#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫২
সত্যজিৎ রায় আর নেই! রাত সাড়ে আটটায় রেডিওতে খবরটি শোনার পর থেকে কেমন যেন শূন্য শূন্য লাগছে সবকিছু। বেশ কিছুদিন থেকে তিনি অসুস্থ তা জানতাম। গতমাসের শেষে তাঁকে অস্কার পুরষ্কার দেয়া হয়েছে। অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে তিনি যেতে পারেননি। আশা করেছিলাম তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তাঁর জীবনাবসান হবে চিন্তাও করিনি। ১৯২১ সালের ২ মে থেকে ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল; একাত্তর পূর্ণ হবার আগেই! আমার ১৫ বছর বয়স থেকে এই পঁচিশ পর্যন্ত কতভাবে যে তিনি আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরিতে মুগ্ধ হয়েছি। প্রফেসর শঙ্কু পড়েছি একটার পর একটা। ভারতীয় বই এখানে তিনগুণ দাম দিয়ে কিনতে হয়। তাই অমর বইঘর থেকে অনেক পুরনো বইও কিনে পড়েছি। দেশ পত্রিকার পূজাবার্ষিকী হাতে পেলেই পড়ে ফেলেছি ফেলুদার নতুন গল্প। তাঁর সিনেমাগুলি দেখার সুযোগ পেয়েছি মাত্র কয়েক বছর আগে – ভিডিও-ক্যাসেট সহজলভ্য হবার পর। মাত্র কিছুদিন আগে দেখেছি তাঁর সর্বশেষ সিনেমা – আগন্তুক। এই সিনেমা দেখার পর থেকে আমার কেবলই মনে হচ্ছে – ভবিষ্যতে আমার পেশা কী হবে আমি জানি না, কিন্তু আমি কেমন মানুষ হতে চাই তা আমি জেনে গেছি। আমি আগন্তুকের মনমোহন মিত্র হতে চাই – যে মনমোহন মিত্র মানুষকে বিশ্বাস করে, যার কাছে আনুষ্ঠানিক ধর্মের চেয়েও মনুষ্যত্বের মূল্য অনেক বেশি।
দু’দিন পর সত্যজিৎ রায় স্মরণে টিভিতে ‘পথের পাঁচালী’ দেখালো। বাংলাদেশের টেলিভিশনে এই প্রথম সত্যজিৎ রায়ের কোন সিনেমা দেখানো হলো। এমনিতে আমাদের রেডিও-টেলিভিশনে ভারতীয় কোন গান, নাটক, কবিতা কিছুই প্রচারিত হয় না। সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে ভারতীয় সিনেমা প্রচারিত হয়েছিল কয়েকটা – সেখানেও সত্যজিৎ রায়ের কোন সিনেমা দেখানো হয়নি। এখন সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ‘পথের পাঁচালী’ দেখানো হলো এটা নিশ্চয় বিটিভির অনেক উদারতা!
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আমাদের মাস্টার্স পরীক্ষার একটা তারিখ দেয়া হয়েছে – যেই তারিখে পরীক্ষা হবার কোন সম্ভাবনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়মগুলি আমার মাথায় এখনো ঢোকে না। যে তারিখে পরীক্ষা নেয়ার কোন সম্ভাবনা নেই – সেই তারিখ ঘোষণা করা হয় কেন? শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন করবে তাই? কিন্তু এবার কোন আন্দোলন হলো না। তারপরও পরীক্ষার ডেট পিছিয়ে দেয়া হলো – কারণ অনেক ডিপার্টমেন্টেই আমাদের আগের ব্যাচের রেজাল্ট এখনো দেয়া হয়নি।
দেশের রাজনৈতিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের উপর হামলা হচ্ছে। বিশেষ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মীদের উপর। গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু হয়েছে। শিবির আর ছাত্রদলের চোখ এড়িয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে এই অভিযান চালানো যাচ্ছে না।
বলা হয়ে থাকে আইন নিজস্ব গতিতে চলে। কিন্তু এই নিজস্ব গতিটা কী তা বোঝা কঠিন। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পেটোয়া বাহিনী গুলি করে হত্যা করেছিল ডাক্তার মিলনকে। ১৩ মে ডাক্তার মিলন হত্যা মামলার রায় দেয়া হয়েছে। চৌদ্দজন আসামীর সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে। তার মানে কী দাঁড়ালো? ডাক্তার মিলনকে কেউ হত্যা করেনি?
এদিকে গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় হয়রানি শুরু হয়ে গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবার পর থেকে তাঁদেরকে অনেকটা নিজের দেশেই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাওয়ার অপরাধে। এসব হয়রানির বিরুদ্ধে ঢাকায় হরতাল পালন করা হয়েছে ১৮ মে। আর সেদিন রাতে আমরা শিক্ষাসফরে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
শিক্ষাসফরের প্রস্তুতি চলছিল মে মাসের শুরু থেকে। ১৫ জনের ছাত্র-প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হলো। মাথাপিছু চাঁদা ধরা হলো ৩৫০ টাকা। ১৮ তারিখ রাত পৌনে দশটার দিকে যীশু আর প্রদীপ নাথের সাথে বটতলী রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখি অনেকেই চলে এসেছে ইতোমধ্যে। মেইল ট্রেনের একটি বগি রিজার্ভ করা হয়েছিল। আরেকটি বগির পুরোটাই দখল করে ফেলা হলো। একটাতে ছাত্রী এবং শিক্ষকরা, অন্যটিতে ছাত্ররা। আমাদের সাথে শংকরস্যার আর রশীদুন্নবীস্যার যাচ্ছেন। হামিদাবানু ম্যাডাম আগেই ঢাকায় চলে গেছেন আমাদের থাকার ব্যবস্থা করতে।
রাত সাড়ে এগারোটার ট্রেন। ঢাকা মেইল, সবগুলি স্টেশনে থেমে থেমে ঢাকায় পৌঁছাতে সকাল আটটা বেজে যাবে। আমরা ছাড়া অন্যান্য যাত্রীদের ভীড় খুব একটা নেই। ইদানীং অনেকগুলি আন্তনগর ট্রেন চালু হওয়াতে এই মেইল ট্রেনে খুব একটা চড়তে চায় না কেউ।
ক্লাসের বাইরে ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে একসাথে হলে একটা অন্য ধরনের আনন্দ হয়। কোন নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই সবাই এক সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। অন্য সময়ে যেসব ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলে না, এখন সবাই একসাথে মন্তব্য করতে থাকে। অতি তুচ্ছ কারণেও হো হো করে হেসে উঠে। আমাদের অঞ্জন খুব মিতভাষী এবং মৃদুভাষী মানুষ। দেখা গেলো সেও হঠাৎ হাহাহা করে হেসে উঠলো। কারণ কী? সে খোলা জানালা দিয়ে মাথা বাইরে দিয়েছিল। প্রচন্ড বাতাসে তার টুপি উড়ে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে সে এই ঘটনাকে কিছুতেই হাসির ঘটনা বলে বিবেচনা করতো না। সাদা রঙের এই টুপি আমাদের শিক্ষাসফর উপলক্ষে বানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামের নিচে ছাপানো আছে ‘শিক্ষাসফর ১৯৯২ পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ’।
আশীষ দাশগুপ্ত কোন একসময় আমাদের সিনিয়র ছিলেন, এখন আমাদের ব্যাচে এসে স্থিত হয়েছেন। আমরা সবাই তাকে আশীষদা বলেই ডাকি। তার কাব্যপ্রতিভার পরিচয় আমরা আগে কোনদিন পাইনি। কিন্তু ট্রেনের গতি বাড়ার সাথে সাথে তার মুখ থেকে অবিরাম যেসব ছন্দোবদ্ধ শব্দ নির্গত হতে শুরু করলো তা লিপিবদ্ধহলে বড় বড় অক্ষরে লিখে দিতে হবে – অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
মানুষের স্মৃতি কতভাবেই না ফিরে আসে। এই মেইলট্রেনের সাথে আমার প্রথম স্মৃতি আজ থেকে বারো বছর আগের। বাবার সাথে প্রথমবার ঢাকা গিয়েছিলাম এই ট্রেনে চড়ে। অনেক যাত্রীর ভীড়ে গুটিশুটিমেরে বসেছিলাম ভীরু অনুসন্ধিৎসু চোখে। যেকোনো স্টেশনে থামলেই সেই স্টেশনের নাম পড়ে মনে রাখার চেষ্টা করতাম। সেইসব স্টেশন থেকে কত বিচিত্র রকমের মানুষ উঠতো। ট্রেনের হকারদের জিনিস বিক্রি করার নানারকম ডাক এখনো কানে ভাসে। কত স্টেশনে অ্যালুমিনিয়ামের জগভর্তি পানি আর গ্লাস নিয়ে পানি বিক্রি করতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। এই বারো বছরে বাইরের পৃথিবী হয়তো খুব বেশি বদলায়নি, কিন্তু আমরা বদলে গেছি। শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণের সেই অনুসন্ধিৎসা এখন আর সেভাবে নেই। এখনকার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম।
এতগুলি ছেলেমেয়ে একসাথে যাচ্ছে, সেখানে শুধু হাসি-ঠাট্টা গান-বাজনা হবে, ঝগড়া-ঝাটি হবে না তা তো হতে পারে না। ঝগড়া লেগে যেতে দেরি হলো না। একটু পরেই আমরা ঝগড়ার খবর পেয়ে গেলাম। অমল এসে জানালো হারুন তাকে ঘুষি মেরেছে। খটকা লাগলো। হারুন তো এই কম্পার্টমেন্টে নেই। ছেলেদের অনেকেই মেয়েদের কাছাকাছি বসার জন্য অন্য কম্পার্টমেন্টে গিয়ে উঠেছে। হাফিজ, হারুন, দুলাল, কবীর, আমান, প্রেমাঙ্করসহ অনেকেই সেখানে। অমলতো আমাদের কম্পার্টমেন্টে ছিল। হারুন তাকে ঘুষি মারার জন্য পেলো কোথায়?
জানা গেলো অমল আমাদের কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠতে গিয়েছিল। এই কম্পার্টমেন্টগুলি সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা, একটা থেকে না নেমে অন্যটাতে ওঠা সম্ভব নয়। আগের স্টেশনে অমল এখান থেকে নেমে ওখানে উঠতে গিয়েছিল। হারুন নাকি সেই কম্পার্টমেন্টের দরজায় দাঁড়িয়েছিল। অমলকে সে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না সেই কম্পার্টমেন্টে। এদিকে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। অমল পড়ে যাচ্ছিলো, কোনরকমে হারুনকে জড়িয়ে ধরে সে। হারুন আর অমলের মধ্যে অনেকদিন থেকেই গায়ে হাত দেয়া বন্ধুত্ব। সুতরাং জড়িয়ে ধরাটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক রইলো না, যখন হারুন অমলকে টেনে নিয়ে দুটো ঘুষি চালিয়ে দিলো। অমল হতভম্ব। কারণ ক্লাসের সব মেয়ে তার মার খাওয়া দেখেছে।
ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেতে পারতো। কিন্তু মিটলো না। কারণ হারুন ঘুষি মারার পরে অমলকে মালাউন বলে গালি দিয়েছে।
ক্লাসমেটদের মধ্যে এরকম সাম্প্রদায়িক শব্দবিনিময় অসহ্য দুঃখজনক। হারুন বিএনপি করে। অমল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কর্মী। আদর্শগত বিভাজন যে বন্ধুত্বেও ফাটল ধরায় তা আবারো দেখতে হলো।
No comments:
Post a Comment