Wednesday, 3 February 2021

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ২




০২


আজ ফিজিক্সের প্রথম ক্লাস হচ্ছে। ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে দু’দিন আগে। প্রথম দিন অনার্সের ক্লাস ছিল না, সাবসিডিয়ারি ক্লাস হয়েছিল একটা।

 

দ্বিতীয় দিন ছিল ছাত্র-ধর্মঘট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এরশাদপন্থী জাতীয় ছাত্রসমাজের রাজত্ব চলছে। শুনেছি হলগুলি সব তাদের দখলে। ক্যাম্পাসে অন্য কোন দলের টুঁ শব্দ করার উপায় নেই। লীগ, দল, ইউনিয়ন, শিবির সবার দৌড় শহরের রেলস্টেশন পর্যন্ত। তাদের ডাকা ধর্মঘটের সর্বোচ্চ ফল হলো শাটল ট্রেন বন্ধ। তাই কাল আসতে পারিনি।

 

সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দোতলা ও তিন তলায় ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস হচ্ছে সায়েন্স ফ্যাকাল্টি পার হয়ে রীতিমতো জঙ্গলের মধ্যে একটা একতলা ভবনে। এই ভবনের নাম নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং। এই বিল্ডিং-এর পরেও ইউনিভার্সিটির আরো বিল্ডিং আছে।  ফরেস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট আরো ভেতরে, আরো গভীর অরণ্যে। ফরেস্ট্রির পাশেই মেরিন সায়েন্স। সে হিসেবে মনে হচ্ছে নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এর ভৌগোলিক অবস্থানকে খুব একটা গভীর জঙ্গল বলা চলে না।

 

লাল ইটের তৈরি একতলা নিউট্রন জেনারেটর বিল্ডিং-এর ঠিক কোথায় নিউট্রন জেনারেট করা হয় জানি না। নিউট্রন জেনারেট করতে গেলে কী ধরনের জেনারেটর লাগে সে সম্পর্কেও কোন ধারণা নেই। ফিজিক্সের কোন্‌ ইয়ারে এই ধারণা পাবো তাও জানি না। তবে ফার্স্ট ইয়ারেই এরকম একটা বিল্ডিং-এ ক্লাস করতে এসে বেশ অন্যরকম লাগছে। বিল্ডিং-এর সামনে ছোট্ট ইট বিছানো পথ। তার দুপাশে ফুলের বাগান। সেখানে বেশ কিছু নীলচে নয়নতারা দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিং-এর মাঝখানে প্রশস্ত করিডোর কিছুটা অন্ধকার ছায়াময়। করিডোরের ডানদিকের প্রথম রুমেই আমাদের ক্লাস।

 

ক্লাসরুমটা বেশ বড়, অনেকটা বর্গাকার। দু’পাশে জানালাহীন দেয়াল, আর অন্য দু’পাশে বেশ বড় বড় শিকওয়ালা জানালা। পেছনের দিকের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়ে সবুজ বুনোঝোপে ভর্তি পাহাড়। মনে হয় পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে এই বিল্ডিং। এই সকালের রোদ পাহাড়ের গায়ে লেগে ফিরে যাচ্ছে বাইরে, রুমের জানালা দিয়ে খুব বেশি ঢোকার সুযোগ পাচ্ছে না। অন্যদিকের জানালা বারান্দার সাথে লাগানো। সেদিকে ঘঁষা কাচের মতো বিক্ষিপ্ত রোদ।

 

রুমে ঢুকে দেখলাম সাত আটজন মেয়ে বসে আছে দেয়ালের পাশের কয়েকটা বেঞ্চে। ফিজিক্সের এক শ শিক্ষার্থীর মধ্যে কতজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে এখনো জানি না। তবে কেমিস্ট্রি, বোটানি কিংবা জুলজি’র চেয়ে ফিজিক্সে মেয়েদের সংখ্যা অনেক কম। গণিতে আরো কম। আমাদের ব্যাচে মাত্র তিনজন মেয়ে ভর্তি হয়েছে গণিতে।

 

ছেলেরা রুমের ভেতর বিক্ষিপ্তভাবে চলাফেরা করছে। টিচার আসার আগে ক্লাসের ভেতর উদ্দেশ্যহীন মুক্তচলাচল এবং মুক্তআলোচনা উভয়ই চলে। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। আমি পারতপক্ষে ফার্স্ট বেঞ্চে বসি না। ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চ এবং লাস্ট বেঞ্চের দিকে টিচারদের নজর বেশি থাকে বলে আমার ধারণা। এই দুই অঞ্চলকে বলা চলে টিচারদের টার্গেট জোন। এই টার্গেট জোনের বাইরে ক্লাসরুমের মাঝামাঝি একটা নিরপেক্ষ অঞ্চল বেছে নিয়ে বসলাম। আশেপাশে পারস্পরিক পরিচয়ের আদানপ্রদান সংক্রান্ত মিথস্ক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় অংশ না নিয়ে আমি পর্যায় সারণির সর্বডানের কলামের নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলির মতো বসে রইলাম। অনেকক্ষণ পর - এপর্যন্ত ক্লাসের যে দু’জনের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে – কফিল এবং অর্পণ – তারা রুমে ঢুকলো আরো অনেকের সাথে। কফিল আমার বেঞ্চে বসতে বসতে বললো, “তুই কি বাসে এসেছিস? ভালো করেছিস। ট্রেন অনেক লেট করেছে আজ। তুই কি জানতি যে ট্রেন লেট করবে?”

“আরে না। আমি ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছি। ট্রেন মিস করবো ভেবেই ষোলশহর না গিয়ে সরাসরি মুরাদপুর চলে গিয়েছিলাম। হাটহাজারির বাসে এসেছি।“

 

বাসে এলে ট্রেনের আগে আসা যায়। হাটহাজারির বাসে না উঠে রাউজান বা রাঙ্গামাটির বাসে উঠতে পারলে আরো আগে আসা যায়। তবে রাঙ্গামাটির বাসে সিট পাওয়া যায় না, দাঁড়িয়ে আসতে হয়।

 

“এখন কোন্‌ স্যারের ক্লাস জানো?” – প্রশ্নকর্তা আমার সামনের বেঞ্চে বসে ঘাড় ফিরিয়ে প্রশ্ন করেছে। একটু পরেই তার সাথে পরিচয় হলো – আরিফ সাঈদ সুমন। একটু পরেই বারান্দায় যারা ঘুরাঘুরি করছিলো তারা সবাই দ্রুত রুমে ঢুকে গেলো। স্যার আসছেন।

 

এক হাতে ক্লাস রেজিস্টার ও চক-ডাস্টার, এবং অন্য হাতে লম্বা ছাতা নিয়ে প্রবেশ করলেন একজন মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক। সাদা চিকন চেকের হাফশার্ট আর ধূসর ঢোলা প্যান্ট। গম্ভীর মুখ - চৌকো ও নির্মেদ। প্রশস্ত কপাল, ব্যাকব্রাশ করা পাতলা চুল। আপাতদৃষ্টিতে নিতান্তই সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু সোনালী ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে তাঁর চোখের দৃষ্টি গভীর এবং স্বচ্ছ।

 

“ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস তো? – গলার স্বর খুব একটা স্পষ্ট নয়। মনযোগ দিয়ে না শুনলে বুঝতে সমস্যা হতে পারে। সামনের বেঞ্চের অনেকেই এক সাথে উত্তর দিলো, জ্বি স্যার।

 

স্যার আর কোন কথা না বলে রেজিস্টার খুলে রোল কল করতে শুরু করলেন। শুনেছি ক্লাসে উপস্থিতি খুব দরকারি বিষয়। কলেজেও খুব দরকারি বিষয় ছিল। নন কলেজিয়েট, ডিস-কলেজিয়েট ব্যাপারগুলি সেখানেও ছিল। পরীক্ষার ফরম পূরণের সময় সেগুলি দেখা হতো। দেখেছি অনেকে সারাবছর কোন ক্লাস না করেও ফরম পূরণের সময় বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে সব ঠিক করে নেয়। ইউনিভার্সিটিতে এসেও দেখি একই ব্যবস্থা। একজন শিক্ষার্থী সবগুলি ক্লাস করলেই যে সবকিছু বুঝতে পারবে, পরীক্ষায় পাস করতে পারবে এমন কোন নিশ্চয়তা কি আছে? আবার কেউ কোন ক্লাস না করেও নিজে নিজে পড়ে সিলেবাস কভার করে পাস করতে পারবে না, এমন নিয়মও নেই। তাহলে শুধু শুধু ক্লাসে উপস্থিতির হিসেবের পেছনে প্রত্যেক ক্লাসে দশ পনেরো মিনিট সময় নষ্ট করার কোন দরকার আছে? পয়ঁতাল্লিশ মিনিটের একটি ক্লাস থেকে পনেরো মিনিট চলে যাওয়া মানে তিন ভাগের এক ভাগ সময় নষ্ট হওয়া।

 

“আমি প্রফেসর হুজ্জোত আলি প্রামাণিক। আমি বর্তমানে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছি। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে তোমাদেরকে ওয়েলকাম জানাচ্ছি। তোমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এখানে ভর্তি হয়েছো। ইউনিভার্সিটির মানে কী তোমরা জানো? ইউনিভার্স যেমন একেবারে মাইক্রোস্কোপিক লেভেল থেকে কসমিক লেভেলের সবকিছুকে নিয়েই ইউনিভার্স, তেমনি জ্ঞানের জগতের সবকিছু নিয়েই হলো ইউনিভার্সিটি। ঠিকমতো লেখাপড়া করলে তোমরা শিক্ষিত হবে, জাতি শিক্ষিত হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার চায় না তোমরা শিক্ষিত হও। কারণ মানুষ যত শিক্ষিত হবে, মিলিটারি সরকারের ততই অসুবিধা হবে। শিক্ষিত মানুষের ব্রেইন ওয়াশ করা যায় না। কিন্তু জানো তো রেজিমেন্টাল সিস্টেমে ব্রেইনের ব্যবহার নেই। সেখানে শুধু অর্ডার দেবে এবং অর্ডার মানবে। কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ ব্রেইন ব্যবহার করবে, বুদ্ধি ব্যবহার করবে। যে শাসন করতে চায়, সে চাইবে না তুমি ব্রেইন ব্যবহার করো। তাই তোমাকেই বেছে নিতে হবে তুমি কী চাও। শিক্ষিত হতে চাইলে নিজের চেষ্টায় শিক্ষিত হতে হবে।“

 

স্যারের চিন্তাভাবনার সাহসিকতা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। ক্লাসরুমে সামরিক সরকারের এরকম সরাসরি সমালোচনা করতে পারা সহজ কথা নয়। ফিজিসিস্টরা সম্ভবত এরকম সাহসী হয়। আর্কিমেডিস নাকি সশস্ত্র সৈনিককে ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন তাঁর জ্যামিতিক চিত্রের উপর ছায়া না ফেলতে। অবশ্য সেই সাহসের মূল্য আর্কিমেডিসকে দিতে হয়েছিল নিজের জীবন দিয়ে। প্রামাণিক স্যারকেও কী মূল্য দিতে হয় জানি না। তবে স্যারের কথাগুলি খুব ভালো লেগে গেল।

 

“ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে কে কী পড়েছো আমাদের জানার কথা নয়। এখানে ইউনিভার্সিটি লেভেলের ফিজিক্স পড়তে এসে অনেক জিনিস নিজেকেই করতে হবে।  আগে না পড়ে থাকলে পড়ে নেবে, না বুঝে থাকলে বুঝে নেবে।“ – স্যারের কথা বলার স্টাইল মনোটোনাস। একটু টেনে টেনে কথা বলার কারণে মনে হচ্ছে এক্ শব্দের সাথে পরের শব্দ লেগে যাচ্ছে। কিন্তু শেষের কথাগুলির অর্থ তো খুব একটা পরিষ্কার হচ্ছে না। বলছেন, না বুঝে থাকলে বুঝে নিতে। কার কাছ থেকে বুঝে নিতে? যিনি পড়াবেন তাঁর কাছ থেকে? তবে কি তিনি কোন কিছু না বুঝলে স্যারকে প্রশ্ন করে জেনে নেয়ার কথা বলছেন?

 

“আমি তোমাদের পড়াবো ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্স” – বলেই ব্ল্যাকবোর্ডে খসখস করে লিখলেন – “গাউস থিওরম”। তারপরের বিশ-পঁচিশ মিনিট একটা ঝড় বয়ে গেলো ব্ল্যাকবোর্ডের উপর দিয়ে। স্যারের হাত আর মুখ একসাথে চললো। একের পর এক জটিল সমীকরণ লিখছেন – যার গ্রিক নোটেশানগুলি উচ্চারণ করতে পারি, কিন্তু সেগুলি দিয়ে আসলে কী বোঝায় তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছি না। স্যারের হাতের লেখাও সমীকরণের মতোই দুর্বোধ্য। স্যার বলেছেন, না বুঝলে বুঝে নিতে। কিন্তু কীভাবে বুঝে নেবো? স্যার যে গতিতে এগোচ্ছেন তাতে ক্লাস শেষ হওয়ার আগে একবারও থামবেন বলে তো মনে হচ্ছে না। মাছি মারা কেরানির মতো ব্ল্যাকবোর্ড কপি করলাম। টর্নেডো থেমে যাবার পর যেরকম চারদিকে স্তব্ধ-লন্ডভন্ড অবস্থা দেখা যায়, প্রামাণিক স্যার ক্লাস শেষ করে চলে যাবার পর আমাদের অবস্থা হলো সেরকম। এই দুর্বোধ্য গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানের সাগর কীভাবে সাতরাবো জানি না।

 

বুকভরে শ্বাস নেবার আগেই ক্লাসে ঢুকলেন আরেকজন স্যার - ইনিও গম্ভীর, কাঁচাপাকা কোঁকড়ানো চুল, আর কুঁচকানো কপাল। স্যারকে দেখেই আমার হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে গেল। এই স্যার ফিজিক্সের! ক্লাসের ভেতর যে ক’জন ক্লাস-শেষে ফ্রি পার্টিক্যালের মতো র‍্যান্ডমলি ঘুরাঘুরি করার ইচ্ছেয় সিট ছেড়েছিল – তাদেরকে ধমক দিয়ে বাধ্য করলেন সিটে ফিরে যেতে। এই স্যার যে অসম্ভব বদমেজাজি তার পরিচয় আগেও পেয়েছিলাম। এই পিরিয়ডে আমাদের থার্ড পেপার – হিট অ্যান্ড থার্মোডায়নামিক্স। স্যার ব্ল্যাকবোর্ডে নিজের নাম লিখলেন – মোবাশ্বের আহমদ।

 

রোল কল শেষ করে স্যার কুঁচকানো কপাল আরো কুঁচকে অনেকটা শ্লেষভরে জিজ্ঞেস করলেন, “পৃথিবীতে এত বিষয় থাকতে তোমরা ফিজিক্স  পড়তে এসেছ কী কারণে? ফিজিক্স এমন একটা সাবজেক্ট যা শরীরের রসকষ সব নিংড়ে নিয়ে তোমাকে ছোবড়া করে দেবে। পঁচিশ বছর বয়সেই তোমাকে মনে হবে পঞ্চাশ বছরের বুড়ো।“

 

স্যারের দিকে আবার তাকালাম। যতটুকু সম্ভব ভালোভাবে তাকালাম। স্যারকে দেখতে পঞ্চাশ বছরের বুড়োদের মতো লাগছে। তবে কি তাঁর  আসল বয়স পঁচিশ?

 

“যদি ভেবে থাকো সারাবছর আর্টস ফ্যাকাল্টিতে ঘুরে ঘুরে ফিজিক্সে অনার্স পাস করে ফেলবে, তাহলে ভুল করছো। এখনও সময় আছে, ফিজিক্স ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাও। শুধুমাত্র সিরিয়াস স্টুডেন্টদের জন্য ফিজিক্স।“

 

ক্লাসে পায়চারি করতে করতে ফিজিক্স বিষয়ের পরিচিতি দিচ্ছেন মোবাশ্বের স্যার। শরীরের কোথাও একচিলতে মেদ তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় মাংসও ঠিকমতো নেই। তাঁর শরীর যেমন কাঠখোট্টা, মেজাজও তেমন। কথা বলতে বলতে ক্লাসের বেঞ্চের সারির মাঝখানে যে পথ আছে সেই পথ ধরে তিনি প্রত্যেক বেঞ্চের কাছে যাচ্ছেন। স্যারের দিকে তাকাতে গিয়ে আমাদের ঘাড়ের ব্যায়াম হয়ে যাচ্ছে। তবে আমি স্যারের চোখের দিকে তাকাচ্ছি না। কারণ আমি জানি না স্যার এখনো আমার চেহারা মনে রেখেছেন কি না। ফরেস্ট্রির লিখিত পরীক্ষায় আমার পাশে বসেছিল আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু। উচ্চ মাধ্যমিকে দুর্দান্ত রেজাল্ট তার। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াই ছিল তার লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিল নিজের মেধার একাধিক স্বীকৃতির জন্য। যতগুলি ডিপার্টমেন্টে সম্ভব সবখানেই পরীক্ষা দিয়েছিল সে – কয়টা ডিপার্টমেন্টে টিকে তা দেখার জন্য। ফরেস্ট্রির প্রশ্ন অনেক জটিল ছিল। মাত্র ২০% প্রশ্নের উত্তর আমার জানা ছিল, আমার বন্ধুটির প্রায় ৭০% জানা ছিল। কিন্তু যেহেতু তার সব পরীক্ষাতেই টিকতে হবে, সে একটু পরপর আমার খাতার দিকে ঝুঁকছিল আমি কী লিখেছি দেখার জন্য। এরকম কয়েকবার ঘটার পর স্যার এসে আমাদের দু’জনের খাতাই কেড়ে নিলেন। আমি খুশি মনে হল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। পেছন ফিরে দেখলাম আমার বন্ধুটি স্যারের পায়ে ধরে ফেলেছে খাতা ফেরত পাবার জন্য। সেই স্যার ছিলেন মোবাশ্বের স্যার। এতদিন পরেও আমার কেন যেন লজ্জা লাগছে – যদি স্যার চিনে ফেলেন!

 

“ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে কে কত নম্বর পেয়েছ, কয়টাতে লেটার পেয়েছ, স্টার মার্ক পেয়েছ, স্ট্যান্ড করেছো – ওসব ভুলে যাও। ওগুলি এখানে কোন কাজে আসবে না। অনেক স্টারমার্ক এখানে এসে থার্ড ক্লাস পায়। এখানে তুমি লেখাপড়া করলে টিকে থাকবে, নইলে ছিটকে পড়ে যাবে।“

 

স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছে ফিজিক্সে পড়তে এসে আমরা ভুল করেছি। অথচ পরিসংখ্যান ক্লাসে ম্যাকস্যার আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে দৈনন্দিন জীবনে পরিসংখ্যানের প্রয়োজনীয়তা কী অপরিসীম। পরিসংখ্যান সম্পর্কে কত সুন্দর সুন্দর কথা। ম্যাকস্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ফিজিক্সের বদলে পরিসংখ্যানে ভর্তি হলেই মোক্ষলাভ করা যেত। অথচ আজ ফিজিক্সের ক্লাসে স্যারের কথা শুনে মনে হচ্ছে ফিজিক্সের মতো জটিল রসকষহীন বিষয় পৃথিবীতে আর একটিও নেই।

 

“হোয়াট ইজ থার্মোডায়নামিক্স? কে বলতে পারবে? এনিবডি? নো ওয়ান ইন দি ক্লাস? এত এত স্টারমার্ক কোথায় গেলো? কে বলতে পারবে?”

 

স্যারের সামনে মুখ খোলার মতো সাহস মনে হয় কারোরই নেই। কেউই কোন সাড়াশব্দ করছে না। স্যার বিরক্ত হয়ে “শেম অন ইউ” বলতেই সামনের বেঞ্চ থেকে একটি নাতিদীর্ঘ হাত উত্তোলিত হলো।

“বলো”

একটি শ্যামলা পাতলা ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে উত্তর দিলো, “থার্মোডায়নামিক্স ইজ দি স্টাডি অব দি ডায়নামিক্স অব হিট এনার্জি।“

“ভেরি গুড়। তোমার নাম কী?”

“স্যার তাজুল ইসলাম।“

তাজুল ইসলাম আমাদের থার্মোডায়নামিক্স ক্লাসের হিরো হয়ে গেলো।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts