Tuesday 4 September 2018

পরানের গহীন ভিতর এক নাট্যকার




"যদি মানবিক অনুভূতিগুলোকে স্থানভেদে, পাত্রভেদে, কালভেদে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ করতে না পারো তবে কবিতা নির্মাণ তোমার কাজ নয়।"

আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে কথাগুলো বলেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। না, ঠিক আমাকে নয় - বলেছিলেন আমার এক বন্ধুর বোনকে। কবিযশোপ্রার্থী তরুণীটি সেই সময় দৈনিক একাধিক 'কবিতা নির্মাণ' করছিল অসীম ধৈর্যের সাথে। মানবিক অনুভূতিগুলো সে প্রকাশ করার চেষ্টা করছিল কবিতায়। কিন্তু আমার কথা ভিন্ন। সুকুমার মানবিক অনুভূতি - আনন্দ-বেদনা-ক্রোধ-ঈর্ষা-প্রেম-অভিমান ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তো দূরের কথা, কোনভাবে প্রকাশেই আমি সক্ষম নই। তাই কবিতার নির্মাণ-শিল্পে আমার স্থান হয়নিসৈয়দ হকের দেহাবসানের খবর পাবার পর অনুভূতিশূন্য আমার মনে পড়লো ছাব্বিশ বছর আগের সেই দিনটির কথা। সৈয়দ শামসুল হককে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম একেবারে হাতছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে।

১৯৯০'এর প্রথম দিকে তখন এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছে বাংলাদেশের সবখানে। চট্টগ্রাম মুসলিম ইন্সটিটিউট হলের প্রতিবাদী কবিতা উৎসবে এসেছিলেন সৈয়দ হক। কবিতা পড়ার চেয়েও কবিতা শোনার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল বেশি। প্রতিবাদী কবিতাগুলো তখন আগুনের মতো জ্বালা ধরাতো আমাদের তরুণ ধমনীতে। আমার কাছে কবির চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল আবৃত্তিকার। যেমন নাট্যকারের চেয়েও অভিনেতা জনপ্রিয়। অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে গিয়ে ঘুরঘুর করে কবি মহাদেব সাহা ও ত্রিদিব দস্তিদারকে পাশ কাটিয়ে অটোগ্রাফ নিচ্ছিলাম ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। বন্ধু টেনে নিয়ে গেলো হলের ভেতর যেখানে একেবারে সামনের সারিতে বসে কথা বলতে বলতে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। দেখলাম আরো অনেকের সাথে দাঁড়িয়ে উঠতি তরুণী-কবি হা করে গিলছে কবি-বাণী। কবিতা কীভাবে লিখতে হয়, কীভাবে লিখতে হয় না, কীভাবে গড়ে ওঠে কবিতার শরীর, কবিতার মন - অনেক কিছুই বলেছিলেন সৈয়দ হক। সেসবের বেশিরভাগই ভুলে গেছি। অনুভূতির ব্যাপারটা যে ভুলে যাইনি সেটা বুঝতে পারলাম আজ সৈয়দ হকের মৃত্যুর পর।




বাংলা সাহিত্যের সবগুলো শাখায় হাত দিয়েছেন সৈয়দ হক, এবং সোনা ফলিয়েছেন। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, গান, নাটক, অনুবাদ সম্পর্কে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলবে অনেকদিন। ইতোমধ্যেই তাঁর নাটক নিয়ে অ্যাকাডেমিক গবেষণা হয়েছে - বাংলাদেশে তো বটেই, অন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার উলংগং ইউনিভার্সিটিতে "থ্রি বাংলাদেশি প্লেস কনসিডার্‌ড ইন পোস্টকলোনিয়াল কনটেক্স" (Three Bangladeshi Plays considered in postcolonial context) থিসিসে সৈয়দ শামসুল হকের "নুরলদিনের সারাজীবন" কাব্যনাটকের ওপর আলোকপাত করেছেন খাইরুল হক চৌধুরি। শিল্পকলা সম্পর্কিত এধরনের গভীর আলোচনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু তাঁকে কীভাবে দেখেছি কীভাবে চিনেছি সেটুকুই বলতে পারি।

সৈয়দ শামসুল হক যে কত বড় কবি এবং নাট্যকার সে সম্পর্কে প্রথম ধারণা পাই চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে। তখন গ্রাম থেকে শহরে এসেছি কলেজে পড়ার জন্য। থাকি হোস্টেলে। পড়াশোনা করি বা না করি, ক্লাস কোনটাই মিস করি না। বাংলা ক্লাসগুলো থাকতো বিকেলের দিকে। সায়েন্সের টিচাররা সেই সময় তাঁদের বাসায় বাসায় টিউশনির দোকান খুলতেন। অনেকেই বাংলা ইংরেজি ক্লাসগুলো বাদ দিয়ে সায়েন্সের সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়তে যেতো। ক্লাসের পড়াই আমার ঠিকমতো করতে ইচ্ছে করে না, আবার টিউশনির দোকানে যাবো বিদ্যা কিনতে? আমি এবং আমার মতো আরো কয়েকজন বাংলা ক্লাসও করতাম। আমাদের সেকশানে বাংলা পড়াতেন সিরাজ স্যার। তিনি অবশ্য তাঁর পুরো নাম আ ফ ম সিরাজউদ্দৌলা চৌধুরি বলতেই পছন্দ করতেন। তিনি নিজেও কবি - অন্য কবিদের সন্ধানও দিতেন। একদিন দেখা গেলো পঁচাত্তর জনের ক্লাসে আমরা মাত্র তেরো জন উপস্থিত হয়েছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, "বাকি সবাই কি 'মানসম্মান' দেখতে গেছে?"
            
তখন চট্টগ্রামে অনেকগুলো সিনেমা হল। চট্টগ্রাম কলেজের খুব কাছেই গুলজার সিনেমা হল। প্রতি সপ্তাহে একাধিক সিনেমা দেখা আমার 'অবশ্য কর্তব্য'র তালিকায় আছে। শাবানা অভিনীত বাণিজ্যিক ছবি মানসম্মান মুক্তি পেয়েছিল ঈদ উপলক্ষে। প্রথম শো'তেই দেখে ফেলেছি। তাই স্যারের কথায় বেশ উৎসুক হয়ে উঠলাম। স্যার বললেন, "এই সিনেমাটা ভালো হওয়া উচিত। এর কাহিনি নেয়া হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরানি উপন্যাস থেকে। আর চিত্রনাট্য লিখেছেন সৈয়দ শামসুল হক। সিনেমাটা আমি দেখেছি - কিন্তু অভিনেতা অভিনেত্রীর নামগুলো ছাড়া অন্যদের নামও যে পড়তে হয় সে বোধ তখনো জন্মায়নি। সিরাজ স্যার বললেন সৈয়দ শামসুল হকের কথা। তিনি যে কত বড় কবি, উপন্যাসিক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার আরো কত কী। বললেন আরেকটি সিনেমার কথা - যেটা নাকি অনেকগুলো জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছে। "বড় ভালো লোক ছিল"- সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল আমি শহরে আসার আগে। নইলে মিস হবার কথা নয়। পরে টিভিতে দেখেছি। সৈয়দ হকের লেখা "হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ফুস" গানটি খুবই জনপ্রিয়। সৈয়দ হক জাতীয় চলচিত্র পুরষ্কার পেয়েছিলেন এই সিনেমার সংলাপ লেখার জন্য।
            
শিল্পকলার যে শাখার প্রতি আমার সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ জন্মেছিল তা হলো মঞ্চনাটক। গ্রামে সারারাত জেগে নাটক করতাম। না যাত্রা, না থিয়েটার - একটা রঙিন কাপড় ঝোলানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টানে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে অনেক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করতাম। শহরে আসার পর হঠাৎ স্বাধীনতা পেয়ে প্রথম কয়েক বছর শুধু সিনেমা দেখে কাটিয়েছি। তারপর যেদিন প্রথম গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখলাম - মনে হলো একটা নতুন জগৎ খুলে গেলো চোখের সামনে। দেখলাম থিয়েটারের "যুদ্ধ এবং যুদ্ধ"। নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক। মাত্র দুই ঘন্টার একটা নাটক যে এত শক্তিশালী হতে পারে - আমার কোন ধারণাই ছিল না।
            
১৯৮৭ সাল তখন। এরশাদ স্বৈরাচার চালাচ্ছে, আর সামরিক আচ্ছাদনের আড়ালে জামায়াত শিবির প্রসারিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম শহরের বেশিরভাগ কলেজ শিবিরের দখলে চলে গিয়েছিল আগেই। ১৯৮৬'র নভেম্বর মাসে তারা দখল করলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সময় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে দেখলাম "যুদ্ধ এবং যুদ্ধ"। নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের ভক্ত হয়ে পড়লাম আমি। পরের কয়েক বছরে যখনই সুযোগ পেয়েছি - মঞ্চনাটক দেখেছি। দেখেছি "পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়", "নূরলদীনের সারাজীবন", "ঈর্ষা"।

কাব্য-নাটকের সাথে আগেও পরিচয় ছিল। ইন্ডিয়ান কিছু যাত্রাপালা ছিল কাব্যনাটকের ধরনে রচিত। পৌরাণিক নাটক "রাবণ বধ"-এ "ত্রিদিব কম্পিত আজি বীরত্বে আমার। তবু আজ প্রাণে জাগে ভীতি, কে যেন বলিছে ডাকি অন্তর হইতে - রে দশানন ..." ইত্যাদি দীর্ঘ সংলাপ মুখস্থ করে আউড়েছি খোলা মঞ্চে কয়েক হাজার দর্শকের সামনে। কিন্তু সেই সংলাপের সাথে নুরলদিনের সংলাপের কত পার্থক্য! একেকটা শব্দের কী জোর, কী আবেদন!

            নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
            যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়
            নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
            যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়;
            নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
            যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়;
            নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
            যখন আমার কন্ঠ বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়;
            নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়
            যখন আমারই দেশে এ আমার দেহ থেকে রক্ত ঝরে যায়
            ইতিহাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায়।

          
বুঝলাম স্থান-কাল-পাত্রভেদে অনুভূতি প্রকাশ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন। ১৭৮০'র দশক আর ১৯৮০'র দশকে কত মিল। বিদ্রোহের প্রয়োজন এখনো ততোটাই তীব্র।

           
কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে "ঈর্ষা"। মাত্র তিনটি চরিত্র। সর্বমোট সাতটি সংলাপে দুইঘন্টারও বেশি সময় ধরে টান টান উত্তেজনা। একেকটা সংলাপের দৈর্ঘ্য সাত-আট পৃষ্ঠা। কী অভিনয় জামাল উদ্দিন হোসেন, সারা জাকের আর খালেদ খানের। মানবিক অনুভূতি প্রকাশের কী সূক্ষ্ম অথচ কী তীব্র ভঙ্গি! সেই থেকে আমার প্রিয় নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক।

            
তারপর কত সময় চলে গেছে। তাঁকে দ্বিতীয় এবং শেষ বার দেখেছি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। চট্টগ্রামের তির্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শেক্‌সপিয়ারের অনুবাদ বিষয়ে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। কাছ থেকে শুনেছি তাঁর বক্তৃতা। শেক্‌সপিয়ারের নাটকের এত সার্থক বাংলা অনুবাদ তাঁর মতো করে আর কেউ করতে পারেননি। উৎপল দত্ত ছিলেন শেক্‌সপিয়ারের নাটকের দিক্‌পাল। তিনি নিজে স্বীকার করে গেছেন সৈয়দ শামসুল হকের সার্থক অনুবাদের কথা। একেকটা শব্দের যথার্থতা নিয়ে দিনের পর দিন ভেবেছেন সৈয়দ হক। সেদিন তিনি বলেছিলেন - বাংলা সাহিত্যে যদি কেউ পথ খুঁজে না পায় - তাহলে রবীন্দ্রনাথ পথ দেখাবেন। অনুবাদ করার সময় অনেক শব্দ তিনি খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথে। আবার বলেছেন সেই অনুভূতি প্রকাশের ভিন্নতার প্রয়োজনীয়তা, মাত্রা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা- বহুমাত্রিক হবার জন্য মাত্রাজ্ঞান থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা।

            
লেখকরা যখন একটা উচ্চতায় পৌঁছে যান - আত্মবিশ্বাসের প্রাবল্যে তাঁরা কিছুটা শিথিল হয়ে যান মাঝে মাঝে। কিন্তু সৈয়দ হকের রচনার বুননে আশি বছর বয়সেও কোন শৈথিল্য দেখা যায়নি। অসুস্থ শরীরে শেষ সময়ে নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন যে জীবন নাটকের শেষ দৃশ্য চলছে - মঞ্চের আলো নিভে যাবে একটু পরেই। সেই সময়ের সবটুকু তিনি ঢেলেছেন নতুন সৃষ্টির নির্মাণ-কল্পে। শব্দের কারিগর কখনোই থেমে থাকেননি।

            
দেড় যুগ আগে যখন একটা স্যুটকেস হাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম পৃথিবীর পথে আমার দিদি একটা বই রেখে দিয়েছিল আমার হ্যান্ডব্যাগের সাইড-পকেটে। বইটা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-আর পুরুত্বে সাধারণ বইয়ের থেকে অনেক ছোট, কিন্তু অনেক ঢাউশ বইয়ের চেয়েও তীব্র -সৈয়দ হকের "পরানের গহীন ভিতর"।  তেত্রিশটি সনেট আছে বইটিতে, আর আছে কবির আঁকা কয়েকটি স্কেচ। কতবার যে কবিতাগুলো পড়েছি। প্রতিবারই কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে পরানের গহীন ভেতর। ভাষাটা কবির আঞ্চলিক, অথচ মনে করিয়ে দেয় আমার শেকড়ের কথা -

            "এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
            যে তাঁর রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।"

3 comments:

  1. Athocho amare kau ekdin ero sesh ache....asharer purnimar asha ar e deshe korina...

    ReplyDelete
  2. পড়ার জন্য ধন্যবাদ। কোনভাবে কি বাংলা অক্ষরে লেখা সম্ভব? ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখা অনেকসময় পড়তে কষ্ট হয়।

    ReplyDelete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts