বেগানা পুষ্প
পড়তে শুরু করার আগেই চোখে পড়ে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” – যেখানে লেখা আছে “অতীব ঝুঁকিপূর্ণ
অঞ্চল, মারাত্মকভাবে ১৮+, অনুগ্রহপূর্বক প্রাপ্ত বয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠকের
স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থটি দূরে সরিয়ে রাখুন। অজাগর মন ও মগজের কুপ্রভাব থেকে বেগানা
উপাখ্যানের স্বাস্থ্য রক্ষায় যত্নবান হোন। আদেশক্রমে, কর্তৃপক্ষ।“
ব্যাপারটি যে
ভীষণ নতুন - তা নয়। শতাব্দী আগে আঠারো পেরিয়েছি। আমার নিজস্ব আঠারোর আগেই কত ধরনের
১৮+ মার্কা বই পড়ে ফেলেছিলাম – সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ১৮+ বিজ্ঞাপিত যেসব বই যেসব
“নিষিদ্ধ” আশায় হস্তগত করে দ্রুত গিলে ফেলেছিলাম তাদের বেশিরভাগের বিজ্ঞাপনই সার, ভেতরে
সারবস্তু কিছুই নেই। বেগানা পুষ্পের ক্ষেত্রে প্রশ্ন বয়সের নয়, প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
বলা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠক যেন বেগানা পুষ্পের স্পর্শ
না পায়। প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠকের সংজ্ঞা কী? তাদের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থ দূরে সরিয়ে
রাখার দায়িত্ব কার?
যাই হোক – এই
লাইনগুলি বইয়ের শুরুতে ছাপিয়ে দেয়ার তাগিদ লেখকের না প্রকাশকের জানি না। সৃজনশীল সাহিত্যের
ক্ষেত্রে লেখকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাঁর গল্প তিনি কীভাবে বলবেন, কতটুকু বলবেন।
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কী কী করবে – গল্পের কাঠামোর ভেতর থেকে কীভাবে বেড়ে উঠবে, কীভাবে
প্রথা ভাঙবে – সবই লেখকের হাতে। সৃজনশীল লেখকদের ক্ষমতা তাঁর সৃজনশীলতার কারণেই ঈর্ষণীয়।
মুহম্মদ নিজামের সৃজনক্ষমতা ঈর্ষণীয়।
“বেগানা পুষ্প”র
নায়ক জীবন আহমেদ। জীবনের গল্প জীবনের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন লেখক মুহম্মদ নিজাম। উত্তম
পুরুষে লেখা গল্পের সুবিধে হলো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীতার পাশাপাশি মনে মগজে কী চলছে
তার শৈল্পিক বর্ণনার সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধাটি অসুবিধাও বটে। কারণ উত্তম পুরুষে বলা
গল্পের দৃষ্টি একমুখি হয়। সবার মনের কথা খুলে বলার স্বাধীনতা তখন লেখকের থাকে না। বেগানা
পুষ্পও সে হিসেবে শুধুমাত্র জীবনের দৃষ্টিতে দেখা একপাক্ষিক বিবরণ। বিথীর অন্তর্দহন
কিংবা আনুষঙ্গিক মিথষ্ক্রিয়ার বিবরণও জীবন যতটুকু দিয়েছে ততটুকুই।
বেগানা পুষ্প
প্রেমের উপন্যাস। ম্যাটম্যাটে মধ্যবিত্ত সংস্কারে আবদ্ধ জলে-নামবো-চুল-ভেজাবো-না ধরনের
প্রেম নয়। উদ্দাম শরীরী প্রেম। শরীর বিনিময়ের বিশদ বিবরণ আছে বলেই হয়তো গল্প শুরুর
আগে সেই ১৮+ এর আদিখ্যেতা। যদিও লেখক এখানে প্রেমের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ব্যবধান
বর্ণনা করেছেন এভাবে – “প্রেম হল মধ্যবিত্তের পূজার থালা কিংবা ছেলেবেলায় মেলায় হারিয়ে
যাওয়া জমজ ভাই। সে যখন এই জিনিসের সাক্ষাৎ পায়, আবেগে আবেশে দিশেহারা হয়ে যায়। আর ভোগবাদী
বড়লোকেরা কুরবানীর পশুর মতো যত্ন করে ঘরে তোলে, আয়োজন করে জবাই দেয়। এরপর তেলে হলুদে
আদায় লবঙ্গে মরিচে মাখামাখি করে কষিয়ে জ্বালানি দেয়, রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে।“ [পৃ ৩৯-৪০]।
ছোট ক্যানভাসে
রঙের আধিক্য ঘটলে, কিংবা তুলির আঁচড় মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বাস্তব
পরাবাস্তবের সীমানা ঘুচে যায়, বেগানা পুষ্পেও সেরকম ঘটেছে। ইতিহাস দর্শন সমাজ এবং সমাজের
মানুষ সব যেভাবে তালগোল পাকিয়ে থাকে – তার সবকিছুই কিছু কিছু আঁকতে চেয়েছেন লেখক এখানে।
জীবন লেখক হবার
স্বপ্ন দ্যাখে, আবার এক সময় লন্ডন যাবার চেষ্টাও করে। কিন্তু বিথীর শরীর বেয়ে প্রেমে
পড়ে যাবার পর সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। বিথী যখন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় – তখন বর্তমানকে
অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার কৌশল চমৎকার।
জীবনের ভাবনার
মধ্য দিয়ে লেখক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিয়েছেন। যেমন, “ভিড়ের ভেতর ভ্রান্তি
থাকে, জ্ঞান থাকে যৎসামান্য। নীলক্ষেতের কোন একটা বইয়ের দোকানের কোণায় পড়ে থাকা “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী”
কিংবা “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা” বইয়ে যে পরিমাণ সত্যবদ্ধ ঘটনা রয়েছে,
সমগ্র ঢাকা শহরের যাবতীয় জনমানুষের ভিড়ে একযুগ ঘুরেফিরেও এইটুকু সত্য কেউ আহরণ করতে
পারবে না।“ [পৃ ৬২]
পুরুষের নেতিবাচক
দিক সম্পর্কে জীবনের পর্যবেক্ষণ নির্মম: “একটা পুরুষ একটা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট এবং
বিকৃত আচরণ করার ক্ষমতা রাখে। এই পৃথিবীর মেয়েরাই শুধু সেই দৃশ্যগুলোর সাক্ষী থাকে।
পুরুষ জাতির পরম সৌভাগ্য যে, প্রিয়তম নারী জাতি সীমাহীন গ্লানি কিংবা অতলান্ত ভালোবাসা
দিয়ে পুরুষ জাতির এই কদর্য দিকটা সভ্য মানুষের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখে।“ [পৃ ৬৭]
পুরুষ মানুষ
প্রেমিকার জন্য কাউকে খুনও করতে পারে। এটা দেখা গেল জীবনের বেলায়। আজমল বিথীকে নিয়ে
বাজে প্রস্তাব করায়, জীবন ও বিথীর গোপন মিলনের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করার
চেষ্টার কারণে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে আজমলকে খুন করে জীবন। তবে এটা কি শুধুমাত্র
বিথীর সম্মান বাঁচাতে, নাকি নিজেরও – এটা পরিষ্কার হয় না। তবে আজমলকে ঠান্ডা মাথায়
খুন করার পরও জীবন কীভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকে – এটাই আশ্চর্যের। পাঠক হবার এখানেই
আনন্দ যে – একজন খুনি কিংবা ধর্ষকও যদি নিজে
কথা বলে - পাঠকের কাছে সবকিছুই অবলীলায় বলে ফেলে – লজ্জা কিংবা ভয় না করেই।
বইটির ছাপা
এবং বাঁধাই বেশ উন্নত। বানান ভুল মাত্র কয়েকটি। নীলা হারুনের প্রচ্ছদ সুন্দর। তবে প্রকাশনীর
নাম “নয়েস” – শুনতে কেমন যেন লাগে।
মুহম্মদ নিজাম
একটি ভালো গল্প বলেছেন। ভালোভাবেই বলেছেন।
No comments:
Post a Comment