Saturday 11 May 2019

ফাইনম্যানের ইলেকট্রোডায়নামিক ভালোবাসা - ২য় পর্ব


রিচার্ড ভাবলো আরলিন হয়তো খুব সুন্দরী কোন মেয়ে তাই ছুটছে সবাই এভাবে। কিন্তু সব কাজ ফেলে কোন মহারানিকে দেখতে ছুটে যাবার বিষয়টা তার কাছে অগণতান্ত্রিক মনে হল। সে তাই কোন কৌতূহল না দেখিয়ে যা করছিল তাই করতে থাকলো।
            এর কিছুদিন পরে যখন আরলিনের সাথে পরিচয় হলো তখন আরলিন তাকে বলেছিলো সেই পার্টির কথা - "সব প্রাণবন্ত মানুষ আমাকে দেখতে গেল, আমার সাথে কথা বলল। অথচ একটা ছেলে এক কোণায় বসে একটা মেয়ের সাথে এমন মগ্ন ছিল যে আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি!"
            অথচ আরলিন জানতো না দু'মিনিট আগেও তার ভাষায় প্রাণবন্ত মানুষগুলো রিচার্ড যা করছিল ঠিক তাই করছিলো।
            
আরলিন গ্রিনবামের সাথে রিচার্ডের প্রথম কথা হয় একটা নাচের পার্টিতে। আরলিনের জনপ্রিয়তা তখন সাংঘাতিক। তার সৌন্দর্যের জন্য এবং তার ব্যক্তিত্বের জন্যও বটে। সবাই তার সাথে নাচতে চাচ্ছিলো। ফলে সবাই অন্য কারো সাথে নাচতে নাচতেই আরলিনের কাছে চলে যাচ্ছিলোরিচার্ডও ভাবছিকীভাবে আরলিনের সাথে নাচা যায়।
            ড্যান্স পার্টির সুবিধে হলো হাত ধরে নাচা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো সঠিক সময়ে পা বাড়ানো। রিচার্ডের এরকম সমস্যা ভয়াবহ। প্রায়ই সে রকম সমস্যায় পড়ে। আরলিন যখন ফ্লোরের অন্য প্রান্তে একজনের সাথে নাচছে তখন রিচার্ড ভাবছে - 'এদিকে এলেই তার সাথে নাচবো' কিন্তু যখন ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে আসে তখন মনে হয় মিউজিকটা তেমন ভালো নয় বা এই মিউজিকের সাথে সে ভাল নাচতে পারে না। অপেক্ষা করতে থাকে নতুন মিউজিকের। যখন মিউজিক পছন্দ হয় তখন দেখা যায় আরলিন তার কাছ থেকে অনেক দূরে। তারপরেও সাহস করে কয়েক স্টেপ এগোনোর পর দেখা যায় সাঁ করে অন্য কেউ ঢুকে পড়ে নাচতে শুরু করেছে আরলিনের হাত ধরে। এখন আবারো অপেক্ষা করতে হয় কিছুক্ষণ। কারণ সেই মুহূর্তে তাদের নাচের ভেতর ঢুকে গিয়ে হাত ধরা অভদ্রতা। ভদ্রতার সময় যখন পেরুবে তখন দেখা যাবে হয় মিউজিক বদলে গেছে বা অন্যপ্রান্তে চলে গেছে আরলিন

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল রিচার্ড। বোকার মতো হাঁটাহাঁটি করলো, অন্য কারো সাথে নাচার চেষ্টা করলো। কিন্তু তার মন পড়ে আছে আরলিনে। আরলিনের সাথে ছাড়া আর কারো সাথে নাচতে কোন উৎসাহ পেলো না সে। মরিয়া হয়ে একটা চেষ্টা করলো সে। এক বন্ধুর কানে কানে বললো তার ইচ্ছের কথা। বন্ধুটি বেশ জোরে চিৎকার করে ঘোষণা করল, "বন্ধুগণ শোন, ফাইনম্যান আরলিনের সাথে নাচতে চায়।"
            একথা শোনার পর আরলিনের সাথে যে নাচছিলো সে নাচতে নাচতেই রিচার্ডের সামনে এসে আরলিনের হাত ছেড়ে দিলো। আর রিচার্ডের বন্ধুটি পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে রিচার্ডকে ড্যান্সফ্লোরে পাঠিয়ে দিল। রিচার্ড আরলিনের হাত ধরে নাচতে শুরু করলোআরলিনকে প্রথম যে কথাটি সে বললো তা ছিলো একটা প্রশ্ন - "এরকম জনপ্রিয়তা কেমন লাগে তোমার?"
            আরলিন উত্তর দেবার আগেই রিচার্ডকে ডিঙিয়ে আরেকজন নিয়ে গেল আরলিনকে।
        রিচার্ড ও তার বন্ধুরা সবাই নাচ শিখেছিল। কিন্তু কেউই তা স্বীকার করতে চাইত না। তখন আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। সবাই কোন না কোনভাবে উপার্জনের উপায় খুঁজছিল। রিচার্ডের মায়ের এক বান্ধবী একটা নাচের স্কুল খুলেছিলেন বাসার দোতলার একটা ঘরে ধরতে গেলে ওটাই ছিল ঐ সময় তার উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন। রিচার্ডের মত ছেলেদের জন্য তিনি ঘরের পেছনে একটা গোপন দরজা তৈরি করেছিলেন যেন গোপনে গিয়ে নাচ শেখা যায়। ছেলেদের নাচ শিখতে কেন লজ্জা লাগতো তা রিচার্ড ভেবে পেতো না, কিন্তু তার নিজেরই লজ্জা করতো আরো বেশি।
            নাচের স্কুলটি বেশ চলছিল। সবাই যার যার মতো গিয়ে নাচ শিখে আসতো। ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সমস্যা ছিল বেশি। নাচতে গিয়ে দেখা যায় ছেলেরাই সব সময় মেয়েদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। মেয়েরা কখনো তাদের নাচের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারতো না। অন্তত তাদের ইচ্ছা হলেও তারা তা প্রকাশ করতে পারতো নাআর ছেলেরা তো সবসময় সুন্দরী মেয়েদের সাথে নাচতে চাইতো। তাই যে মেয়েরা একটু কম সুন্দর তাদের মুখ গোমড়া করে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকতো না।
            
আবার রিচার্ডের মত যারা বেশি চিন্তা করে তাদের জন্যও ব্যাপারটা সহজ ছিল না। একটা পার্টিতে রিচার্ড দেখলো একটা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। রিচার্ড অনেকক্ষণ ধরে নাচতে চাইছে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। মেয়েটিকে দেখে ভাবল যাক এবার একজনকে পাওয়া গেল। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ নয়। রিচার্ড এগিয়ে গিয়ে নাচার প্রস্তাব দিলো। কিন্তু মেয়েটি বললো, "ধন্যবাদ, এখন আর নাচতে পারব না। আমি খুব টায়ার্ড।"
            রিচার্ডের খুব খারাপ লাগলো। নিজেকে সান্ত্বনা দিল - আহা বেচারি হয়তো আসলেই ক্লান্ত। কিন্তু একটু পরে তার নিজের গালে থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করল যখন দেখল সেই ক্লান্ত মেয়েটিই নাচছে তার সামনে অন্য একজনের হাত ধরে। ছেলেটি হয়তো তার বয়ফ্রেন্ডমেয়েটি হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতক্ষণ। অথবা তার পছন্দ হয়নি রিচার্ডকে। তার পোশাক হয়তো অতটা উজ্জ্বল নয় যতটা মেয়েটার পছন্দ। এরকম অনেক কিছুই ভাবা যায়। রিচার্ড অবাক হয় দেখে যে কত অবৈজ্ঞানিক সহজ ব্যাপার চোখের সামনে কীভাবে জটিল হয়ে যায়।
            
একদিন এরকম একটা নাচের পার্টিতে রিচার্ড নিমন্ত্রণ করলো আরলিনকেআরলিনের সাথে ওটাই তার প্রথম বাইরে যাওয়া। রিচার্ডের প্রিয় বন্ধুরাও ছিলো ওই পার্টিতে পার্টিটা হচ্ছিলো রিচার্ডের মায়ের বন্ধুর নাচের স্কুলে। রিচার্ডের মা-ই রিচার্ডের সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন যেন তাঁর বান্ধবীর নাচের স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ে। এই বন্ধুরা রিচার্ডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারমধ্যে কয়েকজন কবি টাইপের, আবার কয়েকজন বৈজ্ঞানিক টাইপেরতারা যখন রিচার্ডকে আরলিনের সাথে দেখলো হৈ হৈ করে কাছে চলে এলো।
            কয়েকজন বলতে লাগলো, "ফাইনম্যান, আমরা জানি আরলিন আজ তোমার। সুতরাং আমরা কেউ আজ আরলিনের দিকে হাত বাড়াবো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।"
            রিচার্ড তাদের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মোটামুটি আশ্বস্ত হয়েছিলকিন্তু একটু পরেই দেখা গেলো তারাও বারবার রিচার্ড আর আরলিনের নাচের মধ্যে ঢুকে পড়ছে আর আরলিন তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। যে বন্ধুটি আশ্বাস বাক্য উচ্চারণ করেছিলো তার ভূমিকা আরো বেশি এক্ষেত্রে। মনের দুঃখে রিচার্ডের গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলকিন্তু লজ্জায় তাও করতে পারছিল না।
            মেয়েদের ব্যাপারে রিচার্ড তখনো খুব লাজুকতাছাড়া কিছুটা  ভয়ে ভয়ে থাকত কারণ তার বন্ধুরা সবাই ছিল তার চেয়ে শক্তিশালী। সবাই বেসবল খেলত, নানারকম শরীরচর্চা করতো। আর রিচার্ড খেলাধূলার ধারে কাছেও যেত না। কোথাও খেলা হলে রিচার্ডের চিন্তা হতো কীভাবে সেখান থেকে পালানো যায়। তার চিন্তাগুলোও ছিল অদ্ভুত - "যদি একটা বল হঠাৎ আমার সামনে এসে পড়ে। আমাকেই যদি বলটা নিয়ে থ্রো করতে হয়। আমার ছুঁড়ে দেয়া বলটা যদি জায়গামতো না যায় সবাই হাসবে। এর চেয়ে লজ্জার কাজ আর কী হতে পারে?"
            কিছুদিন পরে আরলিন নিমন্ত্রণ করলো রিচার্ডকে তাদের বাড়িতে। বিরাট পার্টি হচ্ছে সেখানে। সবাই এসেছে। কারণ আরলিন তখন রিচার্ডদের পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। সবাই পছন্দ করে তাকে। সুতরাং তার পার্টিতে সবাই আসবে এটাই স্বাভাবিক। রিচার্ড অনেকটা হীনমন্যতায় ভুগতে ভুগতে জগতের অসারতা চিন্তা করতে করতে একটা সোফায় বসেছিল একটু পরে আরলিন এসে বসলো তার সোফার হাতলে। সেই মুহূর্তে আরলিনকে দেখে রিচার্ডের মনে হলো পৃথিবীটা এত্তো সুন্দর কেন। যে রিচার্ড কখনো কবি টাইপের ছিল না তারও মনে হলো একটা কবিতা লিখলে কেমন হয় আরলিনকে নিয়ে? রিচার্ড আরলিনের প্রেমে পড়ে গেল।
            
সেসময় ইহুদি ছেলেমেয়েদের জন্য বেশ বড় একটা ইয়থ সেন্টার ছিলো সেখানেবেশ বড় ক্লাব। অনেক কার্যকলাপ, অনেকগুলো গ্রুপে কাজ চলতো। একদল ছিলো লেখক গ্রুপ - তারা গল্প লিখে নিজেদের মধ্যে পড়ে শোনাতো। আরেক দল ছিলো নাটকের গ্রুপ - নাটক লিখে তা মঞ্চস্থ করতো। একটা বিজ্ঞান গ্রুপ ছিল আর ছিলো আর্টস গ্রুপ। বিজ্ঞান গ্রুপটা ছাড়া আর কোন গ্রুপের প্রতি বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না রিচার্ডের। কিন্তু আরলিন ছিল আর্টস গ্রুপে। তাই রিচার্ডও আর্টস গ্রুপে যোগ দিলো।
            
আর্টস গ্রুপে যোগ দিয়ে টিকে থাকার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করতে হল রিচার্ডের। ছবি আঁকা, মূর্তি তৈরি করা তার কখনো আয়ত্ত্বে ছিল না। আগ্রহও ছিল না কখনো। শুধুমাত্র আরলিনের গ্রুপে থাকার জন্যই তার এ অবস্থা। কিন্তু আরলিনের ব্যাপারে তেমন সুবিধা করতে পারলো না রিচার্ড।  আরলিনের একজন বয়ফ্রেন্ড ছিল। নাম জেরোম। একই আর্টস গ্রুপে। সুতরাং রিচার্ডের কোন চান্সই রইলো না। তবুও রিচার্ড আরলিনের পেছনে ছায়ার মত ঘুরতে লাগলো।
            
ইয়থ সেন্টারের বিভিন্ন পদের জন্য নির্বাচন হয় প্রতিবছর। সেবছর রিচার্ডের অনুপস্থিতিতে কে যেন তার নাম প্রস্তাব করলো প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য। বড়রা রিচার্ডের নাম শুনে রীতিমত নার্ভাস হয়ে পড়লেন। কারণ ইতোমধ্যেই ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে নাস্তিক হিসেবে যথেষ্ অখ্যাতি অর্জন করে ফেলেছে রিচার্ড।
            ইহুদিদের এই ক্লাবটার উদ্দেশ্যই ছিল ছেলেমেয়েদের মধ্যে ধর্মের প্রতি টান তৈরি করা। সেই ক্লাবে রিচার্ডের মত নাস্তিককে সভাপতির পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেয়াটা বড়দের ভীষণ বিব্রত করে তুললো। তারা রিচার্ডের বিরুদ্ধে একজোট হলেন। নির্বাচনে হেরে গেল রিচার্ড। কিছুদিন পরে যখন ক্লাবটাই বন্ধ হয়ে গেল হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো রিচার্ড। সে নির্বাচিত হবার পরে ক্লাব বন্ধ হলে সব দোষ পড়তো তার ওপর।
            কিন্তু আরলিনের সাথে শিল্পকর্মে যোগ দেয়া বন্ধ হয়ে যাওয়াতে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল রিচার্ডের। আরলিনের সাথে দেখা হবার সুযোগ যা ছিল তাও গেল।
            প্রচন্ড হতাশার মাঝেও একদিন আরলিনের সাথে দেখা হল রিচার্ডের। কথা প্রসঙ্গে আরলিন জানালো জেরোমের সাথে তার সম্পর্ক শেষ। জেরোম আর তার বয়ফ্রেন্ড নয়। রিচার্ডের জন্য এর চেয়ে আনন্দের সংবাদ আর হতে পারে না। তার পৃথিবী হঠাৎ যেন হাজারটা চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। আবারো আশা জাগছে প্রাণে। আরলিন রিচার্ডকে তাদের বাসায় যেতে বললো।
            সন্ধ্যাবেলা রিচার্ড গেল আরলিনদের বাড়িতে ১৫৪ ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাভেনিউ - তাদের নতুন বাড়ি। রিচার্ড আগে কখনো যায় নি সেদিকে। অন্ধকার হয়ে গেছে, অথচ পোর্টিকোর বাতিটি জ্বালানো হয়নি তখনো। বাড়ির নম্বর দেখা যাচ্ছিল না। রিচার্ড বুঝতে পারছিল না ঠিক জায়গায় এসেছে কিনা। শেষে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে নিচু দেয়ালে লাগানো নম্বরগুলো হাত দিয়ে দেখনা, ঠিক আছে ১৫৪।
            
ফিলোসফি নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল আরলিন। ভীষণ সমস্যায় পড়েছে সে। রিচার্ডকে দেখে খুশি বা বিরক্ত কোন্‌টা হয়েছে ঠিক বোঝা গেলো না। বললো - "আমরা এখন দেকার্তে পড়ছি। যেখানে 'আমি হলাম' 'আমি ভাবলাম' ইত্যাদি দিয়ে শুরু হয়েছে, কিন্তু শেষ হয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে। এই দেকার্তের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।"
            "অসম্ভব" - বলল রিচার্ডমহান দেকার্তের কথাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার যোগ্যতা সে রাখে কিনা বিবেচনা না করেই বলে ফেলল, "অসম্ভব, এরকম ধারণা ভুল।"
            
আসলে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখানোটা রিচার্ড পেয়েছে তার বাবার কাছ থেকে। রিচার্ডের বাবা 'কে বললেন' তার ধার ধারতেন না। তিনি 'কী বললেন' তাকে গুরুত্ব দিতেন সবসময়। তিনি বলতেন "কী বলা হয়েছে তা দেখো। নিজের সাথে কথা বল। যদি যুক্তিসংগত হয় মেনে নাও। না হলে যুক্তি দাও, প্রতিবাদ করো।
            রিচার্ড বললো, "তুমি কীভাবে একটা জিনিস দিয়ে শুরু করে ভিন্ন আরেকটা প্রসঙ্গ প্রমাণ করবে?"
            আরলিন বললো, "জানি না, আমি কিসসু জানি না।"
            তার চোখমুখ লাল। রিচার্ড বুঝতে পারল বেচারি অনেকক্ষণ থেকে খাটছে এই খটমটে দর্শন নিয়ে। সহানুভূতির সাথে বললো, "আরলিন, দেখি দাও তো পেপারটা আমাকে।"
            এরপর তারা ফিলোসফি নিয়ে আলোচনায় মেতে রইল দেকার্তের পেপারটা পড়ে দেখল রিচার্ড। যুক্তি যা দেয়া হয়েছে খুব সবল একটাও নয়। বলা হচ্ছে, "আমরা অনেক রকম চিন্তা করতে পারি। চিন্তাগুলো যে ভুল বা শুদ্ধ তা আমরা জানবো কীভাবে, যদি পরম বিশুদ্ধ কোন সত্যি না থাকে? যার সাথে তুলনা করে জানা যাবে কোন্‌টা সঠিক আর কোন্‌টা ভুল? সুতরাং পরম সত্য কোথাও আছে এবং সেই পরম সত্যই তো ঈশ্বর, মহান গড।"
            
পড়ে আঁৎকে ওঠে রিচার্ড - ওরে বাপরে, কী দার্শনিকতা! এরকম ফিলসফির কোন উত্তর দেয়া সহজ নয়। তবুও সেই বয়সে প্রতিবাদ করা, জোর দিয়ে কথা বলা তার চরিত্রের সাথে মিশে গেছে।
            সে বললো, "কিছুতেই নয়। বিজ্ঞানে তুমি পরম সত্য বা অ্যাবসলিউট কিছু না ধরেও বলতে পারো শতকরা কতটুকু গ্রহণযোগ্য বা কত ডিগ্রি পর্যন্ত তা সঠিক। আমার মনে হচ্ছে দেকার্তের ব্যাপারটাকে এতটা সিরিয়াসলি নেবার দরকার নেই।"
            
আরলিন বুঝতে পারলোদেকার্তের বিষয়টা আরেকবার চোখ বুলিয়ে সে দেখলো বা বুঝলো যে রিচার্ডের কথাটাই গ্রহণযোগ্য। বললো, "টিচার বলেছেন প্রত্যেক প্রশ্নেরই দুটো দিক আছেযেমন প্রত্যেকটি কাগজেরই আছে দুটো পিঠ।"

           "এ কথাটিরও দুটো দিক আছে"
            "মানে?"
            "কোন কোন কাগজের দুটো পিঠ নাও থাকতে পারে।"
            
এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা থেকে মোবিয়াস স্ট্রিপ সম্পর্কে জেনেছিল রিচার্ড। সে একটুকরো কাগজ নিয়ে দুপ্রান্তে আঁঠা লাগিয়ে একটা লুপ তৈরি করে আরলিনের হাতে দিয়ে বলল, "যেমন এই কাগজটা।"
            
পরদিন আরলিন তার ফিলোসফির ক্লাসে বেশ মজা পেলো। স্যারকে সে বললো, "প্রত্যেকটা প্রশ্নেরই দুটো দিক আছে, দু'রকম অর্থ হয়। যেমন একটা কাগজের দুটো পিঠ আছে। আবার এ কথাটিরও দুটো অর্থ হতে পারে। একটা কাগজের দুটো পিঠ নাও থাকতে পারে" - বলে সে মোবিয়াস স্ট্রিপ বানিয়ে দেখালো স্যারকে। ফিলোসফি ক্লাসের রানি হয়ে গেল আরলিন।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts