Wednesday 5 September 2018

আয়নাবাজি



 আয়নাবাজি দেখলাম। খুব ভালো লাগলো। বাংলাদেশের সিনেমা দেখে এত ভালো অনেকদিন লাগেনি। আমি  সিনেমাবোদ্ধা নই। সিনেমা দেখে বিজ্ঞজনোচিত সমালোচনা করার মতো পড়াশোনাও আমার নেই। আমি সিনেমা দেখি আনন্দ পাবার জন্য। বই পড়ে যেরকম আনন্দ পাওয়া যায়, কিংবা গান শুনে, খেলা দেখে, কিংবা দেশ-ভ্রমণে - সেরকম আনন্দ। বাংলাদেশের অনেক সিনেমা দেখে আমি আনন্দ যেমন পেয়েছি, তেমনি আবার অনেক সিনেমার পুরোটা দেখাও একটা বিরাট কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অমিতাভ রেজা চৌধুরির আয়নাবাজি দেখে খুবই আনন্দ পেলাম। কী যে ভালো লাগলো, মনে হচ্ছে আরো অনেকবার দেখলেও আনন্দ কমবে না একটুও।

কেন ভালো লাগলো এই সিনেমাটা? গল্প? নির্মাণশৈলী? চিত্রগ্রহণ? সংলাপ? চিত্রনাট্য? সংগীত? অভিনয়? এক কথায় বলা চলে সবকিছুই ভালো। তবে যদি একের পর এক লিখতে হয়, তাহলে সবচেয়ে প্রথমে লিখবো সংলাপ। বাংলা সিনেমায় এরকম স্বাভাবিক সংলাপ আমি অনেকদিন শুনিনি। হালকা থেকে ভারী সব সংলাপই প্রাণবন্ত। কয়েকটি উদাহরণ:

"হলিউড - এটা কি কাঠের দোকান?"
...
"আমার দুধের বাচ্চা কি জেল খাটতে পারবে? জেলখানায় কি এসি আছে?"
...
"আমি দৈনিক পত্রিকা পড়ি না।"
...
"ফাঁসি আয়নাদেরই হয়।"
...
"রাজনীতি তো সবচেয়ে বড় অভিনয়। দেশ একটা মঞ্চ। সামনে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ জনতা।"
...
"মালয়েশিয়া যেতে তো আমার কোন ভিসা লাগে না। অনেক জায়গা জমি কেনা আছে সেখানে।"




তারপর আসে অভিনয়। সব চরিত্রই অনবদ্য। চঞ্চল চৌধুরি সত্যিই আয়নার মতো অভিনয় করেছেন। যখন যে চরিত্র সামনে রাখা হয়েছে সেই চরিত্রই ফুটে উঠেছে আয়নায়। সিনেমার অভিনয় সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন - "সিনেমায় যদি কোন অভিনেতা ভাল অভিনয় না করতে পারেন, সেটা পরিচালকের দোষ। পরিচালক অভিনয় আদায় করে নিতে পারেননি, অথবা অভিনেতা নির্বাচন করতে ভুল করেছেন।" আয়নাবাজিতে পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরি প্রত্যেক অভিনেতার কাছ থেকেই যা চেয়েছেন আদায় করে নিয়েছেন। হলিউড স্টুডিওর ছোট্ট ছেলেটা থেকে শুরু করে সংলাপবিহীন পাগল চরিত্রটাও।

হৃদি চরিত্রটা সত্যিই হৃদয়ে গেঁথে যায়। যুক্তির কাঁচি দিয়ে কাটলে হয়তো টিকবে না কিছুই, কিন্তু পর্দায় হৃদি রূপে নাবিলার উপস্থিতি চারদিক স্নিগ্ধ করে দেয়। বাবা মেয়ের সম্পর্কটা কী যে সুন্দর সহজ আন্ডারস্ট্যান্ডিংটু বিউটিফুল টু বি ট্রু।

"সিংগেল লাইফ কেমন চলছে?"
"ওয়ান্ডারফুল।"
"ডাবল হবার ইচ্ছে আছে?"
"আপাতত নেই।"
"বাপের হোটেলে ক'দিন খাবি?"
"যতদিন বেঁচে আছি।"
"আর আমি ফুড়ুৎ করলে?"
"তখন একটা ভাতের হোটেল দেবো। নাম দেবো বাপের হোটেল।"

সাধারণ বাংলা সিনেমায় প্রেমের মুহূর্তগুলো বড় বেশি আরোপিত, বড় বেশি নাটকীয়। রোমান্টিক সংলাপগুলো যতটা রোমাঞ্চকর তার চেয়ে বেশি বিরক্তিকর। আর আয়নাবাজির মত অসাধারণ সিনেমায় মুহূর্তগুলোও অসাধারণ।

"কাপ অব ক্যাপাচিনো"
"কোন চিনি?"
... ... ...
"এরপর থেকে কোথাও গেলে আমাকে বলে যাবেন।"
... ......
"প্রতিদিন এখানে এসে দুপুরের খাবার খাবো।"
"তাই নাকি? কতদিন?"
"যতদিন নদী থাকে।"
............
"সকালে কখন ওঠ?" ... "তুমি আগে, না সূর্য?"
............
"আয়না পাগলা, আমার সাথে এসব চলবে না।"

সংলাপগুলো পড়লে মনে হয় কত সাধারণ, অথচ কী অসাধারণ রোমান্টিক মুহূর্ত তৈরি করেছেন চঞ্চল ও নাবিলা।

আর তাতে অনুঘটকের কাজ করেছে সংগীত। কী অপূর্ব সুরের কাজ অর্ণবের।

"ধীরে ধীরে যাওনা সময়
আরো ধীরে বও।
আরেকটুক্ষণ রওনা সময়
একটু পরে যাও।"




আয়না তার মায়ের সাথে কথা বলে; যে মা মারা গেছে অনেক বছর আগে। চরিত্রের এই অংশটা হিচককের "সাইকো"র নরম্যান বেইট্‌সকে মনে করিয়ে দেয়।

চলচিত্র সমালোচকদের অনেকেই সিনেমার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আমার কাছে সিনেমা সিনেমাই - তথ্যচিত্র নয়। তাই ফাঁসির আসামী কীভাবে প্রতিদিন কারাগারের মধ্যে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করতেন, নকল চুল-দাড়ি লাগাতেন তা নিয়ে প্রশ্ন আমি করি না। ক্ষমতাশালীদের হাত অনেক লম্বা। কিন্তু একটা অসম্পর্কিত অমূলক প্রশ্ন জাগে, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরি বা মতিউর রহমান নিজামীদের মত ক্ষমতাশালীদের ঠিকঠাক ফাঁসি হয়েছে তো?

পুলিশ অফিসারের অতি-নাটকীয় সংলাপ "বিসিএস সেকেন্ড, পুলিশের চাকরি এমনি এমনি করছি না..." শুনে একটু হাসি অবশ্য পেয়েছে। বিসিএস সেকেন্ডদের এত ক্ষমতা!

সিনেমায় কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে - যাতে চোখে পানি এসে যায়। কখনো আনন্দে, কখনো বেদনায় মুহূর্তগুলো দেখতে দেখতে আমি কাঁদি। আয়নাবাজি দেখে কান্না আসেনি কোন দৃশ্যেযদিও গানের এই লাইনটা বড়ই সুন্দর - "জানি জীবন গল্পে অনেক ধাঁধা, একটু হাসি অনেক কাঁদা।"

অনেক অস্কার পুরষ্কার পাওয়া ছবিও দেখার সময় মাঝে মাঝে মনে হয় - ছবিটা শেষ হচ্ছে না কেন? আবার এমন অনেক ভালো লাগা সিনেমা আছে দেখতে দেখতে মনে হয় - সময় থেমে যাক। আয়নাবাজি দেখতে দেখতে তার গানের মতোই মনে হয়েছে, 

"ধীরে ধীরে যাও না সময়
আরো ধীরে বও।
আরেকটুক্ষণ রও না সময়
একটু পরে যাও।।"

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts