Thursday 7 June 2018

আতঙ্কিত মালাউন


বাংলাদেশের হিন্দুরা ঠিক কী রকমের আতঙ্কে দিন কাটান তা তাঁদের একজন না হলে ঠিকমতো বুঝতে পারা সম্ভব নয়। সংবেদনশীল বিবেকবান মানুষ সহানুভূতি অনুভব করবেন ঠিকই - কিন্তু সামান্য হলেও বোধের তারতম্য একটু থাকবেই।

বাংলাদেশের হিন্দুরা 'মালাউন' শব্দের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত। কারণ জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে তাঁদের এই শব্দটা শুনতে হয় এবং বেশির ভাগ সময় শুনে হজম করে ফেলতে হয়। প্রতিকারের অক্ষমতা মানুষকে প্রতিবাদে নিরুৎসাহিত করে। ক্ষমতাহীন মানুষ 'মাইন্ড' করলেও কারো কিছু যায় আসে না। ফলে হিন্দুদের মালাউন বললে এখন আর তাঁদের 'মাইন্ড' করার উপায় নেই।

বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের পরিমার্জিত সংস্করণের ৯৮১ পৃষ্ঠায় মালাউন শব্দের তিনটি অর্থ দেয়া আছে। ১. লানতপ্রাপ্ত; অভিশপ্ত; বিতাড়িত; কাফের। ২. শয়তান। ৩. মুসলমান কর্তৃক ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোককে দেয় গালিবিশেষ। লানত শব্দের অর্থ নিয়ে সমস্যায় ছিলাম। অভিধানের ১০৫৪ পৃষ্ঠায় সে সমস্যার সমাধান মিললো। লানত শব্দেরও তিনটা অর্থ দেয়া আছে। ১. অভিশাপ। ২. অপমান; লাঞ্ছনা; ভর্ৎসনা। ৩. শাস্তি।

মনে হচ্ছে মালাউন শব্দের অর্থের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার চলছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের হিন্দুরা প্রতিদিনই বুঝতে পারছে বাংলাদেশে হিন্দু হয়ে জন্মনেয়াটা অভিশাপের শামিল, প্রতিদিনই তাঁদের কোন না কোনভাবে অপমানিত হতে হয়। অপরাধ না করলেও শাস্তি পেতে হয় - মালাউন হওয়ার চেয়ে বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?





ছবিতে যে অপমানিত লাঞ্ছিত ক্রন্দনরত প্রাণভয়ে পলায়নরত মানুষগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন তাঁদের অপরাধ কী? অপরাধ একটাই - তাঁরা সবাই হিন্দু। এই মানুষগুলোর কেউই পাঁচই জানুয়ারির নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেননি, নির্বাচন প্রতিহত করার 'জেহাদ'-এও অংশ নেননি। হিন্দুর ঘরে জন্মনেয়ার ব্যাপারেও তাঁদের নিজেদের কোন হাত ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নাকি লেখা আছে - মানুষের ভাগ্যে কী ঘটবে তা পূর্ব-নির্ধারিত। তাই কি এঁদের সারাজীবনের তিল তিল করে গড়ে তোলা আশ্রয়টুকুরও এই অবস্থা করে দেয়া যায়?





আমি জানি উপরের দুটো ছবির বিষয়বস্তুর সাথে আমার মতো আরো অনেকেরই অনেকদিনের পরিচয়। ১৯৭১ সালে আমাদের গ্রামে এই ছবিটা তোলা হলে এই অসহায় মানুষগুলোর ভীড়ে আমার বাবার আতঙ্কিত মুখও দেখা যেতো। দেখা যেতো তাঁর শিশুসন্তানদের কোলে পিঠে নিয়ে যাত্রা করেছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। লক্ষ্য একটাই কীভাবে বাঁচাবেন নিজের সন্তানদের প্রাণ। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এই বাড়িটার সাথে আমাদের বাড়ির পোড়া-ছাইয়ে কোন পার্থক্য নেই। কেবল পার্থক্য সময়ের - ১৯৭১ থেকে ২০১৪

১৯৭১-এ শত আতঙ্কের মধ্যেও একটা স্বপ্ন ছিল - একদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। সেই স্বপ্নে মানুষ কষ্টকে কষ্ট মনে করেননি। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও যখন বারবার অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর, কিসের স্বপ্ন দেখবে আজকের আতঙ্কিত হিন্দুরা?

বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবীর উর্বর ক্ষেত্র। এইদেশে কাজের মানুষ নেই - কিন্তু কথা বলার মানুষের অভাব নেই। যে কোন বিষয়েই বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণে কান ঝালাপালা করে দেয়ার মানুষের অভাব নেই - কিন্তু সেই বিশ্লেষণ আতঙ্ক বাড়াতে হয়তো কিছুটা সহায়তা করে - কিন্তু হিন্দুদের আতঙ্ক কমাতে পারে না কিছুতেই।

রাউজানের ফজলুল কাদের চৌধুরি তাঁর এলাকার হিন্দুদের তুলনা করতেন তাঁর পুকুরের মাছের সাথে - যেগুলো তাঁর পুকুরে ভীষণ নিরাপদে স্বাধীনভাবে বাস করে। সালাহ্‌উদ্দিন কাদের চৌধুরিও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাঁর আব্বার কথাগুলোই বলতেন। তাঁরাই এলাকার হিন্দুদের রক্ষাকর্তা! বাংলাদেশের প্রত্যেকটি এলাকাতেই এরকম কিছু  রক্ষাকর্তা জন্মেছেন বা বেড়ে উঠেছেন গত ৪২ বছরে। বাংলাদেশের হিন্দুরা এখন এসব রক্ষাকর্তার পুকুরের মাছ। প্রাণভয়ে আক্ষরিক অর্থেই পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গলা ডুবিয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশের আতঙ্কিত হিন্দুদের।

এখন অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় প্রভাবশালী মুসলমানরা বলতে শুরু করেছেন তাঁরা হিন্দুদের রক্ষা করবেন। এই বীরেরা অবশ্যই আতঙ্কিত হিন্দুদের রক্ষা করবেন। বার্টোল্ট ব্রাখ্‌টের গ্যালিলিও নাটকের দুটো সংলাপ মনে হয় প্রাসঙ্গিক মনে হবে এখানে:

- দুর্ভাগা সেই জাতি যে জাতি বীরের মর্যাদা দিতে জানে না।
- না, দুর্ভাগা সেই জাতি যে জাতির বীরের প্রয়োজন হয়।

আমাদের সকল কাজেই বীরের দরকার হয় এবং আমরা বীরের মর্যাদা দিতে জানি না।

ধর্মীয় বিভাজন যতদিন থাকবে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা 'মালাউন' হয়েই থাকবে। তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকবে এবং তাদের ওপর সংখ্যাগুরুদের অত্যাচার ক্রমশ বাড়তে থাকবে। তারপরেও মাঝে মাঝে তারা কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে - যেমন পুকুরের মাছেরা স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। 


2 comments:

  1. মনে তো হয় না বর্তমান বিশ্বে প্রকৃত অর্থেই কোনো অসাম্প্রদায়িক দেশ আছে!!! ওপরে যদিও সবাই অসাম্প্রদায়িকতার ভাব ধরে থাকে, ভেতরে ভেতরে কেউ কারোর চেয়ে কম সাম্প্রদায়িক না!!! পাশের দেশগুলোর দিকেই দেখেন না, কতটা অসাম্প্রদায়িক (!) তারা? প্রত্যেকটা মানুষই সাম্প্রদায়িক ( কেউ ধর্মের দিক থেকে, কেউ অধর্মের দিক থেকে, কেউ বর্ণের দিক থেকে, কেউ অর্থের দিক থেকে) এখানকার কিছু জ্ঞানী-মহান ব্যক্তিগণ যেমন হিন্দুদের "মালাউন" বলে, তাদের ঘরবাড়ি পোড়ায়, তেমনি পাশের দেশের কিছু জ্ঞানী-মহান ব্যক্তিগণ মুসলিমদের দিয়ে "জয় শ্রীরাম" বলান, গো মাংস বহনের অপরাধে হত্যা করেন!! পশ্চিমে গেলে পশ্চিমের এলিট সভ্য লোকেরা আপনাকে ভালোবেসে নিগা ডাকবে :) :) ।। অনেক সময় কেউ আরও ভালোবাসা দেখাতে আপনার গায়ে হাত দেবে, আপনার হাতঘড়িটাও তাদের কাছে আতঙ্কের টাইম বোমা হবে!!! সেই তুলনায় এই বঙ্গদেশ অনেক অসাম্প্রদায়িক :) :) এখানে একমাত্র বিয়ের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক আচরণ দেখা যায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে "অর্থ" আর মেয়েদের ক্ষেত্রে "বর্ণ" এবং অবশ্যই ছেলে-মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই "ধর্ম"।। বাদ বাকি অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানকার মানুষ অনেক সহনশীল।। একটা লাইন পড়ে বেশ হাসি পেলো - ধর্মীয় বিভাজন যতদিন থাকবে বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা 'মালাউন' হয়েই থাকবে!!! এ কিভাবে সম্ভব??? মোহাম্মদ আলীকে চেনেন তো দাদা? শুরুতে উনার সাথে কিন্তু বাকি আমেরিকানদের ধর্মীয় বিভাজন ছিলো না!! বর্ণ বিভাজন ছিলো।। শুধু ধর্ম বিভাজন থাকলেই "মালাউন" শুনতে হবে, এটা কোনো যৌক্তিক কথা না।। বর্ণ বিভাজন থাকলে "নিগা" শুনবেন!! কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের কাউকে গালি দিতে বলে নাই।। বরং মানুষ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে।। সবাই যদি প্রকৃতই ধার্মিক হতো, সবাই সৌহার্দ্যের সাথেই থাকতে পারতো :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সম্প্রদায় থাকলে সাম্প্রদায়িকতা থাকবেই। বিভিন্ন সম্পরদায়ের মধ্যে বিভাজন থাকবে। কিন্তু বিভাজন যখন বিদ্বেষে পরিণত হয় তখনই সমস্যা দেখা দেয়।

      Delete

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts