Tuesday, 25 September 2018

আইরিন কুরি ।। ষষ্ঠ পর্ব



রেডিয়াম ইনস্টিটিউট থেকে আইরিনদের বাসা খুব বেশি দূরে নয়। সরবোন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের পেছনের রাস্তা দিয়ে ল্যাটিন কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে লা ট্যুরনেল ব্রিজ পার হয়ে বিখ্যাত নটর ডেম ক্যাথিড্রালের সামনে দিয়ে হেঁটে প্রতিদিনই বাসায় ফেরেন আইরিন।

এই পথে হাঁটার সময় আইরিনের অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মনে হয় মায়ের পথেই হাঁটছেন তিনি। তাঁর মা পোল্যান্ড থেকে এসে এই সরবোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই ল্যাটিন কোয়ার্টারের একটা চিলেকোঠায় থাকতেন।

ফ্রেড আজ সাথে চলেছেন। ফ্রেড শুধু কাজের কথাই বলে যাচ্ছেন আজ, ক্লাউড চেম্বারের কথা, পোলোনিয়ামের কথা, রেডিয়ামের কথা। বাড়ির দরজায় আসার পরেও কথা শেষ হলো না তাঁর। বাকিটা পরের দিন হবে বলে বিদায় নিয়ে চলে এলেন। তাঁকে আবার অনেকদূর ঘুরে যেতে হবে নিজের বাসায়।

পরের দিনও ঠিক সময়ে কাজ শেষ করে বাইরে এসে সিঁড়ির কাছে বসে রইলেন ফ্রেড। ঘন্টাখানেক পর আইরিনকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে এগিয়ে গেলেন। আবার একই পথে দু’জনের পাশাপাশি হাঁটা। নটর ডেম ক্যাথিড্রালের সামনে এসে ফ্রেড হঠাৎ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, “নটর ডেমের বাইরের চেয়ে ভেতরটাই বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। আপনার কেমন লাগে?”
“আমি জানি না”
“বুঝলাম না”
“অর্থাৎ আমি কখনো নটর ডেমের ভেতরে ঢুকে দেখিনি।”
“কেন?”
“ইচ্ছে করেনি।”
“আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপনার অনিচ্ছার কারণ কী।”
“বারো বছর বয়স পর্যন্ত আমি আমার গ্র্যানপির কাছে মানুষ হয়েছি। তাঁর কাছেই আমি পেয়েছি আমার জীবন-দর্শন। রাষ্ট্রীয় দখলদারিত্ব উপনিবেশ এগুলোকে খুবই ঘৃণা করি আমি। চার্চ যে ধর্মের নামে মানুষকে প্রতিনিয়ত শোষণ করছে, রাষ্ট্রের সব কাজে হস্তক্ষেপ করছে তা আমি জানি। আমার মা আমাদের দু’বোনকে ধর্মহীনভাবে বড় করেছেন। বলেছেন, আমি তোমাদের ওপর কোন ধর্মের বোঝা চাপিয়ে দিতে চাই না। তোমরা বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখবে তখন যার যা খুশি অনুসরণ করবে। আমি যখন থেকে নিজে নিজে বুঝতে শিখেছি আমার দাদুর শিক্ষা মানবতাকেই আমার ধর্ম হিসেবে মানি। পৃথিবীর সবগুলো ক্যাথিড্রালে লক্ষ লক্ষ ফ্রাঙ্ক খরচ করে নানারকম চিত্রকর্ম, শিল্পকর্ম স্থাপন করা হয়। মূল উদ্দেশ্য কিন্তু এক - অলৌকিক ঈশ্বর বা যিশুখ্রিস্টের মহিমা প্রচার করা। আমি কখনোই কোন ধর্মীয় স্থানে এ পর্যন্ত ঢুকিনি, ভবিষ্যতেও ঢোকার ইচ্ছে নেই।”
“আপনি যিশুখ্রিস্টকে বিশ্বাস করেন না?”
“না। সব মানুষ পাপী, যিশু তাদের উদ্ধারকর্তা জাতীয় কথাবার্তা বিশ্বাস করার মতো নির্বোধ আমি নই।”
 
প্রায় প্রতিদিনই একসাথে হাঁটতে বেরোচ্ছেন ফ্রেড ও আইরিন। চেনা পথ দিয়ে বাড়ি ফেরার বদলে প্যারিসের অপরিচিত গলি দিয়েও হাঁটতে শুরু করেছেন তাঁরা। বিজ্ঞান ছাড়াও ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, শ্রেণিসংগ্রাম এবং কবিতা নিয়েও আলোচনা শুরু হলো তাঁদের মধ্যে। ফ্রেড আবিষ্কার করলেন আইরিন কবিতা পছন্দ করেন। অনেকগুলো ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও ইংরেজি কবিতা তাঁর মুখস্থ।

যে আইরিনকে সবাই বরফের মূর্তি মনে করেন, সেই আইরিনের ভেতর একটা নতুন আইরিনের সন্ধান পান ফ্রেড। এই নতুন আইরিনের সাথে পাহাড়ে বেড়াতে যান ফ্রেড, স্কি করেন, সাঁতার কাটেন, টেনিস খেলেন। আবার একই সাথে গবেষণাও করেন। যদিও আইরিন ফ্রেডকে সরাসরি বলেন, “আপনাকে দেখলে মোটেও বিজ্ঞানী বলে মনে হয় না। আপনার চেহারা বড় বেশি মিলিটারি টাইপ।”

১৯২৫ সালে আইরিন সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল থিসিস জমা দিয়েছেন - ‘আলফা রে অব পোলোনিয়াম’ শিরোনামে। থিসিস উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাকে - ‘টু মাদাম কুরি বাই হার ডটার এন্ড পিউপিল’। আইরিন থিসিস ডিফেন্ড করতে গেলেন একটা ঢিলেঢালা ব্যাগি ড্রেসের ওপর কালো একাডেমিক গাউন পরে।

অডিটোরিয়ামে প্রায় হাজার দর্শক উপস্থিত রেডিয়াম-কন্যার বক্তৃতা শোনার জন্য। আইরিন যদিও সমাবেশ পছন্দ করেন না, কোন ধরনের টেনশান ছাড়াই তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি যা জানেন তা এত ভালো জানেন যে সেটা নিয়ে কোনদিনই কোন উৎকন্ঠায় ভোগেন না। আইরিনের পরীক্ষকদের ওপর মানসিক চাপ পড়বে ভেবে মাদাম কুরি যাননি সেই অনুষ্ঠানে।

পরীক্ষকদের সবার ভূয়সী প্রশংসার ভেতর দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেলেন আইরিন কুরি। সরবোন থেকে রেডিয়াম ইনস্টিটিউটে ফিরেই চমকে উঠলেন আইরিন। সেখানে আইরিনের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করে ফেলেছেন ফ্রেড। ল্যাবরেটরির বিকারে করে শ্যাম্পেন পান করার মধ্য দিয়ে শেষ হলো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।




এতদিন ধরে ফ্রেডের সাথে মেলামেশা করতে করতে আইরিনের ভেতর অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। জীবনে প্রেম-ভালোবাসার কোন স্থান ছিল না তাঁর। কিন্তু ফ্রেড যেন নতুন দরজা খুলে দিয়েছেন তাঁর জীবনে। তিনি ফ্রেডকে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। ফ্রেড তো অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বিয়ে যদি করেন তো আইরিনকেই করবেন।

ডক্টরেটের পর আইরিনকে নিয়ে মাদাম ব্রাজিলে গেছেন। ইনস্টিটিউটে গিয়ে আইরিনকে না দেখে কাজে মন বসাতে পারেন না ফ্রেড। তিনি আইরিনকে চিঠি লেখেন, “আমি এতদিন ভাবতাম গবেষণাকেই আমি বেশি ভালোবাসি। এখন তোমাকে না দেখতে পেয়ে বুঝতে পারছি আমি গবেষণার চেয়েও তোমাকেই বেশি ভালোবাসি। তুমি আছো বলেই আমার গবেষণা আছে। তুমি কাছে না থাকলে আমার সবকিছুই খালি খালি লাগে। তুমি যে আমার জীবনের সাথে মিশে গেছো তা কি তুমি জানো?”
চিঠি পেয়ে আইরিন ঠিক বুঝতে পারলেন না কী করবেন। তিনি সবসময় বস্তুনিষ্ঠ ব্যাপারে অভ্যস্ত। এরকম ভাবালুতার সাথে তাঁর পরিচয় নেই। ফ্রেড তাঁকে ভালোবাসে সেটা লিখেছে স্পষ্ট করে। কিন্তু বিয়ের প্রস্তাব তো এটা নয়। আইরিন বস্তুনিষ্ঠভাবে ভাবতে সাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। তিনি ভেবে দেখলেন ভালোবাসা যখন হয়েছে তখন বিয়ে করে ফেলাই ভালো। তাঁর মা একই সাথে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী আবার দুটো সন্তানের মা। মাদামের মেয়ে হয়ে আইরিনও নিশ্চয় বিজ্ঞান ও সংসার দুটোই সামলাতে পারবেন। তাছাড়া স্বামী হিসেবে খুব একটা খারাপ হবেন না ফ্রেড। 
কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় ফ্রেডের সাথে খোলাখুলি কথা বললেন আইরিন।
“তোমার চিঠি আমি পেয়েছি।”
“কিন্তু চিঠির জবাব আমি পাইনি।”
“চিঠিতে একটি প্রশ্ন তুমি করেছিলে - আমি যে তোমার জীবনের সাথে মিশে গেছি তা আমি জানি কিনা। সে প্রশ্নের উত্তরে কী লিখতে হয় আমি জানি না। ফ্রেড, এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে ভীষণ জটিল বলে মনে হয়। সরাসরি বলো - তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
“হ্যাঁ চাই চাই চাই।”
“একটা শব্দ এতবার বলছো কেন?”
“আমার ইচ্ছের প্রাবল্য বোঝানোর জন্য বলছি মাদ্‌মাজেল। আমার মনে হচ্ছে আমি আজ চাঁদ হাতে পেয়েছি।”
“সবকিছুতে কেন যে তুমি চাঁদের উপমা দাও বুঝতে পারি না। আলফা পার্টিক্যলকে তুমি চাঁদে নিয়ে যাও। আজ বলছো তুমি চাঁদ হাতে পেয়েছো। চাঁদের আয়তন কত জানো?”
“তোমার বিজ্ঞান দিয়ে ভালোবাসা বোঝার চেষ্টা করো না মাদ্‌মাজেল। ওটা আমার হাতেই ছেড়ে দাও। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি চাঁদ হাতে পাওয়া বলতে কী বোঝায়” - বলতে বলতে গভীর আবেগে আইরিনকে জড়িয়ে ধরেন ফ্রেড। সময় থেমে যায়, চন্দ্রগ্রস্তের মত তিরতির করে কাঁপতে থাকেন আইরিন।

[সপ্তম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন এখানে]

2 comments:

Latest Post

হেনরি ক্যাভেন্ডিস: অদ্ভুত মানুষ, অসাধারণ বিজ্ঞানী

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির যে সিঁড়ি ধরে পৃথিবীর মানুষ এত উপরে উঠে এসেছে সেই সিঁড়ির ভিত্তি তৈরি হয়েছে যেসব গবেষণাগারে, সেসব গবেষণাগারের নাম...

Popular Posts