Monday 15 November 2021

মঙ্গলে অধ্যবসায়


২০২০ সালে পৃথিবী্র মানুষ যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে জর্জরিত, স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবন যেখানে থমকে গিয়েছিল, সেই কঠিন সময়েও নাসার বিজ্ঞানীরা দিনরাত কাজ করে গেছেন মঙ্গল গ্রহের সাম্প্রতিক মিশন মার্স-২০২০ সফল করার লক্ষ্যে। তাঁদের পরিশ্রম বিফলে যায়নি। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ফ্লোরিডার কেইপ ক্যানাভেরাল থেকে যথাসময়েই উৎক্ষিপ্ত হয় রকেট অ্যাটলাস ভি-৫৪১। এই রকেট পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ ভেদ করে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে পৌঁছে দেয় বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট মার্স-২০২০। পৃথিবী থেকে  বের হয়ে সাড়ে ছয় মাস ধরে মহাকাশে ৪৭১ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ির আকারের বৈজ্ঞানিক রোবট পারসিভারেন্স – যাকে বাংলায় বলা যায় অধ্যবসায়। মহাকাশ গবেষণায় এই মঙ্গল অভিযান – অন্যান্য সবগুলি অভিযানের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক, অনেক বেশি উন্নত, এবং অনেক বেশি চমকপ্রদ। মহাকাশবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম একটি হেলিকপ্টার উড়বে – পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহের ভূমির উপর দিয়ে। মার্স-২০২০ মিশনে রোভার পারসিভারেন্সের সাথে গেছে একটি ছোট্ট হেলিকপ্টার – ইঞ্জেনুইটি। 

মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ হাজার বছরের পুরনো হলেও, তার প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ এই শতাব্দীতে বেড়ে যাবার প্রধান কারণ – মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলি যেভাবে লাগামহীন অতিরঞ্জন করতে পারে, বিজ্ঞান তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সেরকম কিছুই করতে পারে না। তাই এইচ জি ওয়েল্‌স এর ‘দি ওয়র অব দি ওয়ার্ল্ডস’-এ মঙ্গল গ্রহের প্রাণিরা এসে পৃথিবী দখল করে নেবার কল্পনার মধ্যে শিহরণ থাকলেও তার কোন বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু কল্পকাহিনিগুলির প্রভাবে সাধারণ মানুষের আগ্রহ জন্মে পৃথিবীর বাইরে অন্যান্য গ্রহগুলি সম্পর্কে। প্রথমে খালি চোখে, তারপর দূরবীণের সাহায্যে এবং স্যাটেলাইট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর থেকে একের পর এক স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু জেনেছেন মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে। ১৯৬০ থেকে শুরু করে মার্স-২০২০ মিশনের আগপর্যন্ত ৪৮টি বৈজ্ঞানিক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য জানার লক্ষ্যে। তার মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল ১৭টি, আমেরিকার ছিল ২২টি। শুরুটা সোভিয়েত ইউনিয়নের থাকলেও ক্রমে ক্রমে সাফল্যের দিক থেকে আমেরিকার মঙ্গল মিশনগুলি অনেক বেশি এগিয়ে যায়। ১৯৬৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসা যে ২২টি মঙ্গল অভিযান পরিচালনা করে তাদের মধ্যে ১৭টি মিশন সফল হয়। মঙ্গল গ্রহের ভূমি থেকে প্রথম ছবি আমরা পাই সেই ১৯৬৫ সালে ম্যারিনার-৪ স্যাটেলাইট থেকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মহাকাশের অভিযানগুলিও দ্রুত আধুনিক হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে পাঠানো মার্স গ্লোবার সার্ভেয়ার মঙ্গল গ্রহের পুরোটাই জরিপ করে ফেলে। বিজ্ঞানীরা পেয়ে যান মঙ্গল গ্রহের ভূমির সম্পূর্ণ মানচিত্র। এর পরবর্তী বছরগুলিতে মঙ্গলের পিঠে নামানো হয় একের পর এক স্বয়ংক্রিয় রোবট এবং রোভার বা যান্ত্রিক গাড়ি। ১৯৭৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাইকিং-১ ও ভাইকিং-২ ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম ও দ্বিতীয় রোবট। ১৯৯৬ সালে নাসার পাঠানো সোজার্নার ছিল মঙ্গলের বুকে প্রথম স্বয়ংক্রিয় রোভার। তারপর ২০০৩ সালে স্পিরিট ও অপরচুনিটি, এরপর ২০১২ সালে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে তখনপর্যন্ত সবচেয়ে আধুনিক রোভার কিওরিসিটি। কিওরিসিটি রোভার এখনো কাজ করছে মঙ্গলে। 

নাসার পাঠানো সাম্প্রতিক রোভার পারসিভারেন্স হলো মঙ্গলের বুকে তাদের পঞ্চম রোভার। প্রায় ২৪০ কোটি ডলার বা বিশ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মার্স-২০২০ মিশন পরিচালনা করার উদ্দেশ্য কী? মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে অনেক তথ্য তো বিজ্ঞানীরা আগের মিশনগুলি থেকে জেনে গেছে। মঙ্গলের চারপাশে এখনো ঘুরছে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইট – যেগুলি নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত ও ছবি পাঠাচ্ছে। রোভার কিওরিসিটি এখনো সক্রিয়ভাবে মঙ্গলের ভূমি থেকে তথ্য পাঠাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আরেকটি রোভার পাঠানোর দরকার কী ছিল? বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে অনবরত চালিয়ে যেতে হয়। পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরের একটি গ্রহের সবকিছু পৃথিবীতে বসে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে হলে ক্রমাগত চালিয়ে যেতে হয় বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম। এপর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে তাতে আমরা নিশ্চিন্তভাবে জানি এই গ্রহের আয়তন পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের ভূমি শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে কয়েক শ কোটি বছর আগে। এর মোট ভূমির ক্ষেত্রফল পৃথিবীর স্থলভাগের ক্ষেত্রফলের প্রায় সমান। মঙ্গলের ভর পৃথিবীর ভরের মাত্র দশ ভাগের এক ভাগ, মঙ্গলের অভিকর্ষজ ত্বরণের মান পৃথিবীর অভিকর্ষজ মানের তিন ভাগের এক ভাগের চেয়ে সামান্য বেশি। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের চেয়ে প্রায় ৪০ মিনিট লম্বা, কিন্তু মঙ্গলের এক বছর হয় পৃথিবীর ৬৮৭ দিনে। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব খুব কম, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ঘনত্বের মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ। মঙ্গল খুব ঠান্ডা একটি গ্রহ। দিনের বেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর রাতের ঠান্ডায় তাপমাত্রা মাইনাস ১২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। 

প্রত্যেকটি অভিযান থেকে পাওয়া তথ্য ও উপাত্ত একই কথা বলে এ ব্যাপারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিন্ত হতে পারেননি কিছু কিছু ব্যাপারে। যেমন, শুরুতে পৃথিবীর সমান বয়সী এই গ্রহের উপাদান এবং পরিবেশের মধ্যে মিল ছিল। সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে বাঁচানোর জন্য উভয় গ্রহেই চৌম্বকক্ষেত্র ছিল। উভয় গ্রহেই পানি এবং অন্যান্য অনুকুল পরিবেশ থাকলেও পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে। তবে মঙ্গলেও কি ঘটেছিল? যদি ঘটে থাকে, তাহলে সেই প্রাণের উপাদানের ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কেন? মঙ্গলে শুকিয়ে যাওয়া নদী ও পানির প্রবাহের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র পানি থাকলেই যে জৈবপ্রাণ থাকবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু প্রাণের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় এমন রাসায়নিক উপাদানগুলি তো খুঁজে পাবার চেষ্টা করতে হবে। এর আগের রোভার কিওরিসিটি তো সেই কাজ করেছে। কিন্তু ফলাফলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ কিওরিসিটি রোভার মঙ্গলের যে উপাদান সংগ্রহ করেছে তা সেখানেই বিশ্লেষণ করে তথ্য ও উপাত্ত পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। এই উপাদানগুলিকে যদি সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসা সম্ভব হয়, তাহলে পৃথিবীর আরো আধুনিক পরীক্ষাগারে সেগুলিকে পরীক্ষা করে হয়তো আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। এটা করার জন্যই সর্বাধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর প্রকল্প মার্স-২০২০ চালানো হচ্ছে মঙ্গলে। পারসিভারেন্স রোভার মঙ্গলের উপদান তো পরীক্ষা করবেই, সাথে আরো অনেক উপাদান সংগ্রহ করে তা একটি নির্দিষ্ট জায়গায়  সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করবে। পরে অন্য কোন মিশন মঙ্গল থেকে সেই নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবে। 

মার্স-২০২ মিশনটি সবচেয়ে উচ্চক্ষমতার এবং উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এই প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য প্রধানত চারটি: (১) প্রাচীন অণুজীবের সন্ধান করবে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কি না প্রমাণ করবে, (২) মঙ্গলের ভূতত্ত্ব পর্যবেক্ষণ করবে, (৩) মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যবেক্ষণ করবে, এবং (৪) ভবিষ্যতে মঙ্গলে মানুষের যাওয়ার পথ সুগম করবে। 

এই উদ্দেশ্যগুলি বাস্তবায়ন করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিয়েছেন। ২০১২ থেকে এই মিশনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। নাসার জেট প্রপালসান ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়েছে আধুনিক মঙ্গলযান পারসিভারেন্স রোভার। এই রোভার – গাড়ির আকারের একটি অত্যন্ত আধুনিক রোবট যা মঙ্গলের বুকে একটি স্বয়ংক্রিয় গবেষক ও গবেষণাগারের কাজ করবে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক কাজগুলি করার জন্য প্রচন্ড অধ্যবসায়ের দরকার হয়। রোভারের কাজের সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয়েছে পারসিভারেন্স। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে নাসা তাদের বিভিন্ন মিশনের নাম দেয়ার জন্য স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরকে আহ্বান করে। আটাশ হাজার নাম পাঠায় আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়েরা। সেখান থেকে আন্তর্জাতিকভাবে অনলাইনে ভোটের মাধ্যমে  ভার্জিনিয়ার লেক ব্রাডক স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র আলেকজান্ডার মাথিরের পাঠানো নাম ‘পারসিভারেন্স’ নির্বাচিত হয় মার্স-২০২০ মিশনের রোভারের নাম। 

স্বয়ংক্রিয় রোবট রোভার – পারসিভারেন্স এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগুলি সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়। পারসিভারেন্স রোভারটি ৩ মিটার লম্বা, ২.৭ মিটার চওড়া, এবং ২.২ মিটার উঁচু। পৃথিবীতে এর ওজন ১,০২৫ কেজি। এর সাথে সংযুক্ত আছে ২ মিটার লম্বা রোবটিক হাত যা প্রয়োজন অনুযায়ী ঘুরতে পারে, ছবি তুলতে পারে, পাথর খুড়তে পারে, নমুনা সংগ্রহসহ অন্যান্য দরকারি সব কাজ করতে পারে। এই হাতের ওজন ৪৫ কেজি। মঙ্গলের অভিকর্ষ ত্বরণ যেহেতু পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের শতকরা ৩৮ ভাগ, মঙ্গলে রোভারের ওজন দাঁড়াবে প্রায় ৩৯০ কেজি। চলার জন্য রোভারটিতে লাগানো আছে ছয়টি ধাতব চাকা। শক্ত কিন্তু হালকা অ্যালিমিনিয়ামের তৈরি চাকাগুলি মঙ্গলের মরুভূমিতে চলার উপযুক্ত করে তৈরি করা হয়েছে। এগুলি ধুলোবালির উপর দিয়ে যেমন যেতে পারবে, তেমনি পাথরের উপর দিয়েও চলতে পারবে। পাথর আর বালির ঘর্ষণে এই চাকার খুব একটা ক্ষতি হবে না। 

পারসিভারেন্স রোভার খুবই আধুনিক রোবট। এই রোবট ক্যামেরার সাহায্যে দেখতে পারে, মাইক্রোফোনের সাহায্যে শুনতে পারে, আর কম্পিউটারের সাহায্যে ভাবতে পারে। বেশ কিছু ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তাকে কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে। দুটি শক্তিশালী কম্পিউটার তার মস্তিষ্কের কাজ করে। দুটো কম্পিউটারই একই রকমের, দুটোই একই কাজ করে, তবে এক সাথে করে না। একটা যখন কাজ করে, তখন অন্যটা ব্যাক-আপ হিসেবে কাজ করে। রোভারে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে যে ছবি তোলা হয়, তা বিশ্লেষণ করে রোভারটির কম্পিউটার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সামনে কী আছে, এবং কীভাবে তা অতিক্রম করতে হবে। যেমন মঙ্গলে নামার সময় ভূমি থেকে কত দূরে আছে তা হিসেব করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে এই রোভার। নামার পরে কম্পিউটার নতুন একটি প্রোগ্রাম চালু করেছে যা দিয়ে মঙ্গলের ভূমিতে চলাচল নিয়ন্ত্রণ করবে নিজে নিজে। 

ছোটবড় সব মিলিয়ে ২৩টি ক্যামেরা ফিট করা আছে পারসিভারেন্সের গায়ে। এর মধ্যে ৯টি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরা, ৭টি ইডিএল অর্থাৎ এন্ট্রি-ডিসেন্ট-ল্যান্ডিং ক্যামেরা, এবং ৭টি সায়েন্স ক্যামেরা। ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যামেরার সবগুলিই ২০ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন শক্তিশালী ক্যামেরা – যার মধ্যে ২টি নেভিগেশান ক্যামেরা লাগানো আছে রোভারের মাথায়। রোভারের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয় এদের দ্বারা। ৬টি হ্যাজক্যাম বা হ্যাজার্ড এভয়ডেন্স ক্যামেরার চারটি সামনে আর ২টি পেছনে লাগানো আছে। চলাচলের সময় পাথর বা অন্যকিছু সামনে বা পেছনে পড়লে তা এড়িয়ে চলায় সাহায্য করবে এই ক্যামেরাগুলি। 

মঙ্গলে নিরাপদে অবতরণ করা সবচেয়ে কঠিন এবং জটিল কাজ। পারসিভারেন্স অবতরণ করানো হয়েছে সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে। এই কাজে সাহায্য করেছে ৭টি ইডিএল ক্যামেরা। এর মধ্যে তিনটি ক্যামেরা প্যারাশুট আপলুক ক্যামেরা – যেগুলি নামার সময় প্যারাশুট নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করেছে। ভূমির দিকে নেমে আসার সময় সামনে পেছনে এবং পাশে লাগানো ক্যামেরার সাহায্যে সঠিক অবতরণ সম্ভব হয়েছে। 

সাতটি সায়েন্স ক্যামেরার প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা কাজ আছে এবং তাদের গঠন এবং অবস্থানও সেরকম। রোভারের ডান দিকে এবং বাম দিকের মাথায় লাগানো আছে ২টি ২ মেগাপিক্সেল রেজ্যুলেশনসম্পন্ন মাস্টক্যাম-জেড বা জেডক্যাম। রোভারের মাথায় মাঝামাঝি জায়গায় লাগানো আছে ৪ মেগাপিক্সেলের সুপারক্যাম রিমোট মাইক্রো-ইমেজার বা আর-এম-আই। রোভারের রোবটিক হাতের মাথায় লাগানো আছে ২টি গোয়েন্দা ক্যামেরার সেট- শার্লক হোমসের নাম অনুসারে যাদের নাম দেয়া হয়েছে শার্লক। অবশ্য শার্লক (SHERLOC) -এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals. শার্লক থাকলে ওয়াটসনের নামও থাকতে হয়। শার্লক ক্যামেরার একটির নাম ওয়াটসন। ওয়াটসন (WATSON) এর লম্বা বৈজ্ঞানিক নাম Wide Angle Topographic Sensor for Operations and eNgineering. 

মঙ্গল গ্রহের শব্দ শোনা এবং ধারণ করার জন্য পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো হয়েছে দুটো মাইক্রোফোন। একটি মাইক্রোফোন রোভার নামার সময় মঙ্গলের শব্দ ধারণ করে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এবং রোভার কাজ করার সময় কী ধরনের শব্দ হয় তা সংগ্রহ করবে। অন্য মাইক্রোফোনটি লাগানো আছে সায়েন্স ক্যামেরার সাথে। এটি লেজার দিয়ে পাথর ভাঙার সময় শব্দ ধারণ করবে। 

পৃথিবী থেকে ২২ কোটি কিলোমিটার দূরে সমস্ত জটিল যন্ত্রপাতিসহ অক্ষত অবস্থায় পারসিভারেন্স এবং হেলিকপ্টার ইঞ্জেনুইটিকে মঙ্গলের বুকে নিরাপদে নামাতে পারা মানেই  মিশনের প্রধান ধাপ সম্পন্ন হওয়া। পৃথিবী থেকে সোজা পথে মঙ্গলে পৌঁছে যাবার কোন উপায় নেই। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ, সূর্যের সাথে আকর্ষণ ইত্যাদি সব হিসেব করে মার্স-২০২০ এর গতিপথ নির্ধারণ করতে হয়েছে। ২০৩ দিন ধরে মহাকাশ ভ্রমণ করে ৪৭ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গলে পৌঁছেছে পারসিভারেন্স। শেষের ৪৫ দিন ধরে তার গতিপথ ক্রমাগত নিয়ন্ত্রণ করে তাকে নিতে হয়েছে মঙ্গলের সীমানায়। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় প্রচন্ড গতিশীল স্যাটেলাইটের সাথে বাতাসের ঘর্ষণের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ থেকে বাচানোর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ইঞ্জেনুইটিসহ পারসিভারেন্স গুটানো অবস্থায় রাখা ছিল বেশ কয়েকটি স্তরের নিরাপদ ধাতব আস্তরণবিশিষ্ট বিশেষ ধরনের ক্যাপসুলের ভেতর। এই ক্যাপসুল বিশেষ ধাতুর সংকর দিয়ে তৈরি যা প্রচন্ড তাপেও গলে না এবং অত্যন্ত ঘাতসহ। মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের ১০ মিনিট আগে স্যাটেলাইটের যে অংশটি পারসিভারেন্সের ক্যাপসুলকে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে সেই ক্রুজ স্টেজ আলাদা হয়ে মহাকাশে ভাসতে থাকে। ক্যাপসুল ঘন্টায় ১৫০০ কিলোমিটারের অধিক বেগে মঙ্গলের সীমানায় ঢুকে বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে গতি কমাবার ব্যবস্থা আছে ক্যাপসুলের নিচের তাপনিরোধক অংশ বা হিট শিল্ডে। চার মিনিটের মাথায় মঙ্গলের ভূমির ৯ থেকে ১৩ কিলোমিটার উপরে ক্যাপসুলের উপরের অংশে লাগানো প্যারাসুট খুলে যায়। এই ফলে ক্যাপসুলের গতি কমে আসে ঘন্টায় ৫৭৬ কিলোমিটারে। ভূমির ৭ থেকে ১১ কিলোমিটার উপরে থাকতে ক্যাপসুলের নিচের অংশ খুলে পড়ে যায়। তখন পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো ইডিএল ক্যামেরা এবং রাডার তরঙ্গ চালু হয়ে যায়। গতি আরো কমতে থাকে। রাডারের মাধ্যমে প্যারাসুটে লাগানো ক্যাপসুলের অংশসহ পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে যেখানে নামার কথা সেই জায়টাটি খুঁজে বের করে। ভূমি থেকে চার কিলোমিটার উচ্চতায় প্যারাসুটসহ ক্যাপসুলের উপরের অংশ আলাদা হয়ে যায়। ইঞ্জেনুইটিসহ গুটানো পারসিভারেন্স তখন ভূমির দিকে নামতে থাকে। পারসিভারেন্সের গায়ে লাগানো থাকে স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন হলো অনেকটা বাস্তবের ক্রেইনের মতো যেটায় লাগানো থাকে নাইলনের শক্ত সুতা। এই সুতার সাহায্যে পারসিভারেন্স রোভারকে আস্তে আস্তে ভূমিতে নামিয়ে দেয় স্কাই ক্রেইন। স্কাই ক্রেইন ভেসে থাকার জন্য চারটি থ্রাস্টার ব্যবহার করা যায় যা প্রচন্ড বেগে নিচের দিকে ধোঁয়া বের করে, ফলে বিপরীতমুখি বলের প্রভাবে ভূমি থেকে প্রায় ২৫ ফুট উঁচুতে ক্রেইনটি ভাসতে থাকে। সেকেন্ডে ৭৫ সেন্টিমিটার গতিতে খুব আস্তে আস্তে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করার সময় পারসিভারেন্স রোভার তার ছয় চাকার উপর দাঁড়িয়ে যায়। তখন স্কাই ক্রেইন আলাদা হয়ে থ্রাস্টারের বিপরীত বেগে উড়ে চলে যায় অন্যদিকে। সেটার আর কোন কার্যকারিতা থাকে না। 

মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে ঢুকার পর থেকে ভূমিতে অবতরণ করা পর্যন্ত প্রায় সাত মিনিট সময় লাগে। এই সাত মিনিট সময়ের উপর নির্ভর করে পুরো মিশনের সাফল্য। কোন গন্ডগোল হলেই কিন্তু মিশন ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। নামার সময় কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটলে তা এড়িয়ে চলার ক্ষমতা ছিল রোভার পারসিভারেন্সের। এই রোভারটি এমন এক জায়গায় নেমেছে যেখান থেকে মার্স-২০২০ মিশনের মূল উদ্দেশ্য পূরণ করা সহজ হবে। পুরনো একটা শুকিয়ে যাওয়া নদীর বদ্বীপে নেমেছে এটা – যেখানে আছে ঢালু জায়গা, বালিয়াড়ি, আর বড় বড় পাথর। জায়গার নাম জেজিরো ক্রেটার যেটা মঙ্গল গ্রহের উত্তর গোলার্ধের একটা ৪৫ কিলোমিটার বিস্তৃত শুকিয়ে যাওয়া অববাহিকা। ৩৫০ কোটি বছর আগে এখানে নদী বয়ে যেতো। সেই নদী শুকিয়ে পলি জমে একটি বদ্বীপ তৈরি করেছে এখানে। পারসিভারেন্সের বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে এখানে জৈবযৌগের কিছু উপাদান এবং প্রাণধারণের আরো কিছু চিহ্ন এখনো অবশিষ্ট আছে। 

মঙ্গলে ঠিকমতো নামতে পারলো কি না সেই তথ্য পৃথিবীতে নাসার নিয়ন্ত্রণকক্ষে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে মঙ্গলের চারপাশে ঘূর্ণায়মান মার্স রেকনিসেন্স অরবিটার বা এম-আর-ও’র মাধ্যমে। মঙ্গলে নামার সময় পারসিভারেন্সের কম্পিউটার ডাটা পাঠিয়ে দিয়েছে এম-আর-ও’র নেটওয়ার্কে। সেখান থেকে পৃথিবীর ডিপ-স্পেস-নেটওয়ার্ক অ্যান্টেনায়। মঙ্গল থেকে পৃথিবীতে ডাটা আসতে প্রায় ১১ মিনিট ২২ সেকেন্ড সময় লাগে। ডাটা আসে আলোর গতিতে বেতারতরঙ্গের মাধ্যমে। 

মঙ্গলে নেমেই কাজ শুরু করে দিয়েছে পারসিভারেন্স। কাজ করার জন্য যে বৈদ্যুতিক শক্তি লাগে সেই শক্তির জোগান দেয়ার জন্য পারসিভারেন্সে আছে মাল্টি-মিশন রেডিও-আইসোটোপ থার্মোইলেকট্রিক জেনারেটর বা এম-এম-আর-টি-জি। এটা মূলত নিউক্লিয়ার ব্যাটারি। প্রায় ৫ কেজি তেজস্ক্রিয় প্লুটোনিয়াম অক্সাইডের বিকিরণ থেকে দুটো লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি চার্জ করা হচ্ছে অবিরাম। এই ব্যাটারি দুটির ওজন প্রায় ২৭ কিলোগ্রাম। প্রতিটি ব্যাটারির ক্ষমতা ৪৩ অ্যাম্পিয়ার-ঘন্টা। জ্বালানি ইউনিটটি লাগানো আছে রোভারের কেন্দ্রে। পুরো ইউনিটের ওজন প্রায় ৪৫ কেজি। কমপক্ষে ১৪ বছর অনবরত বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করতে পারবে এই ইউনিট। ফলে রোভারকে সৌরশক্তির উপর নির্ভর করতে হবে না। মঙ্গলে প্রচন্ড ধুলিঝড় হয়, সেই ঝড়ে সৌরপ্যানেল ঢেকে যায়। তাই সৌরশক্তির উপর নির্ভর করা যায় না। 

পারসিভারেন্স মঙ্গলে নেমেই সংযুক্ত ক্যামেরার সাহায্যে ছবি তুলে পাঠাতে শুরু করেছে। অবতরণ করার সময় শব্দ ধারণ করেও পাঠিয়েছে পৃথিবীতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী – মঙ্গলে অবতরণের সময় থেকে পারসিভারেন্সের কার্যদিবস শুরু। মঙ্গলের দিনকে বলা হয় সোল। পারসিভারেন্স মঙ্গলের বুকে কমপক্ষে মঙ্গলের এক বছর বা পৃথিবীর ৬৮৭ দিন ধরে কাজ করবে, এবং কমপক্ষে ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করে তার বিশ্লেষণ করে ডাটা পাঠাবে এবং নমুনাগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করে  সেখানে রেখে দেবে। পারসিভারেন্স নিয়ন্ত্রণ করবেন যেসব বিজ্ঞানীরা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে তাদের ঘড়ি চলবে মঙ্গলের সময়ের সাথে মিলিয়ে। অর্থাৎ তাঁদের সময় আর পারসিভারেন্সের সময় হবে একই। (আগামী ৬৮৭ দিনে হবে তাদের এক বছর)। প্রথম ৯০ সোল ধরে বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্সের কার্যক্রম এবং যন্ত্রপাতির দিকে ক্রমাগত লক্ষ্য রাখবেন। প্রথম ৩০ সোলের মধ্যে পারসিভারেন্সের অ্যান্টেনা চালু হবে। নির্দিষ্ট পথে ৫ মিটার আসা-যাওয়া করবে। রোভারের কম্পিউটারের সফ্‌টওয়ার আপডেট করা হবে। সবকিছু ঠিকমতো কাজ করছে কি না পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হবার পর মূল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং ডাটা সংগ্রহ শুরু হবে। এরপর হেলিকপ্টার এঞ্জেনুইটিকে পারসিভারেন্সের গা থেকে খুলে হেলিপ্যাডে রাখা হবে এবং হেলিকপ্টারের কাজ শুরু হবে। 

বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম পৃথিবীর কোন হেলিকপ্টার পৃথিবীর বাইরে অন্যকোন গ্রহের বায়ুমন্ডলে উড়বে। অবশ্য এই হেলিকপ্টারের আকার খুবই ছোট। মাত্র ১৮০০ গ্রাম ওজন তার, অনেকটা ড্রোনের মতো। মঙ্গলে এর ওজন হবে মাত্র ৬৮০ গ্রাম। 

এটা উড়িয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে এধরনের হেলিকপ্টার উড়ানো যায় কি না। যদি যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এরকম আরো অনেক পাঠানো হবে ভিন্ন ভিন্ন কাজে। পারসিভারেন্স রোভারের পেটে এই হেলিকপ্টার লাগানো আছে। হেলিকপ্টারের জন্য একটি তিন মিটার দৈর্ঘ্য ও তিন  মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট হেলিপ্যাড গুটানো অবস্থায় আছে হেলিকপ্টারের সাথে। পারসিভারেন্স নির্দিষ্ট সময়ে একটি সমতল জায়গায় গিয়ে এই হেলিপ্যাড বিছানোর ব্যবস্থা করবে। তারপর তার উপর হেলিকপ্টারটি রাখবে। হেলিকপ্টারের গায়ে দুটি ক্যামেরা লাগানো আছে। মঙ্গলের প্রচন্ড ঠান্ডায় হেলিকপ্টার নিজেকে গরম রাখার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করতে পারে কি না দেখা হবে প্রথম কাজ। তারপর হেলিকপ্টারের গায়ে লাগানো সোলার প্যানেল থেকে শক্তি উৎপন্ন করবে। যে কম্পিউটারের মাধ্যমে হেলিকপ্টার স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে সেটা ঠিকমতো ডাটা আদানপ্রদান করতে পারে কি না পরীক্ষা করা হবে। পাখা ঠিকমতো কাজ করে কি না সব দেখার পর নিজে নিজে উড়তে পারে কি না এবং হেলিপ্যাডে নামতে পারে কি না দেখা হবে। 

পারসিভারেন্স রোভার প্রধানত সাত ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করবে মঙ্গলের বুকে। প্রথমেই আসে পারসিভারেন্সের প্রধান বৈজ্ঞানিক চোখ – মাস্টক্যাম-জেড। এটার জুমিং পাওয়ার এতই বেশি যে প্রায় একশ মিটার দূর থেকে এটা ছোট্ট মাছিকেও পরিষ্কার দেখতে পায়। ৩৬০ ডিগ্রি কোণে ঘুরে ঘুরে এটা রঙিন ছবি এবং ভিডিও তুলতে পারে। মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনেক বেশি কার্যকর হবে এর সাহায্যে। 

পারসিভারেন্সের মাথায় এবং শরীরে লাগানো আছে কয়েকটি সেন্সর যেগুলিকে বলা হচ্ছে মার্স এনভায়রনমেন্টাল ডায়নামিক্স এনালাইজার বা মেডা। মঙ্গলের আবহাওয়ার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করবে এসব সেন্সর। আকাশের দিকে তাক করা স্কাইক্যাম পর্যবেক্ষণ করবে মঙ্গলের মেঘ। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং ইলেকট্রনিক্সের কার্যক্ষমতায় কোন পরিবর্তন ঘটে কি না তা দেখা হবে এই পদ্ধতিতে। 

সম্পূর্ন নতুন ধরনের একটি পরীক্ষা করা হবে মঙ্গলে – যার নাম মক্সি (MOXIE – Mars Oxygen In-Situ Resource Utilization Experiment)। এই যন্ত্র ব্যবস্থা মঙ্গলের বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করবে। যদিও বর্তমানে পারসিভারেন্সের মক্সি প্রতিঘন্টায় মাত্র ১০ গ্রাম অক্সিজেন তৈরি করতে পারবে, এটা সফল হলে ভবিষ্যতে এভাবে আরো বড় মাত্রায় অক্সিজেন তৈরি করে রকেটের জ্বালানির সমস্যা মেটানো যাবে। নভোচারীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজেও লাগবে। 

এরপর আছে পিক্সল (PIXL – Planetary Instrument for X-ray Lithochemistry) – এটা পাথর ও অন্যান্য অংশ থেকে রাসায়নিক উপাদান জরিপ করবে। কী কী আছে দেখবে। বিজ্ঞানীরা এসব আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন মঙ্গলে প্রাণের উপাদান আছে কি না। এর আগে এরকম বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা যায়নি। পারসিভারেন্সের পিক্সল ১০ সেকেন্ডের মধ্যে ২০টির বেশি রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করতে পারে একেবারে বালুকণার মতো ছোট জায়গা থেকেও। 

এরপর আছে রিমফ্যাক্স (RIMFAX – Radar Imager for Mars’ Subsurface Experiment) -  রাডার তরঙ্গ ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ ভূতাত্ত্বিক জরিপ করবে এই যন্ত্র। ভূমির উপাদানে যদি পানির কোন উপাদান থাকে তা শনাক্ত করতে পারবে এই যন্ত্র। 

পারসিভারেন্সের রোবটিক বাহুতে লাগানো আছে ক্যামেরা শারলক। শারলক হোমস এর মতো এই যন্ত্রের নাম শারলক (SHERLOC – Scanning Habitable Environments with Raman & Luminescence for Organics & Chemicals)। এর সাহায্যে পাথর বা যে কোন নমুনার উপর অতিবেগুনি লেজার প্রয়োগ করা হবে। রামন ইফেক্টের ফলে প্রতিফলিত লেজারের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্ক পরিবর্তন বিশ্লেষণ করে জানা যাবে সেই নমুনায় কী কী রাসায়নিক উপাদান আছে। শারলকের ক্যামেরা ওয়াটসন মাইক্রোস্কোপিক ছবি তুলবে। ফলে মঙ্গলের ভূতাত্ত্বিক গঠন বুঝার জন্য অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

এরপর আছে শক্তিশালী লেজার প্রয়োগ করার যন্ত্র সুপারক্যাম। সুপারক্যাম লেজার রশ্মি প্রয়োগ করে পাথর ও রেগোলিথ ভেঙে বাষ্প করে ফেলবে। লেজার প্রয়োগে খুব ছোট জায়গায় তাপমাত্রা প্রায় ১০ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে সেই বস্তুর সেই জায়গা বাষ্পিভূত হয়ে যাবে। তারপর সেই বাষ্প থেকে তাদের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। সুপারক্যাম ৭ মিটার দূর থেকে কোন বস্তুর রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করতে পারবে। এর সাথে একটি মাইক্রোফোন লাগানো আছে। লেজার প্রয়োগের ফলে বস্তু থেকে কী শব্দ উৎপন্ন হয়, সেই শব্দের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেও অনেক নতুন তথ্য পাওয়া যাবে। 

মঙ্গলের ভূতত্ত্ব এবং জলবায়ু সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবে পারসিভারেন্স। মঙ্গলের চারপাশে যে দুটি অরবিটার ঘুরছে – সেগুলি জেজিরো ক্রেটারের ৩২২ কিলোমিটার উপর থেকে ছবি তুলছে অনবরত। কিন্তু প্রাণের চিহ্ন খুঁজে পেতে হলে আরো কাছ থেকে ছবি দরকার। পারসিভারেন্স সেই প্রয়োজন মেটাবে। আগের অভিযানগুলিতে যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল তা পূরণ করবে এই পারসিভারেন্স। 

এপর্যন্ত চাঁদ ছাড়া অন্য সব জায়গায় যেসব অভিযান চালানো হয়েছে তার সবগুলিই একমুখী। অর্থাৎ শুধু যাওয়া, কোনটাই ফিরে আসা নয়। এবার পারসিভারেন্সের ডাটা থেকে আশা করা যাচ্ছে ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে গিয়ে আবার ফিরে আসার মতো অভিযান চালানোর  পদক্ষেপ নেয়া হবে ভবিষ্যতে। এর আগে কিউরিসিটি রোভার মঙ্গলের মাটিতে গর্ত করে তার উপাদান বিশ্লেষণ করেছে। এবার পারসিভারেন্স রোবটিক বাহুতে লাগানো যন্ত্রের মাধ্যমে পাথর কাটবে ছোট ছোট চকের আকারে। তারপর সেগুলি রাখবে নমুনা টিউবে। টিউবগুলি রোভার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাবে। পরে সেগুলি পৃথিবীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হবে ভবিষ্যতের কোন অভিযানের সময়। পৃথিবীতে নিয়ে আসার পর সেই নমুনাগুলি পরীক্ষা করা হবে পৃথিবীর ল্যাবে। 

ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে চাঁদে আবার যাবে মানুষ। মংগলে যাবার ব্যবস্থাও হবে। পারসিভারেন্স  থেকে প্রাপ্ত তথ্য, উপাত্ত এবং যান্ত্রিক অভিজ্ঞতা সেই সুযোগ তৈরি করে দেবে। ল্যান্ডিং সিস্টেম – টেরেইন-রিলেটিভ ন্যাভিগেশানের মাধ্যমে পারসিভারেন্স জেজিরো ক্রেটারে নামতে পেরেছে। এই অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামতে পারবে বিভিন্ন রোভার বিভিন্ন গ্রহে কিংবা উপগ্রহে। এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতে কিছুটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে, কিছুটা রোবটের মাধ্যমে চাঁদে নামতে পারবে মানুষ।

পারসিভারেন্স নিজে নিজে চলতে পারবে মঙ্গলের পিঠে। পৃথিবী থেকে অনেক কম নিয়ন্ত্রণেই পারসিভারেন্স চলতে পারবে। উন্নত সেন্সর, কম্পিউটার আর এলগোরিদমের মাধ্যমে অনেক বেশি বিজ্ঞান জানা যাবে। পারসিভারেন্সের কম্পিউটারের জন্য যে এলগোরিদম লেখা হয়েছে তা সফলভাবে কাজ করলে ভবিষ্যতে আরো অনেকভাবে কাজে লাগানো যাবে এগুলি। এরকম রোভারের মাধ্যমে চাঁদে, মঙ্গলে এবং অন্যান্য গ্রহেও কাজ চালানো যাবে ভবিষ্যতে।

মার্স-২০২০ মিশনে সাধারণ মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য নাসা অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বোর্ডিং পাস দিয়েছিল। প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষ মঙ্গলের রোভারে যাওয়ার জন্য নাম সই করেছিলেন। তাদের সবার নাম সেখানে নিয়ে গেছে পারসিভারেন্স তিনটি সিলিকন চিপের মাধ্যমে। পারসিভারেন্সের গায়ে একটা প্লেটে মোর্স কোডে লেখা আছে explore as one’। 

করোনার সময় মঙ্গলে পারসিভারেন্স পাঠানো সহজ কথা ছিল না। সারাপৃথিবীর ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অনেক প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীরা পারসিভারেন্স মঙ্গলে পাঠাতে পেরেছেন। ডাক্তারদের সম্মানে পারসিভারেন্সের সাথে মঙ্গল গ্রহে একটি আলাদা স্মারকপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে সারাপৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবা, ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। মঙ্গলের সাম্প্রতিক অভিযান সম্পূর্ণ সফল হবে – আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতার উপর এই আস্থা রাখা যায়। 

তথ্যসূত্র: www.mars.nasa.gov, মঙ্গলে অভিযান – প্রদীপ দেব, প্রথমা, ২০২০, 

_____________
বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts