Wednesday 6 June 2018

বিয়ের ভোজ ও অন্যান্য


রবীন্দ্রনাথ যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞগল্পটি লিখেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে। কিন্তু যতবারই পড়ি মনে হয় গল্পটি এখনো সাম্প্রতিক, মনে হয় আমাদের সমাজ এবং সমাজের মানুষ একশ বছরেও বদলায়নি খুব একটা। 

গল্পটি শুরু হয়েছে এভাবে- এক সময় যজ্ঞেশ্বরের অবস্থা ভালোই ছিল। এখন প্রাচীন ভাঙা কোঠাবাড়িটাকে সাপ-ব্যাঙ-বাদুড়ের হস্তে সমর্পণ করিয়া খোড়ো ঘরে ভগবদ্‌গীতা লইয়া কালযাপন করিতেছেন। যজ্ঞেশ্বরের মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছিল। নিজের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা যজ্ঞেশ্বর জানেন। তাই ধনীর ঘরে তার মেয়ের বিয়ে হবে এমন আশা করেন নি। কিন্তু কমলাকে দেখে পছন্দ করে ফেলে জমিদার গৌরসুন্দর চৌধুরির ছেলে বিভূতিভূষণ। অশিক্ষিত জমিদার শিক্ষিত ছেলের মতের বিরুদ্ধে যেতে পারলেন না, দায়ে পড়িয়া মত দিলেন, কিন্তু মনে মনে যজ্ঞেশ্বরের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। দুপক্ষে কথাবার্তা শুরু হলো। কিন্তু বিয়ে কোথায় হবে তা নিয়ে মহা হৈ চৈ।। জমিদার ছেলের বিয়েতে ধুমধাম করতে চান, কিন্তু গরীব যজ্ঞেশ্বরের সামর্থ্য কোথায় যে ধুমধাম করবে? তারপরও পুত্রের জেদের কারণে কন্যার বাড়িতেই যখন বিয়ের অনুষ্ঠান হবে ঠিক হলো গৌরসুন্দর এং তাঁহার দলবল কন্যাকর্তার উপর আরও চটিয়া গেলেন। সকলেই স্থির করিলেন, স্পর্ধিত দরিদ্রকে অপদস্থ করিতে হইবে। বরযাত্রী যাহা জোটানো হইল তাহা পল্টনবিশেষ। বিয়ের দুদিন থেকে প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো। বরযাত্রীগণ ভিজিয়া, কাদা মাখিয়া, বিধিবিড়ম্বনার প্রতিশোধ কন্যাকর্তার উপর তুলিবে বলিয়া মনে মনে স্থির করিয়া রাখিল। হতভাগ্য যজ্ঞেশ্বরকে এই অসাময়িক বৃষ্টির জন্য জবাবদিহি করিতে হইবে। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টিতে যজ্ঞেশ্বরের সমস্ত আয়োজন নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বরযাত্রীরা তা বুঝবেন কেন? তারা যজ্ঞেশ্বরের দুর্গতিতে মনে মনে খুশি হলেন, এবং প্রকাশ্যে রেগে গিয়ে মহা হাঙ্গামা শুরু করলেন। যজ্ঞেশ্বরের প্রতিবেশীরা যজ্ঞেশ্বরের বিপদে এগিয়ে এসে প্রচুর ছানার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু বরযাত্রীরা তাতে সন্তুষ্ট হলেন না। যজ্ঞেশ্বর যেমন-যেমন পাতে ছানা দিয়া যাইতে লাগিলেন তৎক্ষণাৎ বরযাত্রীগণ তাহা কাঁধ ডিঙাইয়া পশ্চাতে কাদার মধ্যে টপ্‌টপ্‌ করিয়া ফেলিয়া দিতে লাগিল। উপায়বিহীন যজ্ঞেশ্বরের চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল। বারম্বার সকলের কাছে জোড়হাত করিতে লাগিলেন; কহিলেন, আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই। একজন শুষ্কহাস্য হাসিয়া উত্তর করিল, মেয়ের বাপ তো বটেন, সে অপরাধ যায় কোথায়
          
গত একশ বছরেরও আমাদের সামাজিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে কি? মেয়ের বাপ হওয়ার অপরাধে এখনো অনেককেই কত রকম গঞ্জনা সহ্য করতে হয় মেয়ের বিয়ের ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে। যজ্ঞেশ্বর মেয়ের বর গৌরসুন্দরের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সামলেছিলেন সেদিন। কিন্তু এখনকার বেশির ভাগ বর ভোজের আয়োজনে একটু এদিক-ওদিক হলেই বর্বরের মত আচরণ করেন। প্রথম আলোতে প্রকাশিত ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ ঘটনাটি পড়ে দেখুন:



 এরকম ঘটনা নতুন নয়। নানারূপে নানাভাবে বাংলাদেশ ও ভারতে অহরহ ঘটছে এমন ঘটনা। অনেক জায়গায় কন্যাপক্ষকে অপদস্ত করার জন্য পেশাদার খাদক নিয়ে যাওয়া হয়। যাদের সাথে আত্মীয়তা হতে যাচ্ছে তাদেরকে অপদস্থ করতে পারলে যেন অফুরন্ত আনন্দ পাওয়া যায়।
          
আজকাল অনেকেই যৌতুক-প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। এটা ভালো দিক। কিন্তু যেখানে কোন দাবী-দাওয়া নেই - সেখানেও দেখা যায় কয়েক শত বরযাত্রীর ভোজের আয়োজন করতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন কন্যাপক্ষ। বরপক্ষকেও বৌ-ভাত নামে ভোজের আয়োজন করতে হয়। তবে সে আয়োজনে স্বাধীনতা থাকে। অন্যপক্ষের মনোরঞ্জন বাধ্যতামূলক নয় বলে বরপক্ষকে খুব বেশি মানসিক চাপে থাকতে হয় না।
          
বিয়েতে এরকম বিশাল ভোজের আয়োজন করাটা কি আসলেই খুব দরকার? এক বেলার ভোজের আয়োজনে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। যার পুরোটাই একেবারে বাজে খরচ। আমাদের মত গরীব দেশেও যাদের সামর্থ্য আছে তারা এত বেশি খরচ করে ভোজ দেন যে অবাক লাগে। চট্টগ্রামে একাধিক বিয়ের ভোজ হয়েছে স্টেডিয়ামে। শতাধিক বাস ভাড়া করে লোক নিয়ে আসা হয়েছে একবেলা খাওয়ার জন্য। সেখানে একবেলায় যা খরচ হয়েছে তা দিয়ে কয়েকটি স্কুল তৈরি করা যায়।
          
বাংলাদেশে অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নামে একটা আইন আছে বলে শুনেছি। এই আইন অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি মানুষকে খাওয়ানো যাবে না। যারা ভোজের আয়োজনে বাধ্য হন তাদেরকে এই অতিথি নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও করতে হয় - মানে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হয়।
          
বিয়েতে এলাহী-ভোজ বাদ দিয়ে বিকল্প কিছু কি ভাবা যায় না?

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।

4 comments:

  1. যোয়েল কর্মকার7 June 2018 at 18:49

    অশিক্ষিত মানসিকতা থেকে বেরোতে না পারলে এমন বর্বরতা থেকে মুক্তি মিলবে না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এখনো রয়ে গেছে এরকম রীতি - কিছুটা ভিন্নভাবে।

      Delete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts