Saturday 19 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬৪

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬৪

কর্মজীবীদের যেমন শ্রেণিবিভাগ আছে, যারা বেকার তাদেরও নিশ্চয় শ্রেণিবিভাগ আছে। ক্যাডারভিত্তিক কর্মজীবীদের শ্রেণিবিভাগ মোটামুটি সহজ। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মজীবী। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির যাঁরা তাঁরা কর্মকর্তা। কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির যাঁরা তাঁরা কর্মচারী। প্রথম শ্রেণির কর্মচারী কিংবা চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা – কেন বলা হয় না জানি না। বেকারদের ক্ষেত্রে এই শ্রেণিবিভাগ কী রকমের হবে? প্রথম শ্রেণির বেকার, দ্বিতীয় শ্রেণির বেকার, তৃতীয় শ্রেণির বেকার ইত্যাদি? এই শ্রেণিবিভাগ কীভাবে করা হবে? অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, নাকি কে কতদিন ধরে বেকার আছে তার ভিত্তিতে? বেকারত্বের অভিজ্ঞতা কীভাবে মাপা হবে? 

বেকারত্বের শ্রেণিভেদ অনুযায়ী আমি কোন্‌ শ্রেণির বেকার এখনো বুঝতে পারছি না। তবে যেসব কর্মজীবী মাসশেষে বেতন পাবার গর্বে স্ফীত হয়ে “বেকারদের আবার সময়ের অভাব!” জাতীয় তির্যক বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেন  – তারা যে ঠিক বলেন না তা বুঝতে পারছি। পুরনো বেকারদের কথা জানি না, কিন্তু আমার মতো নতুন বেকারদের সময়ের সত্যিই অভাব। আমি এখন সিনেমা দেখার সময়ও পাচ্ছি না – এই ব্যাপারটা নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। অথচ ক’দিন আগেও পরীক্ষার সময়গুলিতেও হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আসতে পারতাম। 

এখন দিন শুরু হতে না হতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সকাল সাতটার আগেই আক্কাস এসে হাজির হয়। আমি এই বিল্ডিং ছেড়ে চলে যাবার আগেই সে ফিজিক্স শেষ করে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেছে। তার জেদ দেখে ভালোই লাগছে। 

আটটায় তাকে বিদায় দিয়ে বেরিয়ে পড়ছি নন্দীর হাটের উদ্দেশ্যে। সেখানে রেললাইনের পশ্চিম দিকের পাড়ায় একটা টিউশনি গছিয়েছে অসীম। ক্লাস নাইনের তিনজন মেয়েকে অংক করানোর কথা ছিল। কিন্তু প্রথমদিন যাবার পরে দেখা গেলো বাড়িতে যত ছেলেমেয়ে আছে সবগুলি এসে লাইন ধরে বসে গেছে বারান্দায়। সর্বকনিষ্ঠটি সবে বর্ণমালা শিখছে। ছয় বোনের ওটিই একমাত্র ভাই। বড় তিনজন এক ক্লাসেই পড়ছে। কে কোন্‌ ক্লাসে আটকে গিয়ে তারা একজোট হয়েছে জিজ্ঞেস করিনি। তাদের বয়স বাড়ছে, কিন্তু অপুষ্টির কারণে স্বাস্থ্য কিংবা মেধা কোনটারই বিকাশ হচ্ছে না। তাদের পিতার কথাবার্তা শুনে মনে হলো শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে এসেছেন তিনি। কন্যাদেরকে কোনরকমে এসএসসি পরীক্ষায় বসাতে পারলেই তাঁর কাজ শেষ। পাস-ফেল যাই করুক – বিয়ে দিয়ে দেবেন। তাহলে এখানে আমার ভূমিকা কী? পাস অপ্রয়োজনীয় হলে তো মাস্টারের দরকার হয় না। জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর পাওয়া গেলো – “আপনি শুধু আমার ছেলেটাকে বিশেষভাবে দেখবেন। ওটাই আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।“ পিতার এ কথা শুনে ছয়কন্যা মুখ কালো করে বসে রইলো, আর বংশের মুখ উজ্জ্বল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিশুটি তার নাসিকানির্গত তরল হাতে মাখিয়ে হাতটা বইয়ের পাতার অ-তে ঝুলন্ত অজগরের গায়ে মুছে ফেললো।

প্রথমদিনের পরেই এখানে আর যাচ্ছি না বলে দেয়ার জন্য অসীমকে খুঁজছি। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে সে কিংবা ইলোরা-মিতু-দীলিপ কেউই আসছে না। হয়তো পরীক্ষা আছে বা অন্যকিছু। 

সপ্তাহে তিন দিন বিকেল তিনটা থেকে কর্নিয়া কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে যাই। সেজন্য দুপুরের আগেই বের হয়ে যাই। ফতেয়াবাদ থেকে তিন নম্বর বাসে উঠে চকবাজার গিয়ে নামি। হোটেলে ভাত খেয়ে পাঁচলাইশে কোচিং সেন্টারে যাই। মেডিকেল অ্যাডমিশানের এই কোচিং সেন্টারটি দিয়েছে মেডিকেলের কয়েকজন ছাত্র। তাদের মধ্যে দু’জন – সুজন ও ভাগ্যধন আমার খুবই স্নেহভাজন। রেটিনার সাথে পাল্লা দেবার জন্য তারা কর্নিয়া নাম দিয়ে কোচিং সেন্টার শুরু করেছে। ফিজিক্সের কয়েকটি ক্লাস নিতে পারবো কি না জিজ্ঞেস করতেই আমি সানন্দে রাজি হয়ে গিয়েছি। প্রথমদিন ক্লাস নিতে গিয়েই বলে দিয়েছি আমি মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় তিন বার ফেল করেছি। তাতে সারাক্লাস হো হো করে হেসেছে। আমার বেশ মজা লেগেছে। সদ্য উচ্চমাধ্যমিক দেয়া হবু-ডাক্তারদের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের অলিতে গলিতে ঘুরতে বেশ ভালো লাগছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য সাজেস্টিভ পড়াশোনা করলেও এখন ভর্তি পরীক্ষার বহুনির্বাচনী পরীক্ষার জন্য সবকিছু পড়তে হচ্ছে। সুতরাং এখানে যে অনাগ্রহ দেখাবে সে পিছিয়ে পড়বে। তাই সবাই চোখ বড় বড় করে শুনছে আমি কী বলছি। মনে হচ্ছে মাস্টারি ব্যাপারটা আমি পছন্দ করতে শুরু করেছি।  

আজ কর্নিয়ায় যেতে হবে না। দুপুরটা হাতে আছে। বিকেলটাও। বিকেলে প্রদীপ নাথের সাথে একটা ব্যাচেলর বাসা দেখতে যাবার কথা ছিল। চট্টগ্রাম শহরে ব্যাচেলর বাসা পাওয়া খুবই মুশকিল। এখানে-সেখানে মেস আছে অনেক। কিন্তু আমি চাচ্ছি নিজের মতো স্বাধীনভাবে থাকার জন্য এক রুমের একটা বাসা – যেখানে বাথরুম শেয়ার করতে হবে না। নাথের এক আত্মীয় নালাপাড়ার ওদিকে একটা বাসার খোঁজ দিয়েছিল। বিকেলে সেখানে খোঁজ নিতে যাবার কথা ছিল। কিন্তু সকালে টিউশনি থেকে এসে রুমে ঢুকে প্রদীপ নাথের চিরকুট পেলাম। সে এসে আমাকে না পেয়ে চিঠি লিখে গেছে। বাসাটি আমরা দেখতে যাবার আগেই ভাড়া হয়ে গেছে। সুতরাং আর যাবার দরকার নেই। 

শহরে বাসা পাওয়া মুশকিল। কিন্তু পেলেও যে ভাড়া দিতে হবে, সেই ভাড়া জোগানোর সামর্থ্য আমার এই মুহূর্তে নেই। সামর্থ্য বাড়াতে হবে। মাসে আট নয়শ টাকার কমে কোন রুম পাওয়া যাবে না। এই মুহূর্তে আমার উপার্জন ধরতে গেলে কিছুই নেই। টিউশনির টাকা পাবো মাস শেষ হলে। কোচিং সেন্টারে তিনটি ক্লাস নিয়ে তিন শ টাকা পেয়েছি। এটা নিয়মিত করতে পারলে হয়ে যাবে। পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলেই চাকরির দরখাস্ত করছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দরখাস্তের সাথে দেড়শ দুশ’ টাকার পোস্টাল অর্ডার পাঠাতে হচ্ছে। একজন পূর্ণবেকারের পক্ষে এই টাকা জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ। চাকরির দরখাস্তের সাথে টাকা নেয়ার নিয়মটা বাতিল হওয়া দরকার। কিন্তু এই নিয়মটা নিশ্চয় চালু আছে অনেক বছর আগে থেকে। অনেক আগেই হয়তো অনেকে ভেবেছিলেন এটা বাতিল হওয়া দরকার। যারা ভেবেছিলেন তাঁরাই হয়তো এখন এসব অফিসের বড়কর্তা যাঁরা ইচ্ছে করলেই এই নিয়ম বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু মানুষের স্বভাবই হয়তো এরকম – অর্থ, ক্ষমতা ও সামর্থ্য লাভ করার সাথে সাথে আমরা অতীত ভুলে যাই। 

অতীত ভুলে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। নিজেরা শিক্ষার্থী থাকার সময় যেসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, শিক্ষক হবার পর সেসব অনিয়ম দূর করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দূর করার কোন চেষ্টাই করেননি। শিক্ষকরা ইচ্ছে করলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে সব অনিয়ম থেকে দূরে রাখতে পারতেন। অন্তত আমাদের সেশনজট থেকে মুক্ত করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ – বিশেষ করে আমাদের শিক্ষকদের অব্যবস্থাপনার কারণে চার বছরের পড়াশোনা শেষ করতে আমাদের আট বছর লেগেছে। এর জন্য যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি দায়ি সেই দায়স্বীকারটা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় করছে না। অনার্সের সার্টিফিকেটে লেখা আছে ১৯৮৮ সালের অনার্স পরীক্ষায় আমি পাস করেছি। অবশ্য সেই পরীক্ষা যে ১৯৯০ সালে হয়েছে তা লেখা আছে সার্টিফিকেটে – কিন্তু কেন ১৯৯০ সালে হয়েছে তা লেখা নেই। ১৯৮৯ সালের মাস্টার্স পরীক্ষা যে ১৯৯৩ সালে হলো তার পেছনের কারণটাও লেখা থাকবে না। আমাদের যে চারটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে – সেই চার বছরে আরেকটা বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করা যেতো অন্য কোন দেশে। 

তিনটার দিকে অসীম এলো। তার বাম হাতে্র প্রায় পুরোটাই মোটা ব্যান্ডেজে জড়ানো। 

“তোমার হাতে কী হয়েছে? মুখেও তো লেগেছে দেখি।“

“ও কিছু না দাদা।“ হাসিমুখে আমার উৎকন্ঠা উড়িয়ে দেয় অসীম। তার মানে কী হয়েছে সে বলতে চাচ্ছে না। হয়তো শিবিরের হাতে মার খেয়েছে। নিজে থেকে না বললে হাজার বার জিজ্ঞেস করেও লাভ নেই। 

“আপনার জন্য একটা বাসা পেয়ে গেছি। চলেন আজ গিয়ে দেখে আসি।“

“তুমি যাবে এই অবস্থায়?”

“সমস্যা নেই, চলেন।“

অনেকদিন আগে অসীমকে একবার বলেছিলাম বাসার কথা। মনে রেখেছে সে। আমানত খান বিল্ডিং থেকে বের হয়ে ছরারকুল পর্যন্ত হেঁটে আসার সময় দেখলাম অসীম বেশ খোঁড়াচ্ছে। হয়তো তার পায়েও ব্যথা। নির্ঘাৎ মার খেয়েছে। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, কিছুই বলবে না। 

রিকশা করে ফতেয়াবাদ এসে তিন নম্বর বাসে কোতোয়ালির সামনে নেমে গেলাম। এদিকের গলির ভেতর সেই বাসা। অসীমের পিছু পিছু অলিগলি পার হয়ে একটা পাঁচ তলা ভবনের ছোট্ট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাইরে জুলাই মাসের বিকেলেও কাঠফাটা রোদ। কিন্তু ভেতরে কেমন যেন আবছা অন্ধকার। অপ্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। অসীম বেল বাজালো। একটা পনেরো-ষোল বছরের থলথলে ছেলে এসে দরজা খুললো। 

“মাসীমা আছেন? বলো অসীম এসেছে।“

ছেলেটা ভেতরে চলে গেল। অসীম নিজের বাড়ির মতো করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ভেতরে। পুরনো আমলের বড় বড় আসবাবপত্রে ঠাসা বসার ঘর। দেয়ালে ঝুলছে বিভিন্ন দেবদেবীর ছবি। অনুকুল ঠাকুরের একটা ছবিও দেখা যাচ্ছে হলুদ দেয়ালের এক পাশে। 

ভেতরের দিক থেকে মোটাসোটা একজন মহিলা রুমে ঢুকতেই “মাসীমা কেমন আছেন?” বলে অসীম প্রণাম করলো তাকে। 

“দাদাকে নিয়ে এসেছি বাসা দেখানোর জন্য।“ অসীম সরাসরি প্রসঙ্গে চলে এলো। কিন্তু দ্রুতই প্রসঙ্গ থেকে সরে গিয়ে আমার প্রশংসা শুরু করলো। একটা বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফল কে্ন উল্লেখ করতে হবে বুঝতে পারছি না। অসীম এত বেশি বাড়িয়ে বলতে শুরু করেছে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না কার প্রসঙ্গে বলছে। মনে হচ্ছে স্বয়ং আইনস্টাইনকে সে নিয়ে এসেছে এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে একটা রুম ভাড়া নেয়ার জন্য। 

ইচ্ছে হচ্ছিলো অসীমকে থামিয়ে দিয়ে বলি বাসাটা আগে দেখাতে। যদি এই বিল্ডিং-এরই একটা বাসা হয় – তাহলে তার ভাড়া হবে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা। অসীম জেনেশুনে আমাকে এখানে নিয়ে এলো! নাকি এই বাসারই একটা রুম? 

অসীমকে খোঁচা দেয়ার পর সে থামলো। বাসা দেখার ব্যবস্থা হলো। নিচের তলায় খোলা একটা বারান্দার দুই পাশে দেয়াল তুলে রুমের আকার দেয়া হয়েছে। আলো-বাতাস নেই। প্রথম দর্শনেই অপছন্দ হবার মতো বাসা। ভাড়া নয় শ টাকা। আমার পছন্দ হয়নি। কিন্তু অসীমকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না তার পছন্দ হয়েছে কি না। অবশ্য তার পছন্দ-অপছন্দে কিছুই যায় আসে না। থাকবো তো আমি। 

দোতলায় উঠে আবার অসীমের মাসীমার সামনে কাঠের বেঞ্চে বসলাম। 

“আমার বাড়িতে বাসাভাড়া নেয়ার কিছু শর্ত আছে।“ – ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর প্রাচীনকালের জমিদারদের মতো। ভারতীয় বাংলা সিনেমায় এরকম চরিত্র দেখা যায়। 

“রাত এগারোটার পর বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যায়। কোন অবস্থাতেই রাত এগারোটার পর বাসায় ঢোকা যাবে না। বাসায় কোন মুসলমান আসতে পারবে না। বাসায় প্রাইভেট পড়ানো যাবে না। …” 

ভদ্রমহিলা আরো কী কী শর্তের কথা বলেন শোনার আর ধৈর্য হলো না। বললাম, “আপনার শর্তগুলির একটাও মানা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বাসা দেখানোর জন্য ধন্যবাদ। নমস্কার।“

রাস্তায় বের হয়ে অসীমকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইনি তোমার কেমন মাসীমা?”

“বাসাতুতো মাসীমা।“

“মানে?”

“মানে বাসা খুঁজতে এসে মাসীমা ডেকেছি আরকি!” 

বাসা হলো না বলে অসীমের মনে একটু দুঃখ রয়ে গেলো বুঝতে পারছি। সে বললো, “আপনার জন্য একটা টিউশনিও জোগাড় করেছি।“

“নন্দীর হাটেরটা আমি আর করছি না।“

“আমি জানি আপনি করবেন না। কেউই করবে না ওটা। এখন যেটা বলছি সেটা ওরকম নয়। এখানে কাছেই। ক্লাস এইট আর ফাইভ। ইস্পাহানি স্কুল।“ 

অসীম নিয়ে গেল সেই বাসায়। বেশ অভিজাত বাসা। বিশাল ড্রয়িং রুম। দেয়ালের ঝুলছে কাবা-শরীফের বাঁধানো ছবি। যাদের পড়াতে হবে তারা বাসায় নেই। তাদের মা বেশ সমাদর করলেন। বললেন পরের দিন বিকেল থেকে শুরু করতে। ছেলে-মেয়েদের সাথে কথা বলে ঠিক হবে সপ্তাহের কোন্‌ চারদিন পড়াবো। 

এবার নন্দীর হাট আউট, পাথরঘাটা ইন। 

পরদিন বিকেলে গেলাম সেই বাসায়। ড্রয়িং রুমের এক পাশে ছোট্ট একটা টেবিলের একদিকে একটি চেয়ার, অন্যদিকে দুটি। ক্লাস ফাইভের ছেলে আর ক্লাস এইটের মেয়ে – চুপচাপ বসে আছে চেয়ারে। তাদের মা দরজা খুলে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে – এরাই আপনার ছাত্রছাত্রী বলে উধাও হয়ে গেলেন। 

আমি কীভাবে শুরু করবো ভাবছি। ভাইবোন যেভাবে শক্ত হয়ে গম্ভীরভাবে বসে আছে, মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে আমাকে। বললাম, “আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।“

“আপনাকে ভয় পাচ্ছি কে বললো?” – মনে হলো পাথরের গলা থেকে বের হয়ে এলো কথাগুলি। ইস্পাহানি স্কুলের ক্লাস এইট মনে হচ্ছে ভীষণ স্মার্ট। স্মার্ট ছেলেমেয়েদের পড়াতে বেশ ভালোই লাগবে মনে হচ্ছে। 

পরদিন কর্নিয়ায় যেতে পারবো না বলে দিয়ে ইস্পাহানীর ফাইভ-এইটকে পড়াতে গেলাম। দরজা খুললো একজন অপরিচিত তরুণী। দেখলাম ড্রয়িং রুমের পড়ার টেবিলে ওরা ভাই-বোন পাশাপাশি বসে আছে। তাদের সামনের চেয়ারে বসে আছেন আরেকজন ভদ্রলোক। মনে হচ্ছে তিনি তাদের পড়াচ্ছেন। আমি কি একটু আগে এসে পড়লাম? 

তরুণী আমাকে দরজা খুলে দিয়েই ভেতরে চলে গেছেন। আমি ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কী করবো বুঝতে পারছি না। 

এমন সময় ছাত্রছাত্রীর মা এসে নিচু গলায় বললেন, “বাচ্চাদের টিচার কিছুদিন আসেননি বলেই আপনাকে রাখতে চেয়েছিলাম। এখন তিনি চলে এসেছেন। আপনাকে আর দরকার নেই।“ 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts