Saturday, 6 December 2025

কোয়ান্টাম-সুড়ঙ্গে অতিপরিবাহিতা

 


পদার্থবিজ্ঞানীরা ভূতে বিশ্বাস না করলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত ভূতুড়ে কাজকর্মকে অস্বীকার করার কোনো উপায় তাঁদের নেই। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের, বিশেষ করে তার কার্যকরী সমীকরণের একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবছর (২০২৫) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে কোয়ান্টাম বর্ষ – ইয়ার অব কোয়ান্টাম সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। আধুনিক জগতের সমস্ত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির তত্ত্বগুলির গভীরতর স্তর দখল করে আছে কোয়ান্টাম বিজ্ঞান। মৌলিকতম কণা কোয়ার্ক থেকে শুরু করে বিশাল মহাবিশ্ব পর্যন্ত বিস্তৃত কোয়ান্টাম বিজ্ঞা্ন। কিন্তু কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি মাঝে মাঝে এতটাই অবিশ্বাস্য যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সে গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার পাওয়া বিজ্ঞানীও বিরক্ত হয়ে বলে ফেলেন, “কোয়ান্টাম জগত বলে আসলে কিছুই নেই। কোয়ান্টাম দশার অস্তিত্ব আছে শুধু আমার মাথার ভেতর যা দিয়ে আমি অঙ্ক করি। কোয়ান্টাম অবস্থা বড়জোর কিছু তথ্যের বর্ণনা দেয় – বাস্তব জগতের সাথে তাদের খুব একটা মিল নেই।“ অতি সম্প্রতি কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন জেলিঙ্গার, যিনি ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতির পরীক্ষণ-প্রমাণের জন্য [১]।

বর্তমানের আধুনিক মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে মহাকাশচারী স্যাটেলাইট পর্যন্ত সবখানেই ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরাও বিশ্বাস করতেন না যে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের ব্যবহারিক কোন প্রয়োগ হতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম দুই স্থপতি আরভিন শ্রোডিঙ্গার এবং পল ডিরাক নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯৩৩ সালে। পল ডিরাকের বয়স তখন মাত্র ৩১ বছর, আর শ্রোডিঙ্গারের ৪৬। সাংবাদিকরা যখন জিজ্ঞেস করলেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স মানুষের কী কাজে লাগবে, পল ডিরাক বিরসমুখে জবাব দিয়েছিলেন, “কোন কাজে লাগবে না।“ ভবিষ্যতে কি কোনো কাজে লাগতে পারে? – এ প্রশ্নের উত্তরেও তিনি বলেছিলেন, “ভবিষ্যতেও কোনো কাজে লাগবে না।“[২]। অথচ আমরা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে প্রশ্ন করতে হবে, “এমন কোন ক্ষেত্র কি আছে যেখানে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজে লাগে না?”

কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে কাজের কাজে লাগানোর কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা গত শত বছর ধরে। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাংকের হাত ধরে যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যাত্রা শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র কিছু অদ্ভূত ভূতুড়ে তত্ত্ব হিসেবে, এক শতাব্দী পরেই তা রূপ নিয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রযুক্তির বাহন হিসেবে। একুশ শতকে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের স্বপ্নকে বাস্তবে দেখতে চলেছি। আর এই বাস্তবতার মূল কাঠামো কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স বা কোয়ান্ট্রনিক্স-এর অন্যতম তিনজন কারিগর  - জন ক্লার্ক, মিকেল ডেভোরে এবং জন মারটিনিস - পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এবছর।



কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরষ্কার তেমন বিস্ময়কর কোন নতুন ঘটনা নয়। গত একশ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন চল্লিশ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী। ১৯১৮ সালে ম্যাক্স প্ল্যাংককে দিয়ে শুরু, শক্তির কোয়ান্টাম স্তরের জন্য প্রথম নোবেল পুরষ্কার। তারপর আলবার্ট আইনস্টাইন (১৯২১ - ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট), নীলস বোর (১৯২২ – পারমাণবিক মডেল), আর্থার কম্পটন (১৯২৭ – কম্পটন ইফেক্ট), লুই দ্য ব্রগলি (১৯২৯ – বস্তু তরঙ্গ), ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ (১৯৩২ – অনিশ্চয়তার তত্ত্ব), পল ডিরাক ও আরভিন শ্রোডিঙ্গার (১৯৩৩ – কোয়ান্টাম পারমাণবিক তত্ত্ব), উলফগং পাউলি (১৯৪৫ – বর্জন নীতি), ম্যাক্স বর্ন (১৯৫৪ – কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশান), সিন-ইতিরো টমোনাগা, জুলিয়ান সুইঙ্গার ও রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯৬৫ – কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স), জন বারডিন, লিওন কুপার ও রবার্ট শ্রিফার (১৯৭২ – সুপারকন্ডাকটিভিটি তত্ত্ব – বিসিএস থিওরি), ক্লাউস ফন ক্লিৎঝিং (১৯৮৫ –– কোয়ান্টাইজড হল ইফেক্ট), গার্ড বিনিং ও হেনরিখ রোরার (১৯৮৬ – স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ), রবার্ট লাউলিন, হর্স্ট স্ট্রমার ও ড্যানিয়েল সুই (১৯৯৮ – কোয়ান্টাম ফ্লুইড),  জেরারডুস টি হুফ্‌ট ও মারটিনাস ভেলটম্যান (১৯৯৯ – কোয়ান্টাম স্ট্রাকচার অব ইলেকট্রো-উইক ইন্টার-আকশান।), আলেক্সেই আব্রিকসভ, ভিটালি গিনজবার্গ ও অ্যান্থনি লেগেট (২০০৩ – সুপারকন্ডাক্টর ও সুপারফ্লুইড তত্ত্ব),  রয় গ্লাউবার (২০০৫ –– কোয়ান্টাম থিওরি অব অপটিক্যাল কোহেরেন্স), সার্জ হারোকি ও ডেভিড ওয়াইনল্যান্ড (২০১২ –– স্বতন্ত্র কোয়ান্টাম সিস্টেমের পরীক্ষামূলক পদ্ধতি), এলেইন আসপেক্ট, জন ক্লাউজার, আন্টন জেলিঙ্গার (২০২২ – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের পরীক্ষণ প্রমাণ), এবং জন ক্লার্ক, মিকেল দেভোরে, ও জন মারটিনিস (২০২৫ – ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং)।

দেখতেই পাচ্ছেন ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জন্য পাওয়া সব নোবেল পুরষ্কারই দেয়া হয়েছে তত্ত্বীয় কাজের ভিত্তিতে। তার কারণও আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পঞ্চাশ বছরে কোয়ান্টাম তত্ত্ব সমৃদ্ধ হয়েছে অনেক বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যায় এবং বিশ্লেষণে। শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণের ওয়েভ ফাংশান বিশ্লেষণ করে পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ঘটনা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে যা এতদিন ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। যেমন নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় আলফা কণা বিকিরণের ঘটনা।

১৯২৬ সালে শ্রোডিঙ্গারের সমীকরণ প্রকাশিত হবার পরপরই ১৯২৭ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ হুন্ড আণবিক শক্তিস্তরের ভেতর কোয়ান্টাম টানেলিং-এর সম্ভাবনা আবিষ্কার করেন। ওয়েভ ফাংশান বিশ্লেষণ করলে কিছু আপাত অসম্ভব কাজও তত্ত্বীয়ভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠে। কোয়ান্টাম টানেলিং তাদের মধ্যে একটি। ধরা যাক, কোন কোয়ান্টাম কণার সামনে এমন একটি উঁচু দেয়াল আছে যা পার হয়ে অন্য দিকে যাবার জন্য কণাটির যে পরিমাণ শক্তি দরকার, সে পরিমাণ শক্তি তার নেই। এ অবস্থায় ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স নিশ্চিতভাবে বলে দেবে যে কণাটির দেয়াল পার হবার সম্ভাবনা শূন্য। অর্থাৎ কণাটি দেয়ালের এপাশেই রয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশান অনুযায়ী কণা তরঙ্গের আকারেও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কণাটি তরঙ্গের আকারে দেয়ালের অন্যপাশে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শূন্য নয়। সম্ভাবনা শূন্য না হবার অর্থ হলো – কণাটি দেয়ালভেদ করে অন্যপাশে চলে যেতে পারে – প্রয়োজনীয় শক্তি না থাকা সত্ত্বেও! নিসন্দেহে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা।

কিন্তু কোয়ান্টাম টানেলিং-এর এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দিয়েই পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো, এডওয়ার্ড কনডন, এবং রোনাল্ড গারনি আলফা কণার নিউক্লিয়ার ক্ষয়ের ঘটনা ব্যাখ্যা করলেন ১৯২৮ সালে। তাঁদের যৌথ গবেষণাপত্রে তাঁরা দেখালেন যে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থেকে যখন আলফা-কণা স্বতস্ফূর্তভাবে নির্গত হতে থাকে, তখন কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমেই তারা বের হয়ে আসে নিউক্লিয়াস থেকে। কীভাবে?একটি  উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক।

আমরা জানি মেরি ও পিয়ের কুরি রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। রেডিয়াম-২২৬ আইসোটোপ থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে আলফা-কণা নির্গত হয়। রেডিয়াম-২২৬ এর হাফ-লাইফ বা অর্ধায়ু প্রায় ১৬০০ বছর। অর্থাৎ কারো কাছে দুই গ্রাম রেডিয়াম-২২৬ থাকলে ওটা যেখানে যেভাবেই থাকুক না কেন, ১৬০০ বছর পরে এক গ্রাম হয়ে যাবে। রেডিয়াম নিউক্লিয়াস থেকে আলফা-কণার নির্মগন ঘটে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে। নইলে আলফা-কণার সাধ্য ছিল না রেডিয়াম নিউক্লিয়াসের প্রচন্ড নিউক্লিয়ার ফোর্স এবং বাইন্ডিং এনার্জি অতিক্রম করে বের হয়ে আসার। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব ঘটনার মতোই টানেলিং-এর ঘটনাও ঘটে সম্ভাবনার ভিত্তিতে। অর্থাৎ রেডিয়ামের পরমাণু থেকে আলফা-কণা নির্গত হবে আমরা জানি, কিন্তু একদম সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়, ঠিক কোন্‌ সময় কোন্‌ পরমাণু থেকে আলফা কণা নির্গত হবে। কিন্তু অনেকগুলি ঘটনা একসাথে করে আমরা ঘটনাবিন্যাস থেকে আলফা-কণা নির্গমনের যে এক্সপোনেনশিয়েল গ্রাফ পাই – তা থেকে বোঝা যায় আলফা-কণা নির্গমনের সম্ভাবনা কখনোই শূন্য হয়ে যায় না। তার মানে কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটতেই থাকে।

সূর্যের কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়ার ফিউশান ঘটছে, যেখানে  দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একসাথে মিশে গিয়ে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হচ্ছে – সেটাও ঘটছে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে। নইলে দুটো প্রোটনের মধ্যে কুলম্ব বলের প্রভাবে যে বিকর্ষণ বল বিদ্যমান – তা অতিক্রম করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। জীববিজ্ঞানীরাও এখন নতুন করে ব্যাখ্যা করছেন - আমাদের শরীরের ভেতর বেশিরভাগ জৈব-রাসায়নিক মিথষ্ক্রিয়ার মূলে আছে কোয়ান্টাম টানেলিং।

বিজ্ঞানী হুন্ড, গ্যামো, কনডন, গারনি কোয়ান্টাম টানেলিং তত্ত্ব আবিষ্কার করলেও তাঁদের কেউই এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পাননি। তবে কোয়ান্টাম টানেলের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য পরবর্তীতে অনেকেই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০২৫ সালের নোবেল পুরষ্কারেরও মূলেও আছে কোয়ান্টাম টানেলিং।

১৯৫৭ সালে বারডিন, কুপার আর শ্রিফারের সুপারকন্ডাক্টিভিটি থিওরি বা অতিপরিবাহিতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার প্রায় সাথে সাথেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যবহারিক সম্ভাবনা দ্রুত বাড়তে শুরু করলো। বারডিন-কুপার-শ্রিফার (বিসিএস) তত্ত্ব মূলত অতিপরিবাহিতার মাইক্রোস্কোপিক ব্যাখ্যা দেয়।

বিদ্যুৎ পরিবাহীতার স্বাভাবিক ধর্ম থেকে আমরা জানি বিদ্যুৎ পরিবাহীর ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহের হারকে আমরা কারেন্ট বলি। সে হিসেবে এক অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট হলো এক সেকেন্ডে যদি এক কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হয়। একটি ইলেকট্রনের চার্জ হলো ১.৯ x ১০-১৯ কুলম্ব। এক কুলম্ব চার্জ প্রবাহিত হতে হলে ৬.২৫ x ১০১৮ টি ইলেকট্রন প্রবাহিত হতে হবে এক সেকেন্ডে। ছয় বিলিয়ন বিলিয়ন ইলেকট্রন প্রবাহ প্রতি সেকেন্ডে। ইলেকট্রনের ধর্ম অনুসারে এই ইলেকট্রনগুলি প্রত্যেকে প্রত্যকের কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়। তারপরও বিদ্যুৎ বিভবের কারণে তারা সবাই সুশৃঙ্খলভাবে একদিক থেকে অন্যদিকে (টার্মিনাল টু টার্মিনাল) চলাচল করে। কিন্তু যখনই পরিবাহীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, ইলেকট্রনগুলির নিজস্ব শক্তি বেড়ে যাবার কারণে তারা অস্থির হয়ে পড়ে এবং বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। একে অপরের প্রতি বিকর্ষণ বোধ করার কারণে এই বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই বাধার নাম রেজিস্ট্যান্স। তাই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পরিবাহীর ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের সময় রেজিস্ট্যান্স থাকে। এই রেজিস্ট্যান্সের পরিমাণ অসীম হলে – কোন বিদ্যুৎ-প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিবাহী হয়ে পড়ে অপরিবাহী বা ইনসুলেটর।

এর উলটো ঘটনা ঘটলে কী হবে? তাপমাত্রা বাড়লে যদি রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যায়, তাপমাত্রা অত্যন্ত কমিয়ে দিলে ইলেকট্রনগুলির ব্যবহার কেমন হবে? দেখা গেলো অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় (পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি) ইলেকট্রনগুলির ধর্মে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। দেখা যায় অত্যন্ত কম তাপমাত্রায় কিছু কিছু পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলি কোন ধরনের বাধা ছাড়াই চলাচল করতে পারে। শূন্য রেজিস্ট্যান্সে পরিবাহী হয়ে ওঠে অতিপরিবাহী। তখন ইলেকট্রনগুলি একে অপরের প্রতি আর বিকর্ষণ অনুভব করে না। কীভাবে এটা সম্ভব?

১৯৫৬ সালে বিজ্ঞানী লিওন কুপার আবিষ্কার করলেন অতিপরিবাহীর ক্ষেত্রে ইলেকট্রনের ‘কুপার পেয়ার’। কুপারের নামানুসারে এই পেয়ার হলো – ইলেকট্রনের যুগলবন্দি অবস্থা। অতিপরিবাহীর ভেতর  ইলেকট্রন প্রবাহ ঘটে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মধ্য দিয়ে। সামান্য একটু পজিটিভ আয়নের উপস্থিতিতে ইলেকট্রন পজিটিভ আয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আকর্ষণের ফলে ক্রিস্টাল ল্যাটিসের মৃদু বিকৃতি ঘটে। ফলে কিছু ধনাত্মক চার্জের একটি অঞ্চল তৈরি হয় যেখানে অন্য একটি ইলেকট্রন লেগে যায়। ফলে একটি ইলেকট্রনের সাথে অন্য একটি ইলেকট্রনের পরোক্ষ একটি আকর্ষণ বল তৈরি হয়ে দুটো ইলেকট্রনের জোড়া তৈরি হয় – যার নাম ‘কুপার পেয়ার’। কুপার পেয়ারের ইলেকট্রনগুলির স্পিন – একে অপরের বিপরীত, ফলে তাদের মোট স্পিন হয়ে পড়ে শূন্য। তাদের ভরবেগও একে অপরের বিপরীত, ফলে মোট ভরবেগও শূন্য। স্বতন্ত্র ইলেকট্রনের স্পিন ১/২,এবং তারা ফার্মিয়ন হলেও,  কুপার পেয়ারের ক্ষেত্রে দুটো ইলেকট্রন মিশে গিয়ে স্পিন শূন্য হয়ে – তাদের আচরণ হয়ে পড়ে বোসনের মতো। বোসন বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে এবং যে কোন জায়গায় অসংখ্য বোসন থাকতে পারে কোন ধরনের মিথষ্ক্রিয়া ছাড়াই। ফলে একই কোয়ান্টাম দশায় লক্ষ লক্ষ কুপার-পেয়ার কোন ধরনের সংঘর্ষ ছাড়াই চলতে পারে। তৈরি হয় সুপারকন্ডাক্টিভিটি।

বারডিন-কুপার-শিপার (বিসিএস) তত্ত্ব অনুসারে যখন বিশাল সংখ্যক কুপার-পেয়ার একসাথে হয়ে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম স্টেট তৈরি করতে পারে। যেহেতু ফার্মিয়ন হয়েও তারা বোসনের মতো আচরণ করে – তখন তাদেরকে একে অপরের কাছ থেকে আলাদা করে চেনা যায় না। তাই একটি বড় আকারের ওয়েভ ফাংশান দিয়ে তাদের সবাইকে একসাথে প্রকাশ করা যায়। মাইক্রোস্কোপিক স্টেট থেকে ম্যাক্রোস্কোপিক বা দৃশ্যমান কোয়ান্টাম দশার তত্ত্ব এভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। এই কাজের জন্য জন বারডিন,লিওন কুপার এবং রবার্ট শিপার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯৭২ সালে। জন বারডিনের ছিল এটি দ্বিতীয় নোবেল পুরষ্কার। এর আগে ১৯৫৬ সালে জন বারডিন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ট্রানজিস্টার উদ্ভাবনের জন্য। এখনো পর্যন্ত জন বারডিনই একমাত্র বিজ্ঞানী যিনি পদার্থবিজ্ঞানে দুবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

বিসিএস তত্ত্ব প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই পরীক্ষাগারে সুপারকন্ডাক্টর তৈরির গবেষণা শুরু হয়ে গেল। ব্রিটিশ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী ব্রায়ান জোসেফসন ১৯৬২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র পিএইচডি গবেষণা শুরু করেছেন। মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম টানেলিং-এর নতুন সম্ভাবনা। তিনি দেখালেন দুটো অতিপরিবাহী বা সুপারকন্ডাক্টরের মাঝখানে একটি অপরিবাহী বা ইনসুলেটর রাখলে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর মাধ্যমে ইলেকট্রন এক দিকের অতিপরিবাহী থেকে অপরিবাহী পদার্থ ভেদ করে অন্য দিকের অতিপরিবাহীতে প্রবাহিত হতে পারে। তাঁর নামানুসারে এই প্রক্রিয়ার নাম দেয়া হলো জোসেফসন ইফেক্ট, আর এই যান্ত্রিক অংশটার নাম দেয়া হলো জোসেফসন জাংশান। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে এর পরীক্ষণ প্রমাণ পাওয়া গেল।

এর আগে ১৯৫৭ সালে জাপানের বিজ্ঞানী লিও ইসাকি সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবন করেছেন ইসাকি ডায়োড বা টানেল ডায়োড। নরওয়ের বিজ্ঞানী ইভার গিয়েইভার সুপারকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে টানেলিং ইফেক্ট প্রমাণ করেছেন। ১৯৭৩ সালে টানেলিং ইফেক্টের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেলেন জোসেফসন, ইসাকি এবং গিয়েইভার।

কোয়ান্টাম টানেলিং কাজে লাগিয়ে উদ্ভাবিত হয়েছে স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপ। সেজন্য গার্ড বিনিং ও হেনরিখ রোরার ১৯৮৬ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।

এবছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কারও দেয়া হয়েছে কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট সংক্রান্ত গবেষণার জন্য। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি বার্কলের ল্যাবে জন ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে তাঁর ছাত্র জন মারটিনিস এবং পোস্টডক্টরেট ফেলো মিকেল দেভোরে আবিষ্কার করেছিলেন ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং – যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ইলেকট্রিক সার্কিট – কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিক্স বা কোয়ান্ট্রনিক্সের  প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠছে। চল্লিশ বছর আগের সেই আবিষ্কারের সুদূর প্রসারী প্রভাবের স্বীকৃতি এবারের নোবেল পুরষ্কার।

ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম ফেনোমেনা – অর্থাৎ দৃশ্যমান পর্যায়ে কোয়ান্টাম ধর্মাবলি প্রদর্শনের উপায় উদ্ভাবনে জন ক্লার্ক এবং তাঁর গবেষক দলের অবদান অনেক। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের যেসব ভূতুড়ে কান্ড চোখের আড়ালে ঘটে যায় – সেগুলি যে চোখের সামনে ঘটতে দেখার ব্যবস্থাও করা যায় – তা তাঁরা প্রমাণ করেছেন। পরীক্ষাগারে তাঁরা তৈরি করেছেন সুপারকন্ডাক্টিং কোয়ান্টাম সার্কিট যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত ধর্মগুলি তো প্রদর্শন করেই, তার সাথে অদূর ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং-এর বাস্তব পথের অনেকটাই তৈরি করে দেয়।

এবছরের নোবেলত্রয়ীর দলপতি জন ক্লার্কের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কেমব্রিজে। কেমব্রিজের বিখ্যাত প্রাইভেট স্কুল পার্‌স স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির গবেষণা শুরু করেন স্যার আলফ্রেড ব্রায়ান পিপার্ডের তত্ত্বাবধানে। কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ব্রায়ান পিপার্ড।

পিএইচডি গবেষণার সময়েই জন ক্লার্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল ভোল্টমিটার উদ্ভাবন করেন যা দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিমাণের ভোল্টেজও মাপা যায়। পরবর্তীতে তিনি এর নাম দেন স্লাগ (SLUG – Superconducting Low-inductance Undulatory Galvanometer)। ১৯৬৮ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে। তারপর আর প্রতিষ্ঠান বদল করেননি তিনি। সেখানেই ১৯৬৯ সালে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ১৯৭১ সালে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং ১৯৭৩ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। বিগত ষাট বছর ধরে তিনি গবেষণা করছেন সুপারকন্ডাকটিং কোয়ান্টাম ইন্টারফেস ডিভাইস বা স্কুইড নিয়ে (SQUID – Superconducting Quantum Interface Device)।

গবেষণার স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন অনেক। কর্মজীবনের শুরুতেই পেয়েছেন আলফ্রেড স্লোন ফেলোশিপ, তারপর গুগেনহেইম ফেলোশিপ। রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পেয়েছেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৭ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বর্ষসেরা বিজ্ঞানী মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির জোসেফ কিথলি পুরষ্কার। ১৯৯৯ সালে পেয়েছেন ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের কমস্টক পুরষ্কার। ২০০৪ সালে পেয়েছেন রয়েল সোসাইটির হিউজেস মেডেল। এবছর পেলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার।

এবছরের নোবেলত্রয়ীর দ্বিতীয়জন মিকেল দেভোরের জন্ম ফ্রান্সের প্যারিসে ১৯৫৩ সালে। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘টেলিকম প্যারিস’ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর কন্ডেন্সড ম্যাটার ফিজিক্সে পিএইচডি করেন ১৯৮২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ওরসে (বর্তমান নাম প্যারিস-সুড) থেকে। তাঁর পিএইচডি তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স গবেষণার অন্যতম পথিকৃৎ আনাতোলে আব্রাগাম। ১৯৮২ সালে তিনি পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে প্রফেসর জন ক্লার্কের গ্রুপে। সেখানেই প্রথম বারের মতো আবিষ্কৃত হয় ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম টানেলিং ইফেক্ট।

১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রফেসর জন ক্লার্কের গ্রুপে। এরপর তিনি ফিরে যান ফ্রান্সে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত তিনি কোয়ান্ট্রনিক্স গ্রুপের হেড হিসেবে গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন ফ্রান্সের এটমিক এনার্জি কমিশনে। ১৯৯৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত  তিনি সেখানকার কোয়ান্ট্রনিক্স গ্রুপের হেড এবং গবেষণা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সাল থেকে তিনি যুক্ত আছেন আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রফেসর হিসেবে। একই সাথে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা বারবারাতেও রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন সুপারকন্ডাক্টিং সার্কিট নিয়ে।  সেই থেকে গত ৪৩ বছর ধরে তিনি গবেষণা করছেন এক্সপেরিমেন্টাল সলিড স্টেট ফিজিক্স বিষয়ে। উদ্ভাবন করেছেন সার্কিট কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স, কোয়ান্টাম এমপ্লিফিকেশান, সিংগল ইলেকট্রন ট্রানজিস্টার।

গবেষণার বিশ্বজোড়া স্বীকৃতিও পেয়েছেন মিকেল দেভোরে। ফেলোশিপ পেয়েছেন আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস আন্ড সায়েন্স এবং ফ্রেন্স একাডেমি অব সায়েন্সের। সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট এবং মাইক্রোওয়েভ ফোটনের এন্টেলগেলমেন্টের জন্য ২০১৩ সালে পেয়েছেন জন বেল পুরষ্কার, ২০১৪ সালে নিম্ন-তাপমাত্রার পদার্থবিজ্ঞান গবেষণায় ফ্রিজ লন্ডন মেমোরিয়েল প্রাইজ, ২০২৪ সালে পেয়েছেন কমস্টক প্রাইজ এবং এবছর পেলেন নোবেল পুরষ্কার।

এবছরের নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানের তৃতীয় নায়ক জন মারটিনিস। যে আবিষ্কারের জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেলেন সেই আবিষ্কার তিনি করেছিলেন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে। জন মারটিনিসের জন্ম ১৯৫৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রির পর পিএইচডি গবেষণা শুরু করেন প্রফেসর জন ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে। ১৯৮৭ সালে তিনি পিএইচডি অর্জন করেন। তাঁর পিএইচডি থিসিসের শিরোনাম ছিল “Macroscopic quantum tunnelling and energy-level quantization in the zero-voltage state of the current-biased Josephson junction.” নোবেল কমিটি এবছর নোবেল পুরষ্কারের ঘোষণায় যে বাক্যাংশ ব্যবহার করেছে তার সাথে মারটিনিসের থিসিসের শিরোনামের আশ্চর্য মিল। মূলত জন ক্লার্ক ও মিকেল দেভোরের সহযোগিতায় জন মারটিনিস তাঁর পিএইচডি গবেষণায় যা আবিষ্কার করেছিলেন – তাই-ই এনে দিয়েছে তাঁদের নোবেল পুরষ্কার।

পিএইচডি সম্পন্ন করার পর মিকেল দেভোরের আমন্ত্রণে তিনি ফ্রান্সের এটমিক এনার্জি কমিশনে পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে কাজ করার পর আমেরিকায় ফিরে সে যোগ দেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ডস আন্ড টেকনোলজিতে। ২০০৪ সালে যোগ দেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান্টা বারবারাতে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট সংক্রান্ত গবেষণা চলতে থাকে। ২০১৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত জন মারটিস গুগলের কোয়ান্টাম এ-আই ল্যাবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার গবেষণার নেতৃত্ব দেন। ২০২০ সালে মারটিস অস্ট্রেলিয়ার সিলিকন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানিতে যোগ দেন। ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস এর কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রফেসর মিশেল সিমনস ২০১৭ সালে এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দুবছর এই কোম্পানিতে কাজ করার পর জন মারটিস নিজের কোম্পানি কিউ-ওল্যাব খোলেন ২০২২ সালে। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন জন মারটিনিস।

জন মারটিনিস ২০২৫ সালের নোবেল পুরষ্কারের মূল গবেষণা সম্পন্ন করেছিলেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার বেল ল্যাবরেটরিতে জোসেফসন ইফেক্ট প্রমাণিত হবার পর খুব দ্রুত জোসেফসন জংশনের নানাবিধ প্রয়োগ শুরু হয় – বিশেষ করে চৌম্বক ক্ষেত্রের নিখুঁত পরিমাপের ক্ষেত্রে।

সেসময় জন ক্লার্ক সবেমাত্র স্নাতক পাস করে কেমব্রিজে পিএইচডি শুরু করেছেন। আমেরিকার ফোর্ড সায়েন্টিফিক ল্যাবের বিজ্ঞানী জেমস জিমারম্যান ও জন মারসেরেউ এক জোড়া জোসেফসন জাংশান ব্যবহার করে তৈরি করেছেন প্রথম ব্যবহারিক স্কুইড (SQUID – Superconducting Quantum Interface Device)। অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমাণ চৌম্বকক্ষেত্রও পরিমাপ করতে পারে স্কুইড। জন ক্লার্ক তাঁর পিএইচডি গবেষণায় শুরু থেকেই স্কুইডের ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি এর নানাবিধ প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটান। বর্তমানে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কার্যক্রম থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে যেখানে সূক্ষ্ম চুম্বকক্ষেত্রের পরিমাপ করতে হয় – স্কুইড ব্যবহৃত হচ্ছে।

কোয়ান্টাম টানেলিং-কে মাইক্রোস্কোপিক পর্যায় থেকে ম্যাক্রোস্কোপিক পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা চলছিল অনেক বছর থেকে।  ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী অ্যান্থনি লেগেট ধারণা দেন শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল পরীক্ষার বাস্তব রূপ দেয়া সম্ভব। সুপারকন্ডাক্টর কিংবা সুপারফ্লুইডের ক্ষেত্রে দুটো দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে কোয়ান্টাম টানেলিং সম্ভব – বিশেষ করে শূন্য ডিগ্রি কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রায়। ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে হিলিয়াম-৩ মৌলের সুপারফ্লুইডের কোয়ান্টাম ধর্মাবলি প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর সুপারফ্লুইডের তত্ত্বের জন্য তিনি ২০০৩ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি ধারণা দিয়েছিলেন ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলে কোয়ান্টাম টানেলিং প্রমাণ করা সম্ভব।

১৯৮২ সালে তাঁর ধারণাকে সত্য প্রমাণ করার প্রকল্প গ্রহণ করলেন প্রফেসর জন ক্লার্ক। তাঁর গ্রুপে আছেন তরুণ পোস্টডক্টরেট ফেলো মিকেল দেভোরে এবং পিএইচডি ছাত্র জন মার্টিনিস। জন মার্টিনিসের পিএইচডি প্রকল্প হিসেবেই কাজ শুরু করলেন তাঁরা।

 সুপারকন্ডাক্টিং ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট ব্যবহার করে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষণ পরিকল্পনা করা হলো যেন বাইরের কোন প্রতিবন্ধকতা পরীক্ষণের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে না পারে। কোয়ান্টাম আচরণ প্রত্যক্ষ করার জন্য তাঁরা জোসেফসন জংশনে খুবই ক্ষুদ্র পরিমাণের বৈদ্যুতিক প্রবাহ প্রেরণ করে ভোল্টেজ পরিমাপ করেন। সেখান থেকে রেজিস্ট্যান্স হিসেব করা সহজ। জোসেফসন জাংশানের প্রাথমিক ভোল্টেজ প্রত্যাশা অনুযায়ী শূন্যই ছিল। এরপর সিস্টেমটি শূন্য ভোল্টেজ থেকে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর সাহায্যে বের হয়ে আসতে কত সময় নেয় তার পরিমাপ করলেন। কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটলে ভোল্টেজ শূন্য থেকে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেহেতু কোয়ান্টাম দশা সম্ভাবনার উপর নির্ভরশীল, সেহেতু অনেকগুলি পরিমাপের ডাটা নেয়া হলো। পরীক্ষণে বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাইক্রোওয়েভ শূন্য-ভোল্টেজ দশায় প্রেরণ করা হয়। সিস্টেম যখন কিছু মাইক্রোওয়েভ শোষণ করে তখন সিস্টেমটি উচ্চতর শক্তিস্তরে চলে যায়। সিস্টেমে শক্তি বাড়লে শূন্য-ভোল্টেজ অবস্থার স্থায়িত্বকাল কমে যায় – অর্থাৎ কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটে। পরীক্ষণে প্রমাণিত হলো সুপারকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে ম্যাক্রোস্কোপিক স্কেলের কোয়ান্টাম টানেলিং ঘটে। ১৯৮৪-৮৫ সালে ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারে প্রকাশিত হলো [৩-৫] তাঁদের ফলাফল – যা তাঁদেরকে এনে দিয়েছে এবছরের নোবেল পুরষ্কার।

এবছরের নোবেল পুরষ্কারের পরীক্ষণ যদিও করা হয়েছিল প্রায় চল্লিশ বছর আগে, কিন্তু এই চল্লিশ বছরে কোয়ান্টাম টানেলিং-এর ম্যাক্রোস্কোপিক ব্যবহারযোগ্যতা অনেক বেশি বেড়েছে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রনিকস এখন বাস্তবতা। অদূর ভবিষ্যতে কিউবিটের কোয়ান্টাম কম্পিউটার আমাদের হাতের নাগালে এসে যাবে বলে আশা করা যায়। তখন হয়তো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুর্বোধ্যতার অপবাদ কিছুটা হলেও কমে যাবে।

 

তথ্যসূত্র

[১] বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২২, সেপ্টেম্বর ২০২৫।

[২] প্রদীপ দেব, কোয়ান্টাম ভালবাসা, মীরা প্রকাশনী, ঢাকা ২০১৪।

[৩] এম এইচ ডেভোরে, জে এম মারটিনিস, ডি এসটিভ, জে এম ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৩, পৃ ১২৬০ (১৯৮৪)।

[৪] জে এম মারটিনিস, এম এইচ ডেভোরে, জে ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৫, পৃ ১৫৪৩ (১৯৮৫)।

[৫] এম এইচ ডেভোরে, জে এম মারটিনিস, জে ক্লার্ক, ফিজিক্যাল রিভিউ লেটার, সংখ্যা ৫৫, পৃ ১৯০৮ (১৯৮৫)।

[৬] নোবেল প্রাইজ ডট অর্গ।

_____________

বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত











Thursday, 27 November 2025

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

 

What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have read many books and passed many exams wouldn’t be so lacking in it. Many years ago, I used to work at an educational institution. One of my colleagues would sit in the teachers’ common room—right in front of everyone—pluck his nose hairs and then blow them away into the air. The “common sense” of the common room!! Had he not read enough books?

Knowing full well that common sense cannot be increased by reading books, I still read Sir Terry Wogan’s The Little Book of Common Sense. The book is literally quite “little.” Only 133 pages, and quite small. There’s a lot of blank space on the pages too; they’re not filled from top to bottom with words. So, it was quite a comfortable read.

Sir Terry Wogan is a British journalist. Since 1972, he has been presenting BBC’s morning show. He was knighted in 2005. His experience and his characteristic humour make every line of the book thoroughly enjoyable.

On several essential matters of life, he has expressed very effective philosophies in just a few words. For example, about God he says: Never admit that you are an atheist. Keep your disbelief to yourself. Otherwise, you’ll spend your entire life listening to religious lectures. Even though he doesn’t mention the possibility of losing your life, we all know how that can turn out.

If you feel like speaking the truth to someone’s face, make sure it’s someone you will never have to meet again. If you speak unpleasant truths to a friend or family member, be prepared to hear extremely nasty things about yourself in return.

You must lie sometimes but be prepared to get caught—because lies don’t stay hidden for long.

Don’t regret too much about what has already happened. If you keep walking while looking back, you will bump into a lamppost.




On love, separation, affection, sexuality, kissing, jobs, wealth—he has written many amusing yet truthful short lines. For our talkativeness, he has written a few suitable lines: Never speak unless it is absolutely necessary. When you do speak, be as brief and to the point as possible. Don’t chatter just to show off. No one likes to hear your political speeches in elevators, buses, or trains. At any party, you will notice that everyone gathers around the person who quietly listens but does not talk much himself.




The book is very entertaining. I don’t know whether my common sense has increased, but I enjoyed reading it—and I felt good after finishing it.

 

Book: The Little Book of Common Sense

By Terry Wogan

Published by Orion, London, 2014.


Carl Sagan: the great hero of space

 




By presenting science in language easily understandable to ordinary people, Carl Sagan played a leading role in making science popular — he was one of the brightest among such scientists. Time magazine described him as America’s most successful science communicator. Among world-renowned scientists, only a handful have, alongside complex and rigorous scientific research, also written about science in simple language for the public. Carl Sagan was one of those few — in addition to publishing more than six hundred research papers, he also wrote more than two dozen popular science books. Through his television programs, he brought science directly into people’s homes. His thirteen-episode television documentary Cosmos was broadcast in nearly sixty countries around the world, and nearly six hundred million viewers watched it with fascination. In this documentary, he explained in a lively and accessible style the nature of planets in space, the origin and evolution of life on Earth, and whether life might exist on planets beyond Earth. His documentaries, books, and research greatly enriched twentieth-century space science and astronomy.

Carl Edward Sagan was born in New York City, USA, on November 9, 1934. His father, Samuel Sagan, was a manager in a clothing factory. His mother, Rachel Sagan, was a homemaker. Carl Sagan’s curiosity about the mysteries of space began from early childhood, when he would visit the neighbourhood library with his mother and pore over books filled with images of planets and stars.

After earning his bachelor’s and master’s degrees in physics from the University of Chicago, he completed his PhD in astronomy in 1960. His advisor was the renowned astronomer Gerard Kuiper — the Kuiper Belt in our solar system was named after him. Carl Sagan conducted detailed research on the atmospheres of Jupiter and Venus. He determined the properties of Venus’s unusually high-pressure atmosphere and its likely causes.

Carl Sagan was directly involved in many NASA space missions. He designed the Golden Record sent aboard Voyager 1 and Voyager 2 in 1977 — a message sent beyond Earth containing images, sounds, and greetings in many languages from humans and other living beings, intended to attract the attention of any intelligent extraterrestrial life.

Carl Sagan devoted immense effort to making science popular. He passed away on December 20, 1996, at the age of only 62.


Monday, 24 November 2025

Tsung-Dao (T.D.) Lee

 


The Nobel Prize in Physics 1957 was awarded jointly to Chen Ning Yang and Tsung-Dao (T.D.) Lee "for their penetrating investigation of the so-called parity laws which has led to important discoveries regarding the elementary particles."

Tsung-Dao (T.D.) Lee

Born: 24 November 1926, Shanghai, China

Died: 4 August 2024, San Francisco, California, USA

Affiliation at the time of the award: Columbia University, New York, NY, USA

Prize motivation: "for their penetrating investigation of the so-called parity laws which has led to important discoveries regarding the elementary particles."

Prize share: 1/2


Work

For a long time, physicists assumed that various symmetries characterized nature. In a kind of "mirror world" where right and left were reversed and matter was replaced by antimatter, the same physical laws would apply, they posited. The equality of these laws was questioned concerning the decay of certain elementary particles, however, in 1956 and Tsung Dao Lee and Chen Ning Yang formulated a theory that the left-right symmetry law is violated by the weak interaction. Measurements of electrons' direction of motion during a cobalt isotope's beta decay confirmed this.


Simon van der Meer

 


The Nobel Prize in Physics 1984 was awarded jointly to Carlo Rubbia and Simon van der Meer "for their decisive contributions to the large project, which led to the discovery of the field particles W and Z, communicators of weak interaction."

Simon van der Meer 
Born: 24 November 1925, the Hague, the Netherlands
Died: 4 March 2011, Geneva, Switzerland
Affiliation at the time of the award: CERN, Geneva, Switzerland
Prize motivation: "for their decisive contributions to the large project, which led to the discovery of the field particles W and Z, communicators of weak interaction."
Prize share: 1/2

Life
Simon van der Meer was born and raised in The Hague, Netherlands. His father was a teacher and his mother also came from a family of educators. After studying at the University of Technology, Delft, van der Meer spent several years working at the Philips Research Laboratory in Eindhoven. In 1956 he began working at the new European particle physics laboratory, CERN, where he remained for the rest of his career. Simon van der Meer was married with two children.

Work
According to modern physics, there are four fundamental forces in nature. The weak interaction, responsible for e.g. the beta-decay of nuclei is one of them. According to the theory forces are mediated by particles: the weak interaction by the so called heavy bosons W, Z, about 100 times more massive than the proton. Simon van der Meer developed a method to accumulate a large number of energetic antiprotons in an accelerator ring. These were used in experiment where antiprotons and protons of high energy were brought to collide. In these experiments W and Z particles were discovered in 1983.

Monday, 17 November 2025

Enigmatic quantum theory

 


‘There is actually no such thing as a quantum world. The quantum state exists only inside my head, something I use to do calculations. Quantum states at most describe certain information — they do not correspond very well to the real world.’

Hearing these words, one might think a frustrated university student—annoyed by the incomprehensibility of quantum mechanics—is venting irritation. But to our astonishment, these remarks about quantum mechanics were recently made by Anton Zeilinger, the quantum physicist at the University of Vienna who received the 2022 Nobel Prize in Physics for proving experimentaly the principles of quantum mechanics.

Quantum theory is one of the most successful theories in twentieth-century science. From computer chips to complex medical life-support technologies, modern technology depends extensively on quantum theory. Whether explaining the intricate workings of microscopic biological cells or unlocking the mysteries of the universe, quantum theory works with remarkable success. So what does it mean to say such an effective theory has no real world behind it? If a Nobel-winning quantum physicist denies the existence of the quantum world, where do we turn?

Great scientists like Einstein and Feynman have issued various warnings about the perplexities of quantum theory. But did that stop quantum theory—or prove it wrong? The answer is no. For the past hundred years, quantum theory has only grown more powerful and dominant in the scientific world. The year 2025 is being celebrated as the Quantum Year of Physics, and for that reason scientists have begun reflecting anew on the fundamental question: What is quantum theory actually? Why is its relationship with physical reality so puzzling?

Not all scientists agree with Zeilinger in rejecting a real quantum world. Alain Aspect, the Paris-based physicist who shared the Nobel Prize with Zeilinger for similar quantum research, disagrees. Professor Aspect believes that the quantum world is fully real, though its behavior is as mysterious as nature itself.

The debate about quantum theory and physical reality intensified recently in response to a large survey published by the world-renowned journal Nature. The aim was to discover what quantum researchers themselves think about the quantum world — how they interpret its rules and underlying reality. A broad questionnaire was sent to 15,000 quantum researchers. All of them are active contributors to quantum-theoretical research, each with multiple recent publications. The same questions were also placed before many leading quantum experts who attended the centenary celebration of Schrödinger’s equation on Germany’s Heligoland Island.

Although fifteen thousand scientists were contacted, only eleven hundred responded and shared their views on quantum theory. Nearly fourteen thousand researchers did not even feel compelled to reply. Even so, this survey remains the largest ever of its kind.

The results show that researchers still have no consensus on how to interpret the reality behind quantum mechanics. And this once again demonstrates that quantum theory remains as enigmatic as ever.

Asia’s first Nobel-winning scientist in the sciences, C. V. Raman, once remarked—while explaining the difference between science and non-science—that in science, a precise question has only one correct answer. But in anything that is not science, a single question may have many correct answers. In quantum theory, we often see the possibility of many correct solutions to the same question. If we strictly follow Raman’s logic, we must conclude that quantum theory is not rigidly orthodox as a science. It leaves room for plurality.

Although scientists remain divided on how quantum mechanics should be interpreted, the rules for applying quantum mechanics are perfectly clear. For example, when predicting the possible outcomes of an event, quantum mechanics describes a superposition of multiple possible states at once. The most effective way to describe these quantum states is through the wave function. If one can construct a wave function solvable by Schrödinger’s equation, and solve that equation, then the probabilities of possible outcomes can be determined.

But when the outcome of the event is actually observed, the quantum world’s wave function of possibilities collapses into a single real state—so instead of a superposition of many outcomes, only one definite outcome appears.

Take Schrödinger’s famous cat as an example. When the cat is inside a box and we cannot see its real state, the wave function describing its life-status may be a superposition of both “alive” and “dead.” But once we open the box and look, we see only a single state: the cat is either alive or dead. This shows that observation causes the quantum wave function to collapse. Here the question arises: should we then assume that the quantum world is an invisible realm?

In Nature’s survey, researchers were asked about the wave function—whether this mathematical description of an object’s quantum state has any real physical basis.

Only 36% of scientists believe that the wave function represents something real in the physical world. Among them, only 17% believe it is entirely real, while 19% think it is partially real.

But 47% of scientists believe that the wave function is merely a mathematical tool used to solve quantum-mechanical problems, with no real existence of its own.

Another 8% think the wave function reflects a kind of personal preference embedded in the experimental outcome—meaning that through it, one can influence or control the results of quantum experiments!

Even more surprising: of the remaining 10% of scientists, 8% believe the wave function is something else, and 2% have no idea what the wave function really is.

 

 

Is there any conflict between our classical, everyday idea of objects and the quantum concept of objects? To put it simply: Is there a definite boundary between quantum objects and classical objects — a threshold beyond which a quantum object becomes classical, or a classical object becomes quantum? Scientists are divided on this question as well.

According to the survey, 45% of researchers believe such a boundary does exist (among them, 40% think the boundary is very definite, while 5% think it exists but is not sharply defined).

Another 45% of scientists believe that no such boundary exists between classical and quantum objects.

The remaining 10% are unsure.

 

A blue and white bar with black textAI-generated content may be incorrect.


One of the key features of quantum theory is its observer dependence. Quantum mechanics can speak about the probabilities of a particle’s behavior, but it cannot say with certainty what exactly will happen. To know with certainty, the particle must be observed. Einstein himself strongly objected to this idea. Frustrated by quantum mysteries, Einstein asked his biographer Abraham Pais:
“Do you really believe that the moon exists only when you look at it, and not at other times?”

Although Einstein raised this objection, quantum scientists agree that such questions do not apply to large objects like the Moon. But when it comes to the behavior of extremely tiny particles—whose properties must be described using quantum mechanics—we find that how a particle behaves depends on its observer.

This old question was raised again in the Nature survey. Here too, scientists could not reach agreement.

  • 56% of scientists believe that the measurement of quantum events is observer-dependent.
  • 9% believe that it is not enough for an observer to simply “look”; the observer must be conscious of what is happening—that is, must understand the full context of the event.
  • 28% believe that no observer is required at all for the measurement of quantum events.
  • 8% are unsure whether an observer is needed or not.

 

Among the experiments on which quantum theory is built, the double-slit experiment is one of the most fundamental. It provides evidence that electrons exhibit both particle and wave properties. If a stream of electrons is directed toward a screen with two microscopic slits, and if a detector records the pattern created by electrons passing through the slits, we see that a single electron behaves like a wave—passing through both slits at once and interfering with itself.

But if we place detectors behind the slits individually—observing which slit the electron goes through—then the observed pattern changes. The electrons behave like particles, passing through a slit and landing in straight-line paths. Quantum theory accepts these results as true, and from this we embrace the wave–particle duality of nature.

In the Nature survey, scientists were asked a question about this experiment: When no one is observing them, do electrons pass through both slits?

The responses were striking:

  • 48% of scientists expressed irritation at the question, saying that such a question is meaningless for quantum objects.
  • 31% believed the answer is yes.
  • 14% believed the answer is no.
  • 6% were unsure how electrons pass through the slits, or whether observation has any role at that stage.

 

The fact that quantum scientists cannot agree even on the established phenomena of quantum theory is astonishing. This indicates an important divide among researchers. On one side are those who adopt a realist viewpoint—scientists who believe that the equations of quantum mechanics reflect an underlying physical reality. On the other side are those who follow an epistemic perspective—scientists who think that quantum physics deals only with information, even if that information does not correspond directly to physical reality.

On the question of how the quantum world can be explained in relation to the real world, scientists have split into multiple camps. The Nature survey asked researchers which interpretation they think best explains quantum events and interactions—that is, which attempt to link the mathematics of the theory with physical reality they prefer.

The largest group (36%) favored the Copenhagen interpretation. But when asked how confident they were that their preferred interpretation is the correct one, only 24% said they believe it is actually correct; the rest see it merely as a suitable or contextually useful tool.


 

Many researchers showed inconsistencies between their answers to one question and their answers to a related supplementary question. Does this mean that many quantum researchers simply use quantum theory without deeply thinking about its true meaning? An American physicist once gave this approach a name—“Shut up and calculate!”

So, what exactly is this popular interpretation of quantum mechanics—the Copenhagen interpretation? In quantum theory, the behavior of an object is described by its wave function. Erwin Schrödinger introduced the quantum wave function through his famous equation a hundred years ago. The wave function provides a mathematical representation of all possible states of a quantum system through the idea of superposition.

The key explanations of quantum mechanics were given by the founders of the theory themselves—Schrödinger, Heisenberg, and Niels Bohr. Because foundational research in quantum mechanics took place at the University of Copenhagen, this core interpretation became known as the Copenhagen interpretation. In this interpretation, the observer plays a central role. Fundamental particles exhibit both particle-like and wave-like behavior. Quantum tunneling and quantum entanglement are accepted concepts in this interpretation. This is one reason why it remains so popular.

But its major weakness is that, when we try to relate it to the real world, this interpretation does not seem fully “scientific.” It speaks only about probabilities, not certainties—it cannot say beforehand exactly what will happen. Yet for scientists who prefer the Copenhagen interpretation, this is the reality of nature. As a result, another more realist group of scientists emerged who believe that the wave function is merely a mathematical tool used to solve equations. The wave function cannot be seen in the real world, because whenever an observation is attempted, the wave function collapses.

This viewpoint is reflected in the Nature survey, in which 17% of scientists supported an epistemic interpretation. “Epistemic” here means that the wave function is constructed from the viewpoint of an observer—based on what the observer expects the possible outcomes to be.

Quantum scientists feel most uncomfortable when confronted with the idea that wave functions collapse simply because someone looks at them. In 1957, American physicist Hugh Everett proposed a solution to this discomfort: the Many-Worlds interpretation. According to Everett, a particle is, in a sense, present in multiple places at once. In one particular world, an observer measures one particular outcome. But the wave function never really collapses. Instead, it branches into many worlds, each world representing a different outcome. There is no doubt that these worlds are hypothetical. According to the survey, 15% of scientists favor the Many-Worlds interpretation.

As time goes on, scientists are presenting more and more new ideas. But it is clear that quantum theory is still incomplete. Even though quantum mechanics is one of the most experimentally verified theories in the history of science, its mathematics cannot describe gravity. Scientists hope that one day a more advanced form of quantum mechanics will emerge that will cover the shortcomings of the present version.


References:

  1. Biggyanchinta, October 2022
  2. Nature, 12 August 2025
  3. Scientific American, 8 August 2025

প্রহেলিকাময় কোয়ান্টাম তত্ত্ব

 


“কোয়ান্টাম জগত বলে আসলে কিছুই নেই। কোয়ান্টাম দশার অস্তিত্ব আছে শুধু আমার মাথার ভেতর যা দিয়ে আমি অঙ্ক করি। কোয়ান্টাম অবস্থা বড়জোর কিছু তথ্যের বর্ণনা দেয় – বাস্তব জগতের সাথে তাদের খুব একটা মিল নেই।“ – কথাগুলি শুনে মনে হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোন শিক্ষার্থী কোয়ান্টাম মেকানিক্সের দুর্বোধ্যতায় বিরক্ত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে অতি সম্প্রতি কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্পর্কে এই কথাগুলি বলেছেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী আন্তন সাইলিঙ্গার (Anton Zeilinger), যিনি ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিকসের নীতির পরীক্ষণ-প্রমাণের জন্য।

বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের সবচেয়ে সফল তত্ত্বগুলির অন্যতম হলো কোয়ান্টাম তত্ত্ব। আধুনিক প্রযুক্তির বেশিরভাগই – কম্পিউটার চিপ থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রাণরক্ষাকারী জটিল যন্ত্রপাতির সবকিছুতেই কোয়ান্টাম তত্ত্ব কাজে লাগছে। আমাদের শরীরের অতিসূক্ষ্ম কোষের জটিল কাজকর্ম ব্যাখ্যা হোক, কিংবা হোক মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন – সবকিছুতেই সফলভাবে কাজ করছে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এমন এক কার্যকর তত্ত্বের বাস্তব কোন জগত নেই বলার অর্থ কি পুরো কোয়ান্টাম তত্ত্বকেই অস্বীকার করা? নোবেলজয়ী কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী যদি কোয়ান্টাম জগত অস্বীকার করেন, তবে আমরা কোথায় যাই!

কোয়ান্টাম তত্ত্বের দুর্বোধ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের সাবধানবাণী দিয়েছেন আইনস্টাইন-ফাইনম্যানের মতো মহাবিজ্ঞানীরা। কিন্তু তাতে কি কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেমে গেছে, কিংবা ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে? উত্তর হলো – না। গত একশ বছর ধরে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিজ্ঞানের জগতে দাপটের সঙ্গে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে। ২০২৫ সাল পদার্থবিজ্ঞানের কোয়ান্টাম বর্ষ হিসেবে পালিত হচ্ছে। এবং সেকারণেই বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবতে বসেছেন – কোয়ান্টাম তত্ত্ব আসলে কী! বাস্তব জগতের সাথে তার সম্পর্ক কেন এত গোলমেলে!

বিজ্ঞানী সাইলিঙ্গারের মতো সব বিজ্ঞানীই যে কোয়ান্টাম জগতকে অস্বীকার করছেন তা নয়। প্যারিসের পদার্থবিজ্ঞানী আলেন আসপেক্ট (Alain Aspect)-  যিনি একই ধরনের কোয়ান্টাম গবেষণার জন্য সাইলিঙ্গারের সাথেই নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন – এব্যাপারে একমত হননি। প্রফেসর আসপেক্ট মনে করে কোয়ান্টাম জগত পুরোপুরি বাস্তব, তবে প্রকৃতির মতোই রহস্যময় এর আচরণ।

কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও বাস্তব জগত সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আবার আলোচনায় সরব হয়েছেন সম্প্রতি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানসাময়িকী নেচার-এর একটি সমীক্ষার প্রেক্ষিতে। কোয়ান্টাম জগত সম্পর্কে খোদ কোয়ান্টাম তত্ত্বের গবেষকরাই কী ভাবেন, কীভাবে ব্যাখ্যা করেন এই জগতের নিয়মকানুন – সেটা খুঁজে বের করার জন্য একটি ব্যাপক সমীক্ষা চালায় নেচার। পনের হাজার কোয়ান্টাম গবেষকের কাছে সমীক্ষার প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়। এই গবেষকদের প্রত্যেকেই কোয়ান্টাম তত্ত্বের সক্রিয় গবেষক এবং সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল চাবিকাঠি শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের শতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে জার্মানির হেলিগোল্যান্ড দ্বীপের অনুষ্ঠানে যেসব কোয়ান্টাম মহারথীরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের কাছেও রাখা হয়েছিল প্রশ্নগুলি।

পনের হাজার বিজ্ঞানীকে প্রশ্ন পাঠানো হলেও মাত্র এগারো শ কোয়ান্টাম বিজ্ঞানী তাঁদের মতামত জানিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব সম্পর্কে। প্রায় চৌদ্দ হাজার বিজ্ঞানী এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার তাগিদও অনুভব করেননি। তবুও এধরনের সমীক্ষার মধ্যে নেচারের এই সমীক্ষাটিই এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড়। সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে – গবেষকরা এখনো ব্যাপকভাবে একমত হতে পারেননি কীভাবে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আড়ালে থাকা বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা যায়। তাতে এটাই আবারো প্রমাণিত হয় যে কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনো প্রহেলিকাময়।

বিজ্ঞানে এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সিভি রামন বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন – বিজ্ঞানে একটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের একটিই সঠিক উত্তর থাকে। কিন্তু যা কিছু বিজ্ঞান নয়, সেখানে একটি প্রশ্নের অনেকগুলি সঠিক উত্তর থাকতে পারে। কোয়ান্টাম তত্ত্বে আমরা একই প্রশ্নের অনেকগুলি সঠিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাই। সিভি রামনের হিসেব কট্টরভাবে মানতে গেলে বলতে হয় – বিজ্ঞান হিসেবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব মোটেও কট্টরপন্থী নয়। এতে বহুত্ববাদের স্থান আছে।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সঠিক ব্যাখ্যা কীভাবে করা হবে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধাবিভক্ত হলেও কোয়ান্টাম মেকানিকস প্রয়োগের নিয়মগুলি সুনির্দিষ্ট। যেমন কোনো ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে অনুমান করতে গেলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স একসাথে একাধিক সম্ভাব্য অবস্থার সুপারপজিশন বর্ণনা করে। এদের কোয়ান্টাম অবস্থা বর্ণনার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো ওয়েভ ফাংশান। শ্রোডিংগারের সমীকরণের সাহায্যে সমাধানযোগ্য ওয়েভ ফাংশান গঠন করে সমীকরণের সমাধান করতে পারলে ঘটনার সম্ভাব্য পরিণতি জানা যায়। কিন্তু ঘটনার ফলাফল কী হলো তা যখন পর্যবেক্ষণ করা হয় – তখন কোয়ান্টাম জগতের সম্ভাবনার ওয়েভ ফাংশান ভেঙে গিয়ে বাস্তব অবস্থা তৈরি করে যাতে একাধিক ঘটনার সুপারপজিশনের বদলে একটিমাত্র বাস্তব অবস্থা দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে শ্রোডিঙ্গারের বিখ্যাত বিড়ালের কথা ধরা যাক। যখন বিড়ালটি বাক্সের ভেতর থাকে এবং আমরা বিড়ালের প্রকৃত অবস্থা দেখতে পাই না – তখন বিভিন্ন অবস্থা বিবেচনায় বিড়ালটির প্রাণের ওয়েভ ফাংশান হতে পারে একই সাথে ‘বেঁচে আছে’ এবং ‘মরে গেছে’র সুপারপজিশন। কিন্তু বাক্স খুলে যখন দেখবো – তখন দেখতে পাবো একটি মাত্র অবস্থা -  বিড়ালটি হয় বেঁচে আছে, না হয় মরে গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, পর্যবেক্ষণ করলে কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশান ধ্বসে পড়ে। এখানেই প্রশ্ন জাগে – কোয়ান্টাম জগত বলতে আমরা কি ধরে নেবো যে ওটা অদৃশ্য জগত?

নেচারের সমীক্ষায় ওয়েভ ফাংশান সম্পর্কে  প্রশ্ন করা হয়েছিল – যে ওয়েভ ফাংশান কোন বস্তুর কোয়ান্টাম অবস্থার গাণিতিক বর্ণনা দেয় – তার কি বাস্তব কোন ভিত্তি আছে? শতকরা মাত্র ৩৬ ভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন যে ওয়েভ ফাংশান বাস্তব জগতের প্রতিনিধি। তাও মাত্র ১৭ শতাংশ মনে করেন যে এটি পুরোপুরি বাস্তব, ১৯ শতাংশ মনে করেন এটি আংশিক বাস্তব। কিন্তু ৪৭ শতাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন যে ওয়েভ ফাংশান শুধুওমাত্র একটি গাণিতিক উপকরণ যার সাহায্যে কোয়ান্টাম মেকানিকসের গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা যায়, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। আট শতাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন ওয়েভ ফাংশান আসলে পরীক্ষার ফলাফলে ব্যক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর উপাদান, অর্থাৎ এর সাহায্যে কোয়ান্টাম পরীক্ষার ফলাফল নিয়ন্ত্রণ করা যায়! আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো – বাকি শতকরা ১০ ভাগ বিজ্ঞানীর ৮ ভাগ মনে করেন ওয়েভ ফাংশান অন্যকিছু, এবং দুই ভাগের কোন ধারণাই নেই ওয়েভ ফাংশান কী জিনিস।

 

বস্তুর যে চিরায়ত ধারণা, তার সাথে কোয়ান্টাম বস্তুর ধারণার সাথে কি কোন বিরোধ আছে? সোজাসুজি বলতে গেলে কোয়ান্টাম বস্তু আর ক্লাসিক্যাল বস্তুর মধ্যে কি কোন নির্দিষ্ট সীমানা আছে যেটা পার হলে কোয়ান্টাম বস্তু ক্লাসিক্যাল বস্তু হয়ে যাবে, কিংবা ক্লাসিক্যাল বস্তু কোয়ান্টাম হয়ে যাবে? এই প্রশ্নেও বিজ্ঞানীরা বিভক্ত হয়ে গেছেন। শতকরা ৪৫ ভাগ মনে করেন সীমানা আছে (যার মধ্যে ৪০ ভাগ মনে করেন খুবই সুনির্দিষ্ট সীমানা আছে, ৫ ভাগ মনে করেন সীমানা আছে, তবে সুনির্দিষ্ট নয়)। ৪৫ শতাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন কোন সীমানা নেই ক্লাসিক্যাল ও কোয়ান্টাম বস্তুর মাঝখানে। বাকি দশ শতাংশ নিশ্চিত নন। 



কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর পর্যবেক্ষক নির্ভরতা। কোয়ান্টাম মেকানিক্স কণার আচরণের সম্ভাবনার কথা বলতে পারে, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কী হবে তা বলতে পারে না। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে কণাটিকে দেখতে হবে। এটা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম রহস্যে বিরক্ত হয়ে আইনস্টাইন তাঁর জীবনীকার আব্রাহাম পেইজকে প্রশ্ন করেছিলেন, “আচ্ছা, তুমি কি বিশ্বাস করো যে যখন তুমি চাঁদের দিকে তাকাও তখনি শুধু চাঁদের অস্তিত্ব আছে, আর অন্য সময়ে নেই?” আইনস্টাইন প্রশ্ন তুললেও কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা মেনে নিয়েছেন যে চাঁদের মতো বড় আকারের বস্তুর প্রসঙ্গে এরকম প্রশ্ন খাটে না। কিন্তু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার যে ধর্ম কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয় – সেখানে দেখা যায় – কোন একটি কণা কীরকম আচরণ করবে তা নির্ভর করে তার দর্শকের ওপর।

এই পুরনো প্রশ্নটি আবার উত্থাপন করা হয়েছিল নেচারের সমীক্ষায়। বিজ্ঞানীরা সেখানেও একমত হতে পারেননি। শতকরা ৫৬ ভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন যে কোয়ান্টাম ঘটনার পরিমাপ পর্যবেক্ষক-নির্ভর। শতকরা ৯ ভাগ মনে করেন যে পর্যবেক্ষকদের শুধুমাত্র তাকিয়ে দেখলেই চলবে না, কী ঘটছে সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে, অর্থাৎ ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝতে হবে। কিন্তু ২৮ শতাংশ মনে করেন কোয়ান্টাম ঘটনার পরিমাপেও কোন পর্যবেক্ষকের দরকার নেই। আট শতাংশ নিশ্চিত নন পর্যবেক্ষণের দরকার আছে কি নেই।

 

 

কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে যেসব পরীক্ষণের ভেতর দিয়ে, ডাবল স্লিট পরীক্ষণ তাদের অন্যতম। ইলেকট্রন যে কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্মই প্রদর্শন করে তার প্রমাণ পাওয়া যায় এই পরীক্ষণে। দুটো মাইক্রোস্কোপিক চিড়যুক্ত পর্দার দিকে যদি ইলেকট্রনের প্রবাহ পাঠানো হয়, এবং পর্দার অন্য পাশে ডিটেক্টরের সাহায্যে পর্দার চিড়ের ভেতর দিয়ে আসা ইলেকট্রনগুলির প্যাটার্ন রেকর্ড করলে দেখা যায় – একই ইলেকট্রন তরঙ্গের আকারে দুইটি চিড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে নিজেই নিজের তরঙ্গের সাথে ইন্টারফিয়ারেন্স তৈরি করেছে। কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে শুধুমাত্র যে কোনো একটি চিড়ের পেছনে ডিটেক্টর বসিয়ে ইলেকট্রনের প্যাটার্ন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় ইলেকট্রনগুলি কণার মতো চিড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে একই সরলরেখায় গিয়ে পড়েছে। এই পরীক্ষণের ফলাফলকে সত্য ধরে নিয়েই কোয়ান্টাম তত্ত্ব এগিয়েছে – যার মাধ্যমে আমরা কণা-তরঙ্গের দ্বৈতসত্ত্বা মেনে নিই।

নেচারের সমীক্ষায় এই পরীক্ষণের ফলাফল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল – যখন কেউ পর্যবেক্ষণ করছে না, তখন কি ইলেকট্রনগুলি দুইটি চিড়ের ভেতর দিয়েই যায়? ৪৮ শতাংশ বিজ্ঞানী এই প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। বলেছেন কোয়ান্টাম বস্তুর ক্ষেত্রে এরকম প্রশ্ন অবান্তর। অন্যদিকে ৩১ শতাংশ বিজ্ঞানী মনে করেছেন হ্যাঁ, আর ১৪ শতাংশ বিজ্ঞানী মনে করেছেন – না। ছয় শতাংশ বিজ্ঞানী নিশ্চিত নন কীভাবে এই ইলেকট্রনগুলি উভয় চিড়ের ভেতর দিয়ে যায়, সেখানে পর্যবেক্ষণের ভূমিকা আছে কি নেই।

 

 

কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতিষ্ঠিত ঘটনাগুলি সম্পর্কেও কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীরা একমত হতে পারছেন না, এর চেয়ে আশ্চর্যের আর কী হতে পারে। এটি ইঙ্গিত করে যে গবেষকদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাজন রয়েছে—একদিকে আছেন যারা ‘বাস্তববাদী’ (realist) দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, অর্থাৎ সমীকরণগুলিকে বাস্তব জগতে প্রতিফলিত মনে করেন তারা; অন্যদিকে আছেন যারা জ্ঞাতবাদী’ (epistemic) দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করেন, অর্থাৎ যাদের মতে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা কেবলমাত্র তথ্য নিয়েই কাজকারবার করে, বাস্তবতার সাথে মিল না থাকলেও।

কোয়ান্টাম জগতকে কীভাবে বাস্তব জগতের প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছেন। নেচারের এই সমীক্ষায় গবেষকদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁদের মতে কোয়ান্টাম ঘটনাবলী ও পারস্পরিক ক্রিয়ার সর্বোত্তম ব্যাখ্যা কোনটি — অর্থাৎ তত্ত্বের গণিতকে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত করার জন্য বিজ্ঞানীরা যে বিভিন্ন প্রচেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে তাঁদের পছন্দের কোনটি। সবচেয়ে বড় অংশের উত্তর (৩৬%) ছিল কোপেনহেগেন ব্যাখ্যার পক্ষে। তাঁদের উত্তরের বিষয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন করা হলে, মাত্র ২৪% মনে করেন যে তাঁদের পছন্দের ব্যাখ্যাটিই সঠিক; বাকিরা একে কেবল যথাযথ বা কিছু পরিস্থিতিতে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছেন।

 

 

অনেক গবেষকের এক প্রশ্নের উত্তরের সাথে সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরের অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। তার মানে কি এই যে অনেক কোয়ান্টাম গবেষক কেবল কোয়ান্টাম তত্ত্ব ব্যবহার করেন, কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ নিয়ে গভীরভাবে ভাবেন না! মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী এই পদ্ধতির নাম দিয়েছিলেন – শাট আপ আন্ড ক্যালকুলেট!!

এই যে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনপ্রিয় ব্যাখ্যা – কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা – এটি আসলে কী? কোয়ান্টাম তত্ত্বে কোনো বস্তুর আচরণকে চিহ্নিত করা হয় তার ওয়েভফাংশন দ্বারা। আরভিন শ্রোডিঙ্গার তাঁর বিখ্যাত সমীকরণের মাধ্যমে কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশানের প্রচলন করেছেন একশ বছর আগে। ওয়েভফাংশন একটি কোয়ান্টাম অবস্থার যতগুলি সম্ভাবনা থাকতে পারে তার সবগুলির গাণিতিক সুপারপজিশনের ধারণা দেয়। কোয়ান্টাম মেকানিকসের এসব ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স আবিষ্কৃত হয়েছে যাদের হাতে তাঁরাই - শ্রোডিঙ্গার, হাইজেনবার্গ, নিলস বোর। কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোয়ান্টাম মেকানিকসের মৌলিক গবেষণা হয়েছিল বলেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই মূল ব্যাখ্যাটার নাম দেয়া হয়েছে কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা প্রধান। মৌলিক কণাগুলি এখানে কণা এবং তরঙ্গ উভয় ধর্ম প্রদর্শন করে। কোয়ান্টাম টানেলিং এবং কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলমেন্ট এই ব্যাখ্যায় স্বীকৃত। তাই এটি বহুল জনপ্রিয়ও বটে।

কিন্তু এর প্রধান দুর্বলতা হলো – বাস্তব জগতের সাথে মেলাতে গেলে এই ব্যাখ্যাকে পুরোপুরি বিজ্ঞান বলে মনে হয় না। কারণ এই ব্যাখ্যা বাস্তব ঘটনার সম্ভাবনার কথা বলে – সুনির্দিষ্টভাবে আগে থেকেই বলে দিতে পারে না আসলে কী ঘটবে। কিন্তু কোপেনহেগেন-প্রিয় বিজ্ঞানীদের কাছে এটিই বাস্তব। ফলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আরেকটু বেশি বাস্তববাদী দলের উদ্ভব ঘটেছে যাঁরা মনে করেন – ওয়েভ ফাংশান কেবলই একটি গাণিতিক উপকরণ যা গাণিতিক সমস্যার সমাধান করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে ওয়েভ ফাংশান দেখা সম্ভব নয়, কারণ দেখতে গেলেই ওয়েভ ফাংশান ধ্বসে পড়ে। তারই প্রতিফলন দেখা গেছে নেচারের সমীক্ষায় যেখানে ১৭ শতাংশ বিজ্ঞানী একটি জ্ঞাতবাদী ব্যাখ্যায় সমর্থন দিয়েছেন। জ্ঞাতবাদী এই অর্থে যে ওয়েভ ফাংশানগুলি তৈরি করা হয় একজন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গিতে – মানে আগে থেকেই ধারণা করে নেয়া হচ্ছে ফলাফল কী হতে পারে।

কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে অস্বস্তির কারণ ঘটে যখন বলা হয় যে ওয়েভ ফাংশানগুলি ধ্বসে পড়ে যখন সেদিকে তাকানো হয়। ১৯৫৭ সালে মার্কিন পদার্থবিদ হিউ এভারেট এই সমস্যা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রস্তাব করেন মেনি ওয়ার্ল্ড বা বহুবিশ্ব তত্ত্বের। তাঁর মতে কণা প্রকৃতপক্ষে একধরণের অর্থে একাধিক স্থানে একই সময়ে উপস্থিত থাকে। একটি বিশ্বে পর্যবেক্ষক যখন কণার পরিমাপ করবেন, তিনি কেবল একটি ফলাফল দেখবেন। কিন্তু তাতে ওয়েভফাংশন কখনও প্রকৃতপক্ষে ধ্বসে যায় না। বরং এটি অনেক বিশ্বে বিভক্ত হয়ে যায়, প্রতিটি ভিন্ন ফলাফলের জন্য একটি নতুন বিশ্ব তৈরি হয়। এই বিশ্বও যে কাল্পনিক বিশ্ব তাতে কোন সন্দেহ নেই। সমীক্ষায় দেখা গেছে ১৫ শতাংশ বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম বহুবিশ্ব তত্ত্বের ধারণা পছন্দ করেন।

যতই দিন যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন ধারণা নিয়ে হাজির হচ্ছেন। তবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব যে এখনো অসম্পূর্ণ তা অনেকটাই প্রমাণিত। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্স ইতিহাসের সবচেয়ে পরীক্ষামূলকভাবে যাচাই করা তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি হলেও, এর গণিত মাধ্যাকর্ষণ (gravity) বর্ণনা করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে কোনো একদিন আরো উন্নততর কোয়ান্টাম মেকানিক্স উদ্ভূত হয়ে তার বর্তমানের খামতি পূরণ করবে।

 

তথ্যসূত্র

১। বিজ্ঞানচিন্তা অক্টোবর ২০২২

২। ন্যাচার, ১২ আগস্ট ২০২৫

৩। সায়েন্টিফিক আমেরিকান, ৮ আগস্ট ২০২৫

=============

বিজ্ঞানচিন্তা সেপ্টেম্বর ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত








Latest Post

কোয়ান্টাম-সুড়ঙ্গে অতিপরিবাহিতা

  পদার্থবিজ্ঞানীরা ভূতে বিশ্বাস না করলেও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অদ্ভুত ভূতুড়ে কাজকর্মকে অস্বীকার করার কোনো উপায় তাঁদের নেই। কোয়ান্টাম মেকানিক...

Popular Posts