Thursday 25 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ২য় পর্ব



সিডনি সেন্ট্রাল স্টেশনে বাস থামলো সকাল আটটায়। এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম! বাসের সময়সূচি অনুযায়ী সকাল এগারোটায় সিডনি পৌঁছানোর কথা। আসার সময় ক্যানবেরা হয়ে আসার কথা ছিল। কিন্তু ক্যানবেরার যাত্রী না থাকাতে মেলবোর্ন থেকে সরাসরি চলে এসেছে। আমি স্বপনদাকে বলেছিলাম এগারোটায় এসে পৌঁছাবো। এখন তিন ঘন্টা সময় পাওয়া গেলো হাতে। সময়টাকে কাজে লাগানো যাক। এগারোটার আগে কাউকে ফোন করার দরকার নেই।
   
আমার সাথে তেমন কোন ব্যাগেজ নেই। একটাই ব্যাকপ্যাক। বাস থেমেছে রাস্তার ওপর বাস থামার নির্দিষ্ট জায়গায়। ড্রাইভার নেমে বাসের ব্যাগেজ কেবিন খুলে একটার পর একটা ব্যাগ বামিয়ে রাখতে লাগলেন রাস্তার উপর। মনে হলো সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে যার যার ব্যাগ নিয়ে নিচ্ছে। যেভাবে খোলা জায়গায় ব্যাগ নামানোর ব্যবস্থা, কে কোন্‌ ব্যাগ নিচ্ছে দেখার কেউ নেই। যে কেউ যে কোন ব্যাগ নিয়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু মনে হলো এখনো এখানে ব্যাগ হারানোর বা চুরির ঘটনা খুব একটা ঘটেনি। আমরা তো বাধ্য না হলে কোন সিস্টেম বদলাই না। আমার ব্যাকপ্যাক ড্রাইভারের হাত থেকে রাস্তায়  ছিটকে পড়তেই তুলে নিলাম। এবার কোন্‌দিকে? রাতের বাসি মুখটা একটু ধোয়া দরকার।
স্টেশনের বারান্দা দেখে মনে হচ্ছে বেশ পুরনো। কমপক্ষে শত বছরের পুরনো বিল্ডিং। কিছু পুনর্গঠনের কাজও চলছে একদিকে। খুব একটা আহ্লাদিত হয়ে ওঠার মত সুন্দর কিছু নয় এই সেন্ট্রাল স্টেশন। পাবলিক টয়লেট ঝকঝকে পরিষ্কার। স্টেশনের প্লাটফর্মের চেয়েও বেশি পরিষ্কার টয়লেটের মেঝে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। এই মিষ্টি গন্ধে ক্লান্তি দূর হয়ে যায় অনেকখানি। স্নান করতে চাইলেও করা যায় শাওয়ার রুমে। মানুষের সবচেয়ে মৌলিক চাহিদাগুলো এখানে অবহেলিত নয়।
বাস স্টেশনের সাথেই লাগানো সিডনি সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন। বাইরের দিকটা দেখে মনে হয় কয়লার ইঞ্জিনের যুগের কোন স্টেশনে ঢুকছি। কিন্তু ধারণাটা বদলে যায় একটু পরে। বিশাল স্টেশন। তবে খুব একটা সুন্দর লাগছে না আমার। ঢাকার কমলাপুর স্টেশনের স্থাপত্যের সাথে এই সিডনি সেন্ট্রাল স্টেশনের কোন তুলনাই চলে না। আমাদের কমলাপুর এদের তুলনায় ময়লা হতে পারে, কিন্তু স্থাপত্যে অনেক বেশি সুন্দর।
একজন রেল কর্মচারী ট্রেনের সময়সূচি বদল করছেন কিছু কাঠের বোর্ড বদল করে। কিছুটা অবাক হলাম এই 'ম্যানুয়েল' ব্যবস্থা দেখে। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এরা কতটুকু এগিয়ে গেছে। অসংখ্য ডিজিটাল মনিটরে ইলেকট্রনিক্যালি আপডেট করা হচ্ছে ট্রেনের গতিবিধি।
আমাকে যেতে হবে অ্যাশফিল্ড, এগারোটার পরের কোন ট্রেনে। আমার ঠিক ধারণা নেই কত দূরে কিংবা কোন লাইনে যেতে হবে। স্বপনদা বলে দিয়েছিলেন কীভাবে যেতে হবে। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। সময় মতো দেখে নিলেই হবে। উন্নত দেশে নাকি পড়তে জানলে পথ খুঁজে নেয়া কোন সমস্যাই নয়। দেখা যাক। আপাতত সিডনি শহরের মাঝখানে বা সিটি সেন্টারে যাই কীভাবে? নাকি এটাই শহরের কেন্দ্রস্থল বুঝতে পারছি না।
ইনফরমেশান সেন্টার থেকে একটা ফ্রি বুকলেট তুলে নিলাম। ট্যুরিস্টদের জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য আর রঙিন ম্যাপে সমৃদ্ধ অফসেট পেপারে ছাপানো চমৎকার গাইড বই। সিডনি শহরের ম্যাপ, বাস ট্রেন, আর ফেরির সময়সূচি সব আছে এখানে।
সিডনির পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম মেলবোর্নের চেয়ে একটু ভিন্ন। মেলবোর্নের সিস্টেমের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলেই হয়তো এখানে একটু অন্যরকম লাগছে। সিটি সার্কেল ট্রেনের টিকেটের দাম নিলো দুই ডলার। ভাড়াটা একটু বেশি বলে মনে হলো। মেলবোর্নে টিকেটের দাম হয় সময় অনুযায়ী - দু'ঘন্টার টিকেট, সারাদিনের টিকেট, সাপ্তাহিক, মাসিক ইত্যাদি। কিন্তু সিডনিতে ট্রেনের ভাড়া দূরত্ব অনুযায়ী। আবার পিক আওয়ার আর অফ পিক আওয়ারের মধ্যেও দামের পার্থক্য আছে।



ট্রেনের নাম তরঙ্গ। এরা বলে 'টারাঙ্গা'। সুন্দর নাম। বগিগুলো তিনতলা। প্লাটফরমের সমান একটা অংশ। সেখানে সিঁড়ি আছে নিচের তলায় নামার বা উপরের তলায় ওঠার। বাংলাদেশের মত ঘন জনসংখ্যার দেশে এরকম ট্রেনের খুব দরকার। অবশ্য আমাদের দেশে ব্যবস্থা না থাকলেও ট্রেনের ছাদে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে নিই যখন দরকার হয়। ট্রেনের সিটগুলোও বেশ মজার। সিটের হেলান দেয়ার অংশটুকু আগে পিছে টেনে নিয়ে ইচ্ছেমতো সামনের দিকে বা পেছনের দিকে মুখ করে বসা যায়।
শহর ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যেই ট্রেনে ওঠা। কিন্তু সামান্য যে কয়েকটা স্টেশন পার হলাম তার বেশির ভাগই মনে হলো মাটির নিচে। ফলে তেমন কিছুই দেখা হলো না। একবার সামান্য কিছুক্ষণের জন্য ব্রিজের ওপর দিয়ে গেলাম - এটুকুই। ঠিকমত দেখার আগেই আবার সেন্ট্রাল স্টেশনে ফিরে এলাম। প্লাটফরমে নেমে মনে হলো আবারো এখানেই বের হবো? তার চেয়ে নতুন একটা স্টেশনে নামলেই তো হয়। আবার ট্রেনে উঠে পড়লাম।
চাইলে পুরো তিন ঘন্টা ট্রেনে চক্কর মারা যায় - কিন্তু ট্রেন থেকে কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। উদ্দেশ্যবিহীন নেমে পড়লাম একটা স্টেশনে। স্টেশনের নাম উইনিয়ার্ড। বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন। নানা রকম আলো ঝলসিত দোকানের সারি এখানে। মনে হচ্ছে সিডনি শহরের মোটামুটি কেন্দ্রস্থলে এসেছি। স্টেশন থেকে বের হবার মুখে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে টিকেট ঢুকানোর পর গেট খুলে গেল, কিন্তু টিকেট আর বের হলো না। ব্যাপারটা নতুন। মেলবোর্নে টিকেটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে 'এক্সপায়ার্ড' লেখা টিকেট বের হয়ে আসে, কিন্তু এখানে টিকেট খেয়ে নেয়। বেশ মজাই পেলাম। অবাক হবার মন না থাকলে নাকি কোন কিছু দেখে মজা পাওয়া যায় না। আমি তৈরি হয়ে আছি অবাক হয়ে মজা পাওয়ার জন্য। কলেজ জীবনে দেখা বাংলা সিনেমার একটা গানের মতো 'সবই যে নতুন নতুন লাগে রে লাগে রে'।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে এখনো। স্টেশন থেকে বের হয়েই জর্জ স্ট্রিট। ম্যাপে দেখা যাচ্ছে সিডনি শহরের একটা প্রধান রাস্তা এই জর্জ স্ট্রিট। জর্জ নামে পাঁচ ছয় জন রাজা তো ছিল ব্রিটেনে। তাদেরই কোন একজনের নামে হবে এই জর্জ স্ট্রিট। নামের ইতিহাস নিয়ে সাধারণ মানুষ এখানে মাথা ঘামায় বলে মনে হলো না। প্রচুর চায়নিজ দেখা যাচ্ছে এখানেও। চোখে পড়ছে আমার মত বাদামি চামড়ার মানুষও। সিডনিতে প্রচুর ইন্ডিয়ান আর বাংলাদেশি আছে শুনেছি।

জর্জ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। কোন্‌ দিকে যাচ্ছি জানি না। কেবল মনে রাখার চেষ্টা করছি যেন ফিরে আসতে পারি আবার ট্রেন স্টেশনের কাছে। প্রচুর লোকজন রাস্তায়। খ্রিস্টমাস চলে গেছে কয়েকদিন আগে। কিন্তু মানুষের কেনাকাটা কমেনি। সামনে নিউ ইয়ার্স ডে। সব দোকানেই বিরাট বিরাট 'মূল্য হ্রাস' লেখা পোস্টার। মূল্য হ্রাসের পরিমাণ যেমনই হোক বিজ্ঞাপনের সাইজ কিন্তু বিশাল। সারা বছরই তো এই মূল্যহ্রাস চলছে। 'সামার সেল', 'উইন্টার সেল', 'ক্রিস্টমাস সেল', 'নিউ ইয়ার্স সেল', 'ভ্যালেন্টাইন্‌স ডে সেল', 'মাদার্‌স ডে' 'ফাদার্স ডে' - আরো কত রকমের সেল যে আছে এদের। মেলবোর্নের কার্লটনে আমার বাসার কাছে একটা দোকানে সারা বছরই একটা বিজ্ঞাপন ঝুলতে দেখি - 'সেল, ওনলি ফর টুডে'। 
মার্কেট স্ট্রিট পার হতেই দেখি সামনে থৈ থৈ পানি। সুন্দর হারবার। নামটাও সুন্দর - 'ডার্লিং হারবার'। চমৎকার একটা ব্রিজের উপর দিয়ে হেঁটে একদম সাগরের কাছে। হাত বাড়ালেই পানি ছোঁয়া যায়। ট্যুরিস্টের ভিড় লেগে আছে এখানে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আকাশ গোমড়া। বাতাসের বেগও খুব একটা কম নয়। হাতের নড়বড়ে ছাতা একবার উল্টে গেলো। এখানে কেউ আমাকে চেনে না, তারপরও কেমন যেন লজ্জা লাগলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলাম কেউ আমাকে খেয়াল করছে কিনা। অনাবশ্যক অনুসন্ধান। ট্যুরিস্টরা দলে দলে হাঁটছে। কেউ কেউ ছোট ছোট লঞ্চ টাইপের ফেরিতে উঠছে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে। 
একটু এগিয়ে যেতেই সামনে পড়লো সিডনি অ্যাকুয়ারিয়াম। এই অ্যাকুয়ারিয়াম নাকি বিখ্যাত। সিডনিতে এসে এই অ্যাকুয়ারিয়াম না দেখা আর 'সুবর্ণ সুযোগ' হারানো সমান কথা। হাতে সময় আছে আরো দু'ঘন্টা। লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বিরাট লম্বা লাইন। ছেলেমেয়েদের ভীড় দেখে বোঝা যাচ্ছে ছুটির সময়টাকে কাজে লাগাচ্ছে তারা। 
প্রাপ্তবয়স্কদের টিকেটের দাম সাড়ে সতেরো ডলার। স্টুডেন্টদের জন্য প্রায় চল্লিশ পারসেন্ট কনসেশন। স্টুডেন্ট কার্ড দেখানোর পর আমাকে দিতে হলো দশ ডলার। টিকেটের ব্যবস্থা অদ্ভুত। আমার হাতের পিঠে রাবার স্ট্যাম্পের সিল লাগিয়ে দিলো হাস্যময়ী তরুণী টিকেটমাস্টার। তার নামটা সম্ভবত লিজা বা লিন্ডা। বুকের উপর লাগানো নেমট্যাগের লেখাটা লজ্জার কারণে ভালো করে পড়তে পারিনি। আধখোলা বুকের দিকে তাকাতে বুক ধড়ফড় করে। 
ভেতরে ঢোকার মুখেই প্রথমে যা চোখে পড়ে তা হও কোডাক ফিল্মের দোকান। এদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। মানুষ ছবি ওঠাবে, ফিল্ম শেষ হয়ে যেতে পারে, ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ হয়ে যেতে পারে, এমনকি যারা ক্যামেরা সাথে আনতে ভুলে গেছে তারাও ছবি তুলে নিয়ে যেতে পারে এদের কাছ থেকে ক্যামেরা ভাড়া নিয়ে। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এরা পেশাদার ক্যামেরাম্যান দিয়ে ছবি তুলে দিচ্ছে লোকজনের। যাবার সময় দাম দিয়ে ছবি নিয়ে যাবে।
আস্তে আস্তে সামনে এগোচ্ছি। মনে হচ্ছে একটা সুন্দর সাজানো গোছানো গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। নিয়ন্ত্রিত আলো - কোথাও উজ্জ্বল, কোথাও আধো অন্ধকার। জলজ প্রাণিদের প্রাকৃতিক পরিবেশ কৃত্রিম ভাবে তৈরি করতে বেশ যত্ন নেয়া হয়েছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট। ডানে বাঁয়ে বিরাট বিরাট কাচের ঘর। মনে হচ্ছে গভীর সমুদ্রকে বেঁধে রেখেছে কাচের আবরণে। দেয়ালে দেয়ালে পানিতে ভাসমান প্রাণিগুলোর বৈজ্ঞানিক তথ্যাবলি বেশ শিক্ষনীয় আর আকর্ষণীয়। সময়ের অভাবে সব পড়তে পারলাম না। লাল নীল হলুদ নানা রঙের হাজার হাজার মাছ। এদেরই কিছু জাত ভাই ধনীলোকের ড্রয়িং রুমের মিনি অ্যাকুয়ারিয়ামে থাকে। তাদের আবার আলাদা আলাদা বাহারি নামও থাকে। এখানে অবশ্য বৈজ্ঞানিক নাম ছাড়া আর কোন বাহারি নাম নেই। 



এক জায়গায় দেখা গেলো বিশাল একটা কাছিম। বেশ বড় একটা পাথরের কাছে বসে আছে। গায়ে রাজ্যের ময়লা। পাশের খোপে আছে বিশাল আকৃতির কাঁকড়া। দাঁড়া দুটোর দৈর্ঘ্য মাপলে এক মিটারের বেশি হবে। কোথায় পাওয়া যায় এদের, কী বৃত্তান্ত সব লেখা আছে খোপের বাইরের দেয়ালে। ছোট ছোট ডিজিটাল মনিটরে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রাণির বর্ণিল সব তথ্য। ধারাবিবরণী শুনতে ইচ্ছে করলে দেয়ালের হুক থেকে হেডফোন তুলে নিয়ে কানে লাগালেই হলো - জানা হয়ে যায় অনেক কিছু। একটু সামনের দিকে এগোবার পরে দেখা গেলো বেশ বড় একটা পুকুর। ঘরের ভেতর পুকুর দেখে ভালোই লাগলো। পুকুরের মাঝখানে ছোট একটা দ্বীপের মতো আছে। সেখানে বসে আছে চার-পাঁচটা সিল মাছ। কয়েকটা সাঁতার কাটছে পুকুরে। সিল মাছের নানা রকম শারীরিক কসরৎ দেখানো হয় দিনে কয়েকবার। এগারোটায় একটা শো আছে, কিন্তু আমি দেখতে পারবো না। আমাকে এগারোটার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে। 



একটা কুমির দেখা গেলো একটু সামনে যেতেই। খুব একটা বড় নয়। দেখলে ভক্তি বা ভয় কোনটাই জন্মে না। এই ঢেঁকির মত অলস প্রাণীটা নাকি সুযোগ পেলে আস্ত মানুষ গিলে খেতে পারে বিশ্বাস হয় না। চারপাশের স্টিলের বেড়া ধরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। বৈদ্যুতিক আলোঘেরা এই পরিবেশে কুমিরটাকে একদম মানাচ্ছে না। খুব একটা ভালো লাগলো না।
আবার ছোট ছোট কাচের খোপের সারি। সেখানে পেঙ্গুইন দেখা গেলো কয়েকটা। পেঙ্গুইনের ছবি দেখে যতটা ভালো লেগেছিল আমার - এখানে পেঙ্গুইনের নমুনা দেখে ততটাই হতাশ হলাম। এর চেয়ে ভালো কোন পেঙ্গুইন পায়নি এরা প্রদর্শন করার জন্য! আমাদের দেশের চিড়িয়াখানার বাঘ নাকি ঠিকমতো খেতে না পেয়ে বিড়ালের মত হয়ে যায়। এখানে নিশ্চয়ই পেঙ্গুইনের খাদ্য অ্যাকুয়ারিয়ামের কর্মচারীদের পেটে যায় না। তবে এই পেঙ্গুইনগুলো কেন ঝড়ের মুখে পড়া কাকের মতো হয়ে গেছে জানি না। কেমন যেন ভয়ে কাঁপছে সব সময়। 

পেঙ্গুইনের পাশের খোপে প্লাটিপাস। হাঁসের ঠোঁটের মতো ঠোঁট এদের। আবার গায়ে পশুর মতো লোম। পাখি আর পশুর অদ্ভুত সমন্বয় এই প্রাণীর শরীরে। প্লাটিপাস স্তন্যপায়ী প্রাণী। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোথাও এদের পাওয়া যায় কিনা জানি না। ভেবেছিলাম প্লাটিপাস হলো হাঁসের মতোই নিরীহ ধরনের প্রাণী। কিন্তু তা মোটেও ঠিক নয়। প্লাটিপাসের নাকি বিষ আছে, সাপের বিষের মতোই তীব্র বিষ। সাপের ছোবলের মতোই মারাত্মক প্লাটিপাসের কামড়। তবে প্লাটিপাসের কামড়ে কেউ মারা গেছে বলে শোনা যায়নি কখনো। 




হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ নিচের দিকে নামছি। গভীর সমুদ্রের প্রাণিকুলের সমাবেশ এখানে। ওরে বাপ্‌স। কাচের সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, মনে হচ্ছে সমুদ্রের নিচে হাঁটছি। আশেপাশে, মাথার উপরে, পায়ের নিচে সবখানে বিরাট বিরাট হাঙর ভেসে বেড়াচ্ছে। চোখ তুলে তাকালে দেখা যায় তাদের বিশাল তেলতেলে পেট। কোনভাবে কাচের আবরণ ভেঙে গেলে হাঙরের খাদ্য হতে হবে। বৈদ্যুতিক আলোয় সাগর তলের কৃত্রিম পরিবেশ উজ্জ্বলভাবে দেখা যাচ্ছে। বিরাট বিরাট কচ্ছপ ভেসে বেড়াচ্ছে হাঙরের পাশাপাশি। কাচের ঘরে ভরপেট খাবার সহ সব ধরনের আরাম পেয়ে এদের স্বাভাবিক স্বভাব যে বদলে গেছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সমুদ্রের আসল পরিবেশে এরা নিশ্চয় এমন অহিংস থাকে না। তাছাড়া এত ঘনবসতিও নয় সেখানে। ঈল মাছ দেখা গেলো অনেক। অনেকটা অজগর সাপের মত দেখতে এই মাছের কথা পড়েছিলাম মাসুদ রানা সিরিজের কোন একটা বইতে। সেখানে ঈলের বর্ণনা পড়ে ধারনা হয়েছিল এই মাছ একটা জীবন্ত বিভীষিকা। কিন্তু ধারনার সাথে বাস্তবের তেমন মিল দেখছি না এখানে। 


দেড়ঘন্টা সময় কীভাবে যেন কেটে গেলো। অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে বেরোবার পথ হলো একটা স্যুভেনির শপের ভেতর দিয়ে। নানারকম মন কাড়া সব স্যুভেনিরের প্রলোভন এড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ এখন ঘষা কাচের মতো আধাউজ্জ্বল। জর্জ স্ট্রিট, মার্কেট স্ট্রিট ইত্যাদি সদ্য পরিচিত রাস্তা ধরে হেঁটে গিয়ে শহরের একটা রেলওয়ে স্টেশনে ঢুকে পড়লাম।

স্বপনদাকে ফোন করলাম একটা পাবলিক ফোনবুথ থেকে। বাসায় কেউ নেই। তার মানে স্বপনদারা এখনো সিডনিতে ফিরে আসেননি। খারাপ লাগছে খুব। স্বপনদারা সারা বছর ছুটি জমিয়ে কুইন্সল্যান্ড বেড়াতে গেছেন। কিন্তু আমার জন্য তাঁরা ভ্রমণ সংক্ষেপ করে চলে আসছেন। মানুষকে অসুবিধায় ফেলতে আমার জুড়ি নেই। স্বপনদার মোবাইলে ফোন করলাম। 

"প্রদীপ, তুমি কি সিডনি পৌঁছে গেছ?"
"হ্যাঁ দাদা"
"আই অ্যাম সো সরি প্রদীপ। আমরা এখনো সিডনি থেকে অনেক দূরে আছি। সিডনি পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ন'টা বেজে যাবে। কিন্তু তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই। আমি নির্মলদাকে বলে রেখেছি। তিনি স্টেশন থেকে তোমাকে নিয়ে যাবেন তাঁর বাসায়। তুমি নির্মলদার বাসার ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা  লিখে নাও।"
আমি নোটবই খুলে নম্বর লিখলাম, বাসার ঠিকানা লিখলাম। স্বপনদা বলছেন, "নির্মলদা আমার কাজিন। বাংলাদেশে থাকতে ফিশারিজে ছিলেন। তোমার দিদিকে চেনেন। তুমি কোন ধরনের আন-ইজি ফিল করবে না। সিডনি থেকে অ্যাশফিল্ড স্টেশনে নেমেই দেখবে নির্মলদা অপেক্ষা করছেন তোমার জন্য। ট্রেনে ওঠার আগে নির্মলদাকে একটা ফোন করে দিও। তোমার সাথে রাতে দেখা হবে নির্মলদার বাসায়।"
বেশ অস্বস্তি লাগছে। বাংলাদেশে থাকতে স্বপনদা আমার দিদির সহকর্মী ছিলেন। সে হিসেবে আমার দাদা। তাঁরই জোরাজুরিতে সিডনিতে এসে তাঁর বাসায় থাকার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলাম। সেটা করতেই সংকোচ লাগছিল। এখন আবার নির্মলদার বাসায় যেতে হবে। নির্মলদার সাথে আমার পরিচয় নেই। একদম অপরিচিত মানুষের বাসায় কীভাবে ফোন করে বলবো যে আমি আপনাদের বাসায় আসার উদ্দেশ্যে ট্রেনে উঠছি। এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর জন্য যে ধরনের স্মার্টনেস থাকতে হয় তা আমার নেই, কখনো ছিল না। কিন্তু কী করা যাবে। আমি যেমন তাঁকে চিনি না, তিনিও তো আমাকে চেনেন না। তাছাড়া তিনিও যেমন বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে আছেন, তেমনি আমিও। এত ভাবনার কী আছে! নিজেকে বোঝাই আমি। 
উইনিয়ার্ড থেকে অ্যশফিল্ডের ভাড়া দুই ডলার ষাট সেন্ট। মেলবোর্নের সাথে তুলনা এসে যায় স্বাভাবিক ভাবে। মেলবোর্নে দুই ডলার ত্রিশ সেন্ট দিয়ে ছয় বার আসা যাওয়া করা যাবে উইনিয়ার্ড থেকে অ্যাশফিল্ডে। মনে হচ্ছে সিডনির পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম মেলবোর্নের চেয়ে পিছিয়ে আছে। টিকেট কেটে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে স্টেশন। প্লাটফর্ম ঝকঝকে পরিষ্কার। মানুষের আনাগোনা থেমে নেই। যাত্রীর ভীড় দেখে মনে হচ্ছে না যে অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার সাত ভাগের এক ভাগ। অবশ্য অস্ট্রেলিয়ায় সিডনিতেই জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এক একটা ট্রেন এসে চলে যাবার কিছুক্ষণ পর প্লাটফর্ম পরিষ্কার করার যান্ত্রিক ঝাড়ু নিয়ে হাজির হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা বিভাগের গাড়ি। 
আমার ট্রেন আসার সময় হয়েছে। নির্মলদার বাসায় ফোন করলাম। 

"হ্যালো" - মিষ্টি একটা গলা ফোনের ওপ্রান্তে। 
"হ্যালো, নির্মলদা বাসায় আছেন?"
"বাপি তো নেই। আপনি কি মামণির সাথে কথা বলতে পছন্দ করেন?"
ইংরেজিতে কথা বলতে অভ্যস্ত মেয়েটি বাংলা বলার সময় ইংরেজি থেকে সরাসরি অনুবাদ করছে বুঝতে পারছি।
নির্মলদার ছেলেমেয়ে ক'জন জানি না। নির্মলদার স্ত্রীর গলা শুনে বুঝতে পারলাম মেয়ে তার গলার মিষ্টতা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকেই। বৌদির কথা শুনে বুঝতে পারছি আমার আসার ব্যাপারটা তাঁরা জানেন। বৌদি দুঃখপ্রকাশ করছেন আমাকে নিতে স্টেশনে আসতে পারছেন না বলে। স্টেশন থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতে আমার কোন কষ্ট হবে কিনা তিনি বার বার করে জানতে চাইলেন। 

কিন্তু আমার কোন কষ্টই হবে না। বরং আমার স্বস্তি লাগছে এই ভেবে যে আমার জন্য স্টেশনে এসে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না কাউকে। তাছাড়া আমাকে যেহেতু চিনেন না সেহেতু বাদামি চামড়ার কাউকে দেখলেই 'আমি' ভেবে বসতে পারেন। তারচেয়ে এই ভালো। বেশ খুশি মনে ট্রেনে চেপে বসলাম। 

এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts