Wednesday 13 April 2022

ডার্ক ম্যাটার রহস্য - গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে

 



গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – একটি টানটান উত্তেজনাকর রহস্যোপন্যাসের নাম হতে পারে সহজেই। কিন্তু নামের দ্বিতীয় অংশটা পড়েই বোঝা যায় বইটি বিজ্ঞানের। মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির রহস্য রহস্যোপন্যাসের চেয়েও রোমাঞ্চকর। তবে পার্থক্য হলো – রহস্যোপন্যাসের শেষে রহস্য উদ্ঘাটিত হয়, কিন্তু ডার্ক ম্যাটারের রহস্য এখনো অনেকটাই রহস্য হয়েই রয়ে গেছে।

ডার্কম্যাটারের রহস্যময়তাকে কোন গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার না করে বাংলার সহজিয়া বিজ্ঞানের বইতে তুলে আনার ব্যাপারটা খুব কঠিন। এই কঠিন কাজটিই অবলীলায় করে ফেলেছেন লেখক আবদুল গাফফার। পদার্থবিজ্ঞানের জটিল বিষয়সমূহের সহজীকরণ করেন যাঁরা – তাঁরা বোঝেন কাজটা কতটা কঠিন। তারজন্য প্রচুর পড়তে হয়, খাটতে হয়। এই বইটি লিখতে গিয়ে লেখক যে প্রচুর খেটেছেন, পড়াশোনা করেছেন, সেই পাঠ থেকে সারবস্তু তুলে এনে তাঁর পাঠককে দিয়েছেন তা এই বইয়ের সাতাশটি পরিচ্ছেদের প্রত্যেকটিতেই স্পষ্ট।

বাংলায় লিখতে গেলে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যাটা হয় – সেটা হলো যথাশব্দ খুঁজে বের করা। ইংরেজিতে ডার্ক ম্যাটার বললে পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা সবার কাছে সমানভাবে বোধগম্য -  ‘কৃষ্ণবস্তু’ কিংবা আরো সহজ বাংলায় ‘কালো পদার্থ’ বললে তা সবার কাছে সমান অর্থবোধক হয় না। তাই শব্দ প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা একটা বড় সমস্যা বাংলায় বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে। গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে – বইতে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিকে বাংলা নামে না ডেকে লেখক সঠিক কাজই করেছেন।

মহাবিশ্ব খুবই রহস্যময় জায়গা। রহস্যময়তার কারণ এখানে যতটা না দুর্বোধ্যতা – তার চেয়েও বেশি অদৃশ্যতা। পুরো মহাবিশ্বের শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগই এখনো মানুষের চেনা-জানার বাইরে রয়ে গেছে যার একুশ ভাগ ডার্ক ম্যাটার আর পঁচাত্তর ভাগ ডার্ক এনার্জি।

মহাবিশ্বের উপাদানের শতকরা মাত্র চারভাগ দৃশ্যমান পদার্থ দ্বারা গঠিত। দৃশ্যমান কথাটা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করলে আমরা যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে – মহাবিশ্বের যেসব পদার্থের উপর থেকে আলোর প্রতিফলন ঘটে আমাদের চোখে আসে। যেমন খালি চোখে আমরা আকাশের লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের আলো দেখতে পাই। অথবা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের মিথষ্ক্রিয়ায় পরোক্ষভাবে যান্ত্রিক উপায়ে দূর মহাকাশ থেকে পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করি। যেমন এক্স-রে কিংবা গামা-রে’র উপস্থিতি শনাক্ত করে হাজার আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের অস্তিস্ত্ব খুঁজে বের করা হচ্ছে। এসব অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করেও এখনো দেখা সম্ভব হয়নি শতকরা ছিয়ানব্বই ভাগ পদার্থ। মহাবিশ্বের এই বিশাল ভর এখনো রয়ে গেছে গুপ্ত। এই গুপ্ত মহাবিশ্বেরই খোঁজখবর দেয়া হয়েছে এই বইতে।

 সাতাশটি অধ্যায়ে ডার্ক ম্যাটারের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা হয়েছে এই বইতে। অধ্যায়গুলি ছোট ছোট – পড়তে পড়তে খেই হারিয়ে যায় না, তথ্যভারাক্রান্তও মনে হয় না। বিজ্ঞানের বই তর তর করে পড়ে ফেলার বই নয়। বিজ্ঞানের বই – সে যে ভাষাতেই লেখা হোক না কেন, সেখানে বিজ্ঞান থাকবে। আর বিজ্ঞান পড়তে হলে মগজে চাপ পড়তেই হবে। এই বইটা পড়তেও পাঠককে সময় নিয়ে পড়তে হবে – সেটাই স্বাভাবিক। আমি বেশ সময় নিয়ে বইটি পড়েছি এবং পড়ে আনন্দ পেয়েছি।

প্রাচীন মহাবিশ্বের ধারণা থেকে শুরু করে আধুনিক মহাবিশ্বের মানচিত্রে ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির স্থান কোথায় হতে পারে – সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমরা পেয়েছি এই বইতে। লেখক এ ব্যাপারে একটা সমন্বিত চিত্র বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছেন।

প্রথমা প্রকাশন-এর বইগুলির অঙ্গসৌষ্ঠব উন্নত। ব্যবহৃত ছবিগুলি চমৎকারভাবে পরিষ্ফুটিত। কিন্তু সম্পাদনায় কিছুটা ত্রুটি রয়ে গেছে। এটা আমাদের প্রকাশনা জগতের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলে মনে হয় আমার। বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। আমি বইটির প্রথম সংস্করণ পড়েছি। হয়তো পরবর্তী সংস্করণে এসব ত্রুটি সংশোধিত হয়ে গেছে। আরেকটি দুর্বলতা হলো ছবিগুলিতে কোন নম্বর দেয়া নেই, কিন্তু বর্ণনায় বলা হয়েছে “চিত্র-৩ এর মতো” বা ২ নম্বর ছবির মতো ইত্যাদি (পৃষ্ঠা ৬৫)। আবার অধ্যায়গুলির কোন গাণিতিক পরিচয় নেই – অথচ কোন কোন জায়গায় উল্লেখ আছে “চতুর্দশ অধ্যায়ে বলেছিলাম … (পৃষ্ঠা ১৩৯), ১১তম অধ্যায়ে দেখেছি… (পৃষ্ঠা ১০৬) ইত্যাদি। ছবিগুলির লেবেলিং বাংলায় করা হয়েছে – সেটা খুব ভালো হয়েছে। তবে ৯২ পৃষ্ঠার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের ছবিটি জার্মান ভাষায় রয়ে গেছে।

কিছু কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক পরিভাষা আমাদের নেই – যেমন নয়েজকে বাংলায় গোলমাল বললে যা বোঝা যায় – তার সাথে পদার্থবিজ্ঞানের নয়েজের কোন মিল নেই। পদার্থবিজ্ঞানে আমরা নয়েজ বলতে বুঝি – আনওয়ান্টেড ইনফরমেশান; অর্থাৎ অনাকাঙ্খিত সিগনাল। সেখানে গোলমাল বললে অর্থটা গোলমেলে হয়ে যায়। একই ভাবে স্লিট (slit) শব্দের অর্থ ‘ছিদ্র’ বললেও অর্থ বদলে যায় (পৃষ্ঠা ৮৩)

আরো টুকটাক কিছু কিছু বিষয় আরেকটু বিস্তৃতভাবে এলে ভালো হতো – যেমন বলা হয়েছে “ফার্মি টেলিস্কোপে সংযুক্ত আছে বিশাল আকারের এক চুম্বক। এই চুম্বক গামা রশ্মিকে ভেঙে ইলেকট্রন আর পজিট্রন জোড়ায় পরিণত করে ফেলতে পারে।“ (পৃষ্ঠা ১৪৩)  কিন্তু এটুকু বললে একটা সমস্যা থেকে যায়। তা হলো গামা রশ্মির উপর চৌম্বকক্ষেত্রের কোন প্রভাব নেই। সেক্ষেত্রে ঘটনাটা কীভাবে ঘটে তা পুরোটা ব্যাখ্যা করা দরকার।

ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জির আদ্যোপান্ত বইটি বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts