Saturday 25 May 2019

আলফ্রেড নোবেলের বিস্ফোরক ভালোবাসা - পর্ব-২


১৮৭৬ সালে আলফ্রেড ভিয়েনায় গিয়েছিলেন কাজে। শহরটাকে বেশ ভালোই লাগে তাঁর। ভিয়েনার হোটেলে বসেই কিছুদিন কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কাজ করতে করতে নিজেকে বড় একাকী বড় বুড়ো মনে হচ্ছে তাঁর। নিজের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন লোক রেখেছেন কিছুদিন হলো। কিন্তু তাকে দিয়ে সবকিছু সামলানো যাচ্ছে না। মনে হলো এই ভিয়েনায় থেকে এমন একজন কাউকে খুঁজে নেয়া যায় যে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী থেকে বন্ধুও হয়ে যেতে পারে কোন এক সময়। অনেক ভেবেচিন্তে সংবাদপত্রের ‘আবশ্যক’ পাতায় একটা বিজ্ঞাপন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ভিয়েনার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলো সেই বিজ্ঞাপন -  “প্যারিসে বসবাসরত ধনী, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, বয়স্ক ভদ্রলোকের প্যারিসের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এবং ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য একাধিক ভাষায় পারদর্শী বয়স্কা মহিলা আবশ্যক।”

প্যারিসে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর বিজ্ঞাপনের সুবাদে অনেকগুলো দরখাস্ত এসে জমা হয়েছে। আলফ্রেড বাছাই করতে শুরু করলেন। সবার ইন্টারভিউ নেবার সময় তাঁর নেই। যা করার দরখাস্তের ভাষা, তথ্য এবং ছবি দেখে ঠিক করতে হবে। তিনি জানেন তিনি কী চাইছেন। তিনি চাইছেন এমন কাউকে নিয়োগ দিতে যিনি তাঁর চিঠিপত্র লিখতে পারবেন পাঁচটি ভাষায়, যিনি ইতিহাস সচেতন হবেন, সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা থাকলে তো খুবই ভালো।

দরখাস্ত বাছাই করতে করতে তিনি পেয়ে গেলেন যা চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি। চমৎকার হাতের লেখা, চমৎকার শব্দচয়ন - পাঁচটি না হলেও ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান এই তিনটি ভাষায় পারদর্শী - কাউন্টেস বার্থা সোফিয়া ফেলিটাস কিনস্কি ফন কিনিক - সংক্ষেপে বার্থা ফন কিনস্কি। দরখাস্তের সাথে পাঠানো ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। আশ্চর্য সুন্দর আর ব্যক্তিত্বময়ী তেত্রিশ বছর বয়স্কা কুমারী বার্থা। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল।

আলফ্রেড বার্থাকে নিয়োগপত্র পাঠালেন। অনেক বেশি বেতন অফার করলেন যেন বার্থা মত পরিবর্তন না করতে পারেন। নির্দিষ্ট দিনে প্যারিসের ট্রেন স্টেশনে বার্থাকে রিসিভ করতে নিজেই গেলেন আলফ্রেড নোবেল। ছবি দেখে যতটুকু ধারণা করেছিলেন তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী ও ব্যক্তিত্বময়ী বার্থা।

“ওয়েলকাম টু প্যারিস কাউন্টেস ফন কিনস্কি। আমি আলফ্রেড নোবেল।”
“থ্যাংক ইউ মিস্টার নোবেল। ইউ আর সো কাইন্ড।”

বার্থাও আলফ্রেড নোবেলকে দেখে কিছুটা অবাক হয়েছেন। তাঁর চাকরিদাতাকে যতটা বুড়ো মনে করেছিলেন - মোটেও বুড়ো নন তিনি। বার্থার চেয়ে খুব বেশি হলে দশ বছরের বড় হবেন।

গাড়িতে উঠার সময় নোবেল বললেন, “আমার বাড়িতে আপনার থাকার জন্য যে রুম ঠিক করা হয়েছে তা নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। রেডি হতে কয়েকদিন দেরি হবে। আমি আপনার জন্য গ্রান্ড হোটেলে একটি সুইট ঠিক করে রেখেছি। এ ক’দিন আপনি সেখানেই থাকবেন।”

গ্রান্ড হোটেলের রুমে সুটকেস রেখে হোটেলের ডায়নিং রুমে বসে ব্রেকফাস্ট সারলেন বার্থা ও নোবেল। নোবেল বার্থাকে সংক্ষেপে বললেন তিনি কী করেন এবং বার্থার কাজ কী হবে। বার্থা বেশ অবাক হলেন। স্বাভাবিক ইউরোপিয়ানদের তুলনায় যথেষ্ট খাটো মৃদুভাষী সাদামাটা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এই ভদ্রলোক মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই বিশ্বজুড়ে ডায়নামাইটের কারখানার একচ্ছত্র মালিক। দুটো নীল চোখে কেমন যেন বিষন্নতা। কথাবার্তা খুবই মার্জিত, কিন্তু কোথাও যেন প্রচন্ড হতাশার সুর, প্রচন্ড শূন্যতা।

হোটেল থেকে বার্থাকে বাড়ি দেখাতে এবং কাজকর্ম বুঝিয়ে দিতে নিয়ে এলেন নোবেল। বাড়ি দেখে ভালো লাগলো বার্থার। নোবেলের কাজের অফিস এবং ব্যক্তিগত লাইব্রেরি দেখে ভীষণ খুশি হলেন বার্থা। লেখাপড়ার প্রতি তাঁরও আগ্রহ অনেক। বাড়িতে কাজের লোক ছাড়া আর কেউ থাকেন না দেখে সহজেই বুঝে নিলেন নোবেলের একাকীত্ব আর শূন্যতা কোথায়।

বার্থার সাথে কাজের কথা বলতে বলতে নোবেল বিস্তারিতভাবে বললেন তিনি কী কী জিনিস নিয়ে গবেষণা করছেন, কী কী বিস্ফোরক তৈরি হচ্ছে তার কারখানায়, কীভাবে সারা পৃথিবীতে রাস্তাঘাট ট্রেন লাইন তৈরি করার জন্য পাহাড়-পর্বত সমতল করার কাজে ডায়নামাইটের ব্যবহার বাড়ছে। বলতে বলতে আলফ্রেড খেয়াল করলেন - খুব আনন্দ পাচ্ছেন তিনি বার্থার সাথে কথা বলতে। মনে হচ্ছে এতদিন ধরে তিনি যাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁকে পেয়ে গেছেন। বার্থাই হতে পারেন তাঁর জীবনের সুখদুঃখের অংশীদার।

বার্থাও একধরনের মমতা অনুভব করছেন নোবেলের প্রতি। মানুষটা কত ধনী, কত সৃষ্টিশীল, কত বৈষয়িক; আবার একই সাথে কোথাও যেন এক গহীন মননে মগ্ন কবি।
দু’দিন পর গ্রান্ড হোটেলে ডিনার করার সময় বার্থার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন নোবেল।
“কী এটা?”
“পড়ে দেখুন”
“কবিতা বলে মনে হচ্ছে!”
“একজন নিঃসঙ্গ মানুষের গোপন শখ।”

বার্থার ধারণাই ঠিক। এই আপাত কঠিন মানুষটা একজন কবি। কবিতার ছত্রে ছত্রে জাল বুনেছে গভীর কষ্ট। মানুষটা এত হতাশাবাদী কেন? ভেবে পান না বার্থা। কিন্তু বুঝতে পারেন এই মানুষটার একজন অবলম্বন দরকার। শুধুমাত্র সেক্রেটারির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। নোবেলের দরকার বেতনভুক্ত সেক্রেটারির চেয়েও বেশি কাউকে। বার্থার ভয় হতে থাকে - তিনি কি তা হতে পারবেন নোবেলের যা দরকার?

বার্থাকে কাছ থেকে দেখে, কয়েকদিন মিশে বার্থার প্রতি একধরনের দুর্বলতা অনুভব করতে শুরু করেছেন আলফ্রেড। বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় তিনি ভালোবাসার কথা ভাবেননি একবারও। চেয়েছিলেন বয়স্কা কেউ এসে তার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি তার ঘরবাড়ির দেখাশোনাও করবেন। একজন কথা বলার লোক হবে তাঁর। সংসারে কারো সাথেই তো মন খুলে কথা বলতে পারেন না। সবার সাথেই কেমন যেন বৈষয়িক দেয়ানেয়ার সম্পর্ক। বিশ বছর আগে যে মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তাকে ভুলতে পারেন নি। বার্থা স্মার্ট সুন্দরী শিক্ষিতা একাধিক ভাষায় পারদর্শী - তাঁর তো এরকমই কাউকে দরকার। অনেক ভেবেচিন্তে বার্থার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললেন আলফ্রেড নোবেল।
পরদিন ডিনারের পর বার্থাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আলফ্রেড, “তোমার হৃদয়ে কি আমার জন্য একটু জায়গা হবে?”
কী জবাব দেবেন বুঝতে পারেন না বার্থা। আলফ্রেডকে দেখেই ভালো লেগে গেছে বলা যাবে না। ক’দিন কাছ থেকে দেখে যতটুকু বুঝেছেন মানুষটা ভাবুক, কবি, দয়ালু কিন্তু বিষন্ন। খুবই অসুখী, কিছুটা সন্দেহপরায়ণ। মানুষের ভাবনাচিন্তার সবকিছুই বুঝতে পারেন, কিন্তু ভীষণ নৈরাশ্যবাদী। সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, কিন্তু মানুষটা মনে হয় হাসতে জানেন না। বার্থা এক ধরনের মমতা অনুভব করেন আলফ্রেডের প্রতি - কিন্তু তা প্রেম নয়। তার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে যে অন্য একজন বসে আছেন তা কীভাবে বলবেন বার্থা। কিন্তু না বললে যে আরো অবিচার করা হবে নোবেলের প্রতি। বার্থা নোবেলকে খুলে বললেন তাঁর হৃদয়ের কথা। 
ভিয়েনার খুব বনেদি পরিবারে জন্ম বার্থার। পারিবারিক সূত্রেই কাউন্টেস তিনি। বার্থার বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার। বার্থার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। প্রচন্ড শোক ও হতাশা থেকে বার্থার মা মদ-জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন। ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে শিক্ষাদীক্ষা সহবতে বড় হতে হতে বার্থা দেখলেন তার মা স্বামীর অর্থসম্পদ যা ছিল সব জুয়া খেলতে খেলতেই শেষ করে ফেলেছেন। প্রচন্ড অর্থকষ্টে পড়তে হয় তাদের। বার্থাকে জীবিকার প্রয়োজনে গভর্নেসের কাজ নিতে হয়। 
সুন্দরী শিক্ষিতা দরিদ্র বার্থা ভিয়েনার খুব বনেদি ফন শাটনার পরিবারের চারজন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য গভর্নেস হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন। শাটনার পরিবারের ছোটছেলে আর্থার বার্থার চেয়ে সাত বছরের ছোট। কিন্তু আর্থার বার্থার প্রেমে পড়ে গেলেন। বার্থাও ভালোবেসে ফেলেছেন আর্থারকে। আর্থার ঠিক করে ফেলেছেন বার্থাকে বিয়ে করবেন। 

আর্থারের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না এ সিদ্ধান্ত। বার্থা বড়ঘরের মেয়ে এটা ঠিক। কিন্তু বিত্তহীন কাউন্টেসের কোন দাম নেই আর্থারের মায়ের কাছে। তিনি ভাবছিলেন কীভাবে বার্থাকে দূর করে দেয়া যায়। ঠিক সেই সময়েই তাঁর চোখে পড়েছিলো নোবেলের বিজ্ঞাপন। 
আর্থারের মা ভেবেছিলেন - এই তো সুযোগ। কোনভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বার্থাকে প্যারিসে পাঠিয়ে দিতে পারলে আর্থারকে সামলানো কঠিন হবে না। তিনি বিজ্ঞাপনটি বার্থাকে দেখিয়ে বুঝিয়েছেন যে প্যারিসে তার যাওয়া উচিত। বিজ্ঞাপনে বয়স্কা মহিলা চাওয়া হয়েছে। তেত্রিশ বছর নিশ্চয় অনেক বয়স। তাছাড়া বার্থা ইংরেজি, ফরাসি আর ইতালিয়ান তো ভালোই জানেন। বার্থা আর্থারের মায়ের মনোভাব জানেন। এটাও জানেন যে আর্থারের সাথে তার সম্পর্ক খুবই অসম সম্পর্ক। আর্থারের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়াই সব দিক থেকে ভালো। তাই বার্থা বিজ্ঞাপনের চাকরির দরখাস্ত করেছিলেন। 
বার্থা বলেন, “বিদায়বেলায় আর্থার আমার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে বলেছে ‘বার্থা, আমি তোমাকে ভুলব না’। আমিও যে আর্থারকে ভুলতে পারছি না কিছুতেই।” 
সবশুনে আলফ্রেড পরামর্শ দিলেন, “ভুলে যাও সব। আর্থারের সাথে আর কোন যোগাযোগ রেখো না।”
বার্থা ভাবলেন তাই হবে। 
ক’দিন পরেই আলফ্রেডকে দরকারি কাজে যেতে হলো স্টকহোমে। বার্থা রয়ে গেলেন প্যারিসের হোটেলে। পরদিনই দুটো টেলিগ্রাম পেলেন বার্থা হোটেলের ঠিকানায়। একটা পাঠিয়েছেন আলফ্রেড - স্টকহোমে পৌঁছেছেন ঠিকমত। দ্বিতীয়টা টেলিগ্রামটা এসেছে আর্থারের কাছ থেকে। আর্থার লিখেছেন - “তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না বার্থা।” 
উথাল-পাথাল সুখে উদ্বেল হয়ে উঠলেন বার্থা। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। আলফ্রেডের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা চিঠি লিখলেন। যেহেতু আলফ্রেডের চাকরিটি তিনি আর করছেন না, মনে হলো হোটেলের বিলটা তাঁরই  দিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু টাকা-পয়সা নেই তাঁর। পারিবারিকসূত্রে একটা হিরের পিন পেয়েছিলেন তিনি। সেটা বিক্রি করে হোটেলের বিলটা চুকিয়ে ট্রেনের টিকেট কেটে ফিরে গেলেন ভিয়েনায়। সেখানে আর্থার অপেক্ষা করছিলেন বার্থার জন্য। দু’জনে ভিয়েনা থেকে পালিয়ে চলে গেলেন ককেশাস (বর্তমান জর্জিয়া)। আর্থারকে বিয়ে করে বার্থা ফন কিনস্কি হলেন ব্যারোনেস বার্থা ফন শাটনার। 
এদিকে স্টকহোম থেকে প্যারিসে ফিরে এসে বার্থার চিঠি পেয়ে খুব হতাশ হয়ে গেলেন আলফ্রেড। তাঁর মনে হলো কারো ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা তার নেই। তিনি কি বার্থার যোগ্য ছিলেন না? ৪৩ বছর বয়স কি প্রেমের জন্য খুবই বেশি? তিনি কি বার্থার কাছে এমন কিছু চেয়ে বসেছিলেন যে বার্থা এভাবে চলে গেল? এতবছর পর মনে প্রেম অনুভব করেছিলেন তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল এভাবে? 
ক’দিন পর বার্থার চিঠি এলো ককেশাস থেকে। আর্থারকে বিয়ে করে তিনি সুখে আছেন। সুন্দর করে চিঠির উত্তর দেন আলফ্রেড। বার্থার সাথে সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে যায় আলফ্রেডের। আমৃত্যু অটুট ছিল এ সম্পর্ক। 
বিয়ের পর প্রায় আট বছর পর্যন্ত ককেশাসে ছিলেন আর্থার ও বার্থা। সেসময় বার্থা লিখতে শুরু করেন। গল্প উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর। যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্রবিরোধী বই পড়তে পড়তে নিজেও যুদ্ধবিরোধী হয়ে গেছেন বার্থা। আট বছর পর আর্থারের মা তাঁদের সম্পর্ক মেনে নিলে তাঁরা ভিয়েনায় ফিরে আসেন। সেখান থেকে স্বামীকে সাথে নিয়ে প্যারিসে এসে দেখা করে যান আলফ্রেড নোবেলের সাথে। বিয়ের পর সেই একবারই দেখা হয়েছিল বার্থার সাথে আলফ্রেডের। তবে পত্রযোগাযোগ ছিল আলফ্রেডের মৃত্যু পর্যন্ত। 
১৮৭৬ সালে বার্থার হৃদয়ে জায়গা পেতে ব্যর্থ হয়ে আলফ্রেড মনে মনে বেশ জেদী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হৃদয়ের দরজা জোর করে বন্ধ করতে চাইলেও কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো। সময় পেলেই তিনি ভিয়েনায় চলে যান, হেলথ রিসর্টে থাকেন। একটু অবসর পেলেই ঘুরে বেড়ান। 
একদিন এক ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন আলফ্রেড। দোকানে কাজ করছে অষ্টাদশী এক অস্ট্রিয়ান সুন্দরী - মিষ্টি একটা মেয়ে। পায়ে পায়ে দোকানে ঢুকলেন আলফ্রেড। তাঁর চোখের মুগ্ধতা চোখ এড়ালো না মেয়েটির। আরো বেশি উচ্ছল হয়ে উঠলো সে। এগিয়ে এসে নানারকম ফুলের তোড়া দেখাতে লাগলো আলফ্রেডকে। আলফ্রেডের মনে হচ্ছে দোকানের সবগুলো ফুলের চেয়েও সুন্দর এই মেয়েটি। নোবেলের এতদিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত তাঁর এই চিত্তচাঞ্চল্য। 

মেয়েটি খুবই চঞ্চল, অনবরত কথা বলছে, বর্ণিল প্রজাপতির মত যেন উড়ে বেড়াচ্ছে দোকানজুড়ে। হঠাৎ একটা টিউলিপের কলি নিয়ে এসে আলফ্রেডের কোটে পরিয়ে দিলো। মেয়েটির সুন্দর আঙুল ছুঁয়ে গেল আলফ্রেডের কাঁধ, গলার একপাশ আর দাড়িতে। আলফ্রেড এতদিন সীমাহীন কাঠিন্যে এড়িয়ে চলেছেন এরকম সব কমনীয় স্পর্শ। কিন্তু এখন কেমন যেন মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”
আলফ্রেডের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনেকটা ফিস ফিস করে বললো মেয়েটি - “সোফি”। আলফ্রেডের মনে হলো তাঁর কানে চুমু খেলো মেয়েটি। কেমন যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তাঁর শরীর আর মনে। 
সোফি হেস। দরিদ্র ঘরের মেয়ে সোফি জানে এইসব ধনী টাকার কুমিরেরা তাদের মত গরীব সুন্দরী মেয়েদের কী চোখে দেখেন। সোফি জানে কীভাবে তাদের চোখে পড়তে হয়। আলফ্রেড নোবেলের মত মানুষের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কে জড়ানোর মত কোন যোগ্যতাই নেই সোফির। অথচ আলফ্রেড সোফির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অদ্ভূত জটিল এই আকর্ষণ। তাঁর চেয়ে বয়সে তেইশ বছরের ছোট এই মেয়েটির প্রতি আদর মায়া-মমতা অনুভব করছেন তিনি। আবার একই সাথে মেয়েটির যৌবন তাঁকে টানছে। তিনি কামনা অনুভব করছেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি বদলে যাচ্ছে। পুরুষের চোখের এ দৃষ্টি খুবই চেনা সোফি হেসের। 
আলফ্রেডের এতদিনের সংযমের বাঁধ যেন হঠাৎ ভেঙে গেলো। তিনি সোফির সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুললেন - যে সম্পর্কের সামাজিক কোন স্বীকৃতি নেই। আবার নোবেলের মত ধনীদের জন্য এরকম সম্পর্কে তেমন কোন সামাজিক বাধাও নেই। কয়েক দিনের মধ্যেই আলফ্রেড ফুল কেনার মত করে ফুলের দোকানের কর্মচারী সোফি হেসকে একপ্রকার কিনেই নিলেন। 
দামি পোশাক, গয়না, আর দামি বাড়ি পেয়ে সোফির জীবন-পদ্ধতি পাল্টে যেতে সময় লাগলো না। আলফ্রেড সোফির জন্য বাড়ি কিনলেন ভিয়েনাতে। অভিজাত বাংলো ভাড়া করলেন সুইডেনে। আলফ্রেড যখন সুইডেনে বা ভিয়েনায় যান সোফিকে জানিয়ে দেন। সোফি আগে থেকেই সেখানকার বাংলোয় বা বাড়িতে চলে যান। আলফ্রেড দাপ্তরিক কাজ সেরে চলে যান সোফির কাছে। সোফির লাইফস্টাইল দ্রুত বদলে যেতে থাকে। তাঁর অর্থনৈতিক চাহিদাও বাড়তে থাকে জ্যামিতিক হারে।
যদিও আলফ্রেড কখনোই সোফিকে নিয়ে সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে যাননি, কারো সাথে সোফির পরিচয়ও করিয়ে দেননি - সোফির সাথে আলফ্রেডের সম্পর্কের কথা গোপন থাকলো না। নোবেল কোম্পানির প্রধান যে একজন রক্ষিতা রেখেছেন তা নিয়ে সামাজিক গুঞ্জন বাড়ছে। কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতে লাগলেন আলফ্রেড। কাজের প্রয়োজনে সোফির কাছ থেকে দূরেই থাকতে হয় তাঁকে বেশিরভাগ সময়। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই তিনি চিঠি লিখেন সোফিকে। চিঠির ঠিকানায় লিখেন - ‘মিসেস নোবেল’ বা ‘মিসেস সোফি নোবেল’। তাঁর পক্ষ থেকে এটা হলো গুঞ্জন এড়াবার উপায়। কিন্তু সোফির কাছে এটা হলো তাঁর সামাজিক স্বীকৃতি। তিনি নিজেকে ‘মিসেস আলফ্রেড নোবেল’ বলে পরিচয় দিতে শুরু করলেন। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts