#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬১
হরতালের খবরটা কাল রাতেই পেয়েছিলাম। মৌখিক পরীক্ষার দিন হরতাল
আর ভালো লাগছে না। পরীক্ষা যত তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছি, ততই যেন পিছিয়ে যাচ্ছে। সকালে
যতটুকু সম্ভব তাড়াতাড়ি বের হয়েছি। জামায়াত-শিবিরের হরতাল হলে পরীক্ষা হবে না সে ব্যাপারে
শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলা যেতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের হরতাল। দেখা যাবে প্র্যাকটিক্যাল
পরীক্ষাসহ সবকিছু ভেতরে ভেতরে হয়ে গেছে। হরতালের কারণে কেউ যদি পরীক্ষা দিতে না পারে
তার বারোটা বাজবে।
ঢিমেতালে হরতাল হলে অনেকসময় ট্রেন চলে। সকালে আগেভাগে চলে
এসেছি ফতেয়াবাদ স্টেশনে, থুড়ি জংশনে। ফতেয়াবাদ সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জংশন।
প্লাটফরমের কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। স্টেশনমাস্টারের বদলে জংশনমাস্টার বলে কিছু
হয় কি না জানি না, কেউই নেই। বিশ্রামাগারে কয়েকটি ছোটবড় ছাগল দেখা যেতো অন্য সময়। আজ
তাদের দুর্গন্ধ বাহ্যি ছড়িয়ে আছে বিশ্রামাগারের সিমেন্টের বেঞ্চে, কিন্তু তাদের দেখা
যাচ্ছে না কোথাও।
ফেব্রুয়ারির দশ তারিখ আজ। মাঘ মাসের শেষের দিকে। এখনো কুয়াশার
চাদরে মোড়া রেললাইন, লাইনের দুপাশে সবুজ গ্রাম। নাজিরহাট লাইনের একটি ট্রেন এর মধ্যে
চলে আসার কথা। আসেনি। মনে হচ্ছে আজ জোরেশোরে হরতাল হচ্ছে। বাস-ট্রেন বন্ধ করে কি মিরপুর
উপনির্বাচনের ফলাফল বদলানো যাবে? ছয় তারিখও তো হরতাল ছিল ঢাকায়। কিছু কি হয়েছে?
সকাল দশটা থেকে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবার কথা। কার কখন হবে
তার ঠিক নেই। তাই শুরু থেকে গিয়ে বসে থাকতে হবে কখন ডাক পড়ে। মোবাশ্বেরস্যার আমাদের
পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। পরীক্ষা শুরুর পর থেকে তিনি আগের চেয়েও বেশি গম্ভীর হয়ে
গেছেন। ইলেকট্রনিক্স থিওরি পরীক্ষার সময় তিনি আমাদের রুমে এসেছিলেন। আমার জ্যামিতিবাক্সের
ঢাকনা খুলতে খুলতে অনেকটা চোর ধরার ভঙ্গিতে হিসহিস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “অ্যাই ছেলে,
নকল করছো নাকি?”
আমি ঠিক জানি না মোবাশ্বেরস্যার আমাকে ঠিক কী কারণে অপছন্দ
করেন। হতে পারে আমার চেহারাটাই তাঁর মেজাজ বিগড়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। ফাইনাল ইয়ারে ওঠার
পর ডিপার্টমেন্টের শিক্ষকদের সকলেই আমাকে চেনেন। আমার নাম জানেন। কিন্তু মোবাশ্বেরস্যারের
কাছে আমি এখনো “অ্যাই ছেলে”ই রয়ে গিয়েছি। আর পরীক্ষার হলে বসে আমি নকল করতে পারি এই
সন্দেহ করছেন তিনি! অপমানের কাঁটা খচখচ করতে থাকে মাথার ভেতর। আমরা আনন্দ ভুলে যাই,
কিন্তু পরম দুঃখের স্মৃতিগুলি মনে থেকে যায়। সম্মানের স্মৃতি আমরা বিস্মৃত হই। কিন্তু
অপমানের স্মৃতি আমরা ভুলে যেতে চাইলেও ভুলতে পারি না।
আজ মৌখিক পরীক্ষায় যদি সময়মতো উপস্থিত থাকতে না পারি – তাহলে
সাংঘাতিক অবস্থা হবে। মোবাশ্বেরস্যার কথার চাবুকে চামড়া খুলে নেবেন। রেললাইন ধরে হাঁটতে
শুরু করলাম। বেশিক্ষণ লাগবে না ফ্যাকাল্টিতে পৌঁছতে।
“কী রে প্রদীপ, এদিক দিয়ে কই যাস?”
লুঙ্গিপরা মাফলারমোড়া মুখের ছেলেটিকে চিনতে কয়েক সেকেন্ড
বেশি লাগলো। শুকদেব! রেললাইনের পাশ দিয়ে ধানক্ষেতে নেমে যাওয়া মেঠোপথের মাঝখানে কয়েকজন
বয়স্ক মানুষের সাথে দাঁড়িয়ে আছে শুকদেব। শুকদেব রুদ্র।
“ভাইভা আছে। তোর তো আরাম, পরীক্ষা শেষ।“
“আজ হরতালের মধ্যে কিসের ভাইভা? ভাইভা হবে না। চল্ বাড়িত
চল্।“
শুকদেবের বাড়ি এদিকে। সে আমাদের ব্যাচের – ম্যাথের। তাদের
প্র্যাকটিক্যাল নেই, পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন হলো। আমাদের পরীক্ষা শেষ হবার আগেই
তাদের রেজাল্ট হয়ে যাবে।
কিছুদূর আসার পর দেখলাম রেললাইন ধরে আমার আগে আগে চলমান এক ব্যক্তির গতি ক্রমশ কমতে
শুরু করেছে। প্লাস্টিকের ব্যাগে মোড়ানো টিফিন ক্যারিয়ার হাতে সুশীলদা – আমাদের সেমিনার
লাইব্রেরিয়ান।
“আপনাকে দেখে দাঁড়ালাম।“
একবারও পেছনে না ফিরে তিনি আমাকে কীভাবে দেখলেন জানি না।
হয়তো শুকদেবের সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন দেখেছেন। সুশীলদা শুকদেবের দাদা, সে হিসেবে
আমাদেরকে তাঁর তুমি বলারই কথা। কিন্তু সুশীলদা আমি তাঁর ছোটভাইয়ের বন্ধু – এই পরিচয়ের
চেয়েও ডিপার্টমেন্টের ছাত্র পরিচয়কে বেশি গুরুত্ব দেন।
সুশীলদা প্রতিদিনই এই পথে হেঁটে হেঁটে ইউনিভার্সিটিতে যান।
তাঁর সাথে নানারকম কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম।
“আপনাদের থিসিস শেষ হতে তো আরো কয়েক মাস আছে, তাই না?”
“এপ্রিলের বারো তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে।“
“তাহলে তো আরো দুই মাস আছে। এই দুই মাস তো আপনি ছরারকুলেই
আছেন। আমার একটা উপকার করেন। আমার ছেলেটা ইউনিভার্সিটি কলেজে পড়ছে। তাকে একটু ফিজিক্সটা
দেখিয়ে দেন। সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন হলেও চলবে। আমি তাকে পাঠাবো আপনার কাছে।“ সুশীলদার
কথায় এক ধরনের আন্তরিক অধিকারবোধ প্রকাশ পায় – যা ভালোই লাগে আমার।
সায়েন্স ফ্যাকাল্টির গেটের কাছেই দেখা হয়ে গেলো হাফিজ, ফারুক,
প্রদীপ নাথসহ আরো অনেকের সাথে। তাদের প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। হরতাল
হলেও পরীক্ষা বন্ধ হয়নি। ক্যাম্পাসে বাসগুলি চলছে না। কিন্তু অন্যান্য সবকিছু মনে হচ্ছে
স্বাভাবিক। ছাত্রলীগ এখনো কোনঠাসা হয়ে আছে এই ক্যাম্পাসে।
আজ যাদের ভাইভা আছে সবাই চলে এসেছে। হাটহাজারি রোডে বাস চলছে
না, কিন্তু টেম্পু, টেক্সি এসব চলছে। দশটা থেকে ভাইভা শুরু হবার কথা। মোবাশ্বেরস্যারের
রুমের সামনে আমরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছি। সোয়া দশটায় জানানো হলো – আজকের ভাইভা হবে না।
আগামীকাল থেকে রুটিন অনুসারে ভাইভা হবে। আজকেরটা হবে সবার ভাইবা হয়ে যাবার পরের দিন।
তারিখ পরে ঘোষণা করা হবে।
মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মাস্টার্সে উঠে হল পরিবর্তন করে
সোহরাওয়ার্দী থেকে আলাওলে নাম লিখিয়েছিলাম শুধুমাত্র আগে পরীক্ষা শেষ করার জন্য। পরীক্ষার
রোলনম্বরগুলি আলাওল থেকে শুরু হয়। ভাইভার রুটিন হয় সেভাবে। ভেবেছিলাম ভাইভার ভারমুক্ত
হয়ে যাবো তাড়াতাড়ি। কিন্তু এখন কী হলো? সবার ভাইভা হয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে!
আজ যাদের প্র্যাকটিক্যাল বা ভাইভা ছিলো না তারাও অনেকে এসেছে
ডিপার্টমেন্টে। ছেড়ে যাবার আগে মায়া বেড়ে যায়। এখন ডিপার্টমেন্টের প্রতি আমাদের মায়া
সম্ভবত বেড়ে যাচ্ছে। সেমিনার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসলাম। অনেকেই ছোট ছোট ডায়েরি বের করে
সহপাঠীদের হাতের লেখা সংগ্রহ করছে। অটোগ্রাফ!!
তাই তো – এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যখন একেবারে চলে যাবো – আর তো
দেখা হবে না সহপাঠীদের সাথে। সবাই যে যার পথে চলে যাবে, যে যার মতো বদলে যাবে। সময়
কাউকেই একই রকম থাকতে দেয় না। ক্লাসিক্যাল কিংবা কোয়ান্টাম – যে মেকানিক্সই হোক – টাইম
ডেরিভেটিভ বা সময় হলো সবচেয়ে বড় অপেক্ষক। টাইম ইজ দ্য মোস্ট স্ট্রেজ ভেরিয়েবল ইন লাইফ
মেকানিক্স।
সহপাঠীদের দিকে তাকালাম। আজ থেকে অনেক বছর পর অনেকের নামও
মনে থাকবে না। আমাদের ক্লাসে প্রায় একশ ত্রিশ জন শিক্ষার্থী। এখনও কি নাম জানি সবার?
সবার সাথে সমানভাবে মেলামেশাও তো করিনি। এই যে ঝর্ণা-আপা – যাকে আমাদের সোবহানস্যারও
এখন ঝর্ণাভাবী বলে ডাকেন – ম্যাকস্যারের বউ হবার সুবাদে। তাঁর সাথে আবার কোনোদিন যদি
দেখা হয় তিনি কি আমাকে চিনতে পারবেন? এই যে সুনীলদা – ঘোড়াশালের একটি সরকারি অফিসের
কর্মকর্তা। আমাদের কত সিনিয়র। এতবছর পরে শিক্ষাছুটি নিয়ে মাস্টার্স করতে এসেছেন। তাঁর
কি মনে থাকবে আমার কথা? প্রিলিমিনারি থেকে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট থেকে অনার্স
করে যারা এখানে এসে আমার সহপাঠী হয়েছে – তাদের অনেকের সাথে ভালো করে কথাও বলা হয়ে ওঠেনি।
অনেক বছর পরে যদি অন্য কোন পরিবেশে দেখা হয়ে যায়, তাদের চিনতে পারবো তো? তারা চিনতে
পারবে তো? কেমন যেন একটা বিষাদ এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে শুরু করে আমায়। কেমন যেন স্বার্থপরও
মনে হতে থাকে নিজেকে। কেবলই ভাবছি – আমাকে মনে থাকবে কি না। কেন ভাই? আমি কী এমন হয়েছি
যে আমাকে মনে রাখতে হবে? যার যার নিজস্ব পরিবেশ, নিজস্ব সময় – গড়ে দেবে নিজেদের নতুন
পৃথিবী। সেখানে এইসব দিনগুলি কেবল অতীত হয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে ঝড় ঝাপটার মতো কিছু স্মৃতির
ধুলো উড়বে, তারপর আবার সামনে চলা জীবন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এতদিন সবার সাথে একটা সৌজন্যমূলক সম্পর্ক
বজায় রেখেছি। কিন্তু সবারই আলাদা আলাদা বৃত্ত ছিল। এটাই স্বাভাবিক। এখন মনে হচ্ছে সময়টা
বড্ড বেশি নষ্ট করে ফেলেছি। চার বছরের জায়গায় সাত বছর কাটিয়েছি এই ক্যাম্পাসে। অথচ
সময়টাকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারিনি। সময় – বড় বিচিত্র অপেক্ষক বলেই তা চলে যাবার পরেই
আক্ষেপটা আসে যখন তাকে আর ফিরিয়ে আনার কোন উপায় থাকে না।
“তোর ঠিকানাটা লিখে দে।“ – লিপি একটা বাঁধানো খাতা এগিয়ে
দেয়। তার ডায়েরিও যে তার মতো এত সুদর্শনা হবে ভাবিনি।
“কেন? চিঠি লিখবি?”
“না, বিয়ের চিঠি পাঠাবো।“ – লিপি হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।
ঠিকানা লিখে দেয়ার অনুরোধ আরো অনেকেই করেছে। জানি, কেউই লিখবে
না কোন চিঠি। বিয়ের চিঠি পাঠাবার কথাও মনে থাকবে না কারো। তবুও ঠিকানা লিখি, আমাদের
গ্রামের বাড়ির ঠিকানা।
আমার থলের ভেতরও একটা ‘অটোগ্রাফ’ খাতা আছে। অনেক বছর আগে
শিল্পকলা একাডেমিতে মঞ্চের অভিনেতাদের অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম। রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী
মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আসাদুজ্জামান নূর, শান্তা ইসলাম এরকম আরো অনেকের। কিন্তু
কিছুদিন পর সেলিব্রেটিদের দস্তখত শিকারের ইচ্ছেটা চলে গেছে। তবে খাতাটা রয়ে গেছে। ওটা
বের করলাম – আমার বন্ধুরা আমার কাছে সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটি। তাদের স্বাক্ষর রয়ে যাক।
রিনা আমার খাতাটা টেনে নিয়ে খসখস করে লিখলো, “তোর মতো কুফা
আমি আমার জীবনে আর একটাও দেখি নাই।“
“বাহ্, আর একটাও দেখিসনি? মানে আমি ইউনিক বলতে চাচ্ছিস?
প্রশংসা করছিস মনে হচ্ছে!“
“জ্বি না, প্রশংসা করছি না। কুফা কোন প্রশংসাবাচক শব্দ নয়।
নিন্দাবাচক শব্দ।“ – রিনা ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলো। সে রেগে আছে বুঝতে পারছি, কিন্তু
রাগের কারণটা বোঝা যাচ্ছে না।
পরবর্তী কয়েকদিনে সহপাঠীদের অনেকের সাথেই হাতের লেখা বিনিময়
হলো। স্মৃতি ধরে রাখার কত রকমের চেষ্টা আমাদের। ভবিষ্যতই বলে দেবে স্মৃতির ভাণ্ডার
কতটা পূর্ণ থাকে।
হরতালের পরদিন থেকে ভাইভা শুরু হয়েছে। আমরা দল বেঁধে সেমিনার
লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকি। মোবাশ্বেরস্যারের রুম থেকে ভাইভা দিয়ে কেউ বের হলেই আমরা
তাকে ঘিরে ধরে জানতে চেষ্টা করি কী কী প্রশ্ন করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সটার্নাল এসেছেন। তিনি
নাকি সবাইকে নাস্তানাবুদ বানিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। জেনারেল ভাইভাতে ৫০ নম্বর। সতেরোর কম
দিলেই ফেল। ভাইভাতে ফেল করলেই কম্মো সাবাড়। সব পরীক্ষা আবার দিতে হবে আগামী বছর। এরকম
জীবন-মরণ সমস্যা হলে স্নায়ুর উপর চাপ তো পড়বেই। ভাইভা দিতে গিয়ে মাথাঘুরে পড়ে যাবার
অবস্থা হয়েছে কয়েকজনের।
সবার ভাইভা শেষ হবার পরের দিন আমাদের প্রথম দিনের না হতে
পারা ভাইভা শুরু হলো। মৌখিক পরীক্ষা আমার কোনোদিনই ভালো হয় না। স্যাররা যে প্রশ্নগুলি
করলেন সেগুলি লিখতে দিলে হয়তো লিখতে পারতাম। কিন্তু মৌখিকভাবে উত্তর দিতে গিয়ে ঘাম
বের হয়ে যাবার জোগাড়। পরীক্ষাশেষে কী পারলাম কী পারিনি তা মনেই রইলো না। পরীক্ষা যে
হয়ে গেছে তাতেই বেশ হালকা লাগছে নিজেকে।
পরদিন থেকে থিসিসের কাজে মন দিলাম আবার। ডিপার্টমেন্টের সেমিনার
লাইব্রেরিতে গিয়ে ফিজিক্যাল রিভিউর পাতা উল্টাই। একদিন সোবহানস্যার সেমিনারে ঢুকলেন।
আমাকে দেখে বললেন, “প্রদীপ, তুমি একটু আমার অফিসে আসো।“ আমার সহপাঠী জাফর ছিল সুশীলদার
সামনের চেয়ারে বসা। সোবহানস্যার জাফরকেও ডাকলেন।
আমি ভেবেছিলাম সোবহানস্যার দোতলায় চেয়ারম্যানের রুমে নিয়ে
যাবেন। কিন্তু তিনি তাঁর তিন তলার অফিসরুমে ঢুকলেন। সেমিনার রুমের যে পাশে মোবাশ্বেরস্যারের
অফিস, তার বিপরীত দিকে সোবহানস্যারের অফিস।
“তুমি সেদিন অনেক ভালো কথা বলেছিলে। বই পড়ছি না বলেই লাইব্রেরির
বইয়ের উপর ধুলো জমে যাচ্ছে কথাটা একদম ঠিক বলেছো। তাই তোমাকে ডেকে এনেছি আমার লাইব্রেরি
প্রজেক্টের বইগুলি একটু গুছিয়ে রাখতে।“
আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমার বলা কথাগুলির কিছুটা স্যার এখনো
মনে রেখেছেন দেখে ভালো লাগলো। কিন্তু স্যার কি এখন তাঁর বইয়ের আলমারি পরিষ্কার করাবেন
জাফর আর আমাকে দিয়ে? সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টে ছাত্র-পাঠাগার প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প
চালু করেছেন ব্যক্তিগত উদ্যোগে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে তিনি তাঁর অফিসের
আলমারিতে রাখছেন। ছাত্ররা এখান থেকে বই ধার নিতে পারবে। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে সেমিনার
লাইব্রেরি থাকতে আরেকটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরি কী কারণে লাগবে? এটার মূল উদ্দেশ্য কী?
ছাত্রদের কাছ থেকে বই নেয়া কতটা ন্যায়সঙ্গত? এসব প্রশ্ন প্রামাণিকস্যার সরাসরি করেছেন
বলে সোবহানস্যারের সাথে প্রামাণিকস্যারের সম্পর্ক এখন আরো খারাপ হয়েছে। সেক্ষেত্রে
প্রামাণিকস্যারের ছাত্রকে ডেকে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরি প্রকল্পের কাজ করানোটা উদ্দেশ্যমূলক
নয় তো?
সোবহানস্যারের নির্দেশমতো জাফর আর আমি স্যারের টেবিল থেকে
বইগুলি একটি আলমারিতে তুলে রাখতে শুরু করলাম। হঠাৎ স্যার বললেন, “তুমি কি জানো যে ডিপার্টমেন্টে
লেকচারার নিয়োগ করা হচ্ছে? তুমি একটা দরখাস্ত করে দাও।“
“আমার তো এখনো পরীক্ষাই শেষ হয়নি স্যার।“
“তা তো আমি জানি। সিলেকশান কমিটির মিটিং হতে হতে তোমাদের
পরীক্ষা হয়ে যাবে। হারুনকেও বলেছি দরখাস্ত করতে। তুমিও করো।“
সোবহানস্যারকে হঠাৎ খুব মহানুভব মানুষ বলে মনে হচ্ছে। টেবিলের
সব বই আলমারিতে গুছিয়ে রেখে স্যারের রুম থেকে বের হতেই জাফর আমার পিঠে চাপড় দিয়ে বললো
– “তোমার তো কপাল খুলে গেছে। তুমি তো মিয়া ডিপার্টমেন্টে জয়েন করবা!”
কপালে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু সোবহানস্যার ডিপার্টমেন্টের
চেয়ারম্যান, তিনি যখন দরখাস্ত করতে বলেছেন, তখন নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই বলেছেন। স্বপ্নের
বুনন কখন কীভাবে যে শুরু হয়ে যায়! বাস্তবতা ভুলে গিয়ে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।
ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক হবো। রোকসানা লিপি আমার খাতায় লিখেছে – “প্রামাণিকস্যারের কাছে
থিসিস করে আরেকটা প্রামাণিকস্যার হয়ো না।“ কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে শিক্ষক যদি হতে
পারি – চেষ্টা করবো প্রামাণিকস্যারের মতোই হতে।
পরদিন প্রামাণিকস্যার পুরো ব্যাপারটা শুনে বললেন, “ওসব স্বপ্ন
দেখা বাদ দাও। বর্তমান প্রশাসনের আমলে তোমাকে ডিপার্টমেন্টে নেবে না।“
স্যারের অপ্রিয় সত্যকথা আমার ভালো লাগলো না।
No comments:
Post a Comment