Wednesday, 1 May 2019

ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন - সপ্তবিংশ পর্ব



০২ আগস্ট ১৯৯৮ রবিবার

মেলবোর্নে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নাকি তিনটি জিনিস সাথে রাখতে হয়- ছাতা, জ্যাকেট আর খুচরো পয়সা। যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে- তাই ছাতা, প্রচন্ড গরমের সময়েও তাপমাত্রা হঠাৎ দশ ডিগ্রি নেমে যেতে পারে তাই জ্যাকেট। আর খুচরো পয়সা- নানাবিধ প্রয়োজনেঃ গাড়ি পার্ক করতে গেলে, পাবলিক ফোন ব্যবহার করতে হলে, ট্রামের টিকেট করতে হলে, ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিছু কিনতে হলে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ আমার সাথে ছাতা, জ্যাকেট, খুচরো পয়সা সব ছিল। তারপরও ভিজে চুপসে বাসায় ফিরেছি একটু আগে- রাত সাড়ে বারোটায়।
            কাল রাতে চিঠি লিখতে লিখতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আলী সাহেব দেশে যাবার সময় চিঠিগুলো নিয়ে যাবেন। এই সুযোগে বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে লিখে জানানো যে এদেশে কত ভালো আছি আমি। সকালে ঘুম ভেঙেছে অনেক দেরিতে। দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দটা না হলে আরো কতক্ষণ ঘুমাতাম জানি না। ভেতর থেকে বন্ধ করার জন্য কোন ছিটকিনি নেই দরজায়। জানি না এদেশের এটাই নিয়ম কী না। আমি ঘুমানোর সময় চেয়ার দুটো টেনে নিয়ে দরজায় লাগিয়ে রাখি। অন্তঃত একদম নিঃশব্দে কেউ ঢুকতে পারবে না।
            দরজা খুললাম। দরজার সামনে ডেভিড। কাল রাতে জোয়ানাকে সাথে নিয়ে বিয়ারের বোতল হাতে ডেভিড এসেছিলো আমার রুমে। এটা-ওটা গল্প করে গেছে। আমাকে একটা টেবিল দিতে চেয়েছে, দরকার নেই বলে নিতে রাজী হইনি। জোয়ানা আর ডেভিডকে ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছি অস্ট্রেলিয়ানরা আসলেই বেশ ফ্রেন্ডলি। আরো অনেকক্ষণ হয়তো আড্ডা মারতো- কিন্তু ফিল এসে জোরে ধমক লাগায় ডেভিডকে। বলে- লিভ হিম এলোন ডেরেল। বাপের বকুনি খেয়ে দ্রুত চলে যাবার সময় কি কিছু ফেলে গিয়েছিল আমার রুমে?
                গুড মর্নিং প্রাডিব
                মর্নিং ডেভিড
                প্রশ্নবোধক চোখে তার দিকে তাকাতেই সে বললো- বাবা বলেছে ঘরভাড়ার টাকাটা দিতে
                প্রতি দুসপ্তাহের ভাড়া নগদ অগ্রিম দেবার কথা আছে। ২০ তারিখ এসেছিলাম, আজ দুসপ্তাহ পূর্ণ হচ্ছে।
                জাস্ট এ মিনিট বলে ওয়ালেট খুলে দুটো পঞ্চাশ ডলারের নোট তুলে দিলাম ডেভিডের হাতে।
                থ্যাংক্‌স। বাবা পরে তোমার রসিদ দিয়ে দেবেন
                ও-কে ডেভিড
                এগারোটা বেজে গেলো ঘর থেকে বের হতে। শীতের আকাশ যথারীতি মেঘলা। আমার প্রিয় ঋতু শীত, অথচ মেলবোর্নের শীতকাল অসহ্য লাগছে। সারাদিন যখন তখন বৃষ্টি ভালো লাগে? ইউনাইটেড চার্চের সামনে বেশ ভীড়। প্রতি রবিবার এখানে ফ্রি খাবার দেয়া হয়। লম্বা লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের জামাকাপড় দেখে ঠিক গরীব বলে মনে হচ্ছে না।
                হাঁটতে হাঁটতে শহরের অলিগলি পেরিয়ে ইয়ারার তীরে। ব্রিজের নিচে রবিবারের খোলাবাজার আমাকে টানছে। কত রকম মানুষ আর কত রকমের জিনিস-পত্র। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে কেটে গেল সারা দুপুর। আর্ট-সেন্টারের সামনে বিশাল ঘোড়াটার কাছে জাদু দেখাচ্ছে একজন জাদুকর। যতটা কারসাজি তার চেয়ে বেশি চিৎকার চেঁচামেচি। এই ঠান্ডায়ও অসংখ্য মানুষ চলে এসেছে তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। সারা সপ্তাহ চরম ব্যস্ত থাকতে হয় বলেই সপ্তাহান্তের ছুটিতে এত আনন্দ।
দুটোর দিকে চলে এলাম ইউনিভার্সিটিতে। আরো কিছু চিঠি লেখা বাকি ছিল। লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তারপর কম্পিউটার খুলে বসলাম। একটু পর পর মেইলকমান্ড দিই- আর সাথে সাথে স্ক্রিনে রেসপন্স আসে- ইউ হ্যাভ নো নিউ মেইল
            অবশেষে সোয়া নটার দিকে টেলিফোন বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি করে ফোন ধরলাম। ওপ্রান্তে অজিত।
            খবর বল আগে
            স্টার, ছয়টি লেটার
            এতক্ষণ দেরি করলি!
            রেজাল্ট দিয়েছে চারটার পর। দিদিভাই রেজাল্ট নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে আমাকে জানিয়েছে একটু আগে
            আমি ভেবেছিলাম ই-মেইল করবি। ফোনে তো নাও পেতে পারতি
            আমি জানি যে তুই ভাগ্নির খবরের জন্য বসে থাকবি
            দিঠুন আজ এস-এস-সি পাস করে ফেললো। এই আনন্দ আমাকে এখানে একা একা সহ্য করতে হবে। কষ্ট একাকী সহ্য করা যায়। কিন্তু শেয়ার করতে না পারলে আনন্দও কেমন যেন কষ্টকর হয়ে ওঠে। দিদিভাইর বাসায় ফোন করা দরকার, দিঠুনকে অভিনন্দন জানাতে হবে।     
            সাড়ে নটার দিকে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরোলাম ফোন-কার্ডের খোঁজে। কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে রোববারের মেলবোর্ন শহর বিকেল পাঁচটার পরেই মরে যায়। টেলেস্ট্রা ফোন-ওয়ে কার্ড খুঁজতে খুজঁতে মেলবোর্ন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েও কোন কাজ হলো না। সেভেন ইলেভেন স্টোর গুলো 24/7 অর্থাৎ সপ্তাহের সাতদিনই চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে ফ্লিন্ডার স্ট্রিট পর্যন্ত চার-পাঁচটা সেভেন-ইলেভেনে ঢু মারলাম। কারো কাছেই টেলেস্ট্রা ফোন-ওয়ে কার্ড নেই। ট্রেলেস্ট্রা কার্ড যেগুলো আছে সেগুলো লোকাল অন্তঃরাজ্যে ফোন করার জন্য। ইন্টারন্যাশনাল অন্যান্য যে কার্ডগুলো আছে সেগুলো কেনার সাহস পেলাম না। কারণ এরকম একটা কার্ড যে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে তা এখনো ভুলিনি।
            মাথার ওপর রেয়াজুদ্দিন বাজারের ছাতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় পুরোপুরি ভিজে লাইগন স্ট্রিটে এসে ঢুকে পড়লাম একটা পাবলিক ফোন বুথে। কয়েন আছে মাত্র তিন ডলারের। মাত্র দুমিনিট কথা বলতে না বলতেই শেষ। ছয়টি লেটার পেয়েও আমার কন্যাটি খুশি নয়। সামাজিক বিজ্ঞানে লেটার পায়নি বলে আফসোস করছে। আর আমি আফসোস করছি এ মুহূর্তে আমার আরো অনেক কয়েন নেই বলে।
_____________
PART 28



No comments:

Post a Comment

Latest Post

Enigmatic quantum theory

  “ ‘There is actually no such thing as a quantum world. The quantum state exists only inside my head, something I use to do calculations. Q...

Popular Posts