Tuesday 21 July 2020

সত্যেন্দ্রনাথ বসু - পর্ব ২



সত্যেন্দ্রনাথ বসু: বোসন কণার জনক

দ্বিতীয় অধ্যায়

শৈশব কৈশোর

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম ১৮৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি, কলকাতায়। এক সময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। আঠারো শতকের শেষার্ধ থেকে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। সেই সময় কলকাতার উচ্চবিত্তরা আস্তে আস্তে ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এসব ভারতীয়দের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে শুরু করেন এবং স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে শুরু করেন। উনবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও দেশাত্মবোধের উন্মেষ ঘটে বাঙালিদের মধ্যে। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পিতামহ অম্বিকাচরণ বসু ছিলেন প্রথম প্রজন্মের ইংরেজি-শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি। তাঁদের পূর্বপুরুষরা দু'শ বছর ধরে নদীয়ার বাসিন্দা। নদীয়া থেকে কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন অম্বিকাচরণের পিতামহ। সত্যেন্দ্রনাথ বসুদের কলকাতার ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৮১৭ সালে। অর্থাৎ সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ঠাকুরদার ঠাকুরদার আমল থেকে তাঁরা কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা।

          অম্বিকাচরণ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ ভারত সরকারের মিলিটারির খাদ্য সরবরাহ দপ্তরের হিসাবরক্ষণ অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর পোস্টিং ছিল মীরাটে। তাঁর বড় ছেলে সুরেন্দ্রনাথ মীরাট সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশান পাস করে হুগলি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। সেই সময় অম্বিকাচরণ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। খবর পেয়ে মীরাটে ছুটে এলেন সুরেন্দ্রনাথ। অম্বিকাচরণ মারা যান তার আগেই। সুরেন্দ্রনাথের বয়স তখন মাত্র ১৮। অনেক দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। মীরাট থেকে সবাইকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেও ঈশ্বর মিল লেনের নিজেদের বাড়িতে উঠা গেল না। কারণ সেই বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল এবং ভাড়াটেরা কেউই বাড়ি খালি করতে রাজি ছিল না। বাধ্য হয়ে জোড়াবাগান এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে হলো তাদের যতদিন নিজেদের বাড়ি থেকে ভাড়াটেরা চলে যায়। 

            সুরেন্দ্রনাথ খুব কর্মঠ এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে নিজেকেও তৈরি করলেন। অ্যাকাউন্টেন্সি পাস করলেন। তারপর চাকরি শুরু করলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের হিসাবরক্ষণ অফিসে কেরানি হিসেবে কাজ শুরু করে অনেকদূর পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন তিনি। রেলওয়ের চাকরিতে তাঁকে আসাম ও উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। বাইশ বছর বয়সে বিয়ে করেন আলিপুর কোর্টের নামকরা উকিল মতিলাল রায়চৌধুরির মেয়ে আমোদিনীকে। সুরেন্দ্রনাথ ও আমোদিনীর প্রথম সন্তান সত্যেন্দ্রনাথ বসু - জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি।

 

চিত্র: কলকাতার ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেনের এই বাড়িতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এই বাড়িটি তৈরি হয়েছিল ১৮১৭ সালে। তারপর ১৯২৪ সালে এই বাড়ির ব্যাপক সংস্কার করা হয়। সত্যেন বসু জীবনের বেশিরভাগ সময় এই বাড়িতেই বাস করেছেন। তাঁর পরবর্তী বংশধররাও এখনো এই বাড়িতেই থাকেন।


চিত্র : সত্যেন বসুদের বাড়ির ভেতরের একটি অংশ



বাবা সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মিল রেখে আদরের বড় সন্তানের নাম সত্যেন্দ্রনাথ রাখা হলেও সুরেন্দ্রনাথ ছেলেকে ডাকতেন 'বদি' বলে। ডাকনাম বৈদ্যনাথ থেকে বদি। সত্যেন্দ্রনাথের পরে পর পর ছয়টি কন্যাসন্তান হয় তাঁদের। একমাত্র ছেলে বলে সত্যেন্দ্রনাথ স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি আদরে মানুষ হয়েছেন। সেই সময় বাঙালি পরিবারে বাবার সাথে সন্তানদের একটা দূরত্ব থাকতো। মায়ের সাথে যতখুশি আবদার করতে পারলেও অনেকে বড় হবার পরও বাবার সাথে সরাসরি কথা বলতেও ভয় পেতো। সত্যেন্দ্রনাথও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। সুরেন্দ্রনাথ নব্বই বছর বয়সেও ছেলেকে যখন  চিৎকার করে ডাকতেন - বদি বদি, তখন ৬৬ বছর বয়সী ভারতের জাতীয় অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ওরফে বদি ভয়ে কাঁপতেন।

 

চিত্র: শেষ বয়সে সত্যেন বসুর বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসু


সেই যুগের বাঙালি বাবারা অন্য সবার সাথে যেরকমই হোন নিজের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে খুব গম্ভীর এবং কড়া হতেন। সুরেন্দ্রনাথও ছিলেন সেরকম। তিনি সুশিক্ষিত কর্মযোগী মানুষ। সেই ১৯০১ সালে তিনি তাঁর বন্ধু সতীশচন্দ্র ব্রহ্মর সাথে যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাঙালিদের প্রথম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি - 'ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্ক্স'। এই রাসায়নিক কারখানা থেকে অর্থনৈতিকভাবে তেমন কোন লাভ না হলেও তিনি ভারতবর্ষে শিল্পোদ্যোগের ইতিহাস রচনা করেছিলেন।

 

চিত্রসত্যেন বসুর মা আমোদিনী বসু


সেই যুগে খুব কম বয়সেই ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যেতো। ছেলেরা তবু লেখাপড়া করতো। কিন্তু মা-বাবার সঙ্গতি থাকলেও মেয়েদের লেখাপড়ায় উৎসাহ দেয়া হতো না। সত্যেন বসুর মা আমোদিনীর বাবা ছিলেন আলিপুর কোর্টের নামকরা উকিল মতিলাল রায়চৌধুরি। কত বিখ্যাত মানুষের আসা-যাওয়া ছিল তাদের বাড়িতে। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মতিলালের সহপাঠী, নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র ছিলেন তাঁর বন্ধু। এতকিছু থাকার পরেও বর্ণমালা শেখার বেশি লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি আমোদিনীর। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়ে তেরো বছর বয়সেই মা হয়েছেন। নিজের ছয়টি মেয়েরও লেখাপড়া তেমন হয়নি সামাজিক এবং পারিবারিক বিধিনিষেধের কারণে। তাঁর সব গর্ব ছেলে সত্যেনকে নিয়ে।

          মায়ের আদরে আর ছোট বোনদের সেবাযত্নে সত্যেন বসুর শৈশব ছিল বেশ নিরুপদ্রব এবং নির্বিঘ্ন; বলা চলে ঘটনাবিহীন। একান্নবর্তী বড় পরিবারে ছেলের সংখ্যা কম থাকাতে সত্যেন বসুর ছেলেবেলা কেটেছে বেশ আরাম-আয়েশের মধ্যে। ছোট বেলায় কোন কিছুই তাঁকে কষ্ট করে পেতে হয়নি। তাই বড় হওয়ার পরেও কোন কিছুর জন্যই তার কোন উৎকন্ঠা বা তাড়া দেখা যায়নি কোনদিন।

          পাঁচ বছর বয়সে ১৮৯৯ সালে সত্যেন্দ্রনাথের স্কুলজীবন শুরু হয়। প্রথম স্কুল - বাড়ির কাছের নরমাল স্কুল। এই স্কুলটা বেশ ভালো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কুলজীবনও শুরু হয়েছিল এখানে। কয়েক বছর এই স্কুলে পড়ার পর সত্যেন্দ্রনাথকে ভর্তি করানো হলো আরেকটি নামকরা স্কুল - নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। এই স্কুলের হেডমাস্টার ক্ষুদিরাম বসুর বেশ সুনাম ছিল লেখাপড়ার মান উন্নয়নে তাঁর ভূমিকার জন্য। লেখাপড়ায় সত্যেন বসু অত্যন্ত ভালো। গণিতে এত ভালো যে শিক্ষকরা অবাক হয়ে যান তার মেধা ও গাণিতিক দক্ষতায়। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ চাচ্ছেন ছেলের মেধা যেন আরো বিকশিত হয়। চ্যালেঞ্জ না থাকলে, কঠিন প্রতিযোগিতা না থাকলে মেধার বিকাশে ফাঁক থেকে যায়। এই চিন্তা থেকে সত্যেন বসুকে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করানো হলো হিন্দু স্কুলে ক্লাস টেন-এ ১৯০৮ সালে।

          হিন্দুস্কুল ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত স্কুল। ভারতবর্ষে আধুনিক ইংরজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজা রামমোহন রায় ও ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ। ভারতে আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় হিন্দু কলেজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। কলেজের স্কুল সেকশানটাই ছিল হিন্দু স্কুল। ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় কলেজটিকে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার। তখন থেকে হিন্দু কলেজের কলেজ অংশ রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি কলেজে, আর স্কুল অংশ রয়ে যায় হিন্দু স্কুল নামে। সত্যেন বসু যখন হিন্দু স্কুলে ভর্তি হন, তখন তার হেডমাস্টার ছিলেন রসময় মিত্র। তখনকার সময়ে ইংরেজি গ্রামারের শিক্ষক হিসেবে রসময় মিত্রের তুলনা ছিল না। তাঁর লেখা ইংলিশ কম্পোজিশান, গ্রামার অ্যান্ড ট্রান্সলেশান বইটি তখনকার যুগের সবচেয়ে ভালো বই। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরাও ছিলেন বিখ্যাত।

          বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন শরৎচন্দ্র শাস্ত্রী। তিনি ছাত্রদের বাংলা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তুলতেন। সত্যেন বসু ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী। প্রচুর বই পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতা ছিল তাঁর মুখস্থ। মূল সংস্কৃত ভাষায় 'কালিদাস' মুখস্থ ছিল তাঁর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের সব লেখা তিনি পড়ে ফেলেছিলেন সেই সময়।

          হিন্দু স্কুলের গণিতের শিক্ষক ছিলেন উপেন্দ্রনাথ বক্‌শি। ছাত্রদের ভেতর প্রতিভা থাকলে তিনি তা খুঁজে বের করতে পারতেন। সত্যেন বসুর গাণিতিক দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। এক পরীক্ষায় সত্যেনকে তিনি ১০০ নম্বরের মধ্যে ১১০ নম্বর দিয়েছিলেন। সত্যেন সব অংকই শুদ্ধ করে ছিলেন। যতটা অংক করা দরকার তার চেয়ে বেশি করেছিলেন সত্যেন। জ্যামিতির এক্সট্রা সমস্যার সমাধান করেছিলেন বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে। সবগুলোই শুদ্ধ। বক্‌শি স্যার খুশি হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সত্যেন একদিন মস্তবড় গণিতজ্ঞ হবেন - ল্যাপ্লাস[1] কিংবা কচির[2] মত।

          স্কুলের সহপাঠীদের সবার সাথেই সদ্ভাব ছিল সত্যেনের। তবে খুব বেশি মাখামাখি বা ঘনিষ্ঠতা ছিল হাতেগোনা কয়েকজনের সাথে। হিন্দু স্কুলের সব ছাত্রই কলকাতার বনেদী ঘরের ছেলে। তাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে কয়েকজনের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল সত্যেন বসুর।

          ১৯০৮ সালে মাধ্যমিক (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় বসার কথা ছিল সত্যেন বসুর। কিন্তু পরীক্ষার ঠিক দু'দিন আগে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে তার আর পরীক্ষা দেয়া হলো না। একটা বছর নষ্ট হলো তার। পরের বছর ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিলেন সত্যেন। মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান অধিকার করলেন তিনি। তাদের সাথে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন তাদের স্কুলেরই ছাত্র চন্ডিদাস ভট্টাচার্য। কিন্তু পরের বছর চন্ডিদাস ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয় দুরারোগ্য অসুখে।

          এবার উচ্চমাধ্যমিক কলেজ। কলকাতার সবচেয়ে ভালো কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন সত্যেন বসু ১৯০৯ সালে।



[1] ফরাসি গণিতজ্ঞ পিয়ের-সাইমন ল্যাপ্লাস (২৩/৩/১৭৪৯ - ৫/৩/১৮২৭)। গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে ল্যাপ্লাসের সমীকরণ ও ল্যাপ্লাস ট্রান্সফর্ম খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

[2]  ফরাসি গণিতজ্ঞ অগাস্টিন-লুই কচি (২১/৮/১৭৮৯ - ২৩/৫/১৮৫৭)।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts