Tuesday 8 May 2018

শিক্ষানীতি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি


*** আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতিটি প্রকাশ করা হয়েছিল ২০০৯ সালে। এই লেখাটি সেই সময়ের। 
____________________________________________________

অতি সম্প্রতি জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বিষয়বস্তু হলো বর্তমানে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করা। নির্বাচনে ভরাডুবির পর অনেকদিন মুখ লুকিয়ে ছিলেন। এবার একটা অজুহাত পেলেন - মেঠো বক্তৃতা তো দিতেই হবে। তাই লিখিত বক্তব্যে তিনি তাঁর দল জামায়াতি ইসলামীর পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে বর্তমান সরকার যে শিক্ষানীতি তৈরি করেছেন তা চালু হলে বাংলাদেশে ধর্মশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে অনৈতিকতায় ভরে উঠবে দেশ। তাঁদের অভিযোগ-গুলোর কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। জামায়াতি ইসলামীর মত ধর্মাশ্রিত একটা দলের কাছ থেকে যুক্তি আশা করার কোন মানে হয় না।
            
তাঁদের অভিযোগ-গুলো কী কী? অভিযোগ অনেক। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো - এই শিক্ষানীতি যাঁরা তৈরি করেছেন তাঁরা জামায়াতীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নন। স্বাভাবিক। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরি হলেন বর্তমান শিক্ষানীতি কমিশনের চেয়ারম্যান। মতিউর রহমান নিজামীরা তো ভুলতে পারেন না যে তাঁরা এবং তাঁদের অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রশিবির কবীর চৌধুরিকে মুরতাদ ঘোষণা করেছেন। আরো এক ভয়ংকর মুরতাদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল-ও আছেন এই কমিটিতে। নিজামীরা কবীর চৌধুরিকে শিক্ষাবিদ বলেই স্বীকার করেন না। চল্লিশ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেই শিক্ষাবিদ হওয়া যায় না - নিজামীর এই বচন প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে। ঠিকই তো। নিজামীদের আদর্শতো অধ্যাপক গোলাম আজম। তিনি কোন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক - তা অবশ্য আমরা জানি না। সেটা জানার খুব একটা দরকারও নেই। নিজামী কথায় কথায় বলেও ফেলেছেন যে - শিক্ষানীতি যারা তৈরি করেছেন - তারা খুব একটা ধর্মচর্চা করেন না বলেই এই শিক্ষানীতি ধর্মের বিরুদ্ধে উঠে-পড়ে লেগেছে।
            
শিক্ষানীতি প্রবর্তনের বর্তমান কমিটিতে যাঁরা আছেন তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা করেন কি করেন না - তা আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি তাঁদের মধ্যে একজনও নাস্তিক নেই। বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উপাসনা ধর্ম থেকে যতটা দূরে রাখলে বাংলাদেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটতো - তাঁরা সেটা করেননি। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেই তাঁরা তা করেননি। মাদ্রাসা শিক্ষা-ব্যবস্থা একেবারে তুলে দেয়াটাই যে বিজ্ঞান-সম্মত হতো তা সবাই বোঝেন। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাতেও তেমন কোন পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং সেখানেও বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষা দেয়া হবে বলা হচ্ছে। কীভাবে হবে তার একটা রূপরেখা দেয়া হয়েছে শিক্ষানীতিতে। তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে এ ব্যাপারে খুব একটা সন্দেহমুক্ত নই।  
            
নিজামী সাহেব দাবী করছেন যে এই শিক্ষানীতি চালু হলে বাংলাদেশে ধর্মশিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে অনৈতিকতায় ভরে উঠবে দেশ। হাস্যকর যুক্তি। নিজামী সাহেব নিজেও জানেন যে ধর্মশিক্ষার সাথে নৈতিকতা অর্জনের সংযোগ খুব সামান্য। সাধারণ বুদ্ধির একজন মানুষের স্বাভাবিক যুক্তিকে কাজে লাগিয়েই দেখা যাক নিজামী সাহেবের দাবী কতটুকু গ্রহণযোগ্য। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি এখনো চালু হয়নি। বর্তমানে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক। এই বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের কেমন নৈতিকতা অর্জিত হয়েছে? দুর্নীতিতে আমাদের অবস্থান কোথায়? মজার বিষয় হলো - যে সব দেশে দুনীর্তি নেই বললেই চলে - সেসব দেশের কোথাও ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়।
            
নিজামী সাহেব অবশ্য নিজের অজান্তেই একটি সত্য কথা বলে ফেলেছেন। তা হলো - মাধ্যমিক স্তরে বাধ্য না হলে কেউ ধর্ম বিষয়টা আবশ্যিক বিষয় হিসেবে নেবে না। যে শিক্ষার্থী বিজ্ঞান পড়াশোনা করছে, পদার্থের ধর্ম পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিজের বুদ্ধি ও যুক্তিকে শানিত করছে -  সে কেন ধর্মশিক্ষার নামে দুটো বছর ধরে কতকগুলো অর্থহীন বাক্য মুখস্ত করবে?  বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে কখন থেকে? এরশাদ সাহেব ক্ষমতা দখল করে ধর্মকে আশ্রয় করেছেন টিকে থাকার জন্য - এবং টিকে গেছেনও। এরশাদ সাহেবের আমলেই রবিবারের বদলে শুক্রবার ছুটির দিন হয়েছে, বাংলাদেশের সকল নাগরিকের নামের আগে জনাব/বেগম লেখার আদেশ দেয়া হয়েছে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে।  এরশাদের পা ধরেই উত্থান ঘটেছে মওলানা মান্নান গোষ্ঠীর।  এবং এই সময়েই মাধ্যমিক স্তরে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবার পর বাংলাদেশের যে কী পরিমাণ নৈতিক অধঃপতন হয়েছে তা সবাই জানেন। আর খোদ এরশাদ সাহেবের নৈতিকতা যে কেমন তা আলাদা করে বলার দরকার আছে বলে মনে করি না। কদিন আগে জনাব এরশাদও প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বিষয়ে বলেছেন - আল্লাহ্‌র নাম নিতে মানা করা হচ্ছে - এ কেমন শিক্ষানীতি? বি-এন-পিও এই শিক্ষানীতির সমালোচনা করছে। যার যেমন চরিত্র।
            
ইসলামী ছাত্রশিবিরও বসে নেই। তারা একটি পুস্তিকা রচনা করেছে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে। আরবি ও ইংরেজিতে ছাপানো হয়েছে সেটা। বিদেশী দূতাবাসগুলোতে তা দিয়ে আসা হয়েছে। শিবিরের বিশেষজ্ঞ (!) কমিটি এই পুস্তিকা রচনা করেছেন। শিবির স্বাভাবিক ভাবেই নারীশিক্ষা ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার বিস্তারের বিরোধীতা করেছে। আর তাদের আরব দেশীয় দূতাবাসে নালিশ করতে গেছে প্রস্তাবিত শিক্ষা-নীতির বিরুদ্ধে। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থায় আরবদেশের কী ভূমিকা আছে আমি ঠিক জানি না। তবে এটা জানি যে সৌদি আরবসহ আরো বেশ কিছু দেশ এখন তাদের দেশের ছেলেমেয়েদের পশ্চিমী শিক্ষায় শিক্ষিত করছে। নিজামীদের ভাষায় কাফেরদের শিক্ষা নিচ্ছে এই সব আরব দেশের ছেলেরা কাফেরদের দেশে এসে। আমার নিজের ডিপার্টমেন্টেই আছে বেশ কয়েকজন অ্যারাবিয়ান ছাত্র - যারা বিজ্ঞান শিখছে। এবং তাদের নিজের দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়ের পর থেকে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়।
            
প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে সমালোচনা করা যাবে না - এটা কেউ বলছে না। সরকার নিজের উদ্যোগে এই নীতির খসড়া প্রকাশ করেছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ওয়েব-সাইটে  (www.moedu.gov.bd) রাখা আছে এই খসড়া। ৯০ পৃষ্ঠার এই খসড়ার পুরোটা কারো পড়তে কষ্ট হলে প্রফেসর জাফর ইকবালের শিক্ষানীতির সহজ পাঠ (২৬/১০/০৯ প্রথম আলো) পড়ে নিলেই প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে। জামায়াত শিবির বি-এন-পি বা এরশাদের পার্টি বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করবে। কিন্তু আমাদের কি বসে থাকলে চলবে? এটা তো কোন রাজনৈতিক দলিল নয়। এটা আমাদের জাতীয় দিকনির্দেশনার বিষয়। যুক্তিবাদীদের উচিত যুক্তি ও বাস্তবতার নিরিখে মতামত দেয়া। একটা ভালো কাজ শুরু হয়েছে। চলুন আমরাও হাত লাগাই।


___________
মেলবোর্ন, ২০০৯

No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts