Sunday, 17 March 2024

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী - ইতিহাস ও রাজনৈতিক দর্শনের অমূল্য দলিল

 



বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রথমবার যখন পড়েছিলাম তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সাবলীল ভাষার দক্ষতায়। কী অনায়াসে তিনি নির্মেদ বাক্যে তুলে এনেছেন তাঁর সমসাময়িক ইতিহাস। পড়ার পর প্রথম যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হলো – এই বই সর্বজনপাঠ্য হওয়া উচিত। আশা করেছিলাম – বঙ্গবন্ধুকে যাঁরা সহ্যও করতে পারেন না কোনো না কোনো কারণে – তাঁরাও যদি এই বইটি পড়েন – জানতে পারবেন রাজনীতির কত চড়াই-উৎরাই পার হয়ে, কত দীর্ঘ সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। 

তার এক দশক পর সম্প্রতি বইটি আবার পড়লাম। এবার ঘটনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক আদর্শের ব্যাপারটা টানলো আরো বেশি। প্রশ্ন জাগে – একটানা পনেরো বছর বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করার পরেও আমাদের নেতাদের ভেতর তাঁর আদর্শের কোন ছাপ দেখি না কেন?

 বইয়ে উল্লেখিত সেই সময়ের ইতিহাস নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর এই বই থেকে তথ্য নিয়েই রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অসংখ্য বই। সেই বইগুলির কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে রচিত। 

২০১২ সালে প্রকাশিত হবার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’  সম্ভবত সবচেয়ে বেশি আলোচিত বই বাংলাদেশে। পাঠকরা নিজেদের মধ্যে কতটুকু উপলব্ধিমূলক আলোচনা করেছেন জানি না, তবে রাষ্ট্রীয় আনুকুল্যে এবং আনুকুল্য লাভের আশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই বইয়ের সুখ্যাতি করেছেন অনেকেই । শুনেছি বিসিএস পরীক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য এই বই – কারণ এই বই থেকে এক বা একাধিক প্রশ্ন প্রতি বৎসরই আসে, কিংবা মৌখিক পরীক্ষায় জিজ্ঞাসা করা হয়। অনলাইনে খুঁজলেই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র অসংখ্য প্রশ্নোত্তর পাওয়া যায়। নিসন্দেহে এতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তথ্য কে কতটুকু জানে তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু তথ্য জানা আর আদর্শ ধারণ করা কি এক? 

গত এক দশকে বঙ্গবন্ধুর পোশাক পরে যতজন নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক কিংবা সন্তানের চেয়েও বেশি সন্তান বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করেছেন – আমার কেন যেন মনে হয় তাঁদের কেউই বঙ্গবন্ধুর এই বইটি সম্পূর্ণ পড়েননি। যদি পড়তেন, কিছুটা হলেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতিফলন দেখা যেতো তাঁদের মধ্যে। 

অবশ্য এটাও ঠিক, ধর্মীয় গ্রন্থ তো অনেকেই দিনরাত পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেন। তাতে কি ধর্মের আদর্শগুলি তাঁরা ধারণ করেন? যাই হোক, এই বইয়ে বর্ণিত ইতিহাস নয়, আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটা হলো সেই সময় থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভেতর আদর্শ নেতৃত্ব আর সত্যিকারের দেশপ্রেমের দর্শন গড়ে ওঠাটা। তাঁর আদর্শের ছিটেফোঁটাও যদি বর্তমান নেতাদের সবার ভেতর থাকতো!

রাজনীতির  পিচ্ছিল এবং ক্ষেত্রবিশেষে পংকিল পথ ধরে, অনেক ক্ষেত্রে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে করতে তিনি উঠে এসেছেন একেবারে কর্মীর কাতার থেকে নেতার সারিতে। 

নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি ঘটনা লিখতে লিখতে প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু কিছু দার্শনিক লাইন লিখেছেন, যেগুলি আমার দৃষ্টিতে অত্যন্ত মূল্যবান তাঁকে চেনার জন্য। 

টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া জনপ্রতিনিধি সেই সময়েও ছিল (এখনো আছে বলাই বাহুল্য)। তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন: “এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে পাহারা দেবার, যাতে তারা দল র‍্যাগ করে অন্য দলে না যেতে পারে। আমি তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হল। তিনি বার বার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে, কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নাই। বিরোধী দল টাকা দিতেছে, যদি কিছু টাকা নিয়ে আসতে পারি আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগের পক্ষেই দিব।“ আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্যদলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের!” (পৃ ৩৪)। 

বই থেকে কিছু লাইন যেখান থেকে বোঝা যায় তাঁর নীতিবোধ কতটা প্রখর ছিল:

“উদারতা দরকার, কিন্তু নীচ অন্তঃকরণের ব্যক্তিদের সাথে উদারতা দেখালে ভবিষ্যতে ভালর থেকে মন্দই বেশি হয়, দেশের ও জনগণের ক্ষতি হয়।“ (পৃ ৪৭)

“আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল, আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতর সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জনি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।“ (পৃ – ৪৭-৪৮)

“কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও যে বাঙালির দুঃখকষ্টের কারণ তা তিনি বুঝেছিলেন খুব ভালো করে। তাই তিনি পরিষ্কার ভাষায় উদাহরণসহ লিখেছেন এভাবে: “অনেক সময় দেখা গেছে, একজন অশিক্ষিত লোক লম্বা কাপড়, সুন্দর চেহারা, ভাল দাড়ি, সামান্য আরবি ফার্সি বলতে পারে, বাংলাদেশে এসে পীর হয়ে গেছে। বাঙালি হাজার হাজার টাকা তাকে দিয়েছে একটু দোয়া পাওয়ার লোভে। ভাল করে খবর নিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ লোকটা কলকাতার কোন ফলের দোকানের কর্মচারী অথবা ডাকাতি বা খুনের মামলার আসামি। অন্ধ কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাসও বাঙালির দুঃখের আর একটা কারণ।“ (পৃ ৪৮)

ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যে তখনো ছিল, এবং যতই দিন গেছে তা বেড়ে চলেছে তা তিনি জানতেন। “পাকিস্তানের রাজনীতি শুরু হল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রকাশ্যে কেউ সাহস পায় নাই। যেদিন মারা গেলেন ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরাপুরি প্রকাশ্যে শুরু হয়েছিল।“ পৃ ৭৮। 

তিনি কর্মবীর ছিলেন। তাঁর কর্মদর্শনও ছিল পরিষ্কার। “আমি অনেকের মধ্যে একটা জিনিস দেখেছি, কোন কাজ করতে গেলে শুধু চিন্তাই করে। চিন্তা করতে করতে সময় নষ্ট করে এবং জীবনে কোন কাজই করতে পারে না। আমি চিন্তাভাবনা করে যে কাজটা করব ঠিক করি, তা করেই ফেলি। যদি ভুল হয়, সংশোধন করে নেই। কারণ, যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হতে পারে, যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না।“ (পৃ ৮০)

“কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাকে বুঝিতে বলার অধিকার জনগণের আছে।“ (পৃ ১০০)

ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, “আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নেই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই।“ (পৃ ১২৬) এখনকার বৃদ্ধ ছাত্রনেতারা এই বই পড়লে নিশ্চয় লজ্জা পেতেন। 

“জনমতের বিরুদ্ধে যেতে শোষকরাও ভয় পায়। শাসকরা যখন শোষক হয় অথবা শোষকদের সাহায্য করতে আরম্ভ করে তখন দেশের ও জনগণের মঙ্গল হওয়ার চেয়ে অমঙ্গলই বেশি হয়।“ পৃ ২১০

চীনের শান্তি সম্মেলনে গিয়ে তিনি নিজের চোখে যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা এবং চীনা নাগরিকদের মানসিকতার পরিবর্তন দেখেছিলেন তা অত্যন্ত শিক্ষণীয়। “চীন দেশে যে জিনিস তৈরি হয় না, তা লোকে ব্যবহার করবে না।“ “এরা শিল্প কারখানা বানানোর জন্যই শুধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। আমাদের দেশে সেই সময়ে কোরিয়ার যুদ্ধের ফলস্বরূপ যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছিল তার অধিকাংশ ব্যয় হল জাপানি পুতুল, আর শৌখিন দ্রব্য কিনতে। দৃষ্টিভঙ্গির কত তফাৎ আমাদের সরকার আর চীন সরকারের মধ্যে!” “এদেশে একটা বিদেশী সিগারেট পাওয়া যায় না। সিগারেট তারা তৈরি করছে নিকৃষ্ট ধরনের, তাই বড় ছোট সকলে খায়।“ পৃ ২৩১। 

দেশ স্বাধীন হলেই যে আপনাআপনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায় না তা তিনি ভালো করেই বুঝেছিলেন। চীনের সাথে পাকিস্তানের তুলনা করেছিলেন তিনি – “আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।“ পৃ ২৩৪।

পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কে তাঁর মনোভাব ছিল স্পষ্ট। “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।“ পৃ ২৩৪।

যুক্তফ্রন্ট করে ক্ষমতায় যাবার প্রস্তাবের উত্তরে ১৯৫৩ সালে তিনি বলেছিলেন, “ক্ষমতায় যাওয়া যেতে পারে, তবে জনসাধারণের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে না, আর এ ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। যেখানে আদর্শের মিল নাই সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।“ পৃ ২৫০।

“নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।“ “অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।“ পৃ ২৭৩।

আমাদের নেতারা কি দয়া করে এই বইটি মনযোগ দিয়ে পড়বেন এবং আত্মসমালোচনা করে দেখবেন – বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কতটুকু তাঁরা ধারণ করেন? 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts