Tuesday, 11 November 2025

মহাকাশের মহানায়ক কার্ল স্যাগান

 



সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যেসব বিজ্ঞানী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন কার্ল স্যাগান ছিলেন তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম। টাইম ম্যাগাজিন কার্ল স্যাগানকে অভিহিত করেছেন আমেরিকার সবচেয়ে সফল বিজ্ঞান-উপস্থাপক হিসেবে। পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানীদের মধ্যে হাতেগোণা কয়েকজন মাত্র বিজ্ঞানী কঠিন জটিল বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্যও সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের কথা লিখেছেন। কার্ল স্যাগান ছিলেন এই হাতেগোণা ক’জন বিজ্ঞানীর একজন – যিনি ছয় শতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করার পাশাপাশি দুই ডজনের বেশি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। টেলিভিশনে বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান করে তিনি বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের ঘরে ঘরে। তাঁর তেরো পর্বের টেলিভিশন ডকুমেন্টারি – কসমস প্রচারিত হয়েছে বিশ্বের প্রায় ষাটটি দেশে। মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন প্রায় ষাট কোটি দর্শক। এই ডকুমেন্টারিতে তিনি সহজ প্রাণবন্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন মহাকাশের গ্রহগুলির প্রকৃতি, পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি ও বিবর্তন, পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আছে কি না ইত্যাদি সব বিষয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁর ডকুমেন্টারি, বই, এবং গবেষণা সমৃদ্ধ করেছে বিংশ শতাব্দীর মহাকাশবিজ্ঞান।  

কার্ল এডওয়ার্ড স্যাগানের জন্ম আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর। তাঁর বাবা স্যামুয়েল স্যাগান ছিলেন একটি পোশাক কারখানার ম্যানেজার। মা র‍্যাছেল স্যাগান ছিলেন গৃহবধু। কার্ল স্যাগানের মহাকাশের রহস্যের প্রতি আগ্রহ জন্মে একেবারে ছোটবেলা থেকে যখন মায়ের হাত ধরে পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্রহ-নক্ষত্রের ছবিওয়ালা বইগুলি নাড়াচাড়া করতেন।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার পর ১৯৬০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গাইড ছিলেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কুইপার। আমাদের সৌরজগতের ‘কুইপার বেল্ট’ এর নাম তাঁর নামেই রাখা হয়েছে। কার্ল স্যাগান বৃহস্পতি এবং শুক্র গ্রহের বায়ুমন্ডল সংক্রান্ত বিস্তারিত গবেষণা করেন। শুক্র গ্রহের অস্বাভাবিক চাপযুক্ত বায়ুমন্ডলের বৈশিষ্ট্য এবং তার সম্ভাব্য কারণ নির্ণয় করেন কার্ল স্যাগান। নাসার অনেকগুলি স্পেস মিশনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন কার্ল স্যাগান। ১৯৭৭ সালে মহাকাশে প্রেরিত ভয়েজার-১ ও ভয়েজার-২ এ পাঠানো গোল্ডেন রেকর্ড-এর ডিজাইন করেন কার্ল স্যাগান যেখানে পৃথিবীর মানুষসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছবি, শব্দ এবং বিভিন্ন ভাষার শুভেচ্ছাবাণী পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর বাইরে – যদি কোন বুদ্ধিমান প্রাণি থাকে তাহলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।

বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে প্রচুর শ্রম দিয়েছেন কার্ল স্যাগান। ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মাত্র ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কার্ল স্যাগান।


Sunday, 9 November 2025

James Watson – an extraordinary scientist, but an intolerable racist and misogynist man

 


The “Eagle” pub on the Cambridge campus has become as famous as Cambridge University itself, having witnessed hundreds of discoveries, innovations, and achievements. A plaque on the pub’s wall commemorates one such historic moment. Seventy-two years ago, on February 28, 1953, during lunchtime, Francis Crick and James Watson walked into the crowded pub and announced that they had discovered the “structure of DNA,” the secret of life.

While taking a photo of the plaque on the wall of the Eagle Pub, I was pleased to see that it also acknowledges the contributions of Rosalind Franklin and other scientists — recognition that James Watson himself never gave.


For discovering the structure of DNA, Francis Crick, Maurice Wilkins, and James Watson were awarded the Nobel Prize in 1962. Both Crick and Wilkins died in 2004. The third member of the trio, James Watson, passed away on November 6, 2025.

James Watson lived a long life of 97 years. He was born on April 6, 1928, in Chicago, USA. At the age of just 15, he entered the University of Chicago with a special scholarship. He graduated in zoology at 19 and earned his Ph.D. in zoology from Indiana University in 1950. In 1951, he began postdoctoral research at the Cavendish Laboratory, Cambridge, with Francis Crick. In 1953, at only twenty-five, he co-discovered the structure of DNA.

Rosalind Franklin was also researching the structure of DNA. In 1952, she took X-ray diffraction images of DNA, and based on her work, James Watson and Francis Crick were able to determine that DNA has a “double helix” structure. Maurice Wilkins collected the X-ray data. While Watson acknowledged Wilkins’ contribution, he not only failed to credit Rosalind Franklin but also used her X-ray images without her permission to publish their discovery of DNA’s structure. Whether the Nobel Committee would have recognized Rosalind Franklin’s contribution is uncertain, as she passed away in 1958 at the age of only 37 — four years before the Nobel Prize for the DNA discovery was announced in 1962.

After receiving the Nobel Prize, James Watson naturally achieved worldwide fame. From 1956 to 1976, he served as a professor of zoology at Harvard University. In 1968, he became the director of the Cold Spring Harbor Laboratory in New York. Under his leadership, the institution made significant contributions to molecular genetics and cancer research. From 1994 to 2003, he served as its president, and from 2003 to 2007, as its chancellor. From 2007 to 2019, he remained one of its leading scientists and esteemed members. However, in 2019, due to his racist views and remarks, he was removed from all positions at the institution, and all honours previously bestowed upon him were revoked.

Winning a Nobel Prize does not automatically make someone a great human being — and James Watson is one of the clearest examples of that. His contributions to science and research are undeniable. He led the Human Genome Project and strongly opposed granting copyright over genetic research, ensuring that genetic studies did not become the property of large corporations.



However, all his good work was tainted by his deep-rooted misogyny. In his 1968 memoir The Double Helix, he not only failed to acknowledge Rosalind Franklin’s scientific contributions but also made many disparaging remarks about her. Instead of highlighting her brilliance, he focused on trivial personal observations — that she didn’t wear fashionable clothes, didn’t use lipstick, and lacked feminine charm. Yet, he never once admitted that without Franklin’s X-ray diffraction images, it would have been impossible for them to decipher the structure of DNA so easily.

In the early 20th century, women’s participation in science was largely forbidden. Men often appreciated women’s charm far more than their intellectual abilities. Despite these barriers, by the late 20th century, women had made significant progress in scientific fields, and male attitudes began to change. Society no longer tolerates open misogyny and racism as it once did. But James Watson remained untouched by such change.

He continued to express his sexist views openly. He once argued that through genetic modification, all women could be made “beautiful.” He believed that an increase in the number of women in science would motivate men to work harder, thereby improving men’s performance — but that women themselves would not show similar intellectual advancement.

Watson also made absurd remarks about human physical traits. According to him, thin people are naturally unhappy and therefore more efficient at work, while fat people are inherently happy and thus less competent — so, in his view, overweight people should not be hired.

The most appalling aspect of Watson’s mindset was his attitude toward Black people. He bluntly claimed that Black people have lower IQs because of their DNA. In other words, he believed that no amount of social, economic, or political progress could improve their overall condition, since their genetic makeup was inherently inferior.

One of the admirable aspects of modern civilization is that such uncivilized views are no longer tolerated. Even a Nobel laureate is not above accountability when harbouring such beliefs. Watson eventually faced the consequences of his attitudes. The scientific community condemned his views; he lost his job and his honours. His situation became so dire that, in 2014, he auctioned off his Nobel Prize medal. It was bought by a Russian billionaire named Alisher Usmanov for nearly 4.8 million US dollars.

James Watson has passed away. History will acknowledge his great achievements, but it will also condemn his failings. History spares no one — and the history of science is even more unforgiving.

If I were to describe James Watson in just a few words, I would say that as a scientist he was extraordinary, but as a human being he was an intolerable racist and misogynist man.

Farewell, James Watson.


Saturday, 8 November 2025

জেমস ওয়াটসন – অসাধারণ বিজ্ঞানী, কিন্তু অসহ্য বর্ণবাদী নারীবিদ্বেষী পুরুষ

 



শত শত আবিষ্কার উদ্ভাবন কৃতিত্বের সাক্ষী হতে হতে ক্যাম্পাসের “ঈগল” পাবটিও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির মতোই বিখ্যাত হয়ে গেছে। পাবের দেয়ালে লাগানো ফলকটি এমনই একটি ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে। ৭২ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লাঞ্চটাইমে ভরাপাবে ঢুকে ফ্রানসিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা জীবনের রহস্য “ডি এন এ”-র গঠন আবিষ্কার করেছেন। ঈগল পাবের দেয়ালে লাগানো এই ফলকটির ছবি তুলতে গিয়ে আমার বেশ ভালো লেগেছে এটুকু দেখে যে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের অবদানকেও স্বীকার করা হয়েছে – যা জেমস ওয়াটসন নিজে কখনও করেননি।



ডিএনএ’র গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ফ্রানসিস ক্রিক, মরিস উইলকিন্স এবং জেমস ওয়াটসন। ফ্রানসিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্স মারা গেছেন ২০০৪ সালে। এই ত্রয়ীর তৃতীয় জন জেমস ওয়াটসন মারা গেছেন ৬ নভেম্বর।

৯৭ বছরের দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন জেমস ওয়াটসন।

১৯২৮ সালের ৬ ইপ্রিল আমেরিকার শিকাগো শহরে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বিশেষ স্কলারশিপ নিয়ে। ১৯ বছর বয়সে প্রাণিবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে পিএইচডি। ১৯৫১ সালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ শুরু করেন ফ্রান্সিস ক্রিকের সাথে। ১৯৫৩ সালে মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করেন।

ডিএনএ’র গঠন সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনও। ১৯৫২ সালে রোজালিন্ড ডিএনএর এক্স-রে করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএন-এর গঠন ‘ডাবল হিলিক্স’ আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। মরিস উইলকিন্‌স এক্স-রে ডাটা সংগ্রহ করেছিলেন। জেমস ওয়াটসন মরিসের গবেষণার স্বীকৃতি দিলেও রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের গবেষণার স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের কথা, তাঁর অনুমতি ছাড়াই তাঁর করা এক্স-রে চিত্র ব্যবহার করে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করে ফলাও করে তা প্রচার করেছেন। রোজালিন্ডের বৈজ্ঞানিক অবদানের স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার কমিটি দিতো কি না তা এখন বলা সম্ভব নয়। কারণ ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার চার বছর আগে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন মারা যান।

নোবেল পুরষ্কার পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন জেমস ওয়াটসন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত ওয়াটজন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞানের প্রফেসর ছিলেন। ১৯৬৮ সালে নিউইয়র্কের কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরির পরিচালকের দায়িত্ব নেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে মলিকিউলার জেনেটিক্স এবং ক্যান্সার গবেষণায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৪ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী এবং সম্মানিত সদস্য ছিলেন। কিন্তু ২০১৯ সালে তাঁর বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব এবং মন্তব্যের কারণে তাঁকে এই প্রতিষ্ঠানের সব পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং তাঁকে দেয়া সব সম্মান প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

নোবেল পুরষ্কার পেলেই যে কেউ মহামানব হয়ে যান না – তার অন্যতম প্রমাণ জেমস ওয়াটসন। বিজ্ঞান ও গবেষণায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জিনোম প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। জিন সংক্রান্ত গবেষণার কপিরাইটের বিরোধী ছিলেন তিনি – ফলে জিন-গবেষণা কোন বড় কোম্পানির সম্পত্তি হয়ে ওঠেনি।



কিন্তু সব ভালো কাজ কালিমালিপ্ত হয়ে গেছে তাঁর নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বৈজ্ঞানিক স্মৃতিচারণ গ্রন্থ “ডাবল হিলিক্স”-এ তিনি রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের বিজ্ঞান গবেষণাকে স্বীকৃতি দেননি তো বটেই, বরং অনেক অপমানজনক মন্তব্য করেছেন তাঁর সম্পর্কে। রোজালিন্ড ফ্যাশনেবল জামাকাপড় পরতেন না, লিপস্টিক ব্যবহার করতেন না, মেয়েলি কমনীয়তা ছিল না এসবই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর বইতে – কিন্তু একবারও উল্লেখ করেননি যে রোজালিন্ডের এক্স-রে চিত্র ব্যবহার না করতে পারলে তাঁদের পক্ষে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করা এত সহজ হতো না।

বিজ্ঞানের জগতে মেয়েদের অংশগ্রহণ বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষরা মেয়েদের কমনীয় সঙ্গ যতটা পছন্দ করে, মেয়েদের বৈজ্ঞানিক সত্ত্বাকে ততটা নয়। কিন্তু শত বাধা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানে মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেকটা বেড়েছে। পুরুষদের মনোভাবও ক্রমশ বদলাচ্ছে। প্রকাশ্য নারীবিদ্বেষী মনোভাব, বর্ণবিদ্বেষ চুপচাপ মেনে নেয়ার সংস্কৃতি বদলে গেছে। কিন্তু জেমস ওয়াটসনের ভেতর তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।

তিনি তাঁর নারীবিদ্বেষ প্রকাশ করেই চলেছেন। ডিএনএ পরিবর্তন করে সব মেয়েদের “সুন্দরী” করে ফেলার পক্ষপাতী তিনি। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানে মেয়েরা যত বেশি আসবে ছেলেরা ততই উৎসাহ পাবে, তাতে ছেলেদের কাজের উন্নতি হবে। কিন্তু মেয়েদের মানসিক উন্নতি সেভাবে হবে না।

মানুষের শারীরিক গঠন নিয়েও তিনি আজেবাজে কথা বলতেন। তাঁর মতে পাতলা মানুষ স্বভাবগতভাবে অসুখী, তাই কর্মক্ষেত্রে বেশি দক্ষতা দেখাতে পারে। আর মোটা মানুষ এমনিতেই সুখি, তাই কাজের ক্ষেত্রে তেমন দক্ষ নয়। তাই মোটা লোকদের চাকরি দেয়া উচিত নয়।

জেমস ওয়াটসনের সবচেয়ে জঘন্য মানসিকতার পরিচয় ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তাঁর মনোভাব। তিনি সরাসরি বলেছেন কৃষ্ণাঙ্গদের আই-কিউ কম – কারণ তাদের ডিএনএ। অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কোন উন্নয়নই তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাতে পারবে না – কারণ তাদের ডিএনএর গঠনই এরকম।

সভ্যতার প্রশংসাজনক দিক হলো – সভ্য সমাজ এধরনের অসভ্য মনোভাব সহ্য করে না। নোবেলজয়ী মানুষও যদি অসভ্য মনোভাব পোষণ করে – তাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস সভ্য সমাজে আছে। জেমস ওয়াটসনকেও তাঁর মনোভাবের দায় নিতে হয়েছে। বিজ্ঞানীসমাজ তাঁর মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছে। তিনি চাকরি হারিয়েছেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ২০১৪ সালে তিনি তাঁর নোবেল পদক নিলামে তোলেন। আলিশের উসমানভ নামে এক রাশিয়ান প্রায় ৪৮ লাখ ডলার দিয়ে তাঁর নোবেল পদক কিনে নেন।

জেমস ওয়াটসন মারা গেছেন। ইতিহাস তাঁর উঁচু কাজের স্বীকৃতি যেমন দেবে, তাঁর নীচু কাজের নিন্দাও তেমন করবে। ইতিহাস কাউকে ছাড় দেয় না, বিজ্ঞানের ইতিহাস তো আরো নির্মম।

কয়েক শব্দে যদি জেমস ওয়াটসনকে বর্ণনা করতে হয়, আমি বলবো বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি অসাধারণ, কিন্তু মানুষ হিসেবে একজন অসহ্য বর্ণবাদী নারীবিদ্বেষী পুরুষ।

বিদায় জেমস ওয়াটসন।



Friday, 7 November 2025

টেরি ওয়াগ্যান এর ‘দ্য লিটল বুক অব কমন সেন্স’

 



ইংরেজিতে যেটাকে আমরা কমন সেন্স বলি সেটা আসলে খুব একটা কমন নয়। বই পড়ে যদি কমন সেন্স শেখা যেতো – তাহলে অনেক অনেক বই পড়ে বড় বড় পাস দেয়া মানুষের ভেতরও ওই বস্তুটার এত অভাব দেখা যেতো না। অনেক বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম। সেখানে আমার এক সহকর্মী শিক্ষকদের কমন রুমে সবার সামনে বসে নাকের লোম ছিঁড়তেন এবং ছিন্নলোম ফুঁ দিয়ে উড়াতেন। কমন রুমের কমন সেন্স!! তিনি কি বই কম পড়েছেন?

বই পড়ে কমন সেন্স বাড়ানো যাবে না জেনেও স্যার টেরি ওয়াগ্যানের ‘দ্য লিটল বুক অব কমন সেন্স’ বইটি পড়ে ফেললাম। বইটি আক্ষরিক অর্থেও বেশ ‘লিটল’। মাত্র ১৩৩ পৃষ্ঠা, পৃষ্ঠার আকারও বেশ ছোট। পৃষ্ঠাগুলিতেও অনেক ফাঁকা জায়গা আছে, শব্দ দিয়ে আগাপাশতলা ভরিয়ে দেয়া হয়নি। ফলে পড়ে বেশ আরাম পাওয়া গেল।

স্যার টেরি ওয়াগ্যান ব্রিটিশ সাংবাদিক। ১৯৭২ থেকে বিবিসির মর্নিং শো উপস্থাপন করছেন। ২০০৫ সালে নাইটহুড পেয়েছেন। বইটির প্রতিটি লাইনে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং স্বভাবসুলভ হিউমার বইটিকে অত্যন্ত সুখপাঠ্য করে তুলেছে।

জীবনের বেশ কিছু অপরিহার্য বিষয়ে অত্যন্ত কার্যকর কিছু দর্শন তিনি প্রকাশ করেছেন মাত্র কয়েকটি শব্দে। যেমন গড সম্পর্কে বলেছেন, ভুলেও কখনও স্বীকার করবেন না যে আপনি ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। নিজের অবিশ্বাস নিজের কাছে রাখুন। নইলে সারাজীবন ধর্মীয় উপদেশ শুনেই কাটাতে হবে। জীবননাশের সম্ভাবনার কথা তিনি না লিখলেও তো আমরা সবাই জানি ব্যাপারটা কী।

মুখের উপর সত্য কথা বলার ইচ্ছে হলে তা যেন শুধুমাত্র এমন মানুষের কাছে বলেন যাদের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কারো সাথেও যদি অপ্রিয় সত্য কথা বলেন, নিজের ব্যাপারে অসম্ভব কুৎসিত কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে বলবেন।

মিথ্যা কথা অবশ্যই বলবেন, তবে অবশ্যই ধরা পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে বলবেন। কারণ মিথ্যা বেশিদিন চাপা থাকে না।

যা হয়ে গেছে তা নিয়ে বেশি আফসোস করবেন না। পেছনের দিকে তাঁকিয়ে হাঁটতে থাকলে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খাবেন।




প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, যৌনতা, চুম্বন, চাকরি, ধনসম্পদ ইত্যাদি নানারকম বিষয়ে ছোট ছোট বাক্যে তিনি মজার অথচ সত্যি সব কথা বলেছেন। আমাদের বাচালতার জন্য যুৎসই কয়েকটি লাইন তিনি লিখেছেন: জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা বলবেন না। যখন বলবেন যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত এবং মূল বিষয় বলবেন। নিজেকে জাহির করার জন্য বকবক করবেন না। লিফ্‌টে, বাসে, ট্রেনে আপনার রাজনৈতিক বক্তৃতা শুনতে কেউ পছন্দ করে না। যে কোনো পার্টিতে দেখবেন তার কাছে এসেই সবাই কথা বলতে চায় – যে চুপচাপ শোনে, কিন্তু নিজে কিছু বলে না।




বইটি খুবই মজার। কমনসেন্স বাড়লো কি না জানি না, পড়তে ভালো লাগলো, পড়ে ভালো লাগলো।


The Little Book of Common Sense

By Terry Wogan

Published by Orion, London, 2014.


Wednesday, 5 November 2025

Henry Cavendish: A Strange Man, an Extraordinary Scientist

 



The ladder of science and technology on which humanity has climbed so high was built upon the foundations laid in great research laboratories. If one were to list the most important of these, the first name would have to be the Cavendish Laboratory at the University of Cambridge. Research conducted in this single laboratory has, to date, earned thirty-one Nobel Prizes.

The Cavendish Laboratory was established in 1874, when Sir William Cavendish, the 7th Duke of Devonshire, was the Chancellor of the University of Cambridge. This renowned research laboratory was founded with funds provided by the Cavendish family—most of which had originally come from their distinguished ancestor, the 18th-century British scientist Henry Cavendish.

The laboratory was named the “Cavendish Laboratory” not only because it was built with Henry Cavendish’s fortune, but also to show due respect to this extraordinarily gifted scientist of the 18th century. Moreover, from the same family’s endowment, the University of Cambridge established the position of “Cavendish Professor of Physics.” The world-famous physicist James Clerk Maxwell was the first to hold this chair.

Who was this Henry Cavendish?
He was a total scientist, an extraordinary chemist and physicist. He was the first to separate the components of air, and the first to discover hydrogen gas. His contributions to physics were also immense. In the 18th century, using instruments of his own design, he determined the mass and density of the Earth. He also conducted remarkable studies on the nature of electric current—research so advanced that, had it been published in time, it would have caused a revolution in physics.

But Henry Cavendish was an extremely reclusive man. Because of this, he published barely one percent of his research. Many years after his death, the scientist James Clerk Maxwell examined Cavendish’s vast collection of unpublished notes and realized what extraordinary discoveries he had kept hidden from the world. Maxwell later edited and published part of Cavendish’s work on electricity. From this, scientists understood that—had his findings been made public in his own time—Cavendish would have been regarded as one of the pioneers alongside Coulomb, Faraday, and Ohm.

To say that Henry Cavendish disliked publicity would be a great understatement. He lived his entire life in solitude and seclusion, conducting his research alone. He never spoke to anyone about anything other than science. He never gave a lecture anywhere. After studying at the University of Cambridge for four years, he left without a degree—simply because he would have had to talk to other people.

In the 20th century, physicist Paul Dirac was known as an extremely taciturn and socially withdrawn scientist. Yet Dirac still taught as a professor, gave his Nobel lecture, and even married and had a family. Henry Cavendish, however, was antisocial to an extreme degree. He lived entirely alone all his life. After his mother’s death, he never spoke to, nor even looked at, another woman.

Henry’s father, Lord Charles Cavendish, was the third son of the 2nd Duke of Devonshire. His mother, Anne Grey, was the fourth daughter of Henry Grey, Duke of Kent. In honour of his grandfather, his parents named their first son Henry. Henry Cavendish was born on October 10, 1731, in Nice, France, where his parents were staying at the time. A few years later, after giving birth to her second son, Frederick, Anne Grey passed away. After her death, the two brothers were raised by their father under the care of household attendants. From childhood, Henry grew up to be extremely shy and withdrawn.

As the son of a wealthy aristocrat, he completed his schooling at Hackney Academy, a well-known private school in London. In 1748, at the age of 17, he entered St Peter’s College, Cambridge (now Peterhouse), majoring in chemistry and physics. After three years of study, he left the university in 1753, without sitting for his final examinations or obtaining any degree.

Coming from a family of great wealth and status, Cavendish never had to worry about a career—and he never did. His deep love for scientific research had begun in his school days, and at Cambridge he learned how to conduct scientific experiments. Reclusive by nature and utterly friendless, Henry Cavendish avoided direct conversation with anyone. He spent his days alone in his home laboratory, deeply absorbed in experiments with his instruments and apparatus.

Henry’s father, Charles Cavendish, held the title of Lord as the son of a Duke. He himself was also involved in scientific circles and was a member of the Royal Society. In 1758, he began introducing his son Henry to other members of the Royal Society. Although Henry disliked social conversation, he listened attentively to scientific discussions and enjoyed taking part in the committees and administrative work of the Society. Gradually, through his active involvement, Henry Cavendish was elected a Fellow of the Royal Society in 1765.

By that time, he had already built his own private laboratory at home. In 1764, he began research on the effects of arsenic. Over the next several years, he conducted studies related to heat, performing a series of experiments on the condensation of liquids and gases, through which he compiled a table of specific heats. Yet, he did not publish any of this work during his lifetime. When part of this research was finally published in 1783, it became clear that he had been the first to experimentally determine the specific heats of various gases.

Though he spent his days and nights absorbed in research for years on end, Cavendish had little interest in publishing his findings. During his fifty-year scientific career, he published only about twenty papers. His first paper, published in 1766 in the Philosophical Transactions of the Royal Society, dealt with the properties of gases produced in chemical reactions. For this remarkable work, he was awarded the Royal Society’s Copley Medal.

Henry Cavendish was the first scientist to conduct systematic research on the properties of hydrogen, carbon dioxide, and several other gases. He studied hydrogen so extensively that he is credited with its discovery. In his laboratory, Cavendish produced and collected various gases in bottles. By dissolving metals in acids, he generated hydrogen gas—though he never named it. Observing its flammable nature, he simply referred to it as “inflammable air.”

In 1783, the French chemist Antoine Lavoisier named this gas hydrogen and claimed full credit for the discovery. Cavendish also produced carbon dioxide by dissolving alkalis in acids and examined the properties of many different gases. His experiments effectively founded the study of gas chemistry, though the credit for this, too, was later claimed by Lavoisier.

From around 1770 onward, Cavendish performed extensive experiments on electric current, continuing for several decades. However, he published very little of these findings. In 1781, while passing electricity through water, he discovered that water is composed of hydrogen and oxygen—a fact unknown to anyone at that time. Yet even this momentous discovery failed to excite him enough to publish immediately.

Three years later, in 1784, he finally presented his results to the Royal Society, confirming that water is a compound of hydrogen and oxygen. But by then, James Watt had already published similar results. Although Cavendish had made the discovery earlier, his delay in publication led to suspicions among scientists that he might have copied Watt’s findings. Cavendish, however, was indifferent to fame or recognition—so he cared little about what others said or thought of him.

In 1785, Henry Cavendish calculated the percentage composition of air. His meticulous measurements showed that, after accounting for the proportions of oxygen and nitrogen, there was still a small fraction of air unaccounted for—indicating the presence of another gas besides oxygen and nitrogen. However, the identity of this mysterious component remained unknown for more than a century.

In 1890, British scientists William Ramsay and Lord Rayleigh discovered that the air also contains helium, argon, and other noble gases. Cavendish had lacked the kind of advanced instruments needed to detect these inert gases, which is why he could not identify them in his time.

During Cavendish’s era, Newton’s laws of motion formed the foundation of scientific research. By applying Newtonian mechanics, Cavendish deduced that heat is generated by the motion of particles.

In 1783, he published a paper on the temperature of mercury condensation, through which the concept of latent heat was first recognized. He was also the first to demonstrate the principle of conservation of energy in the context of heat.

Cavendish’s most important research was published in 1798, where he determined the density of the Earth. For this work, he constructed an extremely sensitive balance—a remarkable instrument that is still preserved today in the Cavendish Laboratory at Cambridge.

Having no personal relationships of any kind, Cavendish chose science as his sole pursuit and passion. He worked silently on several committees of the Royal Society, was a member of the Royal Society of Arts, a trustee of the British Museum, and a foreign member of the National Institute of France. He handled all official matters entirely on his own, and at committee meetings he rarely spoke—when he did, it was in one or two brief words. He never looked directly at anyone’s face while speaking.

In his personal life, Henry Cavendish was so eccentric that, from early youth until his death, he wore only one style of clothing. His tailor had standing instructions to make him an identical set of garments once a year on a fixed date. He never allowed anyone to paint his portrait. The only portrait of him that exists today—preserved in the British Museum—was secretly painted by an artist who observed him from a distance.

Cavendish was extremely conservative and reserved regarding women. After his mother died when he was just two years old, he never again spoke to a woman. To avoid even encountering the maids in his household, he built a separate staircase for them to use. He communicated with his assistants only in writing, never by speech.

During his experiments on electric currents, he initially conducted low-voltage electrical tests on himself, carefully recording his sensations. Later, he began experimenting on his servants, which terrified many of them into quitting.

On one occasion, when an American scientist visited his laboratory out of curiosity, Cavendish proposed—again, in writing—to pass electricity through him as part of an experiment. Horrified, the visitor fled and later remarked,

“If a British scientist ever came to America, we would never offer to make him a guinea pig!”

After living a solitary and monotonous life, Henry Cavendish’s wealth had grown to over one million pounds by the year 1800—an amount equivalent to about one hundred million pounds today. In his will, he left all his fortune to his relatives and assistants. He passed away on February 24, 1810.

From the inheritance of his relatives, a large portion of that money was later used—sixty-four years after his death—to establish the Cavendish Laboratory, which continues to honour his legacy. From this single laboratory have come some of the greatest scientific discoveries in history: the electron, the neutron, the structure of DNA, pulsars, radio astronomy, cosmic rays, and many more to come.

 

References:

  1. John West, American Journal of Lung Cell and Molecular Physiology, Vol. 307, 2014.
  2. Euan James, Remarkable Physicists, Cambridge University Press, 2004.
  3. Russell McCormmach, The Personality of Henry Cavendish, Springer, 2014.

Thursday, 30 October 2025

হেনরি ক্যাভেন্ডিস: অদ্ভুত মানুষ, অসাধারণ বিজ্ঞানী


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির যে সিঁড়ি ধরে পৃথিবীর মানুষ এত উপরে উঠে এসেছে সেই সিঁড়ির ভিত্তি তৈরি হয়েছে যেসব গবেষণাগারে, সেসব গবেষণাগারের নাম লিখতে হলে প্রথমেই লিখতে হবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের নাম। এই একটি মাত্র গবেষণাগার থেকে উদ্ভূত গবেষণা এপর্যন্ত অর্জন করেছে একত্রিশটি নোবেল পুরষ্কার। এই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭৪ সালে। সেই সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন ডেভনশায়ারের সপ্তম ডিউক স্যার উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিস। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিখ্যাত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্যাভেন্ডিস পরিবারের টাকায়- যার বেশিরভাগই এসেছিল তাঁদের পূর্বপুরুষ অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসের কাছ থেকে। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই শুধু নয়, উনবিংশ শতাব্দীর অসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এই গবেষণাগারের নাম রেখেছে ‘ক্যাভেন্ডিস ল্যাব’। শুধু তাই নয়, ক্যাভেন্ডিস পরিবারের দেয়া টাকা থেকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর অব ফিজিক্স’ পদ। পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ছিলেন এই পদের প্রথম প্রফেসর।

কে ছিলেন এই হেনরি ক্যাভেন্ডিস? তিনি ছিলেন একাধারে অসাধারণ রসায়নবিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম বাতাসের উপাদানগুলি আলাদা করেছিলেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন হাইড্রোজেন গ্যাস। পদার্থবিজ্ঞানেও তাঁর অবদান ছিল সীমাহীন। পৃথিবীর ভর এবং ঘনত্ব নির্ণয় করেছিলেন – সেই আঠারো শতকে নিজের তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে। বিদ্যুৎ প্রবাহের ধর্ম সম্পর্কে এমন সব গবেষণা করেছিলেন – যেগুলি যথাসময়ে প্রকাশিত হলে পদার্থবিজ্ঞানে আলোড়ন পড়ে যেতো। কিন্তু অদ্ভূত রকমের নিভৃতচারি ছিলেন বলে হেনরি ক্যাভেন্ডিস তাঁর গবেষণার এক শতাংশও প্রকাশ করেননি। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল হেনরি ক্যাভেন্ডিসের গবেষণার রাশি রাশি কাগজপত্র দেখে বুঝতে পেরেছিলেন কী অসাধারণ সব গবেষণার ফলাফল লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দিয়েছেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস। ক্যাভেন্ডিসের বৈদ্যুতিক কাজের গবেষণার কিছুটা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন ঠিক সময়ে প্রকাশিত হলে কুলম্ব, ফ্যারাডে কিংবা ওহমের মতো যুগান্তকারী কাজের মর্যাদা পেতেন তিনি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিস প্রচারবিমুখ ছিলেন বললে খুবই কম বলা হয়। তিনি সারাজীবন একাকী নিভৃতে বসবাস করেছেন। একাকী গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কারো সাথে কোন কথা বলেননি। কোথাও কোন বক্তৃতা দেননি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়াশোনা করার পর ডিগ্রি ছাড়াই বের হয়ে গেছেন শুধুমাত্র অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে বলে। বিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাককে আমরা অসম্ভব স্বল্পভাষী অসামাজিক ধরনের বিজ্ঞানী হিসেবে চিনেছি। তবুও পল ডিরাক অধ্যাপনা করেছেন, নোবেল বক্তৃতা দিয়েছেন, এমনকি বিয়ে করে ঘরসংসারও করেছেন। কিন্তু  হেনরি ক্যাভেন্ডিস ছিলেন চরম মাত্রায় অসামাজিক। সারাজীবন একা কাটিয়েছেন। নিজের মায়ের মৃত্যুর পর অন্য কোন মহিলার সাথে কোনোদিন কোনো বাক্যবিনিময় তো দূরের কথা, দৃষ্টি বিনিময়ও করেননি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসের বাবা লর্ড চার্লস ক্যাভেন্ডিস ছিলেন ডেভনশায়ারের দ্বিতীয় ডিউকের তৃতীয় পুত্র। হেনরির মা অ্যানি গ্রে ছিলেন কেন্টের ডিউক হেনরি গ্রের চতুর্থ কন্যা। নিজের বাবার নামেই তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন – হেনরি। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের জন্মের সময় তাঁর মা-বাবা ছিলেন ফ্রান্সের নিস শহরে। সেখানেই ১৭৩১ সালের ১০ অক্টোবর হেনরি ক্যাভেন্ডিসের জন্ম। দু’বছর পর দ্বিতীয় পুত্র ফ্রেডেরিকের জন্মদানের কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় অ্যানি গ্রের। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দায়িত্বেই বড় হতে থাকে হেনরি ও ফ্রেডেরিক। পরিচারকদের তত্ত্বাবধানে কেটেছে হেনরির শৈশব। তখন থেকেই প্রচন্ড লাজুক স্বভাব নিয়ে বেড়ে উঠেছেন হেনরি।

বড়লোকের ছেলে হিসেবে লন্ডনের নামকরা প্রাইভেট স্কুল হেকনি একাডেমি থেকে হাইস্কুলের পড়া শেষ করেন হেনরি। ১৭৪৮ সালে ১৭ বছর বয়সে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সেন্ট পিটারস কলেজে ভর্তি হন। রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের মেজর সাবজেক্ট নিয়ে তিন বছর পড়াশোনা করার পরও ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে কোন ধরনের ডিগ্রি ছাড়াই ১৭৫৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ত্যাগ করেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস।

পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও আভিজাত্য থাকার কারণে ক্যারিয়ার নিয়ে কখনোই ভাবতে হয়নি হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে। তিনি ভাবেনওনি। বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা জন্মেছে সেই স্কুল থেকেই। কেমব্রিজে লেখাপড়া করার সময় শিখেছেন কীভাবে বিজ্ঞানগবেষণা করতে হয়। একেবারেই নির্বান্ধব স্বতন্ত্র স্বভাবের হেনরি কারো সাথেই সরাসরি কোনো কথাবার্তা বলতেন না। নিজের বাড়িতে যন্ত্রপাতি নিয়ে নানারকমের গবেষণায় ব্যস্ত থাকতেন তিনি সবসময়।

হেনরির বাবা চার্লস ক্যাভেন্ডিস ডিউকের সন্তান হিসেবে লর্ডের মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন। নিজেও বৈজ্ঞানিক সমিতির সাথে যুক্ত থাকতেন। রয়েল সোসাইটির মেম্বার ছিলেন তিনি। ১৭৫৮ সাল থেকে তিনি তাঁর ছেলে হেনরিকে রয়েল সোসাইটিতে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন অন্যান্য সদস্যদের সাথে। হেনরি সামাজিক কথাবার্তা পছন্দ না করলেও বৈজ্ঞানিক আলোচনাগুলি মনযোগ দিয়ে শুনতেন। রয়েল সোসাইটির বিভিন্ন কমিটির কাজকর্ম করতে পছন্দ করতেন। এভাবে কাজ করতে করতে ১৭৬৫ সালে তিনি নিজেও রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।

ততদিনে তিনি নিজের বাড়িতে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার তৈরি করেছেন। ১৭৬৪ সালে গবেষণা শুরু করলেন আর্সেনিকের প্রভাব সম্পর্কে। এরপর কয়েক বছর ধরে করলেন তাপ সংক্রান্ত গবেষণা। তরল ও গ্যাসের ঘনীভবন নিয়ে ধারাবাহিক পরীক্ষণের মাধ্যমে তিনি তৈরি করলেন আপেক্ষিক তাপের তালিকা। কিন্তু এই গবেষণার কিছুই তিনি প্রকাশ করলেন না। ১৭৮৩ সালে এই গবেষণার কিছু অংশ প্রকাশিত হবার পর জানা যায় তিনিই প্রথম বিভিন্ন গ্যাসের আপেক্ষিক তাপ নির্ণয় করেছিলেন পরীক্ষণের মাধ্যমে।

বছরের পর বছর দিনরাত গবেষণায় ব্যস্ত থাকলেও – গবেষণার ফলাফল প্রকাশের ব্যাপারে তেমন কোন উৎসাহ ছিল না তাঁর। পঞ্চাশ বছরের গবেষণাজীবনে মাত্র বিশটির মতো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৬৬ সালে রয়েল সোসাইটির ফিলোসফিক্যাল ট্রানিজেকশানে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে যে গ্যাস বের হয় – তাদের ধর্ম সংক্রান্ত এই গবেষণাপত্রের জন্য তিনি লাভ করেন রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসই প্রথম ধারাবাহিকভাবে গবেষণা করেন হাইড্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড  এবং অন্যান্য গ্যাসের ধর্ম সম্পর্কে। হাইড্রোজেনের ধর্ম সম্পর্কে তিনি এত বেশি গবেষণা করেছেন যে তাঁকে হাইড্রোজেন গ্যাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়। তিনি তাঁর গবেষণাগারে অনেকগুলি গ্যাস তৈরি করে বোতলে সংগ্রহ করে রাখেন। এসিডে ধাতু দ্রবীভূত করে তিনি তৈরি করেছিলেন হাইড্রোজেন গ্যাস। যদিও তিনি এই গ্যাসের নাম দেননি। এই গ্যাসের দাহ্য রূপ দেখে তিনি একে দাহ্যগ্যাস হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ১৭৮৩ সালে ফরাসি রসায়নবিদ আন্তন ল্যাভয়সিয়ের এই গ্যাসের নামকরণ করেন হাইড্রোজেন এবং সমস্ত কৃতিত্ব নিয়ে নেন। হেনরি ক্যাভেন্ডিস এসিডে ক্ষার দ্রবীভূত করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করেন। অনেক ধরনের গ্যাস তৈরি করে তাদের ধর্ম পরীক্ষা করেছিলেন তিনি। গ্যাস কেমিস্ট্রির সূচনা হয় তাঁর হাতে। যদিও পরে এর কৃতিত্বও নিয়ে নেন ল্যাভয়সিয়ের।

১৭৭০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক দশকে বিদ্যুৎপ্রবাহ সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি। কিন্তু বেশিরভাগ গবেষণার ফলাফল তিনি প্রকাশ করেননি। পানির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ-প্রবাহ চালনা করার সময় ১৭৮১ সালে তিনি আবিষ্কার করলেন যে পানি মূলত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের সমষ্টি। এতদিন পানি যে যৌগিক পদার্থ তা জানা ছিল না কারো। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশেও তাঁর তেমন কোন উৎসাহ দেখা যায়নি। তবে তিন বছর পর ১৭৮৪ সালে তিনি পানি যে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সম্মিলিত প্রভাব – তা রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর আগেই একই রকম আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশ করেছেন জেমস ওয়াট। আগে আবিষ্কার করলেও ফলাফল দেরিতে প্রকাশ করার কারণে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হয় – হেনরি ক্যাভেন্ডিস জেমস ওয়াটের ফলাফল চুরি করেছেন কি না। কোন ধরনের কৃতিত্বের মুখাপেক্ষি ছিলেন না হেনরি ক্যাভেন্ডিস – তাই কে কী বললো তাতে তার কিছুই যায় আসেনি।

১৭৮৫ সালে হেনরি ক্যাভেন্ডিস বাতাসের উপাদানগুলির শতকরা পরিমাণ হিসেব করেন। তাঁর নিখুঁত হিসেব থেকে দেখা যায় বাতাসে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের শতকরা পরিমাণ হিসেব করার পর কিছু অংশ তখনো কম থাকে। অর্থাৎ অন্য অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন ছাড়াও অন্য কোন গ্যাস বাতাসে মিশে আছে। কিন্তু কী সেই গ্যাস তা জানা যায়নি পরবর্তী একশ বছরেও। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম রামজে এবং লর্ড রেলেই আবিষ্কার করেন যে বাতাসে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন ছাড়া হিলিয়াম আর্গন ইত্যাদি নিষ্ক্রিয় গ্যাস মিশ্রিত আছে। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের কাছে নিষ্ক্রিয় গ্যাস শনাক্ত করার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না বলেই তিনি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি সেই সময়।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসের সময় নিউটনের গতিসূত্রই ছিল গবেষণার মূল ভিত্তি। নিউটনের গতিবিদ্যা কাজে লাগিয়েই হেনরি ক্যাভেন্ডিস আবিষ্কার করেছিলেন পদার্থের গতির ফলেই তাপের সৃষ্টি হয়।

১৭৮৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন পারদের ঘনীভবনের তাপমাত্রা সংক্রান্ত গবেষণাপত্র। সেখান থেকেই প্রথম জানা যায় পদার্থের সুপ্ততাপ বা ল্যাটেন্ট হিটের ব্যাপারটি। তিনিই প্রথম হিসেব করে দেখান তাপের ক্ষেত্রে শক্তির রক্ষণশীলতার নীতি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিস তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন ১৭৯৮ সালে – যেখানে তিনি পৃথিবীর ঘনত্বের হিসেব করেছেন। এই গবেষণায় তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন খুবই সংবেদী নিক্তি – যেটা এখনো কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে রক্ষিত আছে।

কারো সাথেই কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক না রেখে শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি তাঁর একমাত্র আগ্রহের বস্তু হিসেবে। রয়েল সোসাইটির বেশ কয়েকটি কমিটিতে তিনি কাজ করেছেন আক্ষরিক অর্থেই নিরবে। রয়েল সোসাইটি অব আর্টের সদস্য ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ট্রাস্টি ছিলেন, এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ফ্রান্সেরও বিদেশী সদস্য ছিলেন তিনি। দাপ্তরিক কাজকর্ম তিনি করতেন একা। কমিটির কোন মিটিং-এ তিনি কোন কথা বলতেন না। নিতান্তই বলতে হলে এক শব্দ দু’শব্দে কাজ সারতেন। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কোনদিন কথা বলেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এতটাই অদ্ভুত ছিলেন যে যৌবনের শুরু থেকে আমৃত্যু শুধুমাত্র এক ধরনের পোশাকই পরে গেছেন। তাঁর দর্জিকে নির্দেশ দেয়া ছিল প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে হুবহু একই ধরনের এক সেট পোশাক তাঁকে তৈরি করে দেয়ার। তাঁর পোট্রেট তৈরি করার অনুমতি তিনি কাউকে কোনদিন দেননি। তাঁর একটিমাত্র পোট্রেট যা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে – আঁকা হয়েছিল গোপনে তাঁকে দূর থেকে দেখে দেখে।

তিনি মেয়েদের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ রকমের রক্ষণশীল। দুই বছর বয়সে নিজের মায়ের মৃত্যুর পর তিনি আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেননি। বাড়িতে কাজের মেয়েদের সাথে যেন দেখা না হয়ে যায় – সেজন্য তিনি তাদের জন্য আলাদা সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সহকারীদের সাথেও কথা বলতেন না, নির্দেশ দিতেন – কাগজে লিখে। তবে বিদ্যুৎ প্রবাহ সম্পর্কিত গবেষণাগুলি করার সময় তিনি শুরুতে নিজের শরীরে কম মাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করে নিজের অনুভূতি লিখে রেখেছেন। এরপর শুরু হয়েছিল তাঁর কাজের লোকদের উপর বিদ্যুৎ চালনা। অনেকে ভয়ে কাজ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। একবার এক আমেরিকান অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগার দেখতে এলে তিনি তাঁর উপর দিয়েও বিদ্যুৎ চালনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন – অবশ্যই লিখিত প্রস্তাব। ভয় পেয়ে সেই আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী পালিয়ে গিয়ে পরে মন্তব্য করেছিলেন, “কোন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আমেরিকায় এলে আমরা তাকে গিনিপিগ হবার প্রস্তাব করতাম না।“

সারাজীবন একা একঘেঁয়ে জীবন কাটিয়ে শেষ বেলায় তাঁর অর্থ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল সেই ১৮০০ সালে এক মিলিয়ন পাউন্ডের উপর, যার বর্তমান মূল্যমান প্রায় একশ কোটি পাউন্ড। সেই অর্থের পুরোটাই তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং সহকারীদের উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

 তাঁর আত্মীয়দের অংশ থেকেই একটি বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে তাঁর মৃত্যুর ৬৪ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্যাভেন্ডিস ল্যাব – যা তাঁর গৌরব বয়ে চলেছে। যে ল্যাব থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ইলেকট্রন, নিউট্রন, ডিএনএর গঠন, পালসার, রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি, কসমিক রে – এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছুর সম্ভাবনা।

 

তথ্যসূত্র

১। জন ওয়েস্ট, আমেরিকান জার্নাল অব লাং সেল মলিকিউলার ফিজিওলজি, সংখ্যা ৩০৭, ২০১৪।

২। ইওয়ান জেমস, রিমার্কেবল ফিজিসিস্টস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।

৩। রাসেল ম্যাককরমাক, দ্য পার্সোনালিটি অব হেনরি ক্যাভেন্ডিস, স্প্রিঙ্গার, ২০১৪।

__________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Saturday, 18 October 2025

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

 



যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগত থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশা, নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রতি প্রবল আগ্রহ। অনেক সময়েই দেখা যায় তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলাফল যেসব জার্নালে প্রকাশিত হয়, এবং যে বৈজ্ঞানিক ভাষায় সেসব লেখা হয় – তা থাকে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে। ফলে এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অনেকসময়ই অজ্ঞাত থেকে যায়। বৈজ্ঞানিক ভাষাকে সাধারণ ভাষায় রূপান্তর করে বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকদের কাছে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি। যেসব দেশে বিজ্ঞানপত্রিকার চাহিদা বেশি, সেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত। সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হবার লক্ষ্যে শৈশব কৈশোর থেকে প্রস্তুত হতে থাকে। বলা যায়, কোন দেশের বিজ্ঞানচর্চার ভিত তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে প্রধান ভূমিকা রাখে বিজ্ঞানপত্রিকাগুলি। আমাদের দেশে গত নয় বছর ধরে সেই ভূমিকা রেখে চলেছে মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানচিন্তার দশম বর্ষপূর্তিতে বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশনার সাথে যাঁরা যুক্ত, লেখক এবং পাঠক সবাইকে জানাই অভিনন্দন।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামী দুটো বিজ্ঞান সাময়িকীর নাম উল্লেখ করতে হলে – প্রায় সবাই একমত হয়ে বলবেন ‘সায়েন্স’ এবং ‘ন্যাচার’-এর কথা। ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ন্যাচার’ যাত্রা শুরু করেছিল ১৮৬৯ সালে। আর আমেরিকান বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ শুরু হয়েছে ১৮৮০ সাল থেকে। সেই থেকে প্রতি সপ্তাহে এই সাময়িকী দুটো প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবং প্রতিটি সংখ্যায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই সাময়িকী দুটোর যে-কোনো একটিতে কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারলে বিজ্ঞানীদের গৌরব বেড়ে যায় তরতর করে। এই জার্নাল দুটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো – এখানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জটিল প্রক্রিয়া এবং ফলাফল যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি সাধারণ পাঠকদের বোঝার জন্য পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান-প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। সেজন্যই বিজ্ঞানীসমাজে তো বটেই, সাধারণ পাঠক সমাজেও এই সাময়িকী দুটোর গুরুত্ব অসীম।

জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ের ম্যাগাজিনের নাম বলতে গেলে প্রথমেই আসে সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর নাম। ১৮৪৫ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ম্যাগাজিন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ফলাফল বিজ্ঞানসাময়িকীতে প্রকাশিত হলে বা কোন গবেষণাগারে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেলে তা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য আকারে প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ। একই আদলে যুক্তরাজ্যের ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ প্রকাশিত হয়ে আসছে ১৯৫৬ সাল থেকে। সে তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার দশ বছর – সবে মাত্র যাত্রা শুরু হবার সমতুল্য।

জনসংখ্যার অনুপাতে আমেরিকা ও ইওরোপে যত সংখ্যক বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশিত হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞান সাময়িকী নেই বললেই চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের সমাজ খুবই বিজ্ঞানবিমুখ সমাজ। এর পেছনে আর্থসামাজিক কারণ যেমন রয়েছে – খুব প্রকটভাবে আছে রাজনৈতিক কারণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর। সেখানে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনের কৌশল শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয় বেশি। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যত সংখ্যক বিজ্ঞানশিক্ষার্থী আছে – তার সংখ্যা অনেক দেশের মোট শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানী তৈরি হয় খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যবর্তী ফাঁক পূরণ করতে পারে বিজ্ঞান সাময়িকী। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা চেষ্টা করে যাচ্ছে সেব্যাপারে কীভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করা যায়।

আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা নিয়মিত বিজ্ঞান পড়ান, এবং কেউ কেউ যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান-লেখকের সংখ্যা খুবই কম, সম্ভবত পাঠকের সংখ্যাও । যেটুকু পড়াতে হবে – তার বাইরে নিজেরাও নতুন কিছু জানার জন্য কতটুকু পড়াশোনা করেন তা আমার জানা নেই। তবে খুবই ভালো হতো – যদি তাঁরাও নিয়মিত বিজ্ঞানচর্চা করতেন, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করতেন।

বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত লেখা প্রকাশের পাশাপাশি সারাদেশে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেক প্রকল্প চালু রেখেছে। নানা বিষয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজনে সক্রিয় সহযোগিতা করছে। এসবের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যে তৈরি করতে পারছে তাতে বোঝা যায় যে বিজ্ঞানচিন্তা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

বিজ্ঞানচিন্তার হাত ধরে আমাদের সমাজ আরো অনেক বিজ্ঞানপ্রেমী, বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা।

--------

বিজ্ঞানচিন্তার অনলাইনে প্রকাশিত:

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

Sunday, 28 September 2025

তেজস্ক্রিয় সুপারহিরো: কল্পনা ও বিজ্ঞান

 




নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর রবার্ট ব্রুস ব্যানারকে আমরা অনেকেই চিনি। তাঁর চেয়েও বেশি চিনি তাঁর দ্বিতীয় সত্ত্বা হাল্ক-কে যিনি রেগে গেলে মানুষ থেকে প্রচন্ড শক্তিশালী ‘দৈত্য’ হয়ে ওঠেন এবং সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলেন। দুটো চরিত্রই কাল্পনিক; একটুখানি বিজ্ঞানের সাথে অনেকখানি কল্পনার মিশেলে তৈরি। এরকম আরো অনেক সুপারহিরো-সুপারভিলেনের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে কমিক বইতে, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় টেলিভিশনে।

কার্টুনের মাধ্যমে গল্প বলার নতুন ধারা কমিক বইয়ের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৯৭ সালে “দ্য ইয়েলো কিড ইন ম্যাকফ্যাডেন্স ফ্ল্যাটস”প্রকাশের মাধ্যমে। কল্পবিজ্ঞানের প্রথম সুপারহিরো সুপারম্যান। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যালাইড পাব্লিকেশান্স থেকে প্রকাশিত ‘অ্যাকশান কমিক্স’-এর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছিল সুপারম্যানের যাত্রা।

সেইসময় পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নভোযান প্রস্তুত করছিলেন মহাকাশে অভিযান শুরু করার লক্ষ্যে। তারই প্রতিফলন ঘটছিলো অ্যাকশান কমিক্সের চরিত্রগুলোতে। সুপারম্যানের জন্ম ক্রিপটন নামক এক কাল্পনিক গ্রহে – যে গ্রহ লাল নক্ষত্র রাও-এর চারপাশে ঘুরে। ক্রিপটনের বিজ্ঞানী দম্পতি জর-এল এবং লারা-এল যখন দেখলেন তাঁদের গ্রহ ক্রিপটন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে – তখন তাঁরা ছোট্ট একটি মহাকাশযান তৈরি করে তাঁদের একমাত্র সন্তান ক্যাল-এলকে সেখানে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্রিপটন গ্রহ ধ্বংস হয়ে যায়। কাল-এল নানারকম মহাকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছায় পৃথিবী নামক গ্রহে। এখানেই কাল-এল পেয়ে যায় প্রচন্ড শক্তি, প্রচন্ড গতি, উড়ার ক্ষমতা, এক্স-রের মতো দৃষ্টিক্ষমতা। হয়ে ওঠে আমাদের সুপারম্যান।

সুপারম্যানের জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন সুপারহিরো – সুপারভিলেন। ব্যাটম্যান, জোকার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ওয়ান্ডার ওম্যান, সুপারগার্ল, স্পাইডারম্যান, হাল্ক, থর, এক্স-ম্যান, আয়রন-ম্যান – সবাই শারীরিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী – প্রচলিত প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অনেক নিয়মই এদের ক্ষেত্রে খাটে না। এরা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করতে পারে, নিউটনের গতির সূত্র কিংবা শক্তির সংরক্ষণশীলতার ক্ষমতা নেই এদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ কিংবা সার্বিক কোন আইনই এরা মানে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক টানেলিং কিংবা এন্টেঙ্গেলমেন্ট-এর অসম্ভবকে এরা বাস্তবেই কাজে লাগাচ্ছে অবলীলায়। বাস্তব বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে কল্পনার এই চরিত্রগুলো।

সুপারহিরোদের অনেকের ভেতরের অফুরন্ত শক্তির উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প তৈরি করতে গিয়ে বিকিরণ বিজ্ঞানের অপব্যবহার করা হয়েছে সবক্ষেত্রেই। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

(১) দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক: আমেরিকার একটি সরকারি গবেষণাগারের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী ব্রুস ব্যানার ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। খুবই দায়িত্বশীল মানবিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে একটি ‘গামা বোমা’ তৈরি করছিলেন। বোমা তৈরির পর ওটার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় তিনি দেখতে পেলেন বিপদসীমার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়েছে একজন তরুণ। রিক জোন্স নামের এই তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ব্রুস ব্যানার। তেজস্ক্রিয় গামা রশ্মির প্রভাবে তার শরীরের কোষ এবং স্নায়ুকোষের ডিএনএ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যে – যদি তিনি কোনোভাবে রেগে যান – তাহলে তাঁর শরীরের সবগুলি পেশী এমনভাবে ফুলে উঠে যে তিনি প্রচন্ড শক্তিশালী সবুজ দৈত্য – হাল্ক-এ রূপান্তরিত হয়ে যান। রাগ যত বাড়তে থাকে তাঁর বিধ্বংসী ক্ষমতাও তত বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞানের বাস্তবতার সাথে এই গল্প মেলাতে গেলে সমস্যা হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে শরীরের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটতে পারে এটা সত্য। বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে শরীরের সবগুলি ডিএনএর গঠন ভেঙে গিয়ে বেশিরভাগ কোষ মরে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বিকিরণের ফলে ওরকম দৈত্যে পরিণত হওয়ার মধ্যে কোনো প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞান নেই।

(২) স্পাইডারম্যান: স্কুলছাত্র পিটার পার্কার গিয়েছিল একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি প্রদর্শনীতে একটি মাকড়শা হঠাৎ তেজস্ক্রিয় কণার প্রবাহের মাঝখানে চলে আসে এবং নিজেই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই মাকড়শাটি পিটার পার্কারকে কামড় দেয়ার সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় মাকড়শার পরিবর্তিত ডিএনএ পিটার পার্কারের শরীরে প্রবেশ করে। তাতে পিটার পার্কারের ভেতর প্রচন্ড শক্তির সঞ্চার হয়। তীব্র দৈত্যাকার মাকড়শার মতো সে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে, জাল তৈরি করে সেখানে ঝুলে থাকতে পারে – ইত্যাদি।

এই গল্পেও বিজ্ঞানের মারাত্মক অপব্যবহার করা হয়েছে। মারাত্মক বিষধর মাকড়শার কামড়ে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে – কিন্তু মানুষ মাকড়শায় পরিণত হতে পারে না।

(৩) রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান: চায়নিজ নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী চেন লু নিজেকে জীবন্ত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরে পরিণত করার লক্ষ্যে গবেষণাগারে নিজের উপর পরিকল্পিতভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটান। প্রচুর নিউক্লিয়ার বিকিরণ শোষণ করে নিজেই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয়তার উৎসে পরিণত হন এবং হয়ে ওঠেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। যখন খুশি তিনি নিজের শরীর থেকে রেডিয়েশান নির্গমন করে যাকে খুশি ধ্বংস করে দিতে পারেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। আবার অন্য কোন উৎস থেকে রেডিয়েশান নির্গত হলে তা  শোষণও করতে পারেন।

এই গল্পের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যে কীরকম অতিরঞ্জন তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। একটি ছোটখাট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর তৈরি করতেও যে পরিমাণ জটিল অবকাঠামো তৈরি করতে হয়, তার সবকিছু একজন মানুষের শরীরের ভেতরই হয়ে যাবে?

(৪) ডক্টর ম্যানহ্যাটন – পদার্থবিজ্ঞানী জন ওস্টারম্যান একটি বিপজ্জনক গবেষণা করার সময় দুর্ঘটনাবশত শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে আটকা পড়েন। তাতে তাঁর সম্পূর্ণ শরীর বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেলেও তিনি মারা যাননি। কয়েক মাস পর দেখা যায় তাঁর শরীরের সবগুলি কোষ আস্তে আস্তে আবার পুনর্গঠিত হয়ে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন নীল জেলির মতো দেখতে ‘ডক্টর ম্যানহাটন’-এ পরিণত হন যিনি ভর, শক্তি এবং সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এখানেও বাড়াবাড়ি রকমের অতিরঞ্জিত করা হয়েছে পদার্থ ও শক্তির রূপান্তরের পদার্থবিজ্ঞানকে। পারমাণবিক বিক্রিয়ার কোন সূত্র দিয়েই এই রূপান্তর বাস্তবে সম্ভব নয়।

(৫) ফায়ারস্টর্ম – ডিসি কমিক্‌স-এর ফায়ারস্টর্মকে নিউক্লিয়ার ফিউশানের সাথে তুলনা করা হয়। গল্পে পদার্থবিজ্ঞানী মার্টিন স্টেইন এবং তার ছাত্র রনি রেমন্ড নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে একটি বিস্ফোরণের ফলে দুজন একসাথে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হয় ফায়ারস্টর্ম – যেখান থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি পাওয়া যায়।

এখানেও যে বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি রকমের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুজন মানুষের এক হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশান রিঅ্যাক্টর হয়ে যাওয়া অসম্ভব। 

(৬) ক্যাপ্টেন অ্যাটম – গল্পের ন্যাথানিয়েল অ্যাডম ছিলেন সামরিক বিজ্ঞানী। ভয়াবহ এক নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে তিনি মারা যান। কিন্তু দেখা যায় অনেক বছর পর তিনি ধাতব মানুষ রূপে আবির্ভূত হন যিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে শক্তি আহরণ করতে পারেন।

এখানে কোয়ান্টাম ফিল্ডের শক্তি ও পরমাণুর জটিল তত্ত্বের অপব্যবহার করে এমন এক  জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে ধাতব পদার্থেরও প্রাণ আছে।

(৭) দ্য লিডার – মার্ভেল কমিকস এর গল্পের স্যামুয়েল স্টার্নস ছিলেন একজন ঝাড়ুদার। রেডিয়েশান ল্যাবরেটরি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার বদলে তাঁর মগজের কোষের পরিবর্তন হয়। তিনি হয়ে যান অতিবুদ্ধিমান। বুদ্ধি দিয়ে তিনি হাল্ককে পরাজিত করতে চান।

 এখানেও তেজস্ক্রিয়তার ধর্মকে বিকৃত করা হয়েছে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মস্তিষ্কের কোষের বুদ্ধিমত্তা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাস্তবে অসম্ভব।

(৮) নিউক্লিয়ার ম্যান – সুপারম্যান সিরিজের চতুর্থ সিজনে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের এমন অপব্যবহার করা হয়েছে যে আঁৎকে উঠতে হয়। গল্পে দেখানো হয়েছে – সুপারম্যানের ডিএনএ নিয়ে তা নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগ করে সূর্যের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সূর্যের সৌরশক্তির সাথে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ম্যান – যার ভেতর সুপারম্যানের সব গুণাবলি এবং শক্তি পাওয়া যায়। সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্রচন্ড শক্তিশালী হয় নিউক্লিয়ার ম্যান।

সূর্য থেকে মানুষের সৃষ্টির কথা কিছু প্রাচীন লোকগাথায় পাওয়া গেলেও বাস্তবে সেটা যে অসম্ভব তা সবাই জানে।

দেখা যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞানের সবগুলি সুপারহিরোই কোনো না কোনো ভাবে রেডিয়েশানের দ্বারা প্রভাবিত। এই চরিত্রগুলির প্রায় সবগুলিই সৃষ্টি হয়েছে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতার ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে। জাপানের হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহরের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা যে ধ্বংসযুগের সূচনা করেছে তারই পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এসব সুপারহিরো-সুপারভিলেনদের ওপর।

সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন – নিউক্লিয়ার শক্তির ধ্বংসাত্মক পরিণতি বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলি যেরকম যুদ্ধে মেতে ওঠে – তারই রূপক প্রতিফলন দেখানো হয়েছে এখানে কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে।

সামাজিক উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শক্তি, ধর্ম এবং ক্ষমতাকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে যে সুপারহিরো এবং সুপারভিলেনের চরিত্রগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে -তার মূল উদ্দেশ্য বিনোদন। কিন্তু এই বিনোদন পরোক্ষভাবে নিউক্লিয়ার শক্তি এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করছে।

সবগুলি চরিত্রেই দেখানো হয়েছে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে শরীরের কোষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে অদ্ভূত ক্ষমতার উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ দৈত্যের শক্তি প্রাপ্ত হচ্ছে, উড়ার ক্ষমতা অর্জন করছে, শরীর থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি বের করে দিচ্ছে, কিংবা চোখ দিয়ে এক্স-রে নির্গমন করে সেই এক্স-রে দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে।

কল্পবিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানের যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে এসব কাহিনিতে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সত্যিকারের বিজ্ঞান তাহলে কী?

বিকিরণ হলো শক্তির প্রবাহ। বিকিরণ প্রধানত দু’ধরনের হতে পারে – কণা প্রবাহের মাধ্যমে এবং তরঙ্গ প্রবাহের মাধ্যমে। ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা – এরকম কণা যখন তাদের স্থিতিশীল শক্তিস্তরে থাকার জন্য যেটুকু শক্তির দরকার হয় তার চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তখন অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে সেই অতিরিক্ত শক্তির প্রভাবে পদার্থের আয়নাইজেশান বা আয়নায়ন ঘটায়। এরপরও যেটুকু শক্তি বাকি থাকে তা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের আকারে বিকীর্ণ হয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি কোনো তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে তার কম্পাঙ্কের উপর। কম্পাঙ্ক যত বেশি, শক্তিও তত বেশি। কম্পাঙ্ক যত বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত ছোট। দৃশ্যমান আলোর সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হলো বেগুনি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো ছোট হলে হয় অতিবেগুনি। অতিবেগুনি রশ্মির চেয়েও ছোট হলো এক্স এবং গামা রশ্মি। এক্স-রে তৈরি হয় পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির কক্ষপথ থেকে। গামা রশ্মি নির্গত হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে – প্রোটন কিংবা নিউট্রনের শক্তিস্তরের উত্তেজনা থেকে। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গামা রশ্মি নির্গমন করে।

এক্স-রে কিংবা গামা-রে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে – তাদের কতটুকু আমাদের শরীর শোষণ করবে, কতটুকু বের করে দেবে তা নির্ভর করে এক্স-রে বা গামা-রে’র শক্তির উপর। এক্স-রে কিংবা গামা-রে শোষণ করার ফলে কোন প্রাণির শরীর কিংবা কোনো পদার্থই দীর্ঘ সময়ের জন্য তেজস্ক্রিয় বা রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে না। মানুষ নিজে তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়বে শুধুমাত্র তখনই – যখন কোন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয়। সে হিসেবে মানুষের শরীর থেকে কিছুটা বিকিরণ নির্গমন করে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে তা সূর্যের আলোর বিকিরণের মাত্রা থেকেও কম।

এবার দেখা যাক – বিকিরণের প্রভাবে শরীরে কী কী ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত বিকিরণ শরীরে প্রবেশ করলে জীবকোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ আছে তার বন্ধন ভেঙে যেতে পারে। কম পরিমাণে ভাঙলে ডিএনএগুলি নিজেদের মেরামত করে ফেলতে পারে। কিন্তু বেশি ভেঙে গেলে কোষ মরে যায়। খুব বেশি কোষ একসাথে মরে গেলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়, অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়। শরীরের বেশিরভাগ কোষ দ্রুত মরে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কিছুতেই নিজে নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন হয়ে উঠতে পারে না।

কোষের ডিএনএ গুলির বন্ধন যদি ভেঙে যায়, শরীরের স্বয়ংক্রিয় মেরামত পদ্ধতির মাধ্যমে শরীর সেই ভগ্নবন্ধন জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করে। সেই জোড়া লাগাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু উলটোপালটা ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় তাতে ডিএনএ-র ত্রুটি নিয়ে কোষ বিভাজন ঘটে। ফলে ক্যান্সার কোষের উৎপত্তি হতে পারে। বিকিরণের প্রভাবে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা এখান থেকেই তৈরি হয়। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে কোনোভাবেই ‘হাল্ক’ বা ‘স্পাইডারম্যান’ হবার সম্ভাবনা নেই। মস্তিষ্কের কোষ যদি অতিরিক্ত বিকিরণ শোষণ করে – নিউরনের মৃত্যু ঘটে। মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কিন্তু উলটোটা হবার সম্ভাবনা নেই – অর্থাৎ বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কখনও হঠাৎ বোকা থেকে অতিবুদ্ধিমান হয়ে উঠবে না।

কল্পনার সুপারহিরোদের কার্যক্ষমতাকে আমরা যতক্ষণ রূপকথার গল্পের জায়গায় রেখে দেবো ততক্ষণ কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তাকে বিজ্ঞানের জায়গায় রাখতে গেলে আশা করি ভাবনাচিন্তা করে রাখবেন।

 

তথ্যসূত্র

১। বেরি ফিৎজারাল্ড, ফিজিক্স এডুকেশন, সংখ্যা ৫৪, ০১৫০১৯ (২০১৯)।

২। মার্ক ব্রেইক, দ্য সায়েন্স অব সুপারহিরোস, রেসহর্স পাবলিশিং, নিউইয়র্ক, ২০১৮।

৩। জেমস কাকালিওস, দ্য ফিজিক্স অব সুপারহিরোস, গোথাম বুকস, নিউইয়র্ক, ২০০৯।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত






Tuesday, 9 September 2025

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

 



যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন।

পৃথিবীর সব দেশে ক্যান্সার রোগীর বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থা আছে। তবুও অনেক দেশে অনেক মানুষ ক্যান্সার রোগে মারা যায় – রোগ শনাক্ত হবার আগেই। তাদের সংখ্যা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা – ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র এই এক বছরেই সাতানব্বই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যান্সারে [১]।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যায়। দেখা যাচ্ছে মানুষ যত দীর্ঘজীবী হচ্ছে, বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বছরে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ হারে বাড়বে, আর ক্যান্সারে মৃত্যু হবে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর। ২০৪০ সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়ে যাবে। তখন বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে, আর দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার রোগি মারা যাবে। ২০৫০ সালে এই হার আরো বাড়বে। বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হবে – আর মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে শতকরা পঞ্চাশেরও বেশি। তার মানে প্রতি দুই জন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজন মারা যাবে। এই সংখ্যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখে চড় মারার মতোই অপমানজনক।

এক সময় মনে করা হতো ক্যান্সার ধনীদের রোগ। গত শতাব্দীর পরিসংখ্যান থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র কোন দেশের ক্যান্সার রোগীর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার রোগীর শতকরা হার অনেক বেশি। তার একটি প্রধান কারণ ছিল – আফ্রিকার জনগণের গড় আয়ু ছিল অস্ট্রেলিয়ার জনগণের গড় আয়ুর চেয়ে অনেক কম। ফলে ক্যান্সার হবার গড় বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই আফ্রিকার মানুষ অন্য কোন নিরাময়যোগ্য রোগে মারা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুফল এবং পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখন ক্যান্সার আর শুধুমাত্র বড়লোকের রোগ নয়।

কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। ক্যান্সার রোগের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর এবং ব্যয়বহুল বলে ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে ধনীদেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার দরিদ্রদেশের ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক কম।

২০২২ সালে বাংলাদেশে নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার। আর একই বছর ক্যান্সারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ সতের হাজার মানুষ। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করার ব্যাপারে নানারকম অসুবিধা আছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে খুবই নাজুক। অনেক রোগীই ক্যান্সারে মারা যান ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগেই, অথবা একেবারে শেষ পর্যায়ে শনাক্ত হওয়ার পর। তাই বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর বার্ষিক মৃত্যুর হার সত্তর শতাংশেরও বেশি।

ক্যান্সার রোগের যে কোনো চিকিৎসা নেই – তা নয়। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সুস্থও হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে – এই রোগ হবার মূল কারণ এখনো অজানা। সেজন্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করারও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। মূল কারণ অজানা বলেই – ক্যান্সারের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ভীতি যেমন রয়েছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে নিত্যই প্রচারিত হচ্ছে নানারকম মতামত। যে মতামতের বেশিরভাগই এখনো অমীমাংসিত।

ক্যান্সার রোগের মূল কারণ শনাক্ত করা না গেলেও ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যেটুকু বলা যায় – সেটুকু হলো – ক্যান্সার কোনো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। ক্যান্সার হলো কোষঘটিত রোগ। স্বাভাবিক কোষ শরীরের ভেতর ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও কোনো স্বাভাবিক কোষ কখন ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হবে তা বলা যায় না। ক্যান্সার কোষের রূপান্তর বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমান করা গেলেও – কেন এই রূপান্তর ঘটে তা এখনো অজানা।

কোষের কর্মপদ্ধতি লেখা থাকে তার ডিএনএ-তে। দেখা যায় স্বাভাবিক কোষ এবং ক্যান্সার কোষের ডিএনএ-তে পার্থক্য থাকে। কোষের ডিএনএ-র অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কোষের কাজকর্ম অস্বাভাবিক হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। ক্যান্সার কোষ তখন দেহের স্বাভাবিক জৈবনির্দেশ মেনে চলে না। একটি স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজনের পর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক মৃত্যুনির্দেশিকা মেনে চলে না। তাই ক্যান্সার কোষকে যেকোনো উপায়ে মেরে ফেলাই হলো ক্যান্সার চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

ক্যান্সার চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশান প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। কীভাবে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার কোষযুক্ত টিউমারে পাঠানো হবে – তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি। 

বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীকে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়। ক্যামোথেরাপিতে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষে পাঠানো হয়। যদি সার্জারি করে ক্যান্সার টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয় – তাহলে সার্জারি করা হয়। অর্ধেকের কাছাকাছি রোগীকে শরীরের বাইরে থেকে রেডিয়েশান দেয়া হয় – যাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ক্যান্সার নির্মূল করার ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার কোষগুলির স্বাভাবিক কোষের সাথে মিলেমিশে থাকার কারণে। সবগুলি ক্যান্সার কোষকে একসাথে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না – কারণ তাতে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা স্বাভাবিক কোষগুলিও ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরের স্বাভাবিক কোষ যদি অতিমাত্রায় ধ্বংস হয়ে যায় – তাহলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে রোগীর হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি এমনভাবে দেয়া হয় – যেন ক্যান্সার কোষগুলি ধ্বংস হয়, কিন্তু স্বাভাবিক কোষগুলির কার্যক্রম অটুট থাকে [২]।

রেডিয়েশানের ক্ষতিকর দিক থেকে স্বাভাবিক কোষগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যান্সার কোষ ও স্বাভাবিক কোষের কিছু জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়। যেমন স্বাভাবিক কোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে সারিয়ে তুলতে পারে যদি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়। প্রচলিত রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে তাই একসাথে অধিক মাত্রায় রেডিয়েশান প্রয়োগ করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় পরপর কম মাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হয়। একবার রেডিয়েশান দেয়ার পর থেকে আরেকবার রেডিয়েশান দেয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় (সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা) – সেই সময়ে ক্যান্সার কোষের সাথে যেসব স্বাভাবিক কোষ রেডিয়েশানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – তারা নিজেদের সুস্থ করে নিতে পারে (ডিএনএ সংশোধন)। ক্যান্সার কোষগুলির সাধারণত সেই ক্ষমতা থাকে না।

ক্যান্সার কোষগুলিতে সাধারণত অক্সিজেন প্রবাহের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক কোষগুলির চেয়ে কম। অক্সিজেন প্রবাহ কম থাকলে রেডিয়েশানের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হাইপোক্সিক বা কম অক্সিজেনযুক্ত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে গেলে যে মাত্রার রেডিয়েশান দিতে হবে – সেই মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষগুলি অনেক বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বলে রেডিয়েশানের মাত্রা কম রাখতে হয়। ফলে রোগীর চিকিৎসা করতে হয় দীর্ঘদিন এবং খরচ ও ভোগান্তিও বেড়ে যায়।

রেডিওথেরাপিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও তেমন কোন যুগান্তকারী পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি নামে এক নতুন ধরনের অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্বাভাবিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা [৩,৪]।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি এমন একটি প্রযুক্তি যা অতিস্বল্প সময়ে (মিলিসেকেন্ডের মধ্যে) অতি উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন (সেকেন্ডে চল্লিশ গ্রের অধিক) শরীরে প্রয়োগ করে। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে মাত্র কয়েক গ্রে রেডিয়েশান দিতে যেখানে কয়েক মিনিট সময় লাগে,  সেখানে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে নির্ধারিত ডোজ প্রয়োগ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই দ্রুতগতির অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি কমিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্ন হলো -  কীভাবে? যেখানে খুব কম মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান স্বাভাবিক কোষ কীভাবে সহ্য করবে?

ইঁদুর ও শূকরের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এটি কার্যকরভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং স্বাভাবিক কোষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের উপর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিত কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ পরীক্ষা করে দেখছেন ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।

অতি অল্প সময়ে অতিমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন সেটা হলো অক্সিজেন হ্রাস তত্ত্ব বা অক্সিজেন ডিপ্লেশান হাইপোথিসিস। 

প্রচলিত কম মাত্রার রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশান জৈবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে। কোষে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্ষতিকর পার-অক্সাইডে পরিণত হয় যা ডিএনএর ক্ষতি করে। কোষে উপস্থিত অক্সিজেন ডিএনএর এই ক্ষতিকে স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে – ফলে কোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কোষে যদি অক্সিজেন কম থাকে বা না থাকে, এই ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলি ডিএনএর স্থায়ী কোন ক্ষতি করতে পারে না। ফলে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই অস্থায়ী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, ডিএনএ নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায়।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন দেয়া হয়। এই উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বিপুল পরিমাণে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে, যা মুহূর্তেই চারপাশের অক্সিজেন খরচ করে ফেলে। অক্সিজেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যায় যে কোষগুলিতে সাময়িকভাবে অক্সিজেনস্বল্পতা বা হাইপোক্সিয়া তৈরি হয়। এতে স্বাভাবিক কোষে পারঅক্সাইড কম তৈরি হয় এবং ডিএনএ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু টিউমার কোষ সাধারণত আগে থেকেই কিছুটা হাইপোক্সিক থাকে, তাই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির এই অক্সিজেন কমিয়ে ফেলার প্রভাবে তারা খুব একটা প্রভাবিত হয় না।

ইঁদুরসহ অন্যান্য কিছু প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনে পথ এখনো অনেক বাকি। কারণ বিভিন্ন কোষে অক্সিজেনের শোষণ করার ক্ষমতা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। মানুষের কোষের সাথে রেডিয়েশান যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে, অন্যান্য প্রাণির কোষের সাথে সেই মিথষ্ক্রিয়া হুবহু এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন কোষের রেডিয়েশান সংবেদনশীলতাও ভিন্ন। তাই অক্সিজেন হ্রাসের এই তত্ত্ব এখনো সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাছাড়া এই তত্ত্ব প্রমাণিত হলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করতে গেলে এখনো বেশি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এত উচ্চ হারে রেডিয়েশান প্রয়োগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে লিনিয়ার এক্সিলারেটর ব্যবহার করা হয় – তা দিয়ে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো – এত উচ্চ হারের রেডিয়েশান মাপার মতো বিশ্বাসযোগ্য ডোসিমিটার এখনো তৈরি হয়নি। ডোসিমিটার ছাড়া কোনো রোগীকেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশান দেয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত খরচ হিসেবে ধরলে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রচলিত রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসা আবারো ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।

এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্যান্সার শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে হয় (যেমন: মস্তিষ্ক, ফুসফুস)। গবেষণা সফল হলে এটি দ্রুত সময়ে, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, কার্যকর চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

 

তথ্যসূত্র

১। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি, ক্যান্সার টু ডে, ২০২৪।

২। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ঢাকা ২০২৩।

৩। ফ্রনটিয়ার্স ইন অনকোলজি, ভল্যুম ৯, আর্টিক্যাল ১৫৬৩, জানুয়ারি ২০২০।

৪। অনকোলজি লেটারস, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ৬০২, ২০২৪।

________________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Latest Post

মহাকাশের মহানায়ক কার্ল স্যাগান

  সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলার পেছনে যেসব বিজ্ঞানী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন কার্ল স্যাগান ছিলেন তা...

Popular Posts