১ জুলাই ১৯৮৭। আজকের তারিখটি আমার মনে রাখা দরকার। আজ থেকে আমার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বসবাস শুরু হলো। ক্লাস টেন থেকেই আমার হোস্টেল জীবন শুরু হয়েছে। এতদিন যেসব জায়গায় থেকেছি, সবখানেই রুম শেয়ার করতে হয়েছে। আজ থেকে এই রুমটি আমার একার, আমার নিজের ভাড়া করা রুম। সকালে নিজের লাগানো তালা খুলে যখন রুমে ঢুকেছি, একটা অদ্ভুত স্বাধীনতার ভাব এসে ভর করেছে। স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বও জড়িয়ে থাকে। কিন্তু স্বাধীনতা পাবার সাথে সাথেই দায়িত্বের কথা ভাবতে গেলে তো স্বাধীনতার সুখ থাকে না। আপাতত সুখটা উপভোগ করি।
পনেরো ফুট দৈর্ঘ্য আর এগারো ফুট প্রস্থের রুমটিকে আরো বড় লাগতো যদি মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতাটা আরেকটু বেশি হতো। মাত্র সাত ফুট উচ্চতায় ছাদ সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু এই বাড়ির নিচের তলার সিলিং এরকমই। ফ্লোরে দাঁড়িয়েই দেয়ালের একেবারে উপরের দিকে লাগানো হোল্ডারে বাল্ব লাগাতে কোন সমস্যাই হলো না। তবে হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙতে গেলে হাতে ব্যথা পাবার সম্ভাবনা আছে। এখলাস আমার চেয়ে প্রায় আধফুট লম্বা। সোজা হয়ে দাঁড়ালে তার মাথা ছাদে ঠেকে যাবার সম্ভাবনা নেই, তবুও একটু আগে যখন সে এসেছিল – দেখেছি মাথাটা একটু কাৎ করে রেখেছিল। উপরের তলায় - এখলাস যেখানে থাকে – সেখানে এই সমস্যা নেই। দোতলায় ছাদের উচ্চতা স্বাভাবিক।
এই বাড়ির নাম আমানত খান বিল্ডিং। বাড়ির মালিক আমানত খান এই বাড়িটি কিনেছিলেন একজন সোখিন লোকের কাছ থেকে। এই কাহিনি আমি শুনেছি এখলাসের কাছে। এখানে আমার জন্য একটা রুম ঠিক করে দেয়ার পুরো কৃতিত্ব এখলাসের। তাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। ইংরেজিতে যেভাবে হুটহাট ‘থ্যাংক ইউ’ বলে ফেলা যায়, বাংলায় সেভাবে ধন্যবাদের প্রচলন নেই। থাকলেও কাছের মানুষদের আমরা ধন্যবাদ দিই না। আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পদ্ধতিটা বেশ জটিল – একেক জনের একেক রকম।
সেদিন ব্রিটিশ কাউন্সিলে এখলাসের সাথে কথা হবার পরের দিন ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষ করে এই বিল্ডিং-এ এসেছিলাম। এখলাস বলে দিয়েছিল কীভাবে আসতে হবে। ইউনিভার্সিটির এক নম্বর গেট থেকে বাসে উঠে মদন হাট, নন্দীর হাট পার হয়ে ফতেয়াবাদ স্কুলের আগে ছড়ার কুল-এ নামলাম। এখানে আক্ষরিক অর্থেই একটি ছোট্ট ছড়া আছে। পুবের পাহাড় থেকে নেমে এসে হাটহাজারি রোড পেরিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। কোথায় গিয়ে মিশেছে জানি না। ছড়ার উপর যে ব্রিজ, সেখানেই বাস থেকে নামলাম। ব্রিজের দক্ষিণ দিকে রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু দোকানপাট, বাজার - আমাদের গ্রামের বাজারের চেয়েও ছোট। ব্রিজের উত্তর পাশে পায়ে চলা মেঠো পথ চলে গেছে পূর্বদিকে। রাস্তার ওপাশে আরেকটি মেঠোপথ চলে গেছে পশ্চিম দিকে। রাস্তার পশ্চিম দিকে একটি কবরস্থান, তার পাশে বিশাল এক পুকুরের পাড়ে পাকা মসজিদ। রাস্তার পূর্বপাশে সবুজ ধানক্ষেত। ব্রিজ থেকেই দেখা যাচ্ছে ধানক্ষেতের মাঝখানে একটি সাদা দোতলা বাড়ি। ওটাই আমানত খান বিল্ডিং।
প্রায় এক বছর ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করছি। অনেক বার বাসে গিয়েছি এই পথে। কিন্তু একবারও চোখে পড়েনি এই বিল্ডিংটা। ছড়ার কুলের ব্রিজ থেকে বেশ কিছুদূর হেঁটে মসজিদ পার হয়ে একটি করাত-কল; স্থানীয়রা বলে “সোয়ামিল”। সামনের বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বড় বড় গাছের ডালপালাবিহীন প্রকান্ড কান্ড পড়ে আছে যান্ত্রিক করাতে ফালা ফালা হবার অপেক্ষায়। একটি ঠেলাগাড়ি থেকে আরো কাঠ নামানো হচ্ছে। গাড়ির চাকার নিত্য যাতায়াতে মাটিতে বড় বড় গর্ত হয়ে গেছে। সেখানে বৃষ্টির ঘোলাটে পানি।
“প্রদীপ এদিকে চলে আসো।“
দেখলাম এখলাস দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির বাইরের বারান্দায় সিমেন্টের রেলিং-এর কাছে। একটা বিশাল আমগাছ রেলিং ঘেঁষে উঠে গেছে দোতলার ছাদ পর্যন্ত। এই বাড়িটির নিচের তলা রাস্তা থেকে অনেক নিচে। রাস্তা থেকে সরাসরি দোতলায় ঢুকে যাওয়া যায়। দোতলায় মেইন গেট দিয়ে ঢুকতেই এখলাস তার লম্বা হাত বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে – ‘এসো’।
বাইরের বারান্দা পেরিয়ে প্যাসেজের ডানপাশে বেশ বড় রুম – হার্ডবোর্ডের পার্টিশান দিয়ে দুই রুম করা হয়েছে। দক্ষিণ দিকের খোলা বারান্দাসহ রুমে এখলাস আর নজরুল থাকে। নজরুলের সাথে পরিচয় হলো। নজরুল ফিজিক্সের ছাত্র – আমাদের আগের ব্যাচ। এখলাসের পাশের রুমে এখন একজন আছেন, আরো একজন থাকা যাবে। সেই সিটটি খালি আছে। ভাড়া মাসে এক শ বিশ টাকা। এখলাস বললো – আপাতত ওখানে উঠলে পরে আরো ভালো রুমে সিট খালি হলে সেখানে চলে যাওয়া যাবে। একটা সিট তো পাওয়া গেল ভেবে স্বস্তি লাগলো। তবুও জিজ্ঞেস করলাম - যদি একা থাকার মতো কোন রুম খালি থাকে।
“নিচের তলায় একটা রুম
খালি আছে।“
“দেখা যাবে?”
“চলো”
চললাম এখলাসের পিছুপিছু।
এখলাস যে রুমে থাকে – তার সাথে লাগানো রুমের বন্ধ দরজা দেখিয়ে এখলাস ফিসফিস করে বললো
– “এটা হলো বিগ বসের রুম। বিগ বস মিস্টার পি থাকেন এখানে।“
এখলাসের স্বাভাবিক কথাবার্তা এবং সংলাপে প্রচুর নাটকীয়তা থাকে। তার স্বরের উঠানামায় বুঝলাম ‘বিগ বস’-এর পেছনে কোন গল্প আছে। পরে কোন সময় জানা যাবে। বিগ-বসের রুম পেরিয়ে করিডোর ধরে এগুচ্ছি। করিডোরে আলো খুব কম। ডান পাশে একটি বাথরুম – এটাই দোতলায় যারা থাকে – ব্যবহার করে। বাম পাশে আরেকটি ছোট্ট রুম। ডান পাশে আরো দুটি রুম। বাড়ির বিন্যাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাড়ির মালিক পরিবার নিয়ে থাকার জন্য তৈরি করেছিলেন এই বাড়ি। করিডোরের দক্ষিণ দিকে ছোট্ট একটা দরজা পেরিয়েই দেখলাম অত্যন্ত সরু প্যাঁচানো সিঁড়ি। একটা অংশ চলে গেছে উপরের দিকে – ছাদে। অন্য অংশ নেমে গেছে নিচের তলায়। ঘুঁটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি। সিঁড়ির নিচে লাগানো পানির মেশিনের সুইচ। নিচের তলায় এসে খেয়াল করলাম ছাদটা বেশ নিচু। কিন্তু অনেক আলোবাতাস আসার জায়গা আছে এখানে। এখানেও দুপাশে বেশ কয়েকটি রুম। সিঁড়ি থেকে বের হয়ে বাম দিকের কোণার রুমটা খালি। দরজায় কোন তালা নেই, হুক লাগানো। দরজার সামনের মেঝে ভেজা, কারণ পাশেই বাথরুম। বাথরুমের কলটা সম্ভবত নষ্ট হয়ে গেছে, টপটপ করে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। আর বাথরুম টয়লেট সম্ভবত একই জায়গায় – কারণ ইউরিয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। রুমের ভেতরেও এরকম গন্ধ হলে তো বাস করা যাবে না এখানে।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো এখলাস, আমি তার পেছনে। দরজার কাছেই দেয়ালে লাগানো সুইচবোর্ড। এখলাস সুইচ টিপলো, কিন্তু আলো জ্বললো না। বাল্ব নেই। মেঝেতে ধুলোবালি আর ছেঁড়া-কাগজপত্র জমে রুমটা অনেকটা রেয়াজউদ্দিন বাজারের ফুটপাতের মতো হয়ে আছে। কিন্তু মেঝে থেকে চোখ সরিয়ে যখন জানালার দিকে তাকালাম – খুব ভালো লেগে গেল। উত্তর-পূর্ব কোণার দুদিকেই বড় বড় জানালা। জানালায় কাচের পাল্লা। ভেতরের দিকে নেট লাগানো। এই পড়ন্ত বিকেলেও অনেক আলো রুমের ভেতর। এই রুমেই আমি থাকবো। সিদ্ধান্ত জানালাম এখলাসকে।
“এখানে নিচের তলায় কিন্তু
একটা সমস্যা আছে।“
“কী?”
“যাদের জন্য হল থেকে
বিতাড়িত হয়েছো, এখানে তাদেরই ঘাঁটি।“ – এখলাসের মুখে রহস্যজনক হাসি।
“এখানে শিবির আছে?”
এখলাস গলা নামিয়ে আবারো
রহস্য বজায় রেখে বললো, “আছে মানে? শিবিরের অনেক বড় নেতা আছে এখানে। ভেবে দেখো।“
“উপরের তলায় শিবির নেই?”
“ওখানেও আছে।“
“কিন্তু এটা তো ভাড়া
বাসা। যার যা খুশি পার্টি করতে পারে।“
“সেটা করতে পারে। এখানে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না এখানে। কারণ তুমি চাইলেও তো শিবিরে যোগ দিতে পারবে না। হাহাহাহা।“ এখলাস বেশ জোরেই হাসলো।
ঠিক হলো এই রুমেই উঠবো আমি। রুমের ভাড়া দেড়শো টাকা। এখলাস ‘বিগবস’কে জানিয়ে রাখবে। আর কেয়ারটেকারকে বলে রুমটা পরিষ্কার করিয়ে রাখবে।
রুম থেকে বের হয়ে এখলাস আমাকে দেখালো নিচের তলায় সবগুলি রুমের দরজায় ছাত্রশিবিরের পঞ্চভুজের লোগো লাগানো। শিবিরময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি, শিবিরমুক্ত জায়গা কোথায় পাবো?
দোতলায় উঠে এখলাসের রুমের দিকে যাবার সময় দেখলাম ‘বিগবস’-এর রুমের দরজা খোলা। এখলাস রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ সম্ভ্রমের সাথে ডাকলো – ‘মাহমুদভাই’
“এখলাস, কী খবর তোমার?
তোমার বন্ধু এসেছে?” – বলতে বলতে ‘মাহমুদভাই’ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দরজার কাছে
এলেন।
“জ্বি ভাই, এই প্রদীপের
কথা আপনাকে বলেছিলাম।“
“এসো এসো প্রদীপ, ভেতরে
এসো।“ – মাহমুদভাই খুব সুন্দর শুদ্ধভাষায় আহ্বান করলেন আমাকে।
বিশাল রুম মাহমুদভাইয়ের।
সিলিং ফ্যান ঘুরছে। দেয়ালে টিউবলাইটের ঝকঝকে আলো। দামী জিনিসপত্র ঘরের সবখানে। এই রুমটাকে
কিছুতেই মেসের রুম বলা যাবে না। এটাচড বাথরুমও আছে এখানে।
খুবই আন্তরিক ব্যবহার
মাহমুদভাইয়ের। আমি চট্টগ্রামের জেনে তিনিও চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন।
তাঁর বাড়ি পটিয়া। আমি পটিয়া স্কুল থেকে পাস করেছি, তিনিও। আমি নিচের রুমটা পছন্দ করেছি
শুনেই তিনি ওটা পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থা করলেন। বেশ জোরে হাঁক দিলেন, “মাহমুদ মিয়া,
মাহমুদ মিয়া”
একটু পরেই কেয়ারটেকার মাহমুদ মিয়া ছুটে এলেন। মাহমুদ মিয়ার শুকনো পাতলা শরীর, কেমন যেন গুটিয়ে গেছেন। বয়স চল্লিশ থেকে ষাট যে কোনোটাই হতে পারে। এক মাহমুদ আর অন্য মাহমুদে কত পার্থক্য। মাহমুদ মিয়া দরিদ্র। দরিদ্র হলে বয়সের সম্মানও পাওয়া যায় না অনেকসময়।
মাহমুদ মিয়াকে আদেশ দেয়া হলো যেন নিচের রুমটা এক্ষুনি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করে। জানা গেল – মাহমুদ মিয়া কয়েকজনের জন্য রান্নাও করেন এখানে। আমি চাইলে মেসে খেতে পারি। অবশ্যই চাই – শুনে মাহমুদভাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর বেশ খুশি হয়ে বললেন, “এই বিল্ডিং-এ তুমিই কিন্তু প্রথম সংখ্যালঘু। তোমার আগে এখানে আর কোন হিন্দু আসেনি।“ ধর্মীয় পরিচয় কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ছে না। কী জানি, হয়তো ভবিষ্যতে এটাই মানুষের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়াবে এই দেশে।
গতকাল প্রদীপ নাথসহ এসেছিলাম। রুমের ময়লা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। এখলাস একজন কাঠের মিস্ত্রি ডেকে নিয়ে এলো। তিনি জানালেন তার কাছে একটা খাট রেডি আছে। মিলের সস্তা কাঠের তৈরি সস্তা অনাড়ম্বর খাট – যাকে এরা চৌকি বলে। এক শ’ টাকা দামের খাট চারজন মিলে রুমে ঢুকালাম। মিস্ত্রীকে একটা টেবিল আর চেয়ারের অর্ডার দিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে দেয়ার কথা। রুমে লাগানোর জন্য তালা কিনে এনেছিলাম। সেটা লাগিয়ে চলে গিয়েছিলাম গতকাল।
আজ অনেক সকালে উঠে বেবিটেক্সি করে চলে এসেছি। শিবিরের ছিঁড়ে ফেলা তোষকটাকে মেরামত করা হয়েছিল। যেগুলি নিয়ে হল থেকে দিদির বাসায় গিয়ে উঠেছিলাম, সেগুলি নিয়েই চলে এসেছি সকালে। তলোয়ার-কাটা ট্রাংকটাকে মেরামত করা যায়নি। আরেকটা কেনারও ইচ্ছে হয়নি। কাটা ট্রাংকটা নিয়েই চলে এসেছি। ওটা এখন আমার খাটের নিচে মেঝেতে আছে।
সকালে জিনিসপত্র রেখেই বের হয়ে গিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে যাবার জন্য। ছড়ার কুল ব্রিজের কাছেই বাস থামে। সকালে বাসে প্রচন্ড ভীড়। ভেতরে ওঠা যায় না। কিন্তু বাম্পারে সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক নম্বর গেট পর্যন্ত যেতে কোন কষ্টই হয়নি।
সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ থেকে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। আমাদের ক্লাস প্রায় শেষ। সাউন্ডের ক্লাস দেরিতে শুরু হয়েছিল – নুরুল মোস্তফা স্যার আর কয়েকটি ক্লাস নিলেই শেষ হয়ে যাবে। আদম শফিউল্লাহ স্যার প্রোপার্টিজ অব ম্যাটারের মাত্র দুটো ক্লাস করিয়েছেন। সারফেস টেনশান আর ভিস্কোসিটি পড়ানোর কথা তাঁর। মনে হচ্ছে দুটো ক্লাসেই শেষ। তিন পৃষ্টার একটা হাতে লেখা নোট দিয়েছেন আমাদের। আমরা লিখে নিয়েছি। সেখানে কয়েকটি সমীকরণ আছে – আর তেমন কিছুই নেই। ফরায়জী কামাল স্যার প্রোপার্টিজ অব ম্যাটারের গ্রাভিটেশান, ইলাস্টিসিটি ইত্যাদি খুবই বিস্তারিত ভাবে পড়িয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে তাঁর অংশ থেকেই বেশিরভাগ প্রশ্ন আসবে। প্রামাণিক স্যারের টিউটরিয়াল পরীক্ষা ছিল আজ। পরীক্ষা তেমন একটা ভালো হলো না। এতদিন ঠিকমতো পড়াশোনা না করার ফল, আর না বোঝার ফল। আজ থেকে মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করার কথা। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
আসার সময় প্রদীপ নাথসহ ট্রেনে এলাম। ফতেয়াবাদ জংশনে নেমে হেঁটে আসতে প্রায় দশ মিনিটের মতো লাগে। মাটির রাস্তা ধরে পাড়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসতে বেশ ভালোই লাগলো। রুমে ঢুকে খাটে বিছানা পাতার পর প্রদীপ নাথ খাটে বসেই বললো – “তোর খাট তো ভাঙা।“
দেখলাম খাটের মাঝামাঝি এক পাশের ফ্রেমে চিড় ধরেছে। মিস্ত্রিকে ডেকে আনা হলো। মিস্ত্রি সেই জায়গায় জোড়াতালি দিয়ে আরেকটি পা লাগিয়ে দিলো। আমার খাটের এখন পাঁচটি পা। নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রয়োগ করে পাঁচ পায়ের রেজাল্ট্যান্ট ফোর্স বের করতে গেলে ঝামেলা হয়ে যাবে। সন্ধ্যার আগেই প্রদীপ নাথ বাড়িতে চলে গেলো। সে চৌধুরি হাট থেকে সাইকেলে তার বাড়িতে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে।
দোকান থেকে দুটো বাল্ব কিনে নিয়ে এনে লাগালাম। আলো জ্বালানোর পর দেখলাম রুমের দেয়াল মেঝে সব ভেজা ভেজা। এই স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থার কথা তো আগে চিন্তা করিনি। জানালা দিয়ে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে মশা ঢুকছে। এতক্ষণে মনে পড়লো – মশারি ফেলে এসেছি। এখন গিয়ে মশারি নিয়ে আসার উপায় নেই। আজ মশার সাথে বসবাস করতে হবে। একটা কয়েল কিনে নিয়ে আসতে হবে।
নিচের তলায় এখনো কারো সঙ্গে কথা হয়নি। একজনের সাথে দেখা হয়েছে বারান্দায়। তিনি কথা বলেননি। দোতলায় নজরুলের সাথে আগে পরিচয় হয়েছিল। পরিচয় হলো কেমিস্ট্রি থার্ড ইয়ারের ইদ্রিস ভাইয়ের সাথে। আমাদের ব্যাচের হারুন ভাইয়ের সাথে। হারুনকে এখলাস কেন হারুন ভাই বললো জানি না। সে যখন ভাই বলছে, আমাকেও ভাই বলতে হলো।
এখলাসের সাথে বসে মেসে খেলাম। মাহমুদ মিয়া বেশ ভালোই রান্না করেন। এখলাসের রুমে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নিজের রুমে এসে ঢুকতেই কারেন্ট চলে গেলো। মোমবাতি নেই, একটা ম্যাচও নেই। অন্ধকারে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মশারা ইচ্ছে মতো জ্বালাতন করছে। কয়েলও আনা হয়নি। এই অন্ধকারে দোকানে যেতে ইচ্ছে করছে না। স্বতন্ত্র থাকার সুবিধা হলো – ইচ্ছে না করার পূর্ণ স্বাধীনতা।
কতক্ষণ কাটলো জানি না।
ক্লান্ত ছিলাম বলে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো খুটখুট শব্দে। দরজায় নক করছে
কেউ। অন্ধকারে উঠে দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – কে?
“আমি এখলাস।“
দরজা খুললাম। বাম হাতে
জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে এখলাস। ডানহাতে আরেকটি মোমবাতি, ম্যাচ, আর মশার কয়েল
এগিয়ে দিয়ে বললো, “ট্রান্সফর্মারে সমস্যা হয়েছে। আজ আর কারেন্ট আসবে না। আমার মনে হলো
– তোমার এগুলি লাগতে পারে।“
আমি হাত বাড়িয়ে জিনিসগুলি
নেয়ার পর – এখলাস তার মোমবাতি বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “তোমার মোমবাতিটা এখান থেকে জ্বালিয়ে
নাও।“
আমি মোমবাতি জ্বালালাম।
এখলাস চলে গেলো। আমি জানি না, এই মানুষটাকে আমি কীভাবে ধন্যবাদ দেবো।
No comments:
Post a Comment