Friday 26 October 2018

শতাব্দীর মোহনায় সিডনি - ৩য় পর্ব



জানালায় চোখ রেখে বসে আছি। বাইরে সবুজ প্রান্তর আর ছবির মতো সুন্দর সাজানো সব আবাসিক এলাকা। সাব-আর্বান এরিয়া। ছোট ছোট স্টেশনে ট্রেন থামতেই আমার চোখ চলে যাচ্ছে স্টেশনের নাম লেখা বোর্ডে। স্টেশনের প্রত্যেকটা লাইটপোস্টেই স্টেশনের নাম লেখা আছে। ফলে নিজের স্টপেজ পেরিয়ে যাবার সম্ভাবনা কম। একটা ম্যাপ থাকলে সুবিধা হতো। সিডনির ট্যুরিস্ট গাইডে সাবার্বের ম্যাপ হয়তো আছে। কিন্তু ব্যাগ খুলে ম্যাপ বের করতে ইচ্ছে করছে না।
এদেশে ঠিকানা জানা থাকলে বাড়ি খুঁজে বের করা কোন ব্যাপার না। কিন্তু অ্যশফিল্ড স্টেশনে নেমে একটু সমস্যায় পড়ে গেলাম। স্টেশন থেকে বেরোবার পথ হলো একটা ওভারব্রিজের উপর দিয়ে। ব্রিজ থেকে নামার দুটো পথ চলে গেছে দুই বিপরীত দিকে। লোফ্‌টাস স্ট্রিটে যাবার জন্য কোন্‌ পথ দিয়ে নামতে হবে আমাকে? কাউকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়াটা সহজ। কিন্তু সহজ কাজও কেন যেন করতে পারি না সহজে। ভুল পথে একটুও না হাঁটলে নাকি পথ ভুল করার সম্ভাবনা বাড়ে। কথাটা বিখ্যাত কেউ বলেছেন কিনা বা আমি নিজেই বানালাম কিনা জানি না। তবে মনে হলো বেশ আশাব্যঞ্জক কথা। একদিক দিয়ে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। কেবল মনে রাখার চেষ্টা করছি - পথ ভুল প্রমাণিত হলে যেন স্টেশনে ফিরে এসে সঠিক পথ ধরতে পারি। আমার বাবা বলতেন, "অপরিচিত জায়গায় গেলে ওখান থেকে পরিচিত জায়গায় ফিরে আসার পথটা আগে চিনে রাখবি। তাতে মনোবল কমবে না।" এসময় এসব কথা মনে আসার অর্থ হলো আমি মিস করছি আমার বাংলাদেশে ফেলে আসা দিনগুলি।
এই সাবার্বের সাথে মেলবোর্নের সাবার্বের খুব বেশি পার্থক্য নেই। সাজানো গোছানো বাড়িঘর, কিছু দোকানপাট, কয়েকটা পার্ক। চারদিকে কেমন যেন চুপচাপ সবকিছু। শহরের কোলাহল এখানে নেই। এখানে মনে হয় উচ্চস্বরে কথাও বলে না কেউ। লোফ্‌টাস স্ট্রিট কোথায় কোন্‌দিকে কে জানে? ট্যাক্সি নেয়ার দরকার আছে কি? এলাকার মুদি দোকানদাররা নাকি পথঘাটের ভালো নির্দেশনা দিতে পারে। কিন্তু এখানে মুদি দোকান কোথায়? নির্মলদার ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু নিয়ে যাওয়া উচিত বলে মনে হলো। এ ধরনের সামাজিকতায় আমি অনভ্যস্ত। কিন্তু অনভ্যস্ততাতো কোন গুণ নয়।
একটা মিল্কবার চোখে পড়লো রাস্তার মোড়ে। মেলবোর্নে অনেক মিল্কবারের মালিক চায়নিজ। এখানেও দেখছি একই অবস্থা। এরা আছে বেশ সুখে। সুখের চেয়েও কৌশলে। ব্যবসার অলগলি চায়নিজ আর ইহুদিদের মতো আর কোন জাতিগোষ্ঠি এত ভালো চেনে না। ছোট ব্যবসা করলে বিভিন্নভাবে লাভ এদেশে। দোকানও এটা, বাসাও এটা। ফলে বাসার সমস্ত গ্যাস বিদ্যুৎ আর পানির বিল যাচ্ছে ব্যবসার নামে। ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি কাগজেপত্রে দেখাচ্ছে ব্যবসার নামে। ব্যবসার নামে ইনকাম ট্যাক্সে অনেক ছাড় পাওয়া যায়। তাছাড়া বাড়ির সবাইকে ব্যবসার অংশীদার হিসেবে দেখিয়ে মোট আয়কে অনেক ভাগে ভাগ করে দেখানো হয় যে ইনকাম খুব কম। এভাবেও ট্যাক্স ছাড়ের সুযোগ নেয়।
মিল্কবার চালানোর জন্য কোন কর্মচারী রাখার দরকার হয় না এদের। স্বামী বাইরে কাজ করলে স্ত্রী ব্যবসা সামলায়, আর স্ত্রী অন্য জায়গায় কাজ করলে স্বামী। ছোট বাচ্চা থাকলে তাদের রাখার জন্যও বেবি সিটার বা ডে কেয়ার সেন্টারের দরকার হয় না এদের। এই মিল্কবারে ছয়-সাত বছরের একটা মেয়ে বসে আছে কাউন্টারে। যে চেয়ারে বসেছে সেটা তার তুলনায় অনেক উঁচু আর বড়। এই পুঁচকে মেয়েটাই দোকান চালাচ্ছে? তার মা-বাবা হয়তো ভেতরে আছে কোথাও। মেয়েটার চোখ আমার পিছুপিছু ঘুরছে। আর আমার চোখ ঘুরছে দোকানে যেনতেন ভাবে ফেলে রাখা চকলেট আর টফি জাতীয় খাদ্যসামগ্রীর তাকে।
একটা চকলেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে দেখি মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে জুন মাসে। মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার এরকম প্রকাশ্যে দোকানে বিক্রি করার শাস্তি কয়েক হাজার ডলার জরিমানা সহ দোকানের লাইসেন্স বাতিল ইত্যাদি। এরা কি জানে না এসব, নাকি পরোয়া করে না? একটা দুটো নয়, তাকের প্রায় অর্ধেক জুড়ে সাজানো রয়েছে এই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া চকলেট বার। দোকানে যে খুব একটা বিক্রি হয় না তা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু এদেরকে জানানো উচিত যে তাদের চকলেটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
চকলেটের একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে মেয়েটার সামনে যেতেই মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠলো। খাঁটি চায়নিজ ভাষায় চিৎকার। প্রায় সাথে সাথেই দোকানের ভেতর দিক থেকে মহিলা কন্ঠের পাল্টা চিৎকার ভেসে এলো। চায়নিজ যে উপভাষায় এরা চিৎকার বিনিময় করছে তা খুব একটা শ্রুতিমধুর মনে হচ্ছে না। মহিলা বেরিয়ে এসেছেন ভেতর থেকে। গলায় কিচেন অ্যাপ্রোন ঝুলছে আর কোমরে একটা সাত-আট মাসের বাচ্চা। বাচ্চাটার সর্দি লেগেছে আর তা অনেক ঘনত্ব নিয়ে তার নাক দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অ্যাপ্রোনটার ময়লার পুরুত্ব দেখে মনে হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে এটার গায়ে পানি বা সাবান লাগেনি। মহিলার পিছু পিছু বছর চারেক বয়সের আরো একটা মেয়ে এসে দাঁড়ালো দোকানের কাউন্টারের কাছে তার মায়ের গা ঘেঁষে। মহিলার এই তিনটাই মেয়ে নাকি আরো আছে? দেখে মনে হচ্ছে তার আরো বড় বড় ছেলেমেয়েও থাকতে পারে। চীনাদের চীন ছেড়ে আসার একটা প্রধান কারণ নাকি ওদেশের 'ওয়ান চাইল্ড পলিসি'।
আমি কিছু বলার আগেই মহিলা কর্কশ গলায় বললেন, "তু দলার"।
আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে তার দোকানের এই চকলেটগুলোর মেয়াদ শেষ এবং তা বিক্রি করলে তারা কী কী সমস্যায় পড়তে পারে। মহিলা তার ছোট ছোট ঘোলাটে চোখ দুটোকে যথাসম্ভব বড় করে শুনলো আমার কথা। তারপর বললো, "ওয়ান পিচ, তু দলার"। সাথে দুটো আঙুল উঁচিয়েও দেখালো।
এদেশে আঙুল দেখানোর কিছু কায়দা আছে যা একটু এদিক ওদিক হয়ে গেলেই হয়ে পড়ে বড় বেশি অশ্লীল অর্থবোধক। এই মহিলার ইংরেজি জ্ঞান, ভদ্রতাবোধ আসলেই খুব কম, নাকি ইচ্ছে করেই দায়িত্ব এড়ানোর জন্য এরকম করছে জানি না। আমি কি একটা ঝামেলা তৈরি করবো, নাকি আমার কিছু যায় আসে না ভাব করে দোকান থেকে বেরিয়ে আসবো বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে চকলেটের মেয়াদ ইত্যাদি নিয়ে মহিলা খুব একটা বিচলিত নয়। মুখে 'তু দলার' বললেও তার বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে মহিলা আসলে বলতে চাচ্ছে "নিলে নে, না নিলে ফুট্‌"। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। কোন রকমে সামনে নিয়ে চকলেটটা কাউন্টারে রেখে বেরিয়ে এলাম।
আরো দোকান আছে আশেপাশে। একটা ছোট পার্কও দেখা যাচ্ছে। আমাকে খুঁজে বের করতে হবে লোফ্‌টাস স্ট্রিট। পার্কের সামনের রাস্তায় একটা গ্রোসারি শপ দেখা যাচ্ছে। দোকানে ঢুকে ভালোই লাগলো। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর গোছানো। চকলেটগুলোও বেশ টাটকা নতুন। দোকানের ইন্ডিয়ান ছেলেটাও বেশ চটপটে। লোফ্‌টাস স্ট্রিটের নির্দেশনা এমনভাবে দিলো যেন সে নিজের বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছে আমাকে। রাস্তায় বেরিয়ে তার কথা মতো লোফ্‌টাস স্ট্রিট খুঁজে পেতে কোন সমস্যা হলো না। একটু হেঁটে বাড়িটাও পেয়ে গেলাম।
মেইন গেট বন্ধ। গেটের দেয়ালে ইউনিট নম্বর লেখা সারি সারি ডোরবেল। নির্দিষ্ট নম্বরের ডোরবেল টিপতেই সাথে লাগানো স্পিকারে শোনা গেলো - "হু ইজ দেয়ার?" মিষ্টি গলার স্বর চিনতে পারলাম - নির্মলদার স্ত্রী। নাম বলতেই আরো মিষ্টি শব্দ ভেসে এলো - "দরজা খুলে দিচ্ছি, ভেতরে চলে আসুন"।
খুট করে একটা শব্দ হলো, আর দেখা গেলো লোহার গেট ফাঁক হয়ে গেলো একটু। আরব্য রজনীর 'সিসেম ফাঁক'-এর বাস্তব রূপ। ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠার পরেই দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে নেমে আসছেন একজন। বুঝতে পারলাম ইনিই নির্মলদা। মুহূর্তেই আমাকে বুকে টেনে নিলেন আক্ষরিক অর্থেই।
ফ্ল্যাটের দরজার মুখে ভাতের থালা হাতে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন বৌদি। হাতে ভাতের থালা দেখে হঠাৎ একটু থমকে গেলাম। ফুল চন্দন বা দৈ দিয়ে অতিথিকে বরণ করতে দেখেছি। কিন্তু ফুলের চেয়েও ভাত বেশি দরকারি হওয়া সত্বেও এরকম ভাত দিয়ে অতিথি বরণ করার প্রচলন কোথাও আছে বলে শুনিনি কখনো। অবশ্য একটু পরেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা সেরকম কিছু নয়। বৌদির পেছনে লুকিয়ে আছে পাঁচ-ছয় বছরের ফুটফুটে একটা মেয়ে। বৌদি তাকেই ভাত খাওয়াচ্ছেন।
ঘরে ঢুকলেই শান্তিতে মন ভরে যায় এমন চমৎকার সাজানো গোছানো অ্যাপার্টমেন্ট নির্মলদা আর কাজলবৌদির। ফুটফুটে দুই মেয়ে, ক্লাস ফাইভের তিথন আর নার্সারি ক্লাসের পুম্পা। মানুষকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা এ বাড়ির প্রত্যেক মানুষের। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মনে হচ্ছে আমি যেন এ বাড়িরই কেউ - পড়াশোনা করতে মেলবোর্নে গিয়েছি, এখন ছুটিতে বাড়ি এসেছি। মনেই হচ্ছে না যে আমার সাথে এদের এই প্রথম দেখা। পুম্পা আর তিথন আমার নামও শোনেনি আজকের আগে, কিন্তু আমার সাথে তাদের জড়তাহীন আন্তরিক আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমি তাদের সত্যিকারের কাকু। বাংলাদেশে রেখে আসা আমার দাদা-দিদির ছেলেমেয়েদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে এরা। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, আমার চোখে পানি চলে আসছে।
নির্মলদা নাকি টেনশান করছিলেন আমার জন্য। কারণ আমি ফোন করেছি প্রায় এক ঘন্টা আগে। স্টেশন থেকে আসতে তো এত সময় লাগার কথা নয়। আমি যে সিডনি থেকে ফোন করেছি তা তাঁদের মাথায় আসেনি, আর আমিও তো বলিনি যে সিডনি থেকে ফোন করছি। নির্মলদা গাড়ি নিয়ে বেশ কয়েকবার খুঁজে এসেছেন আমাকে স্টেশনে গিয়ে। তাঁদেরকে এরকম অসুবিধায় ফেলার জন্য আমার ভেতরের লজ্জার ভাবটা চলে আসছিলো। কিন্তু তা কেটে গেলো পুম্পার দাপাদাপিতে। তিথন আমাকে নিয়ে গেলো তার ঘরে। ছোট্ট ছিমছাম ঘর। একটা মনোরম স্নিগ্ধতা ঘিরে আছে চারপাশে। এই স্নিগ্ধতার নাম ভালোবাসা।
চকলেট হাতে নিয়ে এমন মিষ্টি করে হাসলো মেয়েরা, মনে হলো যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে। এরকম অনেক অনেক প্যাকেট চকলেট তাদের ঘরে আছে। এর চেয়ে অনেক অনেক ভালো চকলেট তারা নিয়মিত খায়। কিন্তু আদর করে কেউ অতি সামান্য কিছু দিলেও তা নিয়ে এরকম খুশি হবার অসামান্য ক্ষমতা তারা কোথায় পেলো!
স্নান করার পর হাজার কিলোমিটার ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। ইলিশ মাছ, শাক, ডাল, মাংস, আচার - এমন দারুণ রান্না আর মজার খাবার দীর্ঘ দেড় বছর খাইনি। আমার খাওয়া দেখে আমি নিজেই বুঝতে পারছি খাওয়াটা 'গোগ্রাসে খাওয়া'র পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম খাবার সামনে পেয়ে সীমা মেনে চলার মত বেকুব আমি হতে পারবো না কোন কালেই। কাজলবৌদি সস্নেহে পাতে তুলে দিচ্ছেন এটা ওটা। নির্মলদাও সমানে 'এটা দাও' 'ওটা দাও' বলে তাল দিচ্ছেন। মানুষ এরকম আন্তরিক হতে পারে কোন অচেনা মানুষের প্রতি! বিদেশে যারা থাকেন সবাই কি এরকম আন্তরিক, নাকি যারা আন্তরিক তারা সবখানেই আন্তরিক?
আমাকে বিশ্রাম করার সুযোগ দিয়ে নির্মলদা মেয়েদের নিয়ে লাইব্রেরিতে চলে গেলেন। আমি তিথনের ঘরে শুয়ে পড়লাম। লাইব্রেরিতে যাবার আগে তিথন ক্যাসেট প্লেয়ারে বাংলা গান চালিয়ে দিয়ে গেছে। আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সেই চিরন্তন সুর, "তুমি কি সেই আগের মতোই আছো, নাকি অনেকখানি বদলে গেছো? খুব জানতে ইচ্ছে করে।"
একটা লম্বা ঘুম দিয়ে উঠে দেখি পুম্পা একটা কাঁচি হাতে দাঁড়িয়ে আছে আমার মাথার কাছে। ঘুমের মধ্যে চুল কেটে দিলো নাকি? না, সেরকম দুষ্টুমি এরা জানে না। পুম্পা জানতে চাইছে তার অতি প্রয়োজনীয় কিছু কাটাকুটিতে আমি তাকে সাহায্য করতে পারি কিনা।

"তুমি কি কাগজ কাটতে পারো আমার মতো?"
"তোমার মতো অত ভালো হয়তো পারবো না। তবে তুমি শিখিয়ে দিলে পারবো।"
"আমি শিখিয়ে দেবো।"
বেশ মজা লাগছিলো এই পাঁচ বছরের শিশুর মুখে পাকা পাকা কথা। যথাসম্ভব সিরিয়াস ভঙ্গিতেই পুম্পার কাগজ কাটায় সাহায্য করতে লাগলাম এবং আমি যে এই কাজে মোটেও কোন কাজের না তা বার বার শুনতে লাগলাম।
একটু পরে তিথন এসে বসলো আমাদের কাছে। গল্প করলাম তার সাথে কিছুক্ষণ। তাদের স্কুলের গল্প, সে কী কী পছন্দ করে, কেন করে ইত্যাদি। সে জানালো সারাক্ষণ পড়াশোনা তার ভালো লাগে না। খুব বেশি হৈ চৈ করতেও ভালো লাগে না। নিউ ইয়ার্সে অ্যাশফিল্ডে ফায়ারওয়ার্ক্স হয় তবে তা সিডনির মতো অত বড় নয়। সিডনির নিউ ইয়ার্সের বিখ্যাত ফায়ারওয়ার্ক্স এখনো দেখা হয়নি তার। এ পর্যন্ত দেখা জায়গাগুলোর মধ্যে তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে উলংগং।

"সমুদ্রের কাছে ছোট্ট একটা ছবির মতো জায়গা উলংগং। সুযোগ পেলে যেয়ো, তোমারও ভালো লাগবে।"
বললাম, "যাবো"।
ভালো লাগলো তিথনের নিজের মতো করে চিন্তা করার ক্ষমতা দেখে এবং তা গুছিয়ে বলতে পারার ক্ষমতা দেখে। স্বাধীন ভাবে চিন্তা করতে পারা তো সহজ কথা নয়। তার বইয়ের কালেকশান দেখে বুঝতে পারছি জ্ঞানের প্রতি আগ্রহটা খুব পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে তাদের জন্য। ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বুঝতে পারলাম নির্মলদার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর।
নির্মলদা বাংলাদেশে থাকতে মৎস্য বিভাগে কাজ করতেন। গবেষক এবং কর্মকর্তা হিসেবে ছিলেন দারুন সফল। অস্ট্রেলিয়ায় ইমিগ্রেশানের জন্য দরখাস্ত করার ন্যূনতম সময়ের মধ্যে তা পেয়ে গেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর বছর খানেক কাজ করেছেন কম্বোডিয়ায়। সেখান থেকে ফিরে আপাতত কিছুদিন পড়াশোনা করছেন বিভিন্ন বিষয়ে। এই মানুষটার জানার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃত। তাঁর কথা যতই শুনছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। মনে হচ্ছে নির্মলদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালে শিক্ষার্থীদের দারুণ উপকার হতো।
বিকেলের চা খাবার পর নির্মলদা বেরোলেন একটা নতুন আসা বাঙালি পরিবারকে নিয়ে আসতে। আমি কাজলবৌদির সাথে গল্প করতে লাগলাম। কাজলবৌদি একটা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
জানা গেলো অ্যাশফিল্ডে অনেক কৃতি বাঙালি থাকেন। কবি সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত থাকেন এই স্ট্রিটেই। বিখ্যাত বিতার্কিক ও রম্যলেখক বিরূপাক্ষ পাল থাকেন এখানে। সাপ্তাহিক সময়-এ বিরূপাক্ষ পালের কলাম আমি গোগ্রাসে গিলতাম। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে অনেক মহৎ প্রতিভার মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁদের অনেককেই ধরে রাখতে পারছে না নিজের মাটিতে। মায়ের কাছ থেকে দূরে গেলেও সন্তান মায়েরই থাকে চিরদিন। আমাদের দেশের কৃতি সন্তানরাও যেখানেই যান চিরদিন আমাদের দেশেরই থাকবেন। আমরা বাঙালি হিসেবে তাঁদের নিয়ে গর্ব করবো।
নতুন আসা পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার। তিথন ও পুম্পার মতোই ফুটফুটে দুটো মেয়ে তাঁদের। আড্ডা জমে গেলো। আবার চা চপ চললো। নতুন দাদাটি বাংলাদেশ থেকে প্রথমে নিউজিল্যান্ডে মাইগ্রেট করেছিলেন। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছেন কিছুদিন হলো।
নির্মলদা নিঃস্বার্থ পরোপকারী। নতুন এলে এদেশে কী কী সমস্যা হয়ে থাকে তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন আর তার ব্যবহারিক সমাধানও দিচ্ছেন। আমার মুগ্ধতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। কোন্‌ দোকানের চাল ভালো থেকে শুরু করে সর্দির জন্য কোন্‌ ওষুধ বেশি কাজ দেয় সব নির্মলদার ভালোভাবে জানা।
নির্মলদা আর নতুন আসা দাদা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আলোচনা করছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি। ভাবছি আমার দেশ এরকম দুজন কৃতি কর্মী পুরুষকে হারালো। বাংলাদেশের যে কোন ভবিষ্যৎ নেই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের বেশির ভাগই যে ভন্ড তা বলছেন নির্মলদারা। তা তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষও জানে। কিন্তু আমাদের হাতে তো কিছু করতে পারার ক্ষমতা নেই। নির্মলদাদের মতো যারা বিদগ্ধ চিন্তা করতে পারেন তাঁদের সবাইকে তো কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া কিংবা কানাডা। এদেশে যারা প্রবাসী তাঁরা সবাই কি এভাবে নিজেদের ফেলে আসা দেশের কথা ভাবেন? আমি দেশ থেকে এসেছি বেশিদিন হয়নি বলেই হয়তো দেশের নিন্দা খুব একটা ভালো লাগছিলো না। কিন্তু নির্মলদার মতো জ্ঞানীব্যক্তি যখন বলছেন তখন তা বিশ্বাস না করার মতো সাহসও আমার নেই। আমার নিজের জানার পরিধি এতো কম বলেই হয়তো - আমি এখনো স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে।
স্বপনদারা এলেন রাত ন'টার দিকে। স্বপনদা আর নীলিমাবৌদি ঘরে ঢুকতেই তিথন আর পুম্পা হৈ হৈ করে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁদের ওপর। একটু পরেই পুম্পাকে দেখা গেলো স্বপনদার কোলে। স্বপনদা আর নীলিমাবৌদিকে যে এরা দারুণ ভালোবাসে তা কাউকে বলে দিতে হবে না।
স্বপনদার সাথে আমার দেখা হলো অনেক বছর পর। নীলিমাবৌদির সাথে এর আগে একবার মাত্র দেখা হয়েছিল। তাঁদের বিয়ের পর আমার দিদির বাসায়। স্বপনদাও নির্মলদার মতো বুকে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। হৃদয়ে এত উষ্ণতা এঁরা কোত্থেকে পেয়েছেন আমি জানি না। আমার কোন কষ্ট হয়েছে কিনা তা জানার জন্য স্বপনদা আর নীলিমাবৌদি সমান ব্যস্ত। আমার মতো একটা 'নো বডি'র জন্য তাঁদের ব্যাকুলতা দেখে লজ্জা পাচ্ছি আমি। আমার জন্যই তাঁদের ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে জেনে খুবই সংকোচ লাগছে আমার।
রাতের খাবার দেয়া হলো টেবিলে। খাবার আর প্লেট সাজিয়ে রাখা আছে। কাজলবৌদি এতসব কখন তৈরি করলেন বুঝতেও পারিনি। টেবিল থেকে যে যার ইচ্ছে মতো খাবার তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলাম। ব্যবস্থাটা খুব ভালো লাগলো আমার। খেতে খেতে গল্প করছেন স্বপনদা, নীলিমাবৌদি আর নির্মলদা। স্বপনদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন মেলবোর্নের খবর, বাংলাদেশের খবর। কাজলবৌদি বলে ফেললেন যে আমি গত দেড়বছর পর আজকেই প্রথম কোন বাঙালি পরিবারে বাঙালি খাবার খেলাম। স্বপনদা তাঁর স্বাভাবিক রসিকতায় বলে উঠলেন, "কী বলো! তুমি তো বোকা। মেলবোর্নে বাঙালি নেই? তাদের মেয়ে টেয়ে নেই? তাদের বাসায় যাবে, একটু লোভটোভ দেখাবে। দেখবে নিমন্ত্রণ খেয়ে শেষ করতে পারবে না।"
লজ্জা পাওয়ার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি। তাই এই রসিকতায় অন্যদের সাথে আমিও হাসলাম - আকর্ণ বিস্তৃত।
সময়কে আমরা পেছনে ফেলে এগিয়ে যাই ঠিকই, কিন্তু সময় পেলেই ফিরে ফিরে দেখি পেছনের দিকে। দেখি বলেই স্বপনদা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, "বনানী পাল কেমন আছে?"
নীলিমা বৌদির কান এড়ায় না। তিনি হাসতে হাসতে ক্ষেপাচ্ছেন স্বপনদাকে, "কার কথা জিজ্ঞেস করছো?"
"বনানী পালের কথা। জানো তো, বনানীকে যখন দেখতে গিয়েছিলাম তখন প্রদীপ সাথে ছিলো।"
তারপর বনানীর প্রসঙ্গে আলোচনা চলতে লাগলো। বনানী আমাদের বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে আমরা একই ব্যাচের। স্বপনদা বিয়ের আগে একবার আমাদের ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন। বিয়ে করার জন্য মেয়ে দেখছেন জেনে আমরা মজা করে বনানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। বনানীকে বলিনি স্বপনদার প্ল্যান। স্বপনদা অবশ্য বনানীর সাথে তেমন কিছু কথাও বলেননি। আমরা আমাদের আরো কয়েকজন বন্ধুসহ ইউনিভার্সিটির ঝুপড়ি দোকানে বসে চা খেয়েছিলাম। বনানী যে তখন আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র ভাইয়ের সাথে প্রেম করছে তা আমাদের জানা ছিল না। স্বপনদা বনানীর কথা বলে নীলিমাবৌদির সাথে মজা করছেন এখন এত বছর পরেও। আমারও বেশ মজা লাগছিলো তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর খুনসুটি।
নির্মলদা কিছুতেই ছাড়তে চাচ্ছিলেন না আমাকে। পুম্পা তো পারলে হাত ধরে টেনে রেখে দেয়। এত মায়া এরা কোত্থেকে পায়? কোন রকমে বিদায় নিয়ে উঠে বসলাম স্বপনদার লাল টুকটুকে টয়োটায়।
স্বপনদা আর নীলিমাবৌদির বাসা ওয়েস্টমিডে। প্যারামাটা সাবার্বে। ওয়েস্টমিড ট্রেন স্টেশনের সামনেই তাঁদের ইউনিট। নিজেদের অ্যাপার্টমেন্ট। দু'জন মানুষের জন্য বিশাল এই ফ্ল্যাট। বিশাল ডাইনিংরুম, লাউঞ্জরুম। স্টাডিরুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। চারপাশে বই আর বই। বাংলা গানের ক্যাসেটের বিরাট সংগ্রহ। দুটো ডেস্কটপ কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ফ্যাক্স, প্রিন্টার। একজন আধুনিক কর্মী মানুষের যা যা লাগে সব কিছু হাতের কাছে।
ঘরের মাঝখানে ধবধবে তুলতুলে বিছানা। এঘরে আমি থাকবো জেনে মনে হচ্ছে আমার হাতে কেউ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটা অংশ তুলে দিয়েছে। লাউঞ্জরুমের পুরু কার্পেটে পা ফেলে হাঁটতেও অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার পায়ের ময়লা লেগে যাবে এই ধবধবে কার্পেটে। লাউঞ্জরুমে বিশাল টেলিভিশন। ভিসিআর ক্যাবল কানেকশান সবই আছে। একপাশের দেয়ালে সাজানো আছে স্বপনদা আর নীলিমাবৌদির মেধা আর যোগ্যতার স্মারক গোল্ডমেডেল ট্রফি ইত্যাদি।
স্বপনদা প্যারামাটা সেন্টেনিয়াল পার্কের সায়েন্টিফিক অফিসার। ইউনিভার্সিটি জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পাওয়া মানুষ স্বপনদা। দারুণ বিতার্কিক ছিলেন। জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কে শ্রেষ্ঠ বক্তা হয়েছেন অনেকবার। নীলিমাবৌদি এখানে দুটো ইউনিভার্সিটির খন্ডকালীন শিক্ষক। তাঁর অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার দেখলে অবাক হতে হয়। কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে বাণিজ্য বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি। এম-ফিল পরীক্ষায় এতো ভালো করেছেন যে তাঁর এম-ফিলকে পিএইচডিতে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে এত দূরে থেকেও এরা যে বাংলাদেশকে কতো ভালোবাসেন তা যদি সবাই জানতো। ঘরের যেদিকে তাকাই সেদিকেই বাংলাদেশের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের মানচিত্র, পতাকা, নকশিকাঁথা, মাটির পুতুল আর হৃদয়জুড়ে বাংলাদেশের মানুষ।
_________
এ কাহিনি আমার 'অস্ট্রেলিয়ার পথে পথে' বইতে প্রকাশিত হয়েছে।


2 comments:

  1. read this passage in your book long ago. it was nice recalling.

    ReplyDelete

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts