত কঠিন।

একটু পরে নাজমুল ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু আমার চোখ থেকে ঘুম পালালো।

>>>>>>>>>>>>> 

পরেরদিন সারাদিন প্র্যাকটিসের পর প্র্যাকটিস চললো। পক্ষে বিপক্ষে যত যুক্তি আছে সব ঝালাই করা হলো। নির্ধারিত সময়ের এক সেকেন্ড বেশিও নয়, কমও নয় – এরকমভাবে প্রস্তুতি নেয়া হলো। সময় শেষ হয়ে যাবার ঘন্টা বাজার পরেও যদি কোন বক্তা বকতৃতা শেষ না করে তাহলেও নাকি নম্বর কাটা যায়।

নাজমুলের নার্ভাসনেস কেটে গেছে। আমার টেনশান অবশ্য এখনো কাটেনি। আমার টেনশান এরা তিনজন কাল পর্যন্ত সুস্থ থাকবে কি না। মাঝে মাঝে রীমাকেও খুব নার্ভাস মনে হচ্ছে। অবশ্য অন্তরা হাসি-খুশি স্বাভাবিক আছে।

সন্ধ্যাবেলা প্রিন্সিপাল স্যার এলেন। তিনি সকালের ট্রেনে চলে এসেছেন। আসার সময় অনেকগুলি ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছেন। সেখানে অনেকগুলো পৃষ্ঠায় দাগ দেয়া। বললেন ট্রেনে বসে পড়তে পড়তে যেটাই বিতর্কের কাজে লাগতে পারে বলে মনে হয়েছে – সেটাই দাগ দিয়ে রেখেছেন। কোন ব্যাপারে যে কতটা ফোকাস্‌ড আর সিনসিয়ার হওয়া যায় – তা প্রিন্সিপাল স্যারকে দেখে শেখার চেষ্টা করছি। তিনি জানালেন ওসি-অ্যাডমিন স্যারও এসেছেন। কাল টিভি ভবনে যাবেন। নাসির স্যার রাতের ট্রেনে রওনা দেবেন, সকালে এসে পৌঁছাবেন।

কালকেই ঠিক হয়ে যাবে – শাহীন কলেজ চ্যাম্পিয়ন না রানার্স আপ। আমি যে কোনটাতেই খুশি। কিন্তু ম্যাডামদের ভয়ে সেটা বলতে পারছি না। ম্যাডামরা চ্যাম্পিয়নের কমে খুশি হবেন বলে মনে হয় না।

>>>>>>>>>>> 

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বাসে করে আমরা রামপুরা টিভি ভবনে ঢুকে গেলাম। গেটে পাস রাখা ছিল। আমজাদ স্যার একজন উর্দিপরা প্রভোস্টকে দায়িত্ব দিয়েছেন নিরাপত্তা এবং শৃঙ্খলা সম্পর্কিত কাজকর্ম করার জন্য। আমাদের বাসভর্তি ঢাকা শাহীনের শিক্ষার্থী। তারা সারিবদ্ধভাবে প্যারেড করার মত শৃঙ্খলার সাথে টেলিভিশন ভবনের বিশাল মিলনায়তনে গিয়ে বসলো। ঢাকা শাহীনের শিক্ষকদের সাথে পরিচয় হলো। তাঁরা সবাই উদ্দীপ্ত। অন্য তিনটি শাহীন টেলিভিশন বিতর্কে খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি এখনো। তাই চট্টগ্রাম শাহীনের গর্বই এখন সম্মিলিত শাহীনের গর্ব। বিমান বাহিনীর অফিসারদের সরকারি গাড়ি একের পর এক টিভি ভবনে ঢুকেছে। অফিসাররা সবাই ইউনিফর্ম পরে এসেছেন। তাঁদের বুকে ঝুলছে তাঁদের কর্মে অর্জিত ধাতব মেডেল। প্রিন্সিপাল স্যার, নাসির স্যার, আর আমজাদ স্যার অফিসারদের কাছে গিয়ে অভ্যর্থনা করছেন। আমজাদ স্যারকে উচ্চতা ও গঠনের কারণে অমিতাভ বচ্চনের মত লাগছে। ইউনিফর্ম যে স্মার্ট মানুষকে আরো স্মার্ট করে তোলে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

আমরা টিচাররা স্টুডেন্টদের সামনের সারিতে বসেছি পাশাপাশি। আমাদের বিতার্কিকরা ভেতরে চলে গেছে। তাদেরকে মেক-আপ নিতে হয়। টিভি ক্যামেরাতে স্পষ্ট দেখানোর কিছু নিয়মকানুন মেনে মেক-আপ দেয়া হয়। স্টুডেন্টরা দুই হাত রেডি করে আছে হাত-তালি দেয়ার জন্য। সেমিফাইনালে আমাদের বিপক্ষে ছিল কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ। তখন তাদের অনেক স্টুডেন্ট এসেছিল। সেই স্টুডেন্টদের দেখেছি বিতর্কের স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে হাততালি প্র্যাকটিস করতে। স্ক্রিপ্টের কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় হাততালি দিতে হবে তা আগে থেকেই জেনে রেখেছিল তারা। হাততালি দিয়ে নাকি বিচারকদের প্রভাবিত করা যায়। আমার অবশ্য তা মনে হয় না। বিতর্কে অনেক সময় যুক্তির চেয়েও বাচনভঙ্গির কারণে হাততালি পায় অনেকে।

হলিক্রস কলেজের মেয়েরাও এসে হলের অর্ধেক দখল করে ফেলেছে। আজ শাহীন বনাম হলিক্রস। নির্দিষ্ট সময়ে মঞ্চে আলো জ্বললো। টেলিভিশন বিতর্কের পরিচিত মিউজিক বেজে উঠলো। সাধারণত তিন জন বিচারক থাকেন। আজ আছেন পাঁচ জন বিচারক। সবাই বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। আজকের সভাপতি বিজ্ঞানী আবদুল্লাহ আল্‌ মুতী শরফুদ্দীন। এই পদার্থবিজ্ঞানী যে আমার কেমন প্রিয় মানুষ তা বোঝাতে পারবো না। ক্লাস সিক্স সেভেন থেকে তাঁর লেখা বিজ্ঞানের বই পড়ছি।

একে একে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো আমাদের তিন বক্তাকে – সৈয়দ নাজমুল কবীর, নাজমুস সেহার অন্তরা, এবং দলনেতা তানজীবা সুলতানা রীমা। হলিক্রস কলেজের নাহিদ আক্তার, নবনীতা চৌধুরি এবং দলনেতা রেবেকা শফি।

বিতর্ক শুরু হলো। দুই দলই নিখুঁত বক্তৃতা করলো। কারা জিতবে কারা হারবে – তা এখন বিবেচ্য নয়। আমার মতে দুই দলই জিতে গেছে। বক্তৃতা শেষে সভাপতি তাঁর প্রস্তুতি নিয়ে আসা বক্তৃতা শেষ করার আগেই সাধারণত রেজাল্ট চলে আসে তাঁর হাতে। কিন্তু আল্‌ মুতী স্যার তাঁর কথা শেষ করলেন। আরো কয়েক মিনিট এটা ওটা বললেন। কিন্তু তখনো বিচারকরা রায় দিতে পারছেন না। সবাই উশখুস করছে। অফিসারদের মধ্যে অনেকেই বক্তৃতা শেষ হলেই চলে যাবেন বলেছিলেন। ওসি অ্যাডমিন সন্ধ্যার ট্রেনে চট্টগ্রামে ফিরে যাবেন বলেছিলেন। এখন তাঁর ট্রেন পাবার সম্ভাবনা আর নেই। কিন্তু তাতে তাঁর কিচ্ছু যায় আসে না। তিনি বসে আছেন উৎসুক হয়ে। প্রিন্সিপাল স্যার নিজের সিটে বসে ছটফট করছেন। নাসির স্যার আমার সামনের সারিতে ছিলেন। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, “তোমার কী মনে হয় প্রদীপ?”

“জানি না স্যার।“ – আমি নির্বিকার থাকার চেষ্টা করি।

“আমার মনে হচ্ছে আমরা জিতে গেছি। কেন মনে হচ্ছে আমি জানি না। তবে মনে হচ্ছে।“

নাসির স্যারের কথা শুনে রিফাৎ আরা ম্যাডাম বললেন, “আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক নাসির ভাই।“

নাসির স্যার স্বাভাবিক সময়ে ফুল-চন্দনকে খুব একটা পছন্দ করতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন ফুল-চন্দন নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালেন না।

স্টেজে পাঁচ বিচারক এবং দুজন হিসাব-রক্ষক ক্যালকুলেটর নিয়ে বসেছেন একটা টেবিলের চারপাশে। তার্কিকরা দুই দিকে পাথরের মূর্তির মত বসে আছে। সভাপতি আল্‌ মুতী স্যার নিজের আসন ছেড়ে চলে এসেছেন বিচারকদের টেবিলের কাছে। অবশেষে প্রায় আধঘন্টা পর আল্‌ মুতী স্যার নিজের আসনে ফিরে এলেন রেজাল্ট নিয়ে। এরপর তিনি কী বললেন আমি ঠিকমতো শুনতে পেলাম না। তাঁর কথা শেষ হবার আগেই নাসির স্যার হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে, “আমরা জিতে গেছি।“ এর কয়েক সেকেন্ড পরেই শাহীনের শিক্ষার্থীদের চিৎকার আর হাততালিতে হল ফেটে যাবার অবস্থা হলো। দেখলাম রিফাৎ আরা ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরে আছেন নাসরীন বানু ম্যাডাম। প্রিন্সিপাল স্যারকে জড়িয়ে ধরে আছেন ওসি-অ্যাডমিন স্যার। চিরগম্ভীর ওসি-অ্যাডমিন স্যার যে কাউকে এভাবে জড়িয়ে ধরতে পারেন – তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

আমরা সিট ছেড়ে একটু সামনে গেলাম। আমজাদ স্যার এসে আমার সাথে হ্যান্ডশেক করলেন, “কংগ্রাচুলেশান্স চ্যাম্পিয়ন।“

“থ্যাংক ইউ স্যার। ক্রেডিট গো্‌স টু আওয়ার স্টুডেন্টস অ্যান্ড ম্যাডামস।“

প্রিন্সিপাল স্যার হ্যান্ডশেক করলেন। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে ওসি-অ্যাডমিন আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “কনগ্রাচুলেশানস মিস্টার ফিজিক্স।“

“থ্যাংক ইউ স্যার।“ – আমাকে যে উনি ফিজিক্স হিসেবে মনে রেখেছেন সেটাও কম কিসের।

স্টেজের দিকে তাকালাম। আমাদের বিতার্কিকরা পারলে উড়ে চলে আসে আমাদের দিকে। রীমা, অন্তরা, নাজমুল ছুটে এসে রিফাৎ আরা ম্যাডাম আর নাসরীন ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলো। আনন্দের কান্নায় বাতাস ভারী হয় না কখনো। আমার খুব হাল্‌কা লাগছে।

মঞ্চে আবারো ঘোষণা করা হচ্ছে – ১৯৯৪ সালের জাতীয় টেলিভিশন স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বি এ এফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রাম।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts