Sunday 15 July 2018

আত্মঘাতী কুসংস্কার



সম্প্রতি আমার এক কাকা মারা গেছেন। তাঁর যক্ষা হয়েছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে ধরা পড়লো তাঁর মাথায় একটা টিউমারও হয়েছিল এবং ব্রেন টিউমারের নিয়ম অনুসারেই তা দ্রুত বাড়ছিলো। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার পরামর্শই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার আত্মীয় মানে কাকার ছেলে মেয়েরা এবং আরো অনেক আপাত শুভাকাঙ্খীর বিশ্বাস বিক্ষিপ্ত। তাঁরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাশাপাশি কিছু তান্ত্রিকের শরণাপন্নও হয়েছিলেন। বাড়িতে থাকি না বলে ঘটনাগুলো আমার অজানাই ছিল। কিংবা ইচ্ছে করেই আমাকে জানানো হয়নি। কাকার মৃত্যুর পর যা জেনেছি - তাতে দেখা যাচ্ছে কাকাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের আওতায় আনা হয়েছিল একেবারে শেষ অবস্থায়।

যক্ষা রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়ার পর স্থানীয় হাসপাতালে যোগাযোগ করে চিকিৎসা নেয়ার পর কাকার আত্মীয়-স্বজনরা বলতে শুরু করলেন - কাকাকে বাণ মারা হয়েছে। যে সে বাণ নয়, একেবারে রক্তবাণ। রক্তের সম্পর্কের কেউ নাকি কাকার ক্ষতি করার জন্য জাদুটোনা করে এই বাণ মেরেছে। কাকা নিতান্তই দরিদ্র একজন মানুষ। তাঁর ক্ষতি করে আত্মীয়স্বজনদের কী উপকার হবে কে জানে। তবে এ ধরনের ব্যাপারে পাড়া প্রতিবেশীর বিশ্বাস অর্জন করতে সময় লাগে না। বাণ কাটার ব্যবস্থাও আছে। বিখ্যাত তান্ত্রিককে হাজির করা গেলো একজোড়া হালের বলদ বিক্রি করে। নানারকম জাঁকযজ্ঞের প্রহসনে গেলো আরো কয়েক হাজার টাকা। রক্তবাণ কাটা গেছে বলে মহাবাক্য উচচারণ করতে করতে কাকার গোয়াল থেকে একটি গাই গরু নিয়ে চলে গেলেন তান্ত্রিক সাধক। কাকা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলেন আরো কয়েক ধাপ। প্রাণের সাথে সাথে ধনেও টান পড়লো মারাত্মকভাবে।

এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে এতটাই স্বাভাবিক যে শুনে আমাদের খুব একটা প্রতিক্রিয়া হয় না। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে এসব তো ঘটবেই। শুধু আমার দরিদ্র কাকার বেলায় কেন - খুব বড় বড় মানুষের ক্ষেত্রেও তো দেখা যায় নানা রকম অবৈজ্ঞানিক কাজকর্ম। খুবই ধনী, বিশাল টাকার মালিক, হাঁচি-কাশি হলেও সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ছুটে যান চেক-আপ করাতে - এমন মানুষও চিকিৎসার পাশাপাশি তাবিজ-কবজ-মাদুলি পরেন শরীরে - শরীর ভালো থাকার জন্য।




নানা রকম মানুষের নানা রকম সংস্কার আছে। অনেক দিন থেকেই চালু হয়ে আছে এসব সংস্কার। কোন কোন সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলি, কোন কোনটাকে ভালোমন্দ কিছুই না বলে প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে দেখি। যেমন অনেকে ১৩ সংখ্যাটিকে এড়িয়ে চলেন। আনলাকি থার্টিন বেশ প্রচলিত একটি সংস্কার। কেউ এ সংস্কার মেনে চললে আমরা কেউ কিছু মনে করি না। কোরিয়ায় ৪ সংখ্যাটি ছিলো মৃত্যুর প্রতীক। সেখানে পারত পক্ষে কেউ চার সংখ্যাটি ব্যবহার করে না। সেখানে কোন কোন  লিফ্‌টে দেখা যায়  1, 2, 3, F, 5, 6 । এ ধরনের সংস্কার নিয়ে আমরা বড়জোর হাসি। কিন্তু খুব একটা আত্মঘাতী মনে করি না এদের। 




ভারতীয় ক্রিকেটারদের আঙুলে হাতে বাহুতে গলায় নানারকম সুতা, আংটি, তাবিজ, লকেট দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একটা উইকেট পেলে বোলারদের যেভাবে মাদুলিতে চুমু খেতে দেখি তাতে বড়জোর মনে করি যে ক্রিকেটারটি বড়ই সংস্কারাচ্ছন্ন। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে আমরা কিন্তু এই ক্রিকেটারকে বিশ্বাসের এই অন্ধত্বের জন্য বর্জন করি না। আমাদের প্রফেসর জাফর ইকবাল লিখেছেন টিভিতে বাংলাদেশের খেলা দেখার সময় তিনি যে সোফায় যেভাবে বসে খেলা দেখতে শুরু করেন - সেখান থেকে আর নড়াচড়া করেন না পাছে বাংলাদেশের উইকেট পড়ে যায়। ভারতীয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন টিভিতে ভারতীয় টিমের ক্রিকেট খেলা দেখেন না - কারণ তিনি নাকি টিভিতে খেলা দেখলে ভারত হেরে যায়।

বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন মেসি তার পায়ের মোজার ভেতর তাবিজ বেঁধে খেলতে নেমেছিলেন গোল করতে পারার জন্য। কতটা গোল তিনি করেছেন আমরা দেখেছি। মেক্সিকানরা বিরাট যাগযজ্ঞ করেছে তাদের ফুটবল টিম যেন জিততে পারে। মেক্সিকানদের রেজাল্টও আমরা জানি। তারপরও যেন আমরা মানতে চাই না যে এসব কুসংস্কার কুসংস্কারই। কিন্তু সকল কুসংস্কারই যে মাঝে মাঝে আত্মঘাতী হয়ে উঠে।



বেশ কয়েক বছর আগের কথা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন। চট্টগ্রাম শহর থেকে যারা শাটল ট্রেনে ইউনিভার্সিটিতে আসা যাওয়া করেছেন তারা জানেন ট্রেনের অবস্থা। একদিন ট্রেনে ফিরছি ক্যাম্পাস থেকে। প্রচন্ড ভীড়। আমাদের কম্পার্টমেন্টের সিঁড়িতে পা ঝুলিয়ে বসেছে বেশ কয়েকটি মেয়ে। আমি গাদাগাদি ভিড়ে তাদের পেছনে বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্রেন থামতে না থামতেই ধুপধাপ নামতে গিয়ে মেয়েদের একজনের আর্তচিৎকার। তার দুই পা চলে গেছে ট্রেনের নিচে, চাকার কাছে। প্লাটফরমের ধার আর ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মাঝে আটকে আছে সে। স্বাভাবিক রিফ্লেক্স অনুসারে দ্রুত তার হাত ধরে টেনে তুলতে গিয়েই ধাক্কাটা খেলাম। বোরকায় ঢাকা মেয়েটি চিৎকার করছে - আপনি না, আপনি না, কোন মেয়েকে ডাকুন। আশে পাশের মেয়েরা কেউ সাড়া দিচ্ছে না তার আহবানে। এ অবস্থায় কোন সাহসী মেয়েকে ডেকে এনে তাকে টেনে বের করার অর্থ হলো আরো অনেকক্ষণ সময়। ট্রেন এখানে থামে বড়জোর দুমিনিট। এর মধ্যে ট্রেন যদি চলতে শুরু করে - আস্ত পা নিয়ে আর উঠতে হবে না তাকে। দুবন্ধু মিলে তাকে টেনে প্লাটফরমের উপর তোলার পর মেয়েটির আবারো ধমক, কেন আমার হাত ধরলেন আপনারা? একটি  দুর্ঘটনা থেকে একজন মেয়েকে হাত ধরে টেনে উদ্ধার করার মধ্যে কী অপরাধ থাকতে পারে আজও বুঝতে পারিনি। এ কী ধরনের সংস্কার একজন ইউনিভার্সিটি পড়া স্টুডেন্টের!



সাপের কামড়ে ডাক্তারের বদলে ওঝার শরণাপন্ন হয় এখনো বেশির ভাগ মানুষ। সাপ সম্পর্কে কত রকম কুসংস্কারই না চালু আছে আমাদের মাঝে। সাপুড়েরা নানারকম আষাঢ়ে গল্প করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে নিয়মিত। বীণ বাজালে সাপ ছুটে আসে একথা বিশ্বাস করার লোকের অভাব নেই। আর সাপ সম্পর্কে অদ্ভুত সব অসত্য গল্পে ভরা আমাদের লোককাহিনীগুলো, রূপকথাগুলো। আর সিনেমাগুলোর তো কথাই নেই। এসব পড়ে দেখে শুনে সাপ সম্পর্কে আমাদের কুসংস্কার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে - সাপে কামড় দিলে সোজা যে হাসপাতালে নেয়ার দরকার তা না করে ওঝার হাতে সময় সঁপে দিই। নির্বিষ সাপে কামড়ালে বেঁচে যাই - প্রাথমিক চিকিৎসায় - যা ওঝা তাদের নানারকম ভড়ংসহ দিয়ে থাকে। আর বিষধর সাপে কামড়ালে ওঝাও যখন কিছু করতে পারে না - তখন ডাক্তার ডাকি। কখনো বাঁচি - বেশির ভাগই মরি। কারণ বিষের ক্রিয়া ততক্ষণে মারাত্মক হয়ে ওঠে। আমাদের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও ওঝার ডাক পড়ে - এর চেয়ে আত্মঘাতী সংস্কার আর কী হতে পারে।

ঘূর্ণিঝড় সিডরে ভোলার অনেকগুলো ইউনিয়নে নিজেদের ঘর ছেড়ে বের হয়নি বাড়ির বউরা। সবাই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিলেও বাড়ির বউরা ঘরে রয়ে গিয়েছিল এই বিশ্বাসে যে ঘরের মইধ্যে বউরা না থাইকলে হেই ঘর থাহেনা। যুগান্তর পত্রিকায় এ খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল ৪/১২/০৭ তারিখে। সিডর কাউকে রেহাই দেয়নি সেখানে। কারণ ঘরে বউ থাকলো কি থাকলো না তাতে কিছু যায় আসে না প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে। কিন্তু এই আত্মঘাতী কুসংস্কার দূর করা কি যায় এত সহজে? বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে বুড়োআঙুল দেখিয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে বসে থাকার শক্তি যোগাচ্ছে আত্মঘাতী সব কুসংস্কার।

অনেক গ্রামে আমি দেখেছি হিন্দু পরিবারে সন্তান জন্মাবার পর মা ও শিশুকে প্রায় এক মাস থাকতে দেয়া হয় আঁতুড় ঘরে। এই আতুঁড় ঘর হলো বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে নোংরা একটি ঘর। এই একমাস প্রসূতি মাতাকে এই আঁতুড় ঘরে প্রায় বন্দী করে রাখা হয়, অস্পৃশ্য করে রাখা হয়। এক মাস নাকি মা ও শিশু অপবিত্র থাকে। অথচ এই সময়টাতে মা ও শিশুর থাকা দরকার সবচেয়ে আরামে, সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন অবস্থায়। কারণ যে কোন সুযোগেই নানারকম সংক্রমণ ঘটতে পারে মায়ের এবং নবজাতকের। কিন্তু কুসংস্কারের কারণে প্রসূতি মাতা ও নবজাতককে কাটাতে হয় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে যা পরবর্তীতে তাদের স্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

আমাদের সংস্কার চিন্তা প্রবল। দিনে দিনে তা আরো বাড়ছে। কিন্তু যতসব কুসংস্কারের ডিব্বা গলায় বেঁধে সযতনে আগলে রেখে কতটুকু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব আমাদের? আমাদের দেশে লোডশেডিং-এ যত মোমবাতি জ্বলে তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে মোমবাতি জ্বলে মন্দির মসজিদ গির্জা প্যাগোড়া ফকির দরবেশ আউলিয়াদের মাজারে। এই মানত করা মোমবাতির আলোতে মনের কুসংস্কারের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়, আমরা এগিয়ে চলি অন্ধকারের দিকে। এখন আমাদের দরকার একটি ঝকঝকে নতুন বিজ্ঞান-প্রজন্ম। সংস্কারে মসৃণ হওয়ার দরকার নেই, যুক্তিতে দৃঢ় হলেই হলো। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts