Monday 4 June 2018

প্রসঙ্গ: আবুল বাজানদার


কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ব্যাপারে আমাদের মত কৃপণ আর কোন দেশে আছে কি না আমি জানি না। যদি কেউ আমাদের দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আমাদের উপকার করে্ন - আমরা শুরুতে কেঁদেকেটে চিৎকার করে তাঁর গুণগান করি। তারপর যখন তাঁর কাছ থেকে উপকার নেয়াটা আমাদের নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় – তখন আমরা আস্তে আস্তে বদলে যেতে থাকি। কৃতজ্ঞতার ভার আমরা সইতে পারি না। এই ভার কমানোর জন্য আমরা গভীর মনোযোগে উপকারীর উপকারের পেছনে কী উদ্দেশ্য আছে তা বের করার চেষ্টা করি। তেমন কোনকিছু খুঁজে না পেলে যে কোন ছুতোয় তাঁর বদনাম করতে শুরু করি।

বাংলাদেশের ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আচরণের ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। ডাক্তাররা দিনরাত পরিশ্রম করে চিকিৎসা দিয়ে রোগীদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। আর রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে ডাক্তারদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে শুরু করেন। রোগী যত বলেন, রোগীর আত্মীয়স্বজন বলেন তার দশগুণ। সুস্থ থাকার জন্য ডাক্তাররা রোগীকে যেভাবে জীবন-যাপন করতে বলেন, যেভাবে ওষুধ খেতে বলেন তা সেভাবে না মেনে – ডাক্তারের ওপর ডাক্তারি করতে করতে যখন অসুখের ডালপালা গজিয়ে ফেলেন – আবার ডাক্তারের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেন। আর ‘কসাই’ ডাক্তাররা আবার সেই রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে ভালো করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

ডাক্তারদের ব্যাপারে কতটুকু অকৃতজ্ঞ হওয়া যায় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আবুল বাজানদার – যাঁকে বৃক্ষমানব নামে চেনেন বাংলাদেশের মানুষ। আবুল বাজানদার Epidermodysplasia verruciformis (EV) বা Tree syndrome-এ আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন। আবুল বাজানদারের দুই হাতের ত্বকে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়ে গাছের ঝোপের মতো হয়ে গিয়েছিল  সারা পৃথিবীতে বিরল এই রোগের এখনো কোন সুনির্দিষ্ট নিরাময়ের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি।



চিকিৎসার আগে আবুল বাজানদার



ডাক্তার সামন্তলাল সেন এবং তাঁর ইউনিটের একদল বাংলাদেশি ডাক্তার গত আড়াই বছর ধরে অবিরাম চিকিৎসা দিয়েছেন আবুল বাজানদারকে। হাতে-পায়ে ২৪টি অস্ত্রোপচার করে তাঁকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছিলেন আমাদের ডাক্তাররা। এই রোগ জিনেটিক কিনা পরীক্ষা করার জন্য তার রক্ত ও অন্যান্য উপাদান দেশের বাইরে পাঠিয়ে পরীক্ষা করে আনিয়েছেন ডাক্তাররা। হাসপাতালে শুধুমাত্র আবুল বাজানদারের চিকিৎসার কাজে ব্যবহারের জন্য আলাদা যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করেছেন। আবুল বাজানদারের চিকিৎসার অগ্রগতি নিয়ে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রশংসা করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন মেডিক্যাল নিউজে। 


অনেকগুলো অপারেশন ও সমন্বিত চিকিৎসার পর আবুল বাজানদার 


অথচ আমরা কী দেখলাম? আমরা দেখলাম আবুল বাজানদার হাসপাতাল থেকে কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন। অর্থাৎ পালিয়ে গেলেন। তাঁকে কেউ বেঁধে রাখেননি হাসপাতালে। কিন্তু তিনি চলে গিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের লোকদের বলতে শুরু করলেন – হাসপাতালে তাঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন ডাক্তাররা। বিবিসি বাংলায় আবুল বাজানদারের বলা কথা শুনলাম। সেখানে আবুল বাজানদার বললেন যে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানের জন্য প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে খাবার দেয়া হতো। আড়াই বছর ধরে চলেছে সেরকম। কিন্তু চারজনের খাবার নাকি আর দেয়া হবে না বলা হয়েছে তাকে। তাই তিনি চলে গেছেন।

হাসপাতালে রোগী ছাড়া আর কাউকে খাবার দেয়ার নিয়ম নেই। ডাক্তার সামন্তলাল সেন নিজের পকেট থেকে পয়সা দিয়ে গত আড়াই বছর ধরে আবুল বাজানদারের স্ত্রী ও সন্তানদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। হাসপাতালের মোটা চালের ভাত আবুল বাজানদার খেতে পারতেন না – তাই তাদের জন্য ডাক্তারদের ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে এনে দেয়া হতো। আবুল বাজানদার তাঁর থাকার ক্যাবিন নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন ক্যাবিনে এসি ছিল না – তাই তাঁর কষ্ট হয়েছে।

আমাদের ডাক্তাররা তাঁর জন্য যা যা করেছেন – আমি জানি না আর কোনদেশে কোন রোগীর জন্য ডাক্তাররা ব্যক্তিগতভাবে তেমন কিছু করেন কি না। উন্নত দেশে শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে আয়কর দিতে হয় মোট আয়ের কমপক্ষে তিন থেকে চার পারসেন্ট। জনগণের দেয়া সেই টাকায় চিকিৎসার বাজেট হয়। একজন স্পেশালিস্টের প্রতি পনেরো মিনিটের ফি হলো কমপক্ষে আড়াইশ ডলার। আর আমাদের দেশের স্পেশালিস্টরা যে রোগীকে এবং রোগীর পরিবারকে নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে মুখে খাবার পর্যন্ত তুলে দেন – সেই রোগী হাসপাতাল ছেড়ে গিয়ে সেই ডাক্তারদের বদনাম করেন।

এতকিছুর পরেও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই – এই আবুল বাজানদার যখন আবার এসে হাসপাতালে ভর্তি হবেন – আমাদের ডাক্তাররা সবকিছু ভুলে গিয়ে চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে দেবেন পরম মমতায় কসাই না হলে কি এমন করতেন!!


চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে  আবুল বাজানদারের অভিযোগ সম্পর্কে চিকিৎসকদের বক্তব্য পড়ুন এখানে:
http://www.banglatribune.com/others/news/330359/



No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts