রাস্তার পাশে দূরত্বনির্দেশক মাইলফলকগুলি তেমন দেখা যায় না আজকাল। গুগলম্যাপের এই যুগে ওরকম মাইলফলকের গুরুত্বও নেই আর। কিন্তু আমরা যারা ছোটবেলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছোটবেলার কাহিনি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি – তারা জানি রাস্তার এই মাইলফলক আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কী সম্পর্ক ছিল। আমার বাবা তাঁর নিজের ছোটবেলায় পড়াশোনা করতে না পারার জন্য যে আফসোস পুষে রেখেছিলেন তা সুযোগ পেলেই তাঁর ছেলেমেয়েদের দিয়ে পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করতেন। তাঁর নিজের যখন বিদ্যাসাগর হবার আর কোন সুযোগ ছিল না, তিনি বিদ্যাসাগরের বাবা হবার চেষ্টা করতেন। তাতে তাঁর ছেলেমেয়েরা যে খুব একটা খুশি হতো তা নয়। আমি তো ভীষণ বিরক্ত হতাম জ্ঞানের কথাবার্তা বললে। কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করলে ভ্রমণ বাতিল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতো বলে বিরক্তি প্রকাশ করতাম না। বছরে একটি মাত্র ভ্রমণ বরাদ্দ ছিল আমাদের। বার্ষিক পরীক্ষার পর বাবার সাথে শহরে বেড়াতে যাওয়া। অনেক ভোরে বের হয়ে অনেক দূর হেঁটে গিয়ে তারপর রিকশা নিতে হতো।
বিদ্যাসাগরের বাবা নাকি ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই কত কিছু শিখিয়ে ফেলেছিলেন। যেমন রাস্তার মাইলফলক দেখিয়ে দেখিয়ে এক দুই তিন চার গুণতে শিখিয়ে ফেলেছিলেন। মাঝখানে একটি মাইলফলক দেখতে না দিয়ে গণিত গণনার পরীক্ষাও নিয়ে ফেলেছিলেন। আমার বাবাও একবার এই কাজটা খুবই পরিকল্পনা করে করতে চেয়েছিলেন আমাদের সাথে। কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে শহরে আসার প্রধান রাস্তার পাশে মাইলফলক ছিল মাত্র কয়েকটি। আমাদের ছোট্ট ছরা পার হয়ে উত্তর দিকে কিছুদূর আসার পর একটি মাইলফলকে লেখা ছিল চাঁনপুর ১৬ মাইল। তারপর বেশ কয়েকটি ফলক উধাও হয়ে যাবার পর জলদি সিও অফিসের সামনে আরেকটি। ফলে সরাসরি গণনার পরীক্ষা নেয়া সম্ভব ছিল না তাঁর। কিন্তু পরীক্ষা বাতিল করে ছেলেদের শান্তি দেয়া তো বাবাদের কাজ নয়। তিনি অন্য উপায় বের করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত গজে এক মাইল?’
এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। কিছু না শিখেই আমি ক্লাস থ্রিতে উঠে গেছি।
আমার বড়ভাই আমার দুই ক্লাস উপরে পড়ে, গণিতের মাথাও ভালো। সে-ই উত্তর দিলো – ১৭৬০ গজ।
“এক গজে কতটুকু পথ?” আবার প্রশ্ন বাবার।
আমি মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আকাশ লাল হয়ে সূর্য উঠা দেখতেই ভালো লাগছিল আমার। কিন্তু বাবা দেখলাম রাস্তায় পা দিয়ে একটা দাগ কেটে নিচু হয়ে নিজের হাত দিয়ে দুই হাত মেপে আরেকটা দাগ কাটলেন। বললেন, “এইটুকু দূরত্ব এক গজ। এবার তোরা এখানে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে দেখ – এক গজে তোদের কার কত ‘কাই’ হয়।“ ‘কাই’ হলো স্টেপ। আমি উৎসাহ নিয়ে মেপে দেখলাম আমার তিন কাইয়ে এক গজ হয়। বড়ভাই অতিউৎসাহে লম্বা কাই মেরে এক কাইয়ে এক গজ করার চেষ্টা করছে দেখে বাবা বললেন, “সারা রাস্তা ওভাবেই হাঁটতে হবে।“ তাতে দমলো সে। তার দুই কাইয়ে এক গজ।
‘কাই’ মাপার পর নির্দেশ হলো – পরবর্তী মাইলফলক আসা পর্যন্ত আমাদের ‘কাই’ গুণতে হবে। আমার মোট কাইকে তিন দিয়ে ভাগ করলে জানতে পারবো কত গজ গেলাম। তারপর গজ থেকে মাইল।
তারপর কত বছর ধরে কত দেশের কত রাস্তায় হেঁটে চলেছি। এখনো নিজের অজান্তেই ‘কাই’ গুণতে থাকি। এখন যেটাকে আমরা ক্যালিব্রেশান বলি – সেটাই আমার বাবা শিখিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের রাস্তায়। ক্লাস ফোর পাস মানুষটা। আমাদের বাবাটা।
No comments:
Post a Comment