Sunday, 23 June 2019

আইনস্টাইনের কাল - পর্ব-৩


১৮৯১
নিজে নিজে পড়ে ক্যালকুলাস ও উচ্চতর গণিত শিখতে শুরু করেছে  আলবার্ট । হাতের কাছে বিজ্ঞানের বই পেলেই পড়ে ফেলছে। ম্যাক্স ট্যালমুড অ্যালবার্টের জন্য নিয়ে এলেন দুটো জনপ্রিয় পদার্থবিজ্ঞানের বই; লুডিগ বুশনারের (Ludwig Buchner) ফোর্স এন্ড মেটার (Force and Matter) এবং আলেক্সান্ডার ভন হামবোলটের (Alexander von Humboldt)দি কসমসঃ এন অ্যাটেম্পট অ্যাট এ ডেসক্রিপশান অব দি ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ড ( The cosmos: An Attempt at a Description of the Physical World)  আলবার্ট গোগ্রাসে পড়ে ফেললো বই দুটো। এরপর তার হাতে পড়লো অ্যারন বার্নস্টেইনের (Aaron Bernstein)পদার্থবিজ্ঞানের সিরিজ; পদার্থ ও শক্তির বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মোট একুশ খন্ডের বই।  আলবার্ট পড়ে ফেললো জ্যোর্তিবিদ্যা, আলোকবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক শক্তি- অভিকর্ষজ শক্তির ওপর লেখা সবগুলো অধ্যায়।

অ্যালবার্টের মা পলিন চাচ্ছিলেন  আলবার্ট যেন সংগীতটা ভালো করে শেখে। পলিন নিজে তুখোড় পিয়ানোবাদক। মায়াকে শেখাচ্ছেন পিয়ানো। কিন্তু  আলবার্ট এখনো পর্যন্ত সংগীতকে সিরিয়াসলি নেয়নি। পলিনের প্রিয় হচ্ছে বেটোভেন। তিনি আশা করছেন  আলবার্ট একদিন তার সাথে যুগলবন্দী করবে। তিনি পিয়ানো বাজাবেন,  আলবার্ট বেহালা।  আলবার্টকে উৎসাহ দিয়েই চলেছেন পলিন। এসময় হঠাৎ একদিন মোৎসার্ট ভালো লেগে গেলো অ্যালবার্টের। মোৎসার্টের সংগীতে কোথায় যেন গাণিতিক যুক্তির একটা ব্যাপার আছে। সেটা আবিষ্কার করতে গিয়ে সংগীতকে ভালোবেসে ফেললো  আলবার্ট।

১৮৯২
গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে অ্যালবার্টের গতির সাথে এখন আর তাল মেলাতে পারছেন না ম্যাক্স ট্যালমুড। তিনি চাইলেন অ্যালবার্টের জ্ঞানতৃষ্ণা অন্যদিকে প্রবাহিত করতে। অ্যালবার্টের হাতে তুলে দিলেন দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের জটিল বই দি ক্রিটিক অব পিওর রিজন (The critique of pure reason) এই বইটি ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের পক্ষেও হজম করা কঠিন, অথচ কিশোর  আলবার্ট গভীর আগ্রহ সহকারে পড়তে শুরু করেছে কান্টের দর্শন

বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ জন্মাবার পর, বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে পেতে দেরি হলো না কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো অ্যালবার্টের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে ধর্মীয় বইতে যা লেখা আছে, ধর্মের কাহিনী হিসেবে যে ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেয়া আছে, সেগুলোর সাথে বিজ্ঞান ও দর্শনের যুক্তি মেলে না শুধুমাত্র বিশ্বাসে মিলায় বস্তু-তে বিশ্বাস রাখা সম্ভব নয় গোঁড়া ইহুদি হবার ইচ্ছেটা মরে গেলো অ্যালবার্টের আস্তে আস্তে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললো সে এখন সে বুঝতে পারছে কেন তার মা-বাবা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেননা

১৮৯৩
বারো বছর আগে উলম ছেড়ে মিউনিখে আসার পর থেকে ইলেক্ট্রিকের ব্যবসাটি মোটামুটি ভালোই চলেছে আইনস্টাইনদের ১৮৯০ সাল থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হয়েছে আর হারম্যান ও জ্যাকব বিদ্যুৎ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে বেশ ভালোই উন্নতি করেছেন ব্যবসায় এখন তাঁদের কারখানা আরো বড় হয়েছে ফ্রাঙ্কফুর্টে হয়ে গেছে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিরাট প্রদর্শনী জার্মানির সম্রাট নিজে এসেছিলেন সেখানে সেখান থেকে ফিরে জ্যাকবের মাথায় ঢুকেছে কারখানা আরো বড় করার পরিকল্পনা

জ্যাকব একটি ডায়নামো উদ্ভাবন করেছেন তাঁর ইচ্ছা সেটি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করে বাজারজাত করবেন কারখানা আরো বড় করা হলো প্রায় দুশ কর্মী কাজ করছেন তাঁদের কারখানায় কিন্তু আরো সব কারখানার সাথে প্রতিযোগিতা বাড়ছে দিনে দিনে এসময় মিউনিখ সিটিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেবার টেন্ডার আহ্বান করা হলো জ্যাকব ধরে রেখেছেন শহরের একমাত্র ডায়নামো প্রস্তুতকারক হিসেবে তাঁরাই পাবেন টেন্ডার কিন্তু সমস্যা দেখা দিলো আইনস্টাইনরা সরবরাহ করেন ডিসি কারেন্ট কিন্তু অন্যান্য কোম্পানি দেখালো যে দূর থেকে সরবরাহ করার জন্য ডিসি কারেন্টের চেয়ে এসি কারেন্টের খরচ অনেক কম

মিউনিখ শহরের বাইরে থেকেও অনেক কোম্পানি টেন্ডার দাখিল করছে সেগুলোর মধ্যে আছে জার্মানির সবচেয়ে বড় কোম্পানি গুলো; --জি (জার্মান এডিসন কোম্পানি), প্রথম ডায়নামো আবিষ্কারক ওয়ার্নার সিমেনের কোম্পানি সিমেনস এন্ড কোম্পানি, এবং নুরেমবার্গ শুকার্ট(Schukert) কোম্পানি এত বড় বড় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে ঘরবাড়ি সব বন্ধক রেখে ঋণ নেয়া হলো প্রচুর কিন্তু শেষরক্ষা হলো না টেন্ডার পেলো নুরেমবার্গের শুকার্ট কোম্পানি আইনস্টাইনরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন

মিউনিখে এখন কিছুই রইলো না তাঁদের স্থির হলো ইটালিতে চলে যাবেন সেখানে গিয়ে নতুন করে ব্যবসা করবেন ইটালির মিলানে যাবার সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো  আলবার্ট খবরটি শুনে তো ভীষণ খুশি এখানকার স্কুল তার ভালো লাগছে না মোটেও মিলানে চলে গেলে আর যাইহোক, অন্তত স্কুলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে

কিন্তু যখন শুনলো বাড়ির সবাই গেলেও তাকে থেকে যেতে হবে মিউনিখে, ভীষণ মনখারাপ হয়ে গেলো তার আরো তিনবছর ধরে তাকে স্কুলের পড়া শেষ করতে হবে মিউনিখ থেকে, তাও আবার একা একা তার মা-বাবা এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাধ্য হয়ে কারণ জার্মানির নাগরিক হিসেবে ষোল বছর বয়সী ছেলেদের জন্য মিলিটারি সার্ভিস বাধ্যতামূলক ইটালি গেলেও তাকে ফিরে আসতে হবে এই মিলিটারি সার্ভিস শেষ করার জন্য তাছাড়া ইটালির স্কুলে তাকে ভর্তি করানো যাবে না কারণ সে ইটালিয়ান ভাষা জানে না

দূরসম্পর্কের এক মাসির বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হলো অ্যালবার্টের মা পলিন খুব ভালোবাসেন  আলবার্টকে কিন্তু সন্তানের ভালোর জন্য তিনি স্নেহ চেপে রাখতে জানেন মায়ারও খুব কষ্ট হলো ভাইকে ছেড়ে যেতে বছরের মাঝামাঝি  আলবার্টকে মিউনিখে রেখে মা বাবা বোন কাকা সবাই চলে গেলো ইটালির মিলানে

মিউনিখে আইনস্টাইনের বাড়িটা বিক্রি করে দেয়া হলো নতুন মালিক এসে একদিন মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো তাদের পুরনো বাড়ি  আলবার্ট দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলো সবকিছু

১৮৯৪
মিউনিখে মন খারাপ করে বসে আছে  আলবার্ট মিলান থেকে মা ও বোনের চিঠি আসে সেগুলো পড়ে মন আরো খারাপ হয়ে যায় নতুন বাড়িটি কত সুন্দর, ইটালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিউনিখের চেয়ে কত বেশি আকর্ষণীয়- চিঠিতে এসব পড়তে পড়তে মা,বাবা ও বোনকে বড় স্বার্থপর মনে হয় তার কষ্ট ভুলে থাকার জন্য বইয়ের মধ্যে ডুবে যায়  আলবার্ট

কান্টের দর্শন তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছে ইমানুয়েল কান্ট তাঁর হিস্ট্রি অব নেচার এন্ড থিওরি অব দি হেভেনস (History of Nature and Theory of the Heavens) বইতে আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে সম্পর্কে যা লিখেছেন তা নিয়ে ভাবছে  আলবার্ট আমাদের গ্যালাক্সির চাকতিটি তারার সমুদ্রে একটি দ্বীপের মত কান্ট ক্রিটিক অব পিওর রিজন (Critic of Pure Reason) বইতে সময় সম্পর্কে লিখেছেন সময় পরীক্ষালব্ধ কোন ধারণা নয় সময় হলো আমাদের চিন্তাপ্রসূত একটি অনুভূতির ব্যাপার স্থান ও সময়ের অনুভূতি সবার জন্য সমান নয় এটি আপেক্ষিক কান্টের এই ধারণা গভীর রেখাপাত করে অ্যালবার্টের মনে পরবর্তীতে এই ধারণা থেকেই আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছে

আরো তিন বছর মিউনিখের স্কুলে কাটাতে হবে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায় অ্যালবার্টের কী করা যায়? স্কুল পাস করার পর আবার তিন বছর মিলিটারি সার্ভিস করতে হবে! ভাবতেই কেমন যেন হয়ে যায়  আলবার্ট জার্মানির সব ছেলেরাই মিলিটারি হতে চায় কিন্তু আইনস্টাইন ব্যতিক্রম মিলিটারিরা হুকুম করা আর হুকুম তামিল করা ছাড়া আর কোনকিছু করে না বা করতে পছন্দও করে না আইনস্টাইনের কাছে মনে হয় মিলিটারিরা স্বাধীন মানুষ নয় চিন্তার স্বাধীনতা না থাকলে আর মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মানে কী? স্কুলের নতুন শিক্ষাবছর শুরু হলো সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে  আলবার্ট এবার জিমনেশিয়ামের সপ্তম বর্ষে যাচ্ছে সপ্তম বর্ষ মানে দশম শ্রেণীর সমতুল্য এরপর একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণী শেষ করার পরে ইউনিভার্সিটি পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করতে পারবে সে কিন্তু তিন বছর এখানে সে থাকবে কী করে? ক্লাসে একজনও বন্ধু নেই তার শিক্ষকরাও কেউ পছন্দ করেন না তাকে সে যে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ তা কিন্তু নয় স্কুলে গ্রেডিং করা হয় ১ থেকে ৪ পর্যন্ত১ হলো সবচেয়ে ভালো আর ৪ হলো সবচেয়ে খারাপ আইনস্টাইন গণিতে বরাবর ১ পায়, ল্যাটিন ও গ্রিকে ১ বা ২ পায় এবার অবশ্য গ্রিকে ৩ পেয়েছে কারণ গ্রিক ভাষার শিক্ষককে সে ক্রমশ অপছন্দ করতে শুরু করেছে

স্কুল শুরু হবার পর থেকে ভীষণ অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে  আলবার্ট নিজেকে খুব একা মনে হচ্ছে তার মনে হচ্ছে মা-বাবা তাকে ত্যাগ করেছে ডিসেম্বর এসে গেলো- অথচ মা-বাবার সাথে ক্রিস্টমাস কাটাবার কোন কথা বলছেন না তাঁরা ক্রিস্টমাসের সময়টা একা একা কাটাতে হবে তাকে ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে পড়ল সে চিকিৎসার জন্য গেলেও ডাক্তার বার্নার্ড ট্যালমুডের কাছে বার্নার্ড ট্যালমুড ম্যাক্স ট্যালমুডের বড়ভাই ম্যাক্সের সাথে ভালো সম্পর্ক ছিলো অ্যালবার্টের সে হিসেবে ডাক্তার বার্নার্ডের কাছেও বেশ ভালো ব্যবহার পেলো  আলবার্ট

হঠাৎ একটি বুদ্ধি এলো অ্যালবার্টের মাথায় সে ডাক্তারকে অনুরোধ করল একটি সার্টিফিকেট লিখে দিতে যে তাকে কয়েকমাস বিশ্রামে থাকতে হবে বার্নার্ড বুঝলেন ব্যাপারটা অ্যালবার্টের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা দেখে তিনি আসলেই মনে করছেন অ্যালবার্টের এখন মা-বাবার সাথেই থাকা উচিত কিছুদিন

প্ল্যানের একটি অংশ কার্যকরী হলো আরো লম্বা প্ল্যান আছে অ্যলবার্টেরতার ইচ্ছা আছে দর্শনের শিক্ষক হবে কিন্তু ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি না থাকলে তা সম্ভব নয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হলে স্কুল পাসের ডিপ্লোমা লাগবে  আলবার্ট গণিতে দক্ষ স্কুলের পড়ার বাইরে সে উচ্চতর ক্যালকুলাসও করে ফেলেছে এর মধ্যে জিমনেশিয়ামের গণিত শিক্ষক জোসেফ ডাক্রুর সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক আছে তার  আলবার্ট ডাক্রুকে অনুরোধ করলো একটি সার্টিফিকেট লিখে দিতে ডাক্রু লিখে দিলেন যে, স্কুল ডিপ্লোমার জন্য যেটুকু গাণিতিক দক্ষতা দরকার,  আলবার্ট আইনস্টাইনের গাণিতিক দক্ষতা তার চেয়ে বেশি আছে

স্কুল ছেড়ে চলে যাবার জন্য যা যা দরকার তা এখন অ্যালবার্টের হাতে প্রিন্সিপালের কাছে ডাক্তারের সার্টিফিকেটটি নিয়ে গেলেই হলো স্কুল ছাড়ার আগেরদিন গ্রিকভাষার ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসে আছে  আলবার্ট গ্রিক শিক্ষক  আলবার্টকে মোটেও পছন্দ করেন না, আর  আলবার্টও সহ্য করতে পারে না এই শিক্ষককে স্যারের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে  আলবার্ট স্যার মনে হচ্ছে সারাক্ষণই তার দিকে তাকিয়ে আছেন কিছুটা ভয় ভয় লাগলেও খুব একটা পাত্তা দিলো না  আলবার্ট কালতো সে চলেই যাচ্ছে, তবে আর ভয় কি!  আলবার্টকে কম যন্ত্রণা দেননি এই গ্রিক স্যার অ্যালবার্টের বাবা একবার এসেছিলেন এই স্যারের কাছে অ্যালবার্টের ব্যাপারে কথা বলতে সেদিন তো রীতিমত অপমানই করেছেন তিনি হারম্যান আইনস্টাইনকে,
-আপনার ছেলে তো একটা গাধা
-আজ্ঞে স্যার, বলছিলাম কি- গাধাটা কী বিষয় নিয়ে পড়লে একটু ভালো করতো যদি পরামর্শ দিতেন- মানে কোন কাজের উপযুক্ত সে-
-কোন কাজেরই উপযুক্ত না সে তাকে দিয়ে কোন কাজ হবে না জীবনে শুধু শুধু পন্ডশ্রম করছেন
কোন বাবাই নিজের ছেলে সম্পর্কে এরকম কথা শুনতে পছন্দ করেন না কিন্তু অ্যালবার্টের বাবা হাসিমুখে সহ্য করে মাথা নিচু করে চলে গেছেন সেদিন তার দ্বারা কিছুই হবে না জীবনে? ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায় অ্যালবার্টের
-মিস্টার আইনস্টাইন!
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন গ্রিক স্যার
-ইয়েস স্যার!
-ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করবে
-ইয়েস স্যার
ক্লাসের সবাই চলে যাওয়ার পর গ্রিক স্যার দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
-তুমি আমার ক্লাসের একটি আবর্জনা
-আমি তো কিছু করিনি স্যার
-পেছনের বেঞ্চে বসে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিলে এতে অন্য ছাত্রদের কাছে আমার সম্মান নষ্ট করেছো তুমি আমার ক্লাসে বসে তুমি আমাকে অপমান করার সাহস দেখাও! এবার তুমি বিদেয় হও স্কুলে পড়ে তোমার কিচ্ছু হবে না তারচেয়ে স্কুল ছেড়ে দাও, আমার ক্লাসটা একটু শান্তি পাক

স্যারের কথা শুনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হলো অ্যালবার্টের স্যার নিজে থেকেই বলছেন স্কুল ছেড়ে দিতে- সে তো এমনিতেই চলে যাচ্ছে কাল কিন্তু আবার মনে হলো তাকে স্কুল থেকে বহিস্কার করা হচ্ছে! এটা কি কিছুটা অপমানজনক নয়? সে যাই হোক প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে বললো যে গ্রিক স্যার স্কুল ছেড়ে দিতে বলেছেন বলে সে স্কুল থেকে চলে যাচ্ছে
ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে স্কুল ছাড়লো আইনস্টাইন জিনিসপত্র যা ছিলো তা আগেই গুছিয়ে রেখেছিলো পরদিন বাড়িওয়ালীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একদৌড়ে মিউনিখ রেলস্টেশান মিউনিখ থেকে মিলানের দূরত্ব প্রায় আড়াইশো মাইল ট্রেনে চেপে বসলো  আলবার্ট আইনস্টাইন

সুন্দর পাহাড়িপথ এদিকে আগে কখনো আসেনি  আলবার্ট কিছুক্ষণ তন্ময় হয়ে দেখলো দুপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য কিন্তু একটু পরেই মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো কী বলবে সে মা-বাবাকে? তাঁরা তো কিছুই জানেন না এখনো হঠাৎ তাকে দেখে অবাক তো হবেনই কিন্তু কিছু একটা বলতে হবে তো শুধু বলার জন্য নয়, এমনিতেই কী করবে সে এখন? ইচ্ছে আছে জুরিখের পলিটেকনিকে ভর্তি হবে সেখানে ভর্তি হতে স্কুল পাসের সার্টিফিকেট দেখাতে হয়না, কেবল ভর্তি পরীক্ষায় পাস করলেই হলো তাছাড়া গণিতস্যার তো তাকে একটা প্রশংসাপত্র দিয়েই রেখেছেন নিশ্চয় ভর্তি হতে পারবে সে মিলান থেকে কত কাছে জুরিখের পলিটেকনিক, বর্ডারটা পার হলেই হলো কিন্তু যদি জার্মানিতে ফিরে আসতে হয়? মিলিটারি সার্ভিসে ডাক পড়ে? না, কক্ষনো ফিরে আসবে না সে জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করবে সে যেন আর কখনো জার্মানিতে ফিরে আসতে না হয়

আলবার্টকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলো মায়া কিন্তু একটু পরেই শুরু হলো পলিনের জেরা কেন সে পালিয়ে এসেছে? এত সাহস তার কী করে হলো এবার কী হবে? এভাবে নিজের পায়ে কুড়োল মারে কেউ? ইত্যাদি বাক্য চলতে লাগলো অ্যালবার্টের একটিই কথা- সে আর মিউনিখে ফিরে যাবে না মা-বাবা দুজনই বুঝতে পারে  আলবার্টকে আর বোঝানোর চেষ্টা করে লাভ নেই একটু ঠান্ডা হবার পর হারম্যান আইনস্টাইন কথা বললেন ছেলের সাথে
-তা কী করবে ঠিক করেছো?
-আমি ফিলসোফির প্রফেসর হবো
-কী! ওসব ফিলোসফিক্যাল ননসেন্স বাদ দাও দর্শনের মাস্টারি করে পেটের ভাতও জোটাতে পারবে না তারচেয়ে তোমার কাকার দিকে তাকিয়ে দেখো ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কত সম্মান, কত টাকা
-কিন্তু আমার ওসব ভালো লাগে না
-তা লাগবে কেন? ভালো জিনিস কেন ভালো লাগবে তোমার?
ঠান্ডা মাথার মানুষ বাবাকেও আর রেগে যেতে দেখে  আলবার্ট বুঝতে পারে এখন তর্ক করার সময় নয় বললো, ঠিক আছে, আমি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হবো

বাবাকে সহজে বোঝানো গেলেও মাকে বোঝানো সহজ নয় পলিন পলিটেকনিকে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে দিয়েছেন



No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts