Sunday, 3 June 2018

আমরা কি সুস্থ আছি?

২০১১ সালের ঘটনা। কিন্তু ঘটে চলেছে প্রতিবছর বাংলাদেশের কোথাও না কোথাও...


মারি হালামারি হালাপুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাইতোরা মারছ্ না কা? (মেরে ফেলমেরে ফেলপুলিশ বলেছে মেরে ফেলার জন্যমারিস না কেন?) লোকজনের জটলা থেকে কেউ একজন এভাবে বলছেন, আর কিছু লোক কিশোর মিলনকে রাস্তার ওপর ফেলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি ও লাথি মারছেএকজন লাঠি দিয়ে এলোপাথাড়ি পেটাচ্ছে একপর্যায়ে এক যুবক ইট দিয়ে তার মাথায় আঘাত করেমিলনের মৃত্যু নিশ্চিত হলে পুলিশ তার লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়

গত ২৭ জুলাই সকালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে ঘটে এই অকল্পনীয় ঘটনাভিডিও চিত্রে দেখা যায়, ১৬ বছরের কিশোরটিকে পুলিশের গাড়ি থেকে একজন নামিয়ে জনতার হাতে ছেড়ে দিচ্ছেতারপর শুরু হয় কথিত গণপিটুনিঅবিশ্বাস্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটে পুলিশের উপস্থিতিতে
কোম্পানীগঞ্জে ওই দিন ডাকাত সন্দেহে পৃথক স্থানে ছয়জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ দাবি করেছিলএর মধ্যে টেকেরবাজার মোড়ে মারা হয় তিনজনকেতাঁদেরই একজন এই কিশোর শামছুদ্দিন মিলনমিলনকে মারা হয় সকাল সাড়ে ১০টার দিকেআর বাকি দুজনকে মারা হয়েছিল ভোরবেলায় -

প্রথম আলোর প্রথম পাতার এই খবরটি পড়ে অনেক প্রশ্নের ভীড়ে একটি সোজা-সাপ্টা প্রশ্ন এসে ধাক্কা মারে মাথার ভেতর- এরকম পৈশাচিক উল্লাসে মানুষকে পিটিয়ে মারে যেসব মানুষ তাঁরা কি মানসিক ভাবে সুস্থ আছেন?

ঘটনাটি ঘটার দশদিন পর খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই মোবাইল ফোনের ভিডিওতে হত্যা-দৃশ্যটি ধারণ করেছেন। কোম্পানিগঞ্জের অনেকের মুঠোফোনে এই দৃশ্য দেখেছেন এবং এখনো দেখছেন অনেকেই। ষোল বছরের কিশোর মিলনের অপরাধ কী তা কেউ জানেন না। সে চট্টগ্রামের একটা কোম্পানিতে কাজ করে। ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছিল পারিবারিক কাজে। ঘটনার দিন চৌদ্দ হাজার টাকা নিয়ে উপজেলা সদরে যাচ্ছিল জমি নিবন্ধনের কাজে। যাবার পথে চরকাঁকড়া বেপারী উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ুয়া খালাতো বোনের সাথে কথা বলার জন্য বিদ্যালয়ের মসজিদের পুকুরঘাটে বসে অপেক্ষা করছিল সে। এটাই কি অপরাধ? ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জামাল উদ্দিন মিলনের খালাতো বোনকে স্কুল থেকে ডেকে এনে মিলনের পরিচয় নিশ্চিত করেন। এবং এরপর উপস্থিত লোকজন মিলে মিলনকে চড় থাপ্পড় দিয়ে তার টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। তারপর মিলনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। আর পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে জনতার হাত দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে মিলনের লাশ ভ্যানে তুলে চলে যায় বাংলাদেশের বীর পুলিশ বাহিনী।

যে মানুষগুলো মিলনকেমারি হালামারি হালাপুলিশ কইছে মারি হালাইবার লাইতোরা মারছ্ না কা?  বলতে বলতে বিপুল উৎসাহে পিটিয়ে মেরে ফেললো - তাঁরা সবাই নিশ্চয় এরপর স্বাভাবিক ভাবে যার যার কাজে গেছেন, বাসায় ফিরে ভাত খেয়েছেন, ঘুমিয়েছেন, মিলনের বয়সী কোন ভাই বা ছেলে থাকলে তার সাথে আদর করে কথা বলেছেন, মোবাইল ফোনে ধারণ করা হত্যা-দৃশ্যে নিজেদের ভূমিকা উপভোগ করেছেন গর্ব-ভরে। পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলাটা কত সহজ এখন আমাদের দেশে। পুলিশের বড় কর্তা বলেছেন মিলন অপরাধী কি না, তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। আমরা সব বিষয় খতিয়ে দেখছিসব বিষয় খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে ঘোষণা দেবেন মিলন সাধুবেশে চোর অতিশয়। যেন তাতেই আমরা পেয়ে যাই মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার।

এখানে যে ভয়াবহ মানসিক ব্যাধিতে আমরা ক্রমশ আক্রান্ত হচ্ছি তা কি কেউ খেয়াল করে দেখছেন না? আমরা খুন-খারাবী সহ্য করতে করতে নিজেরাই একেকজন খুনি হয়ে উঠছি ক্রমশ। যারা ভীষণ অপরাধী - বড় বড় আইন তাদের সুরক্ষা দেয় - আর আমরা আম-জনতা নিজেদের বঞ্চনার ক্রোধ অন্ধ হয়ে ঢালি নিজেদেরই কোন মিলন-এর ওপর। কীভাবে বলি যে আমরা সুস্থ আছি?

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts