Sunday, 12 May 2024

রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিনে - ২০২৪

 


১৯৭৯ সালে আমেরিকার Omni ম্যাগাজিন রিচার্ড ফাইনম্যানের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। লেখাটির শিরোনাম দিয়েছিল ‘The Smartest Man in the World’. ফাইনম্যানের মা তখনো জীবিত। তিনি যখন শুনলেন যে তাঁর ছেলেকে পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে বলা হচ্ছে – তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, “Our Richie? The World’s smartest man? God help us!”

মায়ের কাছে সন্তান চিরদিনই শিশু থেকে যায়। সন্তান যদি বিখ্যাত হয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই। মায়ের কথা বাদ দিলেও, রিচার্ড ফাইনম্যানকে পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট পুরুষ বলাতে অনেকের আপত্তি থাকতে পারে। আপত্তি তখনো ছিল, এখনো আছে। কিন্তু আমি তাঁকে সবচেয়ে স্মার্ট পদার্থবিজ্ঞানী বলে মনে করি। তিনি যে আইনস্টাইনের মতো মহাবিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানের খোলনলচে পালটে দিয়েছেন তা নয়। তাঁর গবেষণা যে পদার্থবিজ্ঞানের সকল শাখায় কোনো না কোনো ভাবে প্রভাব ফেলেছে – তাও নয়। তিনি কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের অগ্রদূত, ফাইনম্যান-ডায়াগ্রাম তাঁর আবিষ্কৃত অত্যন্ত কার্যকরী গাণিতিক কৌশল, The Feynman Lectures of Physics পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক এবং স্মার্ট ক্লাসরুম লেকচার। কিন্তু ফাইনম্যানের লেকচারের চেয়েও আকর্ষণীয় লেকচার দিয়েছেন আরো অনেক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তাঁর চেয়েও বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিল এবং এখনো আছে পৃথিবীতে। 

তারপরেও কেন শুধুমাত্র একজন পদার্থবিজ্ঞানী বেছে নেয়ার সুযোগ থাকলে আমি রিচার্ড ফাইনম্যানকে বেছে নেবো? কারণ তাঁর অনন্য স্টাইল। তিনি পদার্থবিজ্ঞানকে একেবারে নিজের মতো করে বুঝেছেন। তিনি যা বোঝেননি তা অকপটে বলে দিয়েছেন। তাঁর ভেতরে কোন ব্যাপারেই কোন দ্বিচারিতা ছিল না। তিনি নিজে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হয়েও স্পষ্টভাবে বলেছেন, যে কোনো তত্ত্ব সে যত আকর্ষণীয়ই হোক, তা যদি বাস্তবে প্রমাণ করা না যায় – তা কোন তত্ত্বই নয়। 

এই মানুষটি সারাজীবন কাজ করে গেছেন নতুন জিনিস শেখার আনন্দে। প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে তাঁর কৌতূহল ছিল একেবারে শিশুদের মতো। জনপ্রিয় হবার কোন চেষ্টাই ছিল না তাঁর মধ্যে। জীবদ্দশায় তিনি অতটা জনপ্রিয় ছিলেনও না, যতটা হয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পর। নোবেল পুরষ্কার পাবার পরেও তাঁকে যে আমেরিকার মানুষ খুব একটা চিনতো তা নয়। অবশ্য আমেরিকাতে এত বেশি নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী যে – কে কার খবর রাখে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়তা মাপার মাপকাঠি এখনো নয়, তখনো ছিল না। 

তবে ফাইনম্যান তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগে আমেরিকান সর্বস্তরের জনগণের কাছে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জার শাটল দুর্ঘটনার মূল কারণ উদ্ঘাটন করে। ১৯৮৬ সালের ২৮ জানুয়ারি নাসার মহাকাশ যান চ্যালেঞ্জার উৎক্ষেপণের সাথে সাথেই বিস্ফোরিত হয়ে সাতজন নভোচারীর সবাই মারা যায়। এই ঘটনার তদন্তের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যে কমিটি গঠন করেন সেখানে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী হিসেবে রিচার্ড ফাইনম্যানকে সদস্য করা হয়। ফাইনম্যান সরকারি কাজে উৎসাহী ছিলেন না কোনোদিনই। আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা আর অহেতুক ফরমালিটি তাঁর অসহ্য ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত অনুরোধে অসুস্থ শরীরেও তিনি রাজি হয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ফাইনম্যান শর্ত দিয়েছিলেন – তিনি কমিটিতে থাকলেও কমিটির সকল সদস্যের মতের সাথে তাঁর মত মিলতে হবে কোন কথা নেই। কমিটির রিপোর্টের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করার স্বাধীনতাও তাঁকে দিতে হবে। এরকম তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যায়, অনেক সময় কোন রিপোর্ট প্রকাশিতও হয় না। এসব তাঁর জানা ছিল বলেই তিনি এরকম শর্ত দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট রিগ্যান তাঁর শর্ত মেনে নিয়েই তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিয়েছিলেন। রিচার্ড ফাইনম্যান চ্যালেঞ্জার মহাকাশযানের দুর্ঘটনার সঠিক কারণ বের করেছিলেন। রিপোর্টের সাথে তাঁর নিজের রিপোর্টও প্রকাশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি সংবাদ সম্মেলন করে ন্যাশনাল টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে ছোট্ট পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন কী ঘটেছিল আসলে। রকেটের মোটর সেফটিতে যে রাবারের ও-রিং ছিল – প্রচন্ড ঠান্ডায় সেই রাবারের ইলাস্টিসিটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ফাইনম্যান সাংবাদিকদের সামনে একটুকরো রাবার বরফ-পানিতে ডুবিয়ে দেখিয়েছিলেন কীভাবে রাবারের কার্যকারিতা কমে যায় তাপমাত্রা ভীষণ কমে গেলে। ফাইনম্যান সেই ঘটনার পর আমেরিকার সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। অবশ্য তার দেড় বছর পরেই ফাইনম্যান মারা যান। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে। 

কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে রিচার্ড ফাইনম্যান সম্পর্কে কোন তথ্যই আমরা পাইনি সেইসময়। আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছি। এমফিলেও ভর্তি হয়েছিলাম। আমাদের শিক্ষকরা আমাদের কোনো ক্লাসেই রিচার্ড ফাইনম্যানের নাম উচ্চারণও করেননি। এমফিল করার সময় প্রামাণিকস্যার “ফাইনম্যান’স পাথ ইন্টিগ্র্যাল” নামে একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনো ফাইনম্যান সম্পর্কে কিছুই জানি না। ধরতে গেলে ফাইনম্যানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। ফাইনম্যানস লেকচার অব ফিজিক্সের মতো এত ভালো বই থাকতে কেন আমাদের অনার্সে এই বই পড়তে বলা হয়নি – এই অভিমান আমার কখনো যাবে বলে মনে হয় না। 

আজ ১১ মে রিচার্ড ফাইনম্যানের জন্মদিন। 

Happy birthday Feynman – the finest man! 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts