Friday, 11 March 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৬২

 


#স্বপ্নলোকের_চাবি_৬২

“বিল ক্লিনটন আমেরিকার কততম প্রেসিডেন্ট বল্‌।“

মাসখানেক আগে বিল ক্লিনটন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন সেটা জানি, কিন্তু তিনি কততম প্রেসিডেন্ট সেটা তো জানি না। অজ্ঞানতার লজ্জা ঢাকতে তর্কের আশ্রয় নেয়ার প্রচলিত কৌশল অবলম্বন করে যুক্তি দেখালাম, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে আমাকে কেন জানতে হবে?”

“এখন তো এগুলিই জানতে হবে। জনতা ব্যাংকের পরীক্ষায় তো আর বোরের কোয়ান্টাম মডেল আসবে না। আসবে আজারবাইজানের রাজধানীর নাম, হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্টের নাম, কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কুকুরের নাম। এসব নামযপ করতে না পারলে নো চাকরি।“

প্রদীপ নাথের কথায় যুক্তি আছে। এরকম অদরকারি তথ্য মুখস্থ রাখতে পারলেই নাকি চাকরিলাভ হয়। আমানত খান বিল্ডিং-এর ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে সে। একটু আগে তৌহিদভাই ছাদে এসেছিলেন রোদে কাপড় মেলতে। রোজার মাস বলে তৌহিদভাইকে দেখে সিগারেট লুকিয়েছিল সে। তৌহিদভাই নেমে যাবার পর এখন আবার মুখে দিয়েছে। আমাদের জেনারেল ভাইভা যেদিন শেষ হয় – সেদিন চাকসু ক্যাফেটরিয়ার সামনের ভ্রাম্যমান সিগারেট-বালকের কাছ থেকে সিগারেট কিনে মুখে দিতে দিতে বলেছিল – “আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার একাডেমিক লাইফের লাস্ট দিন, এই সিগারেটও আমার লাইফের লাস্ট সিগারেট।“ আমার চোখের সামনে ঘোষণা দিয়ে এরকম লাস্ট সিগারেট সে এর আগেও অনেকবার খেয়েছে। বার বার শপথ ভাঙে জানার পরেও আশা করেছিলাম এবার হয়তো কথা রাখবে। কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে ফতেয়াবাদ আসার পরেই আবার সিগারেট ধরিয়েছিল। শপথের কথা মনে করিয়ে দেবার পর বলেছিল, “পরীক্ষা শেষের একটা আনন্দ আছে না? জীবনের শেষ পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম, তার মুখাগ্নি করতে হবে না?” সিগারেট খাওয়া যদি মুখাগ্নি করা হয়, তাহলে আর কিছু বলার থাকে না।

পরীক্ষা শেষের আনন্দের কথা বললেও মাস্টার্স পরীক্ষার পর আনন্দের চেয়ে উদ্বেগই বেশি হতে থাকে। পড়াশোনা শেষ করার পর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের একটা চাপ থাকে। এমনই একটা গৎবাঁধা পড়াশোনার পদ্ধতি আমাদের – কেউই ঠিকমতো জানি না আমরা কে কী কাজ করবো। চাকরির জন্য প্রথম যে দরখাস্তটা আমরা তিন বন্ধু মিলে করলাম – সেটা হলো জনতা ব্যাংকের অফিসার পদের জন্য। মার্চের এক তারিখে জিপিওতে গিয়ে রেজিস্টার্ড পোস্টে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছি। আড়াইশ টাকার পোস্টাল অর্ডার জমা দিতে হয়েছে দরখাস্তের সাথে। ব্যাংকের চাকরিতে পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞান কী কাজে লাগবে জানি না।

কয়েক বছর আগেও  ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে ব্যাংকের অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া যেতো। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিলাম – তখনো বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম – প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টের মাস্টার্স পরীক্ষার ফলাফলে মেধার ভিত্তিতে প্রথম পাঁচজনকে সোনালী ব্যাংকের অফিসার পদে সরাসরি নিয়োগের ব্যাপারটা। আমরা পাশ করার আগেই সেই সুযোগ চলে গেছে।

একটু আগেই আমরা আলোচনা করছিলাম – ঠিক কখন থেকে আমাদেরকে বেকার বলা হবে। যীশু ও আমার এখনো থিসিস জমা দেয়া বাকি। তাই আমরা এখনও ছাত্র। সুতরাং আমাদের এখনো বেকার বলা যাবে না। প্রদীপ নাথের পরীক্ষা শেষ হলেও এখনো রেজাল্ট দেয়নি। সুতরাং সে-ও এখনো পূর্ণবেকার হয়নি।

রশীদুন্নবীস্যারের কাছে থিসিসের কাজ করছে যীশু। ইলেকট্রনিক্সের কাজে তার আগ্রহ অনেক। ইদানীং প্রায়ই স্যারের বাসায় যেতে হয় তাকে থিসিসের কাজে। ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেলে আমার এখানে থেকে যায়।

আমি ইদানীং সারাদিন রুমে বসে থিসিস টাইপ করি। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের বড় বড় সমীকরণগুলি টাইপ-রাইটারে টাইপ করতে অনেক সময় লাগে। যীশুর মাধ্যমে রূপকের কাছ থেকে যে টাইপ-রাইটারটা এনেছিলাম সেটা ফেরত দিতে হয়েছে। বিপ্লবের প্রতিবেশী বন্ধু অপু আন্দরকিল্লায় টাইপ শিক্ষার স্কুলে কাজ করে। অপুর মাধ্যমে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড টাইপ-রাইটার কিনে এনেছি তিন হাজার টাকা দিয়ে। ওটার সাথেই এখন আমার বেশিরভাগ সময় কাটছে। এক একটা চ্যাপ্টার হাতে লেখা হলে প্রামাণিকস্যারের বাসায় গিয়ে স্যারকে দিয়ে আসি। স্যার দেখে দেয়ার পর টাইপ করতে বসি। অনেকগুলি চ্যাপ্টার অনেকবার করে লিখতে হয়েছে। এপ্রিলের সাত তারিখের মধ্যে থিসিস জমা দেয়ার কথা। তার আগেই আমার থিসিস রেডি হয়ে যাবে আশা করি।

আজও রুমে বসে টাইপ করছিলাম। যীশু আর প্রদীপ একসাথে ঢুকলো। তারপর এটাওটা গল্প করতে করতে প্রদীপ নাথের ধুম্রতৃষ্ণা নিবারণের জন্য ছাদে আসা। ছাদ থেকে নেমে রুমে আসার সময় সিঁড়ির কাছে সেলিমভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল।

“আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম।“

“ছাদে গিয়েছিলাম। কেন খুঁজছিলেন আমাকে?”

“এমনি, গল্প করার জন্য।“

সেলিমভাই এবারও পরীক্ষা দেননি। তবে কি আমাদের পরের ব্যাচের সাথে পরীক্ষা দেবেন? ছাত্রনেতা হতে গেলে সম্ভবত বছরের পর বছর ধরে পরীক্ষা এড়িয়ে চলা বাধ্যতামূলক।

সেলিমভাই রুমে ঢুকলেন আমাদের সাথে।

“মাংসের গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে! রান্না করেছো নাকি?”

যীশু বাসা থেকে মাংস নিয়ে এসেছে। এখন ভাতটা বসিয়ে দিলেই দুপুরের খাবার হয়ে যাবে। বুঝতে পারছি সেলিমভাইয়ের জন্যও চাল নিতে হবে। বললাম, “আপনার তো রোজা।“

সেলিমভাই মুখে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে একবার যীশু আর প্রদীপের দিকে তাকালেন। মুখে কিছুই বললেন না। ধর্মের ব্যাপারে রাজনীতির নেতারা খুব সতর্ক থাকেন। রোজা রাখেননি বললে যদি প্রতিবেশীরা কেউ শুনে ফেলেন! তিনি ঘরের ভেতর নিরবে গোপনে খাবেন, বাইরে গিয়ে রোজার ফজিলত ব্যাখ্যা করবেন।

“তোমার পরীক্ষা কেমন হলো? আবারো ফার্স্ট হতে পারবে তো?” সেলিমভাই আরাম করে খাটে বসে পা তুলতে তুলতে বলেন।

“জানি না।“

“তুমি তো কারো সাথে কোন কানেকশান রাখো না। কানেকশান না থাকলে তো কেউ তোমাকে চিনবে না।“

“স্যাররা আমাকে চেনেন বলেই তো সমস্যা।“

“তোমার ডিপার্টমেন্টের বাইরে আর কেউ তো তোমাকে চেনেন না। সিন্ডিকেট মেম্বার, সিনেট মেম্বার, ডিন, শিক্ষক সমিতির নেতা – সবার সাথে কানেকশান তৈরি করতে না পারলে তুমি ইউনিভার্সিটিতে কীভাবে ঢুকবে?”

“কানেকশান কীভাবে তৈরি করতে হয় তো জানি না।“

“সরাসরি তো কানেকশান তৈরি হবে না। মিডলম্যান কাউকে ধরতে হবে। জানাশোনা ছাড়া কি কিছু হয়? ডায়নামিক না হতে পারলে তো কিছুই পাবে না। এখন জামায়াত-শিবির-বিএনপি ইউনিভার্সিটি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে আমরা নিয়ন্ত্রণ করবো। তোমার তো কোন দলের সাথেই কোন জানাশোনা নেই।“

সেলিমভাই যে ধরনের জানাশোনার কথা বলছেন সে ধরনের জানাশোনার প্রতি আমার কোন আকর্ষণ নেই। এ জাতীয় কথাবার্তা শুনতে আমার বেশ বিরক্তিই লাগছে। প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্য বললাম, “আপনারা তো অনেক ডায়নামিক। খন্দকার মোশতাক যে দশ পার্টির নেতা হয়েছে সে ব্যাপারে আপনারা কী করছেন?”

বঙ্গবন্ধুর সাথে যে সবচেয়ে বেশি বেইমানি করেছে সেই খন্দকার মোশতাক এখনো সক্রিয়! ২২ ফেব্রুয়ারি প্রথম রোজার দিন দশটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স এর নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে খন্দকার মোশতাক। কী অদ্ভুত সময় এখন। একাত্তরের পরাজিত যুদ্ধাপরাধীরা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশ। আর পঁচাত্তরের ঘাতকেরা বুক ফুলিয়ে নতুন রাজনৈতিক জোট তৈরি করছে। আমরা সাধারণ মানুষ বলেই হয়তো আমাদের এত ক্ষোভ জাগে। রাজনৈতিক নেতারা এসব ব্যাপারে বড়ই সহনশীল। হয়তো ভবিষ্যতে দেখা যাবে – রাজাকাররা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয় দেবে, আর নেতারা তাদের স্বীকৃতি দেবে।

“আমরা ক্ষমতায় গেলে দেখবা কী করি।“

সেলিমভাই ক্ষমতায় গেলে কী করবেন আমি জানি না। তবে আমাকে যে আর চিনতে পারবেন না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

দেশের ভেতর একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে ভেতরে ভেতরে। আমাদের উদারনৈতিক চেতনায় আস্তে আস্তে পরিকল্পিতভাবে দূষণ ঘটানো শুরু করেছে কিছু সংঘবদ্ধ মানুষ। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বাতিল করার লক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশেপাশের এলাকায় পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে। বাইশে এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ ও আইনগত ক্ষমতাবহির্ভূত বলে ঘোষণা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরি। তার মানে গোলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার পথ পরিষ্কার। এদিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গোলাম আযমের বিচার করার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে পুলিশ গিয়ে জাহানারা ইমামকে লাঠিপেটা করে আসে।

দিন দ্রুত চলে যেতে থাকে। থিসিস যথাসময়েই রেডি করে ফেলি। জমা দিতে গিয়ে জানতে পারি – সময় আরো বাড়ানো হয়েছে, মে মাসের তিরিশ তারিখের মধ্যে জমা দিলে হবে। এতদিন ডিপার্টমেন্টে যাইনি বলে জানতে পারিনি।

ডিপার্টমেন্টে গেলে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেলিমভাই ঠিক কথাই বলেছেন – আমার তেমন কোনো জানাশোনা নেই কারো সাথেই। অন্য ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক তো দূরের কথা, আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের অন্য ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সাথেও আমার তেমন কোন পরিচয় নেই। আমাদের পরের ব্যাচের মাত্র কয়েকজনকে আমি চিনি। এর পরের ব্যাচের কারো সাথেই আমার পরিচয় নেই। এতটা বছর একটা ক্যাম্পাসে কাটিয়ে দিলাম পর্যায় সারণির নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলির মতোই।

মে মাসের শেষে থিসিস জমা দেয়ার পর কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগতে শুরু করেছে সবকিছু। প্রদীপ নাথ কক্সবাজার চলে গেছে। সেখানে সে একটা চিংড়িচাষ প্রকল্পের কর্মকর্তা হয়েছে। এখনো তার রেজাল্টও বের হয়নি। পূর্ণবেকার হবার আগেই চাকরি পেয়ে গেছে। কক্সবাজার থেকে ছুটিতে এসেছিল কয়েকদিনের জন্য। তার সাথে কয়েকদিন ঘুরলাম। তার সাথে ভ্রমণের এখন একটা গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। কারণ তার হাতে এখন প্রচুর টাকা। প্রতি মাসে চার হাজার টাকা বেতনের কিছুই খরচ হয় না কক্সবাজারে। এখন ট্যাক্সিটাকেই সে পছন্দ করছে চলাচলের বাহন হিসেবে। মাঝে মাঝে কেমন যেন একটু অচেনা লাগে তাকে।

যীশু বিদেশে চলে যাবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তার দিদি, দাদাসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন সৌদি আরবে থাকেন। যীশুও সম্ভবত সৌদি আরবে চলে যাবে। বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ড্রাইভিং শিখছে। একদিন আমাকেও চড়িয়েছিল তার চালানো শেখার গাড়িতে।

দিনগুলি ক্রমশ বিষন্ন হয়ে উঠছে। দিনে দিনে এগিয়ে আসছে বিচ্ছিন্নতার দিন। এখনো একটা নির্দিষ্ট কাজ বাকি আছে – সেটা হলো থিসিসের ভাইভা। ওটা শেষ হয়ে গেলেই সবকিছু চুকেবুকে যাবে। 


পরের পর্ব >>>>>>>>>>>

<<<<<<<< আগের পর্ব

No comments:

Post a Comment

Latest Post

R. K. Narayan's 'The Grandmother's Tale'

There are many Indian authors in English literature. Several of their books sell hundreds of thousands of copies within weeks of publication...

Popular Posts