Wednesday, 20 August 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর 'বেগানা পুষ্প'

 




বেগানা পুষ্প পড়তে শুরু করার আগেই চোখে পড়ে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” – যেখানে লেখা আছে “অতীব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, মারাত্মকভাবে ১৮+, অনুগ্রহপূর্বক প্রাপ্ত বয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠকের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থটি দূরে সরিয়ে রাখুন। অজাগর মন ও মগজের কুপ্রভাব থেকে বেগানা উপাখ্যানের স্বাস্থ্য রক্ষায় যত্নবান হোন। আদেশক্রমে, কর্তৃপক্ষ।“

ব্যাপারটি যে ভীষণ নতুন - তা নয়। শতাব্দী আগে আঠারো পেরিয়েছি। আমার নিজস্ব আঠারোর আগেই কত ধরনের ১৮+ মার্কা বই পড়ে ফেলেছিলাম – সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ১৮+ বিজ্ঞাপিত যেসব বই যেসব “নিষিদ্ধ” আশায় হস্তগত করে দ্রুত গিলে ফেলেছিলাম তাদের বেশিরভাগের বিজ্ঞাপনই সার, ভেতরে সারবস্তু কিছুই নেই। বেগানা পুষ্পের ক্ষেত্রে প্রশ্ন বয়সের নয়, প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বলা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠক যেন বেগানা পুষ্পের স্পর্শ না পায়। প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠকের সংজ্ঞা কী? তাদের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব কার?

যাই হোক – এই লাইনগুলি বইয়ের শুরুতে ছাপিয়ে দেয়ার তাগিদ লেখকের না প্রকাশকের জানি না। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাঁর গল্প তিনি কীভাবে বলবেন, কতটুকু বলবেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কী কী করবে – গল্পের কাঠামোর ভেতর থেকে কীভাবে বেড়ে উঠবে, কীভাবে প্রথা ভাঙবে – সবই লেখকের হাতে। সৃজনশীল লেখকদের ক্ষমতা তাঁর সৃজনশীলতার কারণেই ঈর্ষণীয়। মুহম্মদ নিজামের সৃজনক্ষমতা ঈর্ষণীয়।

“বেগানা পুষ্প”র নায়ক জীবন আহমেদ। জীবনের গল্প জীবনের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন লেখক মুহম্মদ নিজাম। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের সুবিধে হলো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীতার পাশাপাশি মনে মগজে কী চলছে তার শৈল্পিক বর্ণনার সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধাটি অসুবিধাও বটে। কারণ উত্তম পুরুষে বলা গল্পের দৃষ্টি একমুখি হয়। সবার মনের কথা খুলে বলার স্বাধীনতা তখন লেখকের থাকে না। বেগানা পুষ্পও সে হিসেবে শুধুমাত্র জীবনের দৃষ্টিতে দেখা একপাক্ষিক বিবরণ। বিথীর অন্তর্দহন কিংবা আনুষঙ্গিক মিথষ্ক্রিয়ার বিবরণও জীবন যতটুকু দিয়েছে ততটুকুই।

বেগানা পুষ্প প্রেমের উপন্যাস। ম্যাটম্যাটে মধ্যবিত্ত সংস্কারে আবদ্ধ জলে-নামবো-চুল-ভেজাবো-না ধরনের প্রেম নয়। উদ্দাম শরীরী প্রেম। শরীর বিনিময়ের বিশদ বিবরণ আছে বলেই হয়তো গল্প শুরুর আগে সেই ১৮+ এর আদিখ্যেতা। যদিও লেখক এখানে প্রেমের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ব্যবধান বর্ণনা করেছেন এভাবে – “প্রেম হল মধ্যবিত্তের পূজার থালা কিংবা ছেলেবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া জমজ ভাই। সে যখন এই জিনিসের সাক্ষাৎ পায়, আবেগে আবেশে দিশেহারা হয়ে যায়। আর ভোগবাদী বড়লোকেরা কুরবানীর পশুর মতো যত্ন করে ঘরে তোলে, আয়োজন করে জবাই দেয়। এরপর তেলে হলুদে আদায় লবঙ্গে মরিচে মাখামাখি করে কষিয়ে জ্বালানি দেয়, রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে।“ [পৃ ৩৯-৪০]।

ছোট ক্যানভাসে রঙের আধিক্য ঘটলে, কিংবা তুলির আঁচড় মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বাস্তব পরাবাস্তবের সীমানা ঘুচে যায়, বেগানা পুষ্পেও সেরকম ঘটেছে। ইতিহাস দর্শন সমাজ এবং সমাজের মানুষ সব যেভাবে তালগোল পাকিয়ে থাকে – তার সবকিছুই কিছু কিছু আঁকতে চেয়েছেন লেখক এখানে।

জীবন লেখক হবার স্বপ্ন দ্যাখে, আবার এক সময় লন্ডন যাবার চেষ্টাও করে। কিন্তু বিথীর শরীর বেয়ে প্রেমে পড়ে যাবার পর সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। বিথী যখন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় – তখন বর্তমানকে অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার কৌশল চমৎকার।

জীবনের ভাবনার মধ্য দিয়ে লেখক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিয়েছেন। যেমন, “ভিড়ের ভেতর ভ্রান্তি থাকে, জ্ঞান থাকে যৎসামান্য। নীলক্ষেতের কোন একটা বইয়ের দোকানের কোণায় পড়ে থাকা “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী” কিংবা “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা” বইয়ে যে পরিমাণ সত্যবদ্ধ ঘটনা রয়েছে, সমগ্র ঢাকা শহরের যাবতীয় জনমানুষের ভিড়ে একযুগ ঘুরেফিরেও এইটুকু সত্য কেউ আহরণ করতে পারবে না।“ [পৃ ৬২]

পুরুষের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জীবনের পর্যবেক্ষণ নির্মম: “একটা পুরুষ একটা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট এবং বিকৃত আচরণ করার ক্ষমতা রাখে। এই পৃথিবীর মেয়েরাই শুধু সেই দৃশ্যগুলোর সাক্ষী থাকে। পুরুষ জাতির পরম সৌভাগ্য যে, প্রিয়তম নারী জাতি সীমাহীন গ্লানি কিংবা অতলান্ত ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ জাতির এই কদর্য দিকটা সভ্য মানুষের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখে।“ [পৃ ৬৭]

পুরুষ মানুষ প্রেমিকার জন্য কাউকে খুনও করতে পারে। এটা দেখা গেল জীবনের বেলায়। আজমল বিথীকে নিয়ে বাজে প্রস্তাব করায়, জীবন ও বিথীর গোপন মিলনের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টার কারণে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে আজমলকে খুন করে জীবন। তবে এটা কি শুধুমাত্র বিথীর সম্মান বাঁচাতে, নাকি নিজেরও – এটা পরিষ্কার হয় না। তবে আজমলকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার পরও জীবন কীভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকে – এটাই আশ্চর্যের। পাঠক হবার এখানেই আনন্দ যে –  একজন খুনি কিংবা ধর্ষকও যদি নিজে কথা বলে - পাঠকের কাছে সবকিছুই অবলীলায় বলে ফেলে – লজ্জা কিংবা ভয় না করেই। 

বইটির ছাপা এবং বাঁধাই বেশ উন্নত। বানান ভুল মাত্র কয়েকটি। নীলা হারুনের প্রচ্ছদ সুন্দর। তবে প্রকাশনীর নাম “নয়েস” – শুনতে কেমন যেন লাগে।

মুহম্মদ নিজাম একটি ভালো গল্প বলেছেন। ভালোভাবেই বলেছেন।


Wednesday, 13 August 2025

ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার – রসায়নের মহানায়ক

 



পৃথিবীতে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৯ কোটি। তাঁদের মধ্যে পনেরো কোটির বেশি মানুষকে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। এই ইনসুলিন নেয়া মানুষগুলির মধ্যে কতজন এই ছবির মানুষটিকে চিনেন আমি জানি না। এই মানুষটির নাম ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার। ইনসুলিনে অ্যামিনো অ্যাসিডের নিখুঁত সিকোয়েন্সিং আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তারই ফলশ্রুতিতে গবেষণাগারে ইনসুলিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা বর্তমানে রোগীরা ব্যবহার করছে। তার আগে ইনসুলিন সংগ্রহ করতে হতো গরু ও শুকরের অগ্নাশয় থেকে। 

এই মানুষটিকে রসায়নের মহানায়ক বললেও খুব কম বলা হয়। একটি নোবেল পুরষ্কার পেলেই কেউ কেউ যেখানে বিরাট রাজা হয়ে যান, সেখানে এই মানুষটি দুইবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন রসায়নবিজ্ঞানে। ১৯৫৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ইনসুলিনের গঠন আবিষ্কার করার জন্য। এরপর ১৯৮০ সালে আবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর জন্য। তাঁরই আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের শনাক্তকরণ পদ্ধতি – যেই ডাটা থেকে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে ভাইরাসের টিকা। 

রসায়নের এই মহানায়কের বিজ্ঞান-কাহিনি বিশাল। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি এতটাই মাটির মানুষ ছিলেন যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শুধুমাত্র “স্যার” ডাক শুনতে হবে বলে। অথচ কোন কোন দেশে “স্যার” বলে সম্বোধন না করলে অনেকে রেগে যান বলে শুনেছি।  উচ্চপদস্থ নারী-পুরুষ সবাইকে “স্যার” ডাকার বাধ্যতামূলক আইনও নাকি তৈরি করা হয়েছিল কোন একটি দেশে। 

নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার অকপটে বলেছেন, “আমি পড়াশোনায় কখনো ব্রিলিয়্যান্ট ছিলাম না। ছাত্রজীবনে কখনো কোন স্কলারশিপ পাইনি। আমার বাবার টাকা না থাকলে আমি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগই হয়তো পেতাম না।“ 

এই মানুষটি ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ করার সাথে সাথে গবেষণার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র থাকা অবস্থাতেই অবসর গ্রহণ করে বাকিটা জীবন (তিনি ৯৫ বছর বেঁচেছিলেন) বাড়ির নিভৃতে বাগান করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। অবসর গ্রহণ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন সেটাও অনন্য। তিনি বলেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আমার কর্মক্ষমতা কমে যাবে, তখন ভুল করতে শুরু করবো, সাফল্যের  চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণ বাড়তে শুরু করবে। তখন আমার কাজের ব্যর্থতার সমালোচনা করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও আমার এতদিনের খ্যাতির কারণে হয়তো অনেকে সংকোচ বা ভদ্রতাবশত আমার সমালোচনা করবে না। আমি সেটা চাই না। আমি শুধু শুধু চেয়ার দখল করে থাকার চেয়ে অনেক ভালো যদি আমি আমার চেয়ারটি যথাসময়ে খালি করে দিই – যেখানে নতুন কেউ এসে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে।

১৩ আগস্ট ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গারের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মহানায়ক।


Monday, 4 August 2025

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি: আমাদের মহাজাগতিক ঠিকানা

 



যে পৃথিবীতে আমাদের বসবাস সে পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ঠিকানা আছে। আধুনিক স্যাটেলাইটের কল্যাণে জিপিএস আমাদের অবস্থান (লোকেশান) মুহূর্তেই খুঁজে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়?

প্ল্যানেট আর্থ – পৃথিবী নামের এই গ্রহটি আমাদের কাছে যতই অনন্য হোক না কেন – মহাবিশ্বে গ্রহের আনুমানিক সংখ্যা এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১০২৪)। এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী গ্রহের আছে তার নিজস্ব সৌরজগৎ। এরকম কোটি কোটি কোটি নক্ষত্রজগত আছে মহাবিশ্বে। এই নক্ষত্রগুলির আবার আছে নিজস্ব ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি – যেখানে নক্ষত্রগুলি জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। মহাবিশ্বে আনুমানিক দুই লক্ষ কোটি (দুই ট্রিলিয়ন) গ্যালাক্সি আছে। আমাদের সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত – তার নাম মিল্কিওয়ে। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত নক্ষত্রের সংখ্যা হতে পারে দশ হাজার কোটি থেকে চল্লিশ হাজার কোটি। এতগুলি সূর্যের ভীড়ে আমাদের সৌরজগৎ-এর নাক্ষত্রিক ঠিকানা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন কয়েক শ বছরের নিরলস জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা্র মাধ্যমে।

আজ আমরা  মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদের পৃথিবীর ঠিকানা বলতে পারি এভাবে: দৃশ্যমান মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে আমরা থাকি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ছোট বড় আরো চুয়ান্নটি গ্যালাক্সি মিলে একটি গ্যালাক্সি-পাড়া বা লোকাল গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই পাড়ায় আমাদের গ্যালাক্সি থেকে সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো ক্যানিস মেজর ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি – যা ছোট একটি গ্যালাক্সি। পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই গ্যালাক্সিকে আমাদের গ্যালাক্সি আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে (মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছে নিয়ে আসছে)। আমাদের গ্যালাক্সি পাড়ার সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। এই অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এত বিশাল এবং এত উজ্জ্বল যে আমাদের কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী থেকে আমরা খালি চোখেও এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রমন্ডলী দেখতে পাই। তবে আমাদের জন্য বিপদ এই যে আগামী চার শ কোটি থেকে পাঁচ শ কোটি বছরের মধ্যে  অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে গিলে খাবে – অর্থাৎ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি মিশে যাবে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে। আরো বিশাল সেই মহা-গ্যালাক্সির নাম হবে মিল্কোমিডা।

কিন্তু এতসব আমরা জানলাম কীভাবে? আমাদের গ্যালাক্সির নামই বা কেন হলো মিল্কিওয়ে?


পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব যখন হয়েছে ততদিনে মহাবিশ্বের বয়স হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। আর মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। তাই আদিমানুষ আকাশের দিকে চোখ তুলেই দেখতে পেয়েছে দিনের বেলা সূর্য আলো দিচ্ছে, আর সূর্য ডোবার পর লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রাতের অন্ধকারে মিটমিট করছে। মানুষের অদম্য কৌতুহল আর অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্ম নিয়েছে মহাকাশবিজ্ঞান – পর্যবেক্ষণই যার প্রধান অবলম্বন। প্রকৃতিনির্ভর অসহায় আদিমানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রচন্ড ভয় পেতো। সেই ভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ভক্তি এবং নানারকমের দেবদেবীর কল্পকাহিনি। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নক্ষত্র-ছড়ানো ছায়াপথ দেখতে দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে বিভিন্ন কাহিনি।

ভারতীয় কাহিনিতে আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। প্রাচীন মুনিঋষিরা ধারণা করে নিয়েছিলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত যে নক্ষত্রমন্ডলি দেখা যায় তা আসলে স্বর্গে বয়ে চলা নাক্ষত্রিক নদী। গঙ্গা নদীর সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় আকাশগঙ্গা। এই আকাশগঙ্গার সাথে মিল্কিওয়ে নামের সরাসরি কোন শাব্দিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং গ্রিক এবং রোমান গল্পে সরাসরি ‘মিল্কিওয়ে’ শব্দটির উৎস পাওয়া যায়।

 গ্রিকদের গল্পে আছে – দেবতা জিউস আল্কমেনা নামে এক মানবীর প্রেমে পড়ে। জিউস ও আল্কমেনার একটি সন্তান হয়, যার নাম হারকিউলিস। হারকিউলিসের মা যেহেতু দেবতা নন, তাই হারকিউলিস জন্মসূত্রে অমরত্ব পাননি। জিউস জানেন হারকিউলিসকে যদি কোন দেবীর বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তাহলে হারকিউলিস অমরত্ব লাভ করবে। দেবী হেরা ছিলেন জিউসের স্ত্রী। হারকিউলিস যেহেতু হেরার সন্তান নয়, হেরা স্বাভাবিকভাবে হারকিউলিসকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াবেন না। তাই জিউস একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। একদিন হেরা যখন ঘুমাচ্ছিলেন, জিউস ছোট্ট হারকিউলিসকে হেরার বুকে দিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর হেরা যখন দেখলেন শিশু হারকিউলিস তার বুকের দুধ পান করছে – দ্রুত হারকিউলিসকে বুক থেকে সরিয়ে দিলেন। এই সময় হেরার বুক থেকে দুধ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে তৈরি হয়েছে “গ্যালাক্সিয়াস কাইক্লস” যার ইংরেজি অনুবাদ মিল্কি ওয়ে। রোমানদের গল্পও প্রায় একই রকম। এসব গল্প খ্রিস্টজন্মের অনেক বছর আগের। এরপর বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমাদের গ্যালাক্সির নাম সেই প্রাচীন মিল্কিওয়েই রয়ে গেছে।

 

যতদিন পর্যন্ত খালিচোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে, গ্যালাক্সি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানার পরিধি বিস্তার লাভ করেছে খুবই ধীর প্রক্রিয়ায়। পৌরাণিক কাহিনি বিশ্বাস করে কেউ কেউ এই ছায়াপথকে দুধের নদী বললেও – মানুষ ক্রমেই বুঝতে পেরেছে এর সাথে প্রাকৃতিক কোন ঘটনার যোগাযোগ আছে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল মত দিয়েছিলেন এই ছায়াপথ হলো নক্ষত্র থেকে জ্বলন্ত বাষ্পের নিঃসরণ। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত এরকম গ্রিক ধারণাই প্রচলিত ছিল।

কিন্তু নবম শতাব্দী থেকে এই ধারণার বদলে বাস্তবধর্মী বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। নবম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে খাতির আল-ফারগানি তাঁর “কিতাব ফি আল-হারাকাত আল-সামাইয়া ওয়া জাওয়ামি ইল্‌ম আল-নুজুম” [ইলিমেন্টস অব অ্যাস্ট্রোনমি] বইতে পৃথিবীর ব্যাস, পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব পরিমাপের পাশাপাশি ছায়াপথ সম্পর্কেও কিছু নতুন ধারণা দেন। তিনি মিল্কিওয়েকে আকাশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেন যা ছিল গ্রিকদের কাল্পনিক ধারণা থেকে অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি [১]।

দশম শতাব্দীতে গ্যালাক্সি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণার আরো উন্নতি হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জ্যোতির্বিদদের হাত ধরে। ইরানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-হুসাইন আবদুর রহমান ইবনে উমর আল-সুফি ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর “কিতাব আল-কাওয়াকিব আল-তাবিদ আল-মুসাওয়ার” [দ্য বুক অব ফিক্সড স্টারস] বইতে ৪৮টি তারামন্ডলের বর্ণনা দেন। মিল্কিওয়ে ছাড়াও আমাদের আকাশ থেকে আরো উজ্জ্বল যে অন্য ছায়াপথ “অ্যান্ড্রোমিডা” দেখা যায় – তার প্রথম বৈজ্ঞানিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এই বইতে। অ্যান্ড্রোমিডা নামটি দেয়া হয়েছে গ্রিক পুরানের রাজকন্যা অ্যান্ড্রোমিডার নাম অনুসারে। সেই সময় অবশ্য মনে করা হতো অ্যান্ড্রোমিডা মিল্কিওয়েরই অংশ। বিজ্ঞানী আল-সুফিই সর্বপ্রথম অ্যান্ড্রোমিডার প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।

সেই সময়কার আরেক বিজ্ঞানী আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাসান ইবনে আল-হাইথাম, যিনি আলজাহিন নামে পরিচিত ছিলেন এবং যাঁকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক মনে করা হতো, টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১০১১-১২ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত “কিতাব আল-মানাজির” [দ্য বুক অব অপটিকস]-এ তিনিই সর্বপ্রথম সম্ভাবনা প্রকাশ করেন যে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ হতে পারে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি – যা দূরত্বের কারণে একটি আলোক রেখার মতো দেখায়। টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হবার পাঁচ শ বছরেরও আগে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন – পরবর্তীতে আমরা তা সত্য বলে প্রমাণিত হতে দেখেছি। দ্বাদশ শতকে স্পেনের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ আবু আল-ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদও মিল্কিওয়েকে অনেকগুলি নক্ষত্রের সমষ্টি বলে অনুমান করেছেন যা পরবর্তীতে আশ্চর্যজনকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর আকাশ পর্যবেক্ষণ নতুন মাত্রায় উন্নীত হলো। আমরা সবাই জানি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে গ্যালিলিওরও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহার করেছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানী লিওনার্ড ডিগেস ১৫৫১ সালে [২]। তাঁর পুত্র থমাস ডিগেসও ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৫৫৯ সালে লিওনার্ড ডিগেসের মৃত্যু হলে থমাস ডিগেস তাঁর বাবার অসমাপ্ত গবেষণা চালিয়ে নেন। ১৫৭১ সালে তিনি তাঁর বাবার লেখা একটি বই প্রকাশ করেন যাতে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহারের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইতে মহাবিশ্বের অসীমতা এবং অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলী গুচ্ছাকারে ছায়াপথ তৈরি করার সম্ভাবনার কথা বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে বলা চলে মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য নক্ষত্রের সম্মিলন তা টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রকাশ করেছিলেন থমাস ডিগেস - গ্যালিলিওরও অনেক বছর আগে।  

১৬১০ সালে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ তাক করলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া মিল্কিওয়ের দিকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন খালি চোখে আবছা মেঘের মতো যা দেখা যায় – তাতে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র। এত বেশি নক্ষত্র সেখানে যে তার সীমিত শক্তির টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা গণনা করা ছিল অসম্ভব [৩]। তবে গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণ থেকে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল তা ভেঙে যায়। মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য তারার সমষ্টি সেই ধারণা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করতে শুরু করেন।

কিন্তু মিল্কিওয়ের আকার, আয়তন, গতি ইত্যাদি নিরুপনের কাজ শুরু হয় আরো প্রায় দেড়শো বছর পর। ইংরেজ দার্শনিক থমাস রাইট ১৭৫০ সালে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বীয় ধারণা দেন তাঁর ‘এন অরিজিনাল থিওরি অর নিউ হাইপোথিসিস অব দ্য ইউনিভার্স’ বইতে। তিনি মনে করেন মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি চাকতির মতো দুটো স্তরে সজ্জিত। সেখানে আমাদের সূর্যের অবস্থানও তিনি প্রায়-সঠিকভাবে অনুমান করেন – যা চাকতির কেন্দ্র থেকে দূরে কিনারার একটি প্রান্তে অবস্থিত। গ্যালিলিওর পরে আরো অনেকে মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন টেলিস্কোপের সাহায্যে। মিল্কিওয়ের কিনারায় ছোপ ছোপ মেঘের মতো উজ্জ্বল যে বস্তু দেখা যায় তাকে গ্যালিলিও নেবুলা বা নক্ষত্র তৈরির কারখানা হিসেবে ধারণা দিয়েছিলেন। থমাস রাইট ধারণা দিলেন যে ওগুলি মিল্কিওয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন, হতে পারে অন্য কোন নক্ষত্রমন্ডলির অংশ। সমসাময়িক সুইডিশ দার্শনিক ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ, জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, সুইস-জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জোহান হেনরিক ল্যামবার্ট প্রমুখ মিল্কিওয়ের নক্ষত্র সম্পর্কে থমাস রাইটের ধারণাকে সমর্থন দেন [৪]। কিন্তু এর সবগুলি ছিল পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক দার্শনিক অনুমান।

মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলির অবস্থান এবং উজ্জ্বলতার বৈজ্ঞানিক পরিমাপ শুরু করেন স্যার উইলিয়াম হারশেল ১৭৮০ সালে। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অনেকগুলি উন্নতমানের টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং সেগুলি দিয়ে নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ করে ১৭৮১ সালে সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। মিল্কিওয়ের বিভিন্ন দিক থেকে নক্ষত্রগুলির অবস্থান নির্ণয় করে তিনি মিল্কিওয়ের একটি ম্যাপ তৈরি করেন। ১৭৮৫ সালে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশানে প্রকাশিত [সংখ্যা ৭৫, পৃ ২১৩-২৬৬] মিল্কিওয়ের ম্যাপ থেকে দেখা যায়, হারশেল আমাদের সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে। মিল্কিওয়ের দৈর্ঘ্য তিনি নির্ণয় করেছেন সেখানে অবস্থিত নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ৮০০ গুণ, আর প্রস্থ হিসেব করেছেন নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ১৫০ গুণ। হারশেল ধরে নিয়েছিলেন মিল্কিওয়ের প্রতি একক আয়তনে সমান সংখ্যক নক্ষত্র আছে।  তাঁর হিসেব থেকে মিল্কিওয়ের সত্যিকারের আয়তন নির্ণয় করার কোন উপায় ছিল না, কারণ পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রেরই সঠিক দূরত্ব তখনো নির্ণয় করা যায়নি। মিল্কিওয়ের আকার আকৃতির সঠিক পরিমাপের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

 



উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপ (১৭৮৫)


১৮৪৭ সালে রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী অটো স্ট্রুভ প্রমাণ দিলেন যে মিল্কি ওয়ের সব জায়গায় সমান সংখ্যক নক্ষত্র নেই। অর্থাৎ উইলিয়াম হারশেল যে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রের ঘনত্ব সমান বলে ধারণা করেছিলেন তা সঠিক ছিল না। তাহলে উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপের আকৃতি ঠিক থাকলেও তার ভেতর আমাদের সূর্যের অবস্থান সঠিক নয়। ততদিনে পৃথিবী থেকে সূর্য এবং সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহের দূরত্ব নির্ণয় করা হয়ে গেছে। তার ভিত্তিতে অটো স্ট্রুভ মিল্কিওয়ের আকার নির্ণয় করলেন। তিনি দেখালেন চ্যাপ্টা চাকতির মতো মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব কমপক্ষে তেরো হাজার আলোকবর্ষ। অর্থাৎ মিল্কিওয়ের এক প্রান্তের একটি নক্ষত্রের আলো অন্য প্রান্তের নক্ষত্রে পৌঁছাতে তেরো হাজার বছর সময় লাগবে। বর্তমানে আমরা জানি মিল্কিওয়ের আকার এর চেয়ে আরো অনেক অনেক বড়। সে কথায় আমরা আসবো একটু পর।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই টেলিস্কোপের শক্তি এবং ব্যাপ্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি অবজারভেটরি বা মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঠিক আকার ও আয়তন সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে – তাঁর নাম হারলো শাপলি, মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির উদীয়মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবার কোন লক্ষ্যই ছিল না হারলো শাপলির। আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে। ছোট্ট এক রুমের একটি স্কুলে তাঁর প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা। ষোল বছর বয়সে ক্যানসাসের ডেইলি সান পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর তিনি সাংবাদিকতা পড়ার জন্য গেলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গিয়ে দেখেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ তখনো খোলা হয়নি। অন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ঠিক করলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভর্তি্র ক্যাটালগে প্রথম যে বিভাগের নাম পাবেন সেই বিভাগেই ভর্তি হয়ে যাবেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যেতো। ক্যাটালগের প্রথম নামটি ছিল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের। হারলো শাপলি ‘আর্কিওলজি’ শব্দটি উচ্চারণ করতে না পেরে পরের নামে গেলেন। পরের নামটি ছিল অ্যাস্ট্রোনমি। শাপলি অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে গেলেন  [৫]। এরপর দ্রুত ইতিহাস তৈরি করলেন তিনি। ১৯১০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি গেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেলের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন শাপলি। ১৯১৪ সালে পিএইচডি শেষ করার পর পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে কাজ পেলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে। সেখানকার ১.৫২ মিটার ব্যাসের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি দিনরাত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মিল্কি ওয়ের সঠিক আকার নির্ণয় করেন। যদিও পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে শাপলির পরিমাপে কিছুটা ভুল ছিল, তবুও সেই ১৯১৮ সালে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির এত বিস্তারিত পরিমাপ জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। হারলো শাপলি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। [পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।]

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির যে আকার শাপলি নির্ণয় করেছিলেন তার আয়তন এত বেশি ছিল যে তিনিসহ আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেই সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র গ্যালাক্সি যা পুরো মহাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। ক্যালিফোর্নিয়ার লিক অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেবার কারটিস এবং তাঁর দল তাঁদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দাবি করলেন – মিল্কি ওয়ে মহাবিশ্বের একটি গ্যালাক্সি, একমাত্র গ্যালাক্সি নয়। মহাবিশ্ব আরো অনেক বড়, যেখানে মিল্কিওয়ের মতো আরো হাজার হাজার গ্যালাক্সি আছে।

এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের আয়োজন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ‘দ্য গ্রেট ডিবেট’ নামে খ্যাতিলাভ করেছে। ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল এই বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। প্রচলিত তর্ক-বিতর্ক এটি ছিল না। এটি ছিল মূলত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন। হারলো শাপলি মিল্কিওয়েই পুরো মহাবিশ্ব – এই মতের পক্ষে তাঁর তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন চল্লিশ মিনিট। এরপর হেবার কারটিস উপস্থাপন করেন তাঁর তথ্য-উপাত্ত যেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝান যে মিল্কিওয়ে ছাড়াও আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। উপস্থিত বিজ্ঞানীদের ভোটে কারটিসের যুক্তি জয়লাভ করে।

অবশ্য পরবর্তী চার বছরের মধ্যে এডউইন হাবল প্রমাণ করে দেন যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের অংশ নয়, বরং মিল্কি ওয়ে থেকে পচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের আলাদা আরেকটি গ্যালাক্সি।

 

পৃথিবীর মানমন্দির থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে আলোর তীব্রতার সাথে দূরত্বের বিপরীত বর্গের সূত্র প্রয়োগ করে নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহাজাগতিক ধুলিকণা যা নক্ষত্রের আলোর তীব্রতা কমিয়ে দেয়। ধুলিকণার কারণে প্রায়ই হিসেবে গন্ডগোল হয়ে যায়। সেই গন্ডগোল মিটে গেল রেডিও টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর থেকে। ধুলিকণা বেতার তরঙ্গের ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারে না। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার পরিমাপ অনেক সহজ এবং সঠিক হয়ে ওঠেছে। পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পর থেকে মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছু সঠিকভাবে জানি।

 

মিল্কিওয়ের আকার আকৃতি

আমরা যেহেতু মিল্কিওয়ের ভেতরে থাকি, সেহেতু দূর থেকে মিল্কিওয়েকে পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি সম্ভব হতো, যদি আমরা মিল্কিওয়ের উপর থেকে মিল্কিওয়েকে দেখতে পেতাম, তাহলে মিল্কিওয়েকে মনে হতো রাতের বেলা আলো ঝলমলে এক শহরের মতো যেখানে বিশ হাজার কোটি সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। এই সূর্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তনাক্ষত্রিক ধুলো ও গ্যাসের মেঘ – যেগুলি থেকে ভবিষ্যতে আরো নক্ষত্র তৈরি হবে। এক পাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একটি চ্যাপ্টা চাকতির মতো লাগবে যার মাঝখানে বেশ উঁচু। চাকতির চারপাশে ঘিরে রয়েছে বিশাল গ্যাসের গোলক – যার নাম গ্যালাক্টিক হ্যালো।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চাকতির কেন্দ্রে ফুলে ওঠা জায়গার ব্যাস প্রায় তিন হাজার আলোকবর্ষ। এর ভেতর আছে প্রায় এক হাজারটি নক্ষত্র – যাদের আনুমানিক ভর এক হাজার সূর্যের ভরের সমান। চাকতির সমতল অংশ থেকে কেন্দ্রের এই ঢিবির উচ্চতা প্রায় ১৮০০ আলোকবর্ষ। সমতল অংশে চাকতির পুরুত্ব প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ। কেন্দ্র থেকে চাকতির ব্যাসার্ধ প্রায় পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ। পুরো চাকতিকে ঘিরে অদৃশ্য হাইড্রোজেন গ্যাসের স্তর, কেন্দ্র থেকে যার ব্যাসার্ধ আশি হাজার আলোকবর্ষ।

পুরো চাকতিটি রয়েছে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের একটি গোলকের ভেতর। এই গোলকটির নাম স্টেলার হেলো। ধরে নেয়া হয় এই পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত মিল্কিওয়ের মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে। এর বাইরে যদি কোন নক্ষত্র পাওয়া যায় – তা অন্য কোন গ্যালাক্সির বলে ধরে নেয়া হয়।


মিল্কিওয়ের বিভিন্ন অংশ


হ্যালো

মিল্কিওয়ের হ্যালো অংশটি খুব রহস্যময়। এই গ্যাসীয় গোলকের ভেতর প্রায় দুই শ উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ আছে যারা খুবই কাছাকাছি থেকে গুচ্ছ তৈরি করেছে। এদের একেকটি গুচ্ছের ব্যাস মাত্র কয়েকশ আলোকবর্ষ। এই দুরত্বের ভেতরই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র গাদাগাদি করে খুবই প্রতিসমভাবে একে অপরকে আকর্ষণ করে আছে। এই ‘গ্লোবিউলার ক্লাস্টার’ গুলি নিঁখুত গোলকাকার। গ্যালাক্সির সবচেয়ে বয়স্ক নক্ষত্রগুলিই থাকে এসব গুচ্ছে। চাকতির নক্ষত্রগুলির বয়স যদি এক হাজার কোটি বছর হয়, গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের নক্ষত্রগুলির বয়স তেরো শ কোটি বছর।

গ্যালাক্টিক হ্যালোর গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলি উজ্জ্বল হলেও বাকি অংশ খুবই অন্ধকার। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের সূর্যগুলির ভর আর হ্যালোর মোট ভরের তুলনায় খুবই সামান্য। তাহলে বাকি অন্ধকার স্থানে কি লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার? এই রহস্যের সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি।

 

চাকতি

একপাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়েকে যেমন একটি সাদাসিধে চাকতির মতো লাগে, আসলে কিন্তু এটি সোজা একটি চাকতি নয়। এর চারটি প্যাঁচানো বাহু আছে। কেন্দ্রের উঁচু ঢিবির কাছাকাছি দুটো প্রধান বাহু পারসিয়াস আর্ম ও স্যাজিটারিয়াস আর্ম। তৃতীয় বাহুর নাম সেনটোরাস আর্ম এবং চতুর্থ বাহু – আউটার আর্ম।

পারসিয়াস বাহু মিল্কিওয়ের বেশ প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাহু যেখানে রয়েছে অনেকগুলি নীহারিকা বা নেবুলা যেখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। এখানে নক্ষত্রের ঘনত্ব চাকতির নক্ষত্রের ঘনত্বের চেয়ে বেশি। এই বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ষাট হাজার আলোকবর্ষ, কিন্তু সে তুলনায় প্রস্থ খুবই কম, মাত্র তিন-চার হাজার আলোকবর্ষ। এখানেই আছে ব্রিলিয়েন্ট স্টার ফাই ক্যাসিওপিয়া – যা আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় দুই লক্ষ গুণ উজ্জ্বল। এই বাহুতেই আছে ক্র্যাব নেবুলা সুপারনোভা।

মিল্কিওয়ের প্রধান বাহু স্যাজিটারিয়াস আর্ম। এর দৈর্ঘ্য দশ থেকে পনের আলোকবর্ষ, প্রস্থ তিন থেকে চার আলোকবর্ষ। ঈগল, ওমেগা, ট্রিফিড, ল্যাগুন নেবুলা এই বাহুতে অবস্থিত। এই বাহুতে একাধিক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ষোলটি সূর্যের ভরের সমান ব্ল্যাকহোল সিগনাস এক্স-১ মিল্কিওয়ের এই বাহুতে অবস্থিত।

পারসিয়াস ও স্যাজিটারিয়াস বাহুর মাঝখানে আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাহু আছে – যার নাম অরিয়ন বাহু বা অরিয়ন স্পার। এই অরিয়ন স্পারের আগার দিকে আমাদের সূর্যের বাড়ি। এই সৌরজগতের ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীতে আমাদের বাস।  এই বাহুতে আছে রিং নেবুলা, অরিয়ন নেবুলা, বাটারফ্লাই ক্লাস্টার, টলেমি ক্লাস্টার ইত্যাদি।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে যে উঁচু ঢিবি আছে সেটাই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র বা গ্যালাকটিক সেন্টার। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটাই গ্যালাক্সি রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে কেন্দ্রের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভেরি লার্জ রেডিও-টেলিস্কোপের মাধ্যমে জানা গেছে এর কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান গ্যাস চক্রাকারে ঘুরছে। ১৯৯৭ সালে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোর অস্বাভাবিক দ্রুত ঘূর্ণন বেগ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মিল্কিওয়ের এই কেন্দ্রে আছে ২৫ লক্ষ সূর্যের ভর সম্পন্ন বিশাল ব্ল্যাকহোল স্যাজিটারিয়াস এ স্টার। কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ আলোকবর্ষ দূরে উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ – স্যাজিটারিয়াস এ কমপ্লেক্স।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের এক শ আলোকবর্ষ ব্যাসের মধ্যে যে চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া গেছে তার তীব্রতা মিল্কিওয়ের অন্যান্য জায়গার চোউম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার চেয়ে প্রায় হাজার গুণ বেশি। এই চৌম্বকক্ষেত্রের সঠিক উৎস এখনো অজানা।

 

ভর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর উজ্জ্বলতা ১৪০০ কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সমান। ডার্ক ম্যাটারসহ এর মোট ভর এক লক্ষ কোটি সূর্যের ভরের সমান, যার মধ্যে নক্ষত্রের ভর বিশ হাজার কোটি সূর্যের ভর, মোট গ্যাসের ভর – দুই হাজার কোটি সূর্যের ভর, ধূলিকণার ভর – বিশ কোটি সূর্যের ভরের সমান। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে আমাদের সূর্যের একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে বাইশ কোটী বছর।

 

মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমাদের এখনো অনেক বিষয় জানার বাকি। অতি সম্প্রতি (১১ মার্চ ২০২৫) আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘স্পেকট্রো-ফটোমিটার ফর দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইউনিভার্স, ইপক অব রি-আয়নাইজেশান আন্ড আইসেস এক্সপ্লোরার (SPHEREx) মিশন চালু করেছে। এই স্যাটেলাইট ১১ মার্চ ২০২৫ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। ১ মে থেকে এই স্যাটেলাইট কাজ শুরু করেছে। আগামী দুই বছর ধরে মহাকাশে মহাবিশ্বের পঁয়তাল্লিশ কোটিরও বেশি গ্যালাক্সির তথ্য সংগ্রহ করবে এই স্যাটেলাইট। পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও দশ কোটিরও বেশি নক্ষত্রের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে জানার চেষ্টা করবে মহাবিশ্বের উদ্ভব হবার আসল রহস্য কী। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যেসব উপাদানের দরকার, মিল্কিওয়ের অন্যান্য নক্ষত্রের জগতের অন্য কোন গ্রহে তা পাওয়া যায় কি না তাও অনুসন্ধান করে দেখবে এই মিশন [৬]। সেসব তথ্য থেকে মিল্কিওয়ের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। 

 

তথ্যসূত্র

১। জিম আল-খলিলি, দ্য হাউজ অব উইজডম হাউ অ্যারাবিক সায়েন্স সেইভড অ্যানসিয়েন্ট নলেজ অ্যান্ড গেইভ আজ দ্য রেনেসান্স, দ্য পেঙ্গুইন প্রেস, নিউইয়র্ক, ২০১১।

২। জন গ্রিবিন, গ্যালাক্সি অ্যা ভেরি শর্ট ইনট্রোডাকশান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮।

৩। গাইলস স্পারো, ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি,কুয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬।

৪।  ফ্রাঙ্কোইস কমবিস ও জেমস লেকিস, ‘দ্য মিল্কি ওয়ে স্ট্রাকচার, ডায়নামিক্স, ফরমেশান আন্ড ইভ্যুলিউশান’, কারেন্ট ন্যাচারাল সায়েন্সেস, প্যারিস, ২০১৬।

৫। জে পি ম্যাকইভয়, দ্য ইউনিভার্স ফ্রম এনসিয়েন্ট ব্যাবিলন টু দ্য বিগ ব্যাং, রবিনসন, লন্ডন, ২০১০।

৬। https://www.jpl.nasa.gov/missions/spherex/

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত











Thursday, 17 July 2025

যদি বিজ্ঞানী হতে চাও


[এই লেখায় আমি বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ বিজ্ঞানপ্রেমীদের সাথে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। এই কথাগুলি হয়তো তাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞানচর্চায় কাজে লাগবে। যে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমি এই কথাগুলি বলছি তারা বয়সে আমার কনিষ্ঠ, তাই তাদের তুমি করে সম্বোধন করছি।]

তুমি যখন এই লেখাটি পড়ছো, আমি ধরে নিচ্ছি তুমি বিজ্ঞান ভালোবাসো, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করো। ভবিষ্যতে তুমি কী হবে, তোমার পেশা কী হবে, কীভাবে কাটবে তোমার দিনরাত সে সম্পর্কে এখনই তুমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছো না। কেউই পারে না। কিন্তু তুমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছো কিছু একটা হবার। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তুমি এমনভাবে লেখাপড়া করছো – যেন এই লেখাপড়াটা তোমার স্বপ্ন সফল করে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, লেখক, বিসিএস ক্যাডার, পুলিশ, রাজনীতিবিদ – যা-ই তুমি হও না কেন, তুমি যেহেতু বিজ্ঞান ভালোবাসো, বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসো – বিজ্ঞানী হবার প্রাথমিক দুটো শর্ত তুমি ইতোমধ্যেই পূরণ করে ফেলেছো।

তবে বিজ্ঞানকে শুধুমাত্র ভালোবাসলেই বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। বিজ্ঞান অত্যন্ত জটিল বিষয়, বিজ্ঞানের পথ বড় কঠিন পথ। তুমি হয়তো খেয়াল করেছো বিজ্ঞানচিন্তার পাতায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয় আমরা সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। সেগুলি পড়ার সময় তোমার মনে হতে পারে এ-তো সহজ জিনিস। হ্যাঁ, ঠিকমতো বুঝতে পারলে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি খুবই সহজ। কিন্তু সেই তত্ত্বগুলি আবিষ্কার করেছেন যেসব বিজ্ঞানী – তাঁদের আবিষ্কারের পথ অত সহজ নয়। তুমি যখন বিজ্ঞানের কোন একটা বিষয় – যা সহজভাবে তোমার বোধগম্য আকারে লেখা হয়েছে – পড়ার পর বেশ বুঝতে পারছো, তোমার ভালো লাগছে, বিজ্ঞানের প্রতি তোমার ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে – সেটা হলো ব্যবহারকারির দৃষ্টিতে বিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাকে বলে ইউজার লেভেল সায়েন্স। এই পর্যায়ে বিজ্ঞানের প্রতি তোমার যে ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, বিজ্ঞানী হতে গেলে তাকে আরো অনেক বছর ধরে অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে।  তুমি যদি স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হও, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের গবেষক হতে চাও, বিজ্ঞানী হতে চাও – তোমাকে শুধুমাত্র ভালোবাসলেই হবে না – বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার কঠিন পথটিকেও আপন করে নিতে হবে।

ধরা যাক, তুমি বিজ্ঞানের কঠিন পথ পেরিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানী হতে চাও। কিন্তু কীভাবে বুঝবে কোন্‌ পথটি তোমার জন্য সঠিক পথ? কোন্‌ পথে গেলে তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন সহজ সঠিক উপায় নেই। কিন্তু তোমার যদি বিজ্ঞানের জগৎ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা থাকে এবং এই জগতে প্রবেশ করার পূর্বপ্রস্তুতি থাকে – তাহলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে কোন্‌ পথে হাঁটতে তোমার ভালোও লাগছে, আবার লক্ষ্যেও পৌঁছাতে পারছো।

ইউনেসকোর ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিসটিক্‌স এ প্রকাশিত পরিসংখ্যান [১] থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর মোট বিজ্ঞানীর সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৮৮ লক্ষ। এখানে আমাদের জেনে রাখতে হবে বিজ্ঞানী আমরা কাদেরকে বলছি। বিজ্ঞান বিষয়ে যারা পড়াশোনা শেষ করেছেন তাদের সবাই কিন্তু বিজ্ঞানী নন। পৃথিবীর মোট এক কোটি সাতাশ লক্ষ এমবিবিএস ডাক্তার এবং দুই কোটি সত্তর লক্ষ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার – যারা তাঁদের রুটিনমাফিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন তাঁদেরও সবাই কিন্তু বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞান শিক্ষকদের মধ্যেও যাঁরা শুধুমাত্র ক্লাসরুমে পড়াচ্ছেন বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন – তাঁরাও বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞানী তাঁরাই – যারা বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করছেন, বিজ্ঞানের নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করছেন, বিজ্ঞান গবেষণা যাঁদের নিয়মিত কর্মজীবনের অংশ। বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় কর্মরত যে কেউই বিজ্ঞানী হতে পারেন যদি তিনি নিয়মিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন।

জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানী আছেন ইসরায়েলে। সেখানে প্রতি দশ লক্ষ জনসাধারণের মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় হাজার বিজ্ঞানী। তার ঠিক পরেই আছে দক্ষিণ কোরিয়া (প্রতি মিলিয়নে সাড়ে আট হাজার বিজ্ঞানী।) জাপানে বিজ্ঞানীর সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে সাত হাজার। আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ায় বিজ্ঞানীর সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে প্রায় সাড়ে চার হাজার। চীনে প্রতি মিলিয়নে আনুমানিক দুই হাজার। ভারতে প্রতি মিলিয়নে মাত্র তিন শ জন। আমাদের বাংলাদেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা আরো অনেক কম, প্রতি মিলিয়নে মাত্র একশ জন। সতের কোটি জনসাধারণের এই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা মাত্র সতের হাজার। দশ হাজার মানুষের বিপরীতে আমাদের দেশে আছেন মাত্র একজন বিজ্ঞানী।

এই সীমাহীন বৈষম্যের কারণ কী? বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে বাৎসরিক বাজেটের কী পরিমাণ বরাদ্দ করা হয় সেটা অবশ্যই একটি বড় ফ্যাক্টর। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ইসরায়েলে বাৎসরিক বাজেটের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ বরাদ্দ করা হয়। সেটা আমেরিকায় ২.৮৪ শতাংশ, জার্মানিতে ৩.১ শতাংশ, জাপানে ৩.২৬ শতাংশ, চীনে ২.১৯ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.৫৩ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ১.৮৭ শতাংশ, ভারতে ০.৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশে বার্ষিক বাজেটে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট থাকে না বললেই চলে। যা থাকে তাও চলে যায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের পেছনে।

শুধুমাত্র বাজেট বরাদ্দ কম থাকার কারণেই যে আমাদের বিজ্ঞান গবেষণা পিছিয়ে আছে তা নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে বিজ্ঞানী তৈরি হবার সবচেয়ে বড় বাধা। মনে করো তুমি এখন ক্লাস নাইনে পড়ছো, পদার্থবিজ্ঞান তোমার ভালো লাগে, ভবিষ্যতে তুমি পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাও। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানী কীভাবে হতে হয় সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। তোমার স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা তোমাকে হয়তো কখনোই বলেননি যে পদার্থবিজ্ঞানী হতে গেলে তোমাকে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

আমাদের বাংলাদেশে সত্যিকারের বিজ্ঞানজগত সম্পর্কে জানা কিংবা ধারণা লাভ করার তেমন কোনো সহজ উপায় নেই যেখান থেকে তুমি পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারবে। তোমাদের স্কুলের বিজ্ঞান বইতে যেসব বিষয় লেখা আছে, তোমাদের শিক্ষকরা তোমাদের বাধ্য করে সেসব যেভাবে লেখা আছে সেভাবে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য। তোমরাও বাধ্য হয়ে তাই করো – নইলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার লক্ষ্যে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি তোমরা কোচিংও করো যেখানে শেখানো হয় পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখলে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া যাবে। বিজ্ঞান শাখায় এসএসসি ও  এইচএসসিতে তোমরা বাধ্যতামূলকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, গণিত, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ে থাকো। পড়ার চাপ এত বেশি থাকে যে এই বিষয়গুলির প্রতি তোমাদের ভালোবাসা জন্মানোর কোন সুযোগই তৈরি হয় না। বরং একটু এদিক-ওদিক হলেই নম্বর কম পাওয়ার ভয় থেকে তৈরি হয় প্রচন্ড স্নায়ুচাপ। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় তোমাদের ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি।

যারা ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়, তারা ডাক্তার হয়ে হাসপাতাল-চেম্বার করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেকেই এফসিপিএস, এমডি, এমআরসিপি ইত্যাদি আরো উচ্চতর ডাক্তারি ডিগ্রি পাস করে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সত্যিকারের গবেষণা করার সুযোগ, সময় এবং ইচ্ছে খুব কম ডাক্তারেরই থাকে।

যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায়, তাদের হাতেকলমে প্রকৌশল বিদ্যা শেখার সুযোগ হয়। কিন্তু সিলেবাসের বাইরে তাদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনেরও কিছু সুযোগ থাকে। কিন্তু পাস করে বের হবার পর কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক ইঞ্জিনিয়ারই ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরিবর্তে বিসিএস পাস করে প্রশাসক হবার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়। আমাদের দেশে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর কলকারখানা খুব একটা নেই। ফলে আমাদের দেশের সব ইঞ্জিনিয়ারের উপযুক্ত কাজ করার সুযোগ থাকে না। তাই অনেকেই বিদেশে চলে যায়। বিদেশী কোন ডিগ্রি নিয়ে বিদেশেই থেকে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজ্ঞানী হবার সুযোগ পায়।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের পর যারা বাকি থাকে – তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়। কোন্‌ বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হবে সেটা ঠিক করতে গিয়েও অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে তো তোমরা জানতেই পারো না কোন্‌ বিভাগে কী পড়ানো হয়, কোন্‌ বিষয়ে পাস করলে ভবিষ্যতে কী কী করা যাবে। কিংবা তুমি যদি ভবিষ্যতে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাও – স্কুল থেকেই তোমার কী কী বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কম। তাই তোমাদের তেমন কোন সুযোগই থাকে না সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলার বা তাদের কাজকর্ম কাছ থেকে দেখার। আমাদের দেশে কোনো বৈজ্ঞানিক জাদুঘরও নেই – যেখানে গিয়ে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে পারবে।

কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশে, যেখানে বিজ্ঞানীর সংখ্যা অনেক বেশি – সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মতো নয়। পৃথিবীর সব উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপদ্ধতি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী থেকে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার সবগুলি ধাপে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকে। আমেরিকার কথা ধরা যাক। সেখানে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে নিচের ক্লাস থেকেই বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান প্রকল্প প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। সারা দেশ থেকে বাছাই করা সেরা প্রকল্পগুলির মাধ্যমে বিজ্ঞানের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। একেবারে প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেসব বিজ্ঞানী কাজ করছেন – তাদেরকে মাঝে মাঝে স্কুলে নিয়ে এস পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হয় গবেষণাগারে – সেখানে তারা নিজের চোখে দেখতে পারে কীভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়, কীভাবে বিজ্ঞানীরা কাজ করেন। হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সত্যিকারের বিজ্ঞান-প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। নাসার মতো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ থাকে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই শুরু হয় সত্যিকারের বিজ্ঞান গবেষণা। শুধুমাত্র বই পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার উপরই সব গুরুত্ব সেখানে দেয়া হয় না। যারা শুধুমাত্র চাকরি করে টাকা উপার্জন করার জন্য উদ্দেশ্যে ভর্তি হয়, তাদের কোর্স আর গবেষণা করতে যারা আগ্রহী তাদের কোর্স আলাদা। উন্নত দেশে বিজ্ঞানী তৈরি করার সুব্যবস্থা আছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাজগৎ এবং কর্মজগৎ যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা দুঃসাধ্য বটে, তবে অসাধ্য নয়। তুমি যদি সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে চাও, তাহলে আমাদের দেশ থেকেও বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব। তারজন্য তোমাকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে স্কুল-কলেজ থেকেই। তুমি যদি ডাক্তার হও- চিকিৎসাবিজ্ঞানী হতে তোমার কোনো বাধা নেই। বরং আমাদের দেশে রোগ এবং রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে তোমার যদি গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকে – তুমি অনেক বেশি সুযোগ পাবে এখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হবার। তুমি যদি ইঞ্জিনিয়ার হও এবং নতুন উদ্ভাবনের প্রতি আগ্রহ থাকে – তাহলে তুমি আমাদের দেশের অনেক কারিগরী সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে। আর যদি তুমি মৌলিক বিজ্ঞান – পদার্থবিজ্ঞন, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের যে কোনো শাখায় গবেষণা করতে চাও – তাহলেও অনেক অনেক কিছু করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের যেকোনো শাখাতেই যদি তোমার গবেষণা করার ইচ্ছে থাকে – তাহলে একটা বিষয় তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে। সেটা হলো – বিজ্ঞান গবেষণায় কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। সেখানে কোনো ধরনের জোড়াতালি চলে না, কোনো ধরনের প্রতারণা বা মিথ্যার স্থান নেই। বিজ্ঞান গবেষণার ফলাফল একটুও এদিক-ওদিক করার সুযোগ নেই। যদি কেউ করে – সেটা কারো না কারো কাছে ধরা পড়বেই। বিজ্ঞান গবেষণা সর্বজনীন। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসে কোনো গবেষণার যে ফল তুমি পাবে, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় একই বৈজ্ঞানিক পরিবেশে একই ফলাফল পাবে। বিজ্ঞানের গবেষণায় ভুল করলে ভুল স্বীকার করার মধ্যে কোনো ভয় বা লজ্জা নেই। ভুল করতে করতেই বিজ্ঞানীরা শিখতে থাকে।

বিজ্ঞানী হবার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো প্রশ্ন করতে শেখা। বিজ্ঞানে বিনাপ্রশ্নে কোনো কিছুই মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীর কাজ হলো অজানাকে জানা। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, তার ফলাফল কী হবে তা আগে থেকে জানেন না। এই অজানাকে জানার আগ্রহই তাঁদের বিজ্ঞানী করে তোলে।

তাহলে তুমি কীভাবে এগোবে? বিজ্ঞানের যা-কিছু পড়বে – অবশ্যই ভালোভাবে বুঝতে হবে। শুধু নিজে বুঝলে হবে না, অন্যকেও বোঝানোর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তুমি যদি নিজে কোনো কিছু বোঝো, তুমি দেখবে অন্য কাউকে যদি সেটা নিজের মতো করে বোঝাতে পারো – তাহলে তোমার নিজের কাছেও ব্যাপারটি আরো অনেক পরিষ্কার হয়ে যাবে। তুমি যে বিষয়ে বিজ্ঞানী হতে চাও- সেই বিষয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তোমার আগ্রহের কথা জানাও। শিক্ষকরা আগ্রহী শিক্ষার্থী পেলে ভীষণ আনন্দিত হবেন। দরকার হলে নিজের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলো। কোনো বিষয়ে ভর্তি হবার আগে সেই বিভাগের শিক্ষকদের সাথে কথা বলা সম্ভব না হলে, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলো। তোমার যদি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে – ইন্টারনেট থেকে এখন সব ধরনের গবেষণা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া যায়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অলিম্পিয়াডসহ আরো অনেক প্রতিযোগিতা হয়। সেগুলিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করো। বিজ্ঞান বোঝার ক্ষেত্রে নিজের দুর্বলতা কোথায় সেটা খুঁজে বের করো। কোনো কিছু না বুঝলে তাতে লজ্জার কিছু নেই। বরং না বুঝে মুখস্থ করার চেয়ে কী বুঝতে পারছো না সেটা বের করতে পারাটা অনেক বেশি দরকারি। বিশ্বমানের বিজ্ঞানীদের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়তো আমাদের নেই, কিন্তু তাঁদের বৈজ্ঞানিক জীবন নিয়ে লেখা বইগুলি যদি পড়ো – তাহলেও জানতে পারবে তাঁরা কীভাবে গবেষণা করতেন।


আইরিন কুরি - কিশোর বয়সেই বিজ্ঞানগবেষণা শুরু করেছিলেন তাঁর মা মেরি কুরির সাহচর্যে

আগামী এক দশকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সমস্যার সমাধানে অনেক নতুন গবেষণা উন্মুক্ত হবে। মহাকাশ গবেষণায় ব্যাপক পরিবর্তন হবে। বায়োটেকনোলজি আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার বিশাল সুযোগ তৈরি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার সাথে খাপ-খাইয়ে চলার প্রযুক্তির গবেষণার অসীম সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ন্যানোমেডিসিন আর ন্যানোটেকনোলজি, প্রাণ রসায়ন এবং নতুন ওষুধ উদ্ভাবন – এরকম হাজার হাজার প্রকল্পে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানীর দরকার আমাদের দেশে। যদি বিজ্ঞানী হতে চাও – নিজেকে তৈরি করতে থাকো, তুমি সফল হবেই।


তথ্যসূত্র

১। ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট, প্যারিস, ২০২১।

-----------------------

মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার শততম সংখ্যায় প্রকাশিত







Sunday, 22 June 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর “ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ”

 



মুহম্মদ নিজাম-এর চিন্তা-চেতনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়, বলা যায় ঝটিকা পরিচয়, ঘটে ফেসবুকে তাঁর হ্রস্ব অথচ টাইফুনের শক্তিসম্পন্ন পোস্ট দেখে। ইতোমধ্যে অনেকগুলি গল্প, উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলে দিয়েছেন এই তরুণ লেখক। তাঁর বইগুলি পড়ার জন্য এক ধরনের অস্থির তাগিদ অনুভব করছিলাম অনেকদিন থেকে।

 প্রবাসের পাঠকদের এখন আর আগের মতো খরায় কাটাতে হয় না। অনলাইনে এখন হাজার হাজার বই বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কপিরাইটের দফারফা করে ছেড়ে দেয়া জাতি আমরা। কিন্তু লেখকের প্রতি পাঠকের দায়বদ্ধতা থেকে যারা আমরা বই কিনে পড়তে চাই – তাদের জন্য আমাদের দেশে এখনো আন্তর্জাতিক ডেলিভারির ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমাদের অপেক্ষা করতে হয় – কখন দেশ থেকে কেউ আসবে, যে নিজের ব্যাগের মূল্যবান আয়তন এবং ভর ধার দিয়ে কয়েকটা বই নিয়ে আসবে সাথে করে।




মুহম্মদ নিজামের সবগুলি বই না হলেও – বেশ কিছু বই সংগ্রহ করতে পেরেছি। তালিকা এবং প্রকাশকাল দেখে দেখে প্রথম বই দিয়েই তাঁর বই পড়তে শুরু করলাম।

“ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ” এর কাহিনি প্রচলিত উপন্যাসের কাহিনি থেকে বেশ ভিন্ন। এখানে মানবমনের চিন্তাজগতে হানা দেয়া হয়েছে, তবে শীর্ষেন্দুর মানবজমিনের মতো ঘটনার ঘনঘটা ঘটিয়ে কোনকিছুই জট পাকিয়ে দেননি লেখক। কেন্দ্রিয় চরিত্র মিথুন – নিজের মনের সাথে বোঝাপড়া করেছে এখানে বিভিন্নভাবে। মনের কথা পাঠকের সাথে শেয়ার করার যে কৌশল লেখক এখানে ব্যবহার করেছেন তা বেশ সংযমের সাথে করেছেন। সংযম আর পরিমিতিবোধের কারণেই – গভীর তত্ত্বগুলিও হয়ে উঠেছে উপভোগ্য।

এই বই আমার খুবই ভাল লেগেছে। গল্প-উপন্যাস পড়ে ভালো লাগার কিংবা না লাগার ব্যপারটি পাঠকের নিজস্ব। সেখানে পাঠকের আবেগ কাজ করতে পারে, কাজ করতে পারে ব্যক্তিগত অনুভূতি, কিংবা নীতিবোধ। পাঠকের চিন্তার সাথে লেখকের সৃষ্ট কোন চরিত্রের চিন্তা মিলে গেলেও পাঠক ভালোবেসে ফেলে সেই চরিত্রকে। আমার ভালো লাগার প্রধান কারণ এই উপন্যাসের মূল বিষয়।

বইয়ের কেন্দ্রে বসে আছে যে তরুণ – মিথুন – গভীর চিন্তক। তরুণ বয়সেই বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে। চিন্তার গভীরে প্রবেশ করে একই জিনিস বিভিন্ন জনের মনের প্রতিফলন থেকে দেখতে শিখেছে। মিথুনের ভেতর তারুণ্যের তীব্র অস্থিরতার বদলে চিন্তার স্থিতধি অবস্থান আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। তার দাদা জাবের আলি – ধর্মান্ধ দলের উগ্র নেতা। জাবের আলির সাথেও মিথুনের যে স্নেহ এবং বিশ্বাসের দ্বান্দ্বিক অবস্থান উঠে এসেছে উপন্যাসে তা অনবদ্য।

এই বইতে সঠিক বিজ্ঞান আছে। লেখক এই বই যখন লিখেছেন তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস যে তিনি খোলামনে পড়েছেন এবং তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন – তার সঠিক প্রতিফলন ঘটেছে এই উপন্যাসে।

ঘটনার ব্যাপ্তি, চরিত্রগুলির পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং সংক্ষিপ্ত কথোপকথন আমাকে মুগ্ধ করেছে। ধর্ম নিয়ে যেসব প্রশ্ন ধর্মান্ধদের উগ্রতার ভয়ে আমরা করতে পারি না, লেখক সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন সাহসের সাথে।

“পাঁচশ বছর আগেও হয়তো এই পৃথিবীর বড় হুজুরেরা দাজ্জালের জন্ম হয়ে গেছে এবং কেয়ামত আসন্ন বলে এইভাবেই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এখনো ছড়াচ্ছে। পাঁচশ বছর পরেও ছড়াবে।“ [পৃ ৪১]

“একজন বিশুদ্ধ মানুষ নিজে যে দুঃখ সহ্য করতে পারে না, অন্যকে সেইরকম কোনো দুঃখে পতিত হতে দেখলে অন্তরে তীব্র ব্যথাবোধ করে। মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঞ্চারিত করে যেতে পারে। এই সবই হচ্ছে মানব ধর্মের বৈশিষ্ট্য। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো যাদের রয়েছে, বিশেষ করে এক মতানুসারে তারা সবাই সনাতন ধর্মের প্রাণ। অর্থাৎ জগতের সকল মানুষই সনাতন ধর্মের মানুষ। এই মতানুসারে বর্তমান পৃথিবীতে যে ছয় বা সাতশত কোটি মানুষ রয়েছে তাদের সবাইকে সনাতন ধর্মের মানুষ বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।“ [পৃ ৪৩-৪৪] – এরকম গভীর চিন্তা করতে যেমন খোলা মনের দরকার হয়, তেমনি এই চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে দরকার হয়ে মনের গভীর সাহস। মুহম্মদ নিজামের সেই সাহস আছে।

ধর্মকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করা আমাদের বহু পুরনো অভ্যেস। প্রাণভয়ে সেই অভ্যেসের প্রতি জিজ্ঞাসার আঙুল তুলতে সাহস করে না অনেকেই। মুহম্মদ নিজাম সরাসরিই বলেছেন এই উপন্যাসে, “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের কথাটাই একবার ভেবে দেখুন। সেই সময় পাক সেনারা আদর্শগত দিক থেকে নিজেদের পবিত্র ধর্মযোদ্ধা ভেবে মনে মনে খুব আহলাদিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছে হিন্দুস্থানের দালাল, ইসলামের শত্রু। অথচ যুদ্ধকালীন নয়টা মাসে যতগুলি নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছেন, যত নারী ধর্ষিত হয়েছেন – প্রায় সবকিছুই সংঘটিত হয়েছে ওদের মত মহান মহান স্বর্গীয় সৈনিকদের দ্বারা। আদর্শ নিজেই এখানে বলাৎকারের শিকার।“ [পৃ ৮৯]

এই বইতে অনেকগুলি বিষয় এসেছে যা বেশিরভাগ উপন্যাসের চরিত্রগুলি এড়িয়ে চলে। যেমন বিবর্তনবাদ, ধর্মের অলৌকিক অন্ধ বিশ্বাস। কাহিনির মিথুন অনন্য সাহস দেখিয়ে সরাসরি বলেছেন তাঁর ধর্মান্ধ দাদাকে – “আমাদের মধ্যে একটা শ্রেণি আছে যারা জোর করে কোরআনকে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান-গ্রন্থ বলে জাহির করতে চায়। এটা আমার ভালো লাগে না। আমি ভাবি, গড অলমাইটি তো সবই জানেন। তিনি চাইলে নবীদের মাধ্যমে ইয়া বড় বড় পদার্থবিজ্ঞানের বই, রসায়নের বই লিখে পাঠাতে পারতেন। তা তিনি করেননি। মানুষের জন্য রেখে দিয়েছেন এবং মানুষ সেইগুলি আবিষ্কারও করছে। কিন্তু দুঃখের কথা কী জানেন?” “আবিষ্কারকগণ প্রায় সবাই ইহুদী এবং খ্রিস্টান এবং নিরীশ্বরবাদী। আমরা যে চৌদ্দশ বছর ধরে কোরআন পাঠ করছি, আজ পর্যন্ত একটা যুগান্তকারী কিছু আবিষ্কার করতে পারলাম না। একটা ভাল প্রেডিকশন করতে পারলাম না। অথচ যখনই শুনি, কেউ একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে, জোর করে তার উপর কৃতিত্ব জাহির করার হীন চেষ্টা করি। এটা কি ঠিক বলুন?” [পৃ১০৬]

“যে ধর্ম এখন আমরা পালন করছি তাতে যতটা শ্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা আছে তার চেয়ে বেশি আছে পারস্পরিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অহেতুক নিজের ভেতর কটু গন্ধময় আবর্জনা পোষণ করা।“ [পৃ ১০৭] – এই নির্মম সত্যিকথা বলার জন্য যে নির্ভয় সাহস লাগে – সেটা আছে মুহম্মদ নিজামের।

লেখকের পরিমিতিবোধ আমাকে মুগ্ধ শুধু করেনি, কিছুটা ঈর্ষান্বিতও করে তুলেছে। উর্মির সাথে মিথুনের প্রেম ভালোবাসা ঘটিয়ে দেয়ার এত সুন্দর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেখক শুধুমাত্র তুলির একটা দুটো মানসিক টান দিয়ে পুরো ক্যানভাস খালি রেখেই ছেড়ে দিয়েছেন। প্রথম উপন্যাসেই এরকম বুদ্ধত্ব অর্জন করা সত্যিই দুরুহ।

উপন্যাসের মিথুনের মতো আমারও জেগেছে সেই মোক্ষম প্রশ্ন, “চারদিকে খেয়াল করার মতো এত ইঙ্গিত, দেখার মতো এত বিষয়, তবুও কেন চোখ মেলে তাকায় না মানুষ? কেন ভাবে না?”

বইটির প্রকাশনার ব্যাপারে কিছু কথা না বললে প্রকাশকের প্রতি অবিচার করা হবে। আমাদের বইয়ের প্রকাশনার আঙ্গিক মান যে অনেক উন্নত হয়েছে তা বোঝা যায় বইটি হাতে নিলেই। বায়ান্ন প্রকাশনীর মোহাম্মদ আল আমিন সরকার বেশ যত্ন করেই বইটি প্রকাশ করেছেন। রঙিন ছাপানো, ঝকঝকে প্রিন্ট, বানানভুল অতি সামান্য, কাগজ আকর্ষণীয়। তৃত এর প্রচ্ছদ বইয়ের শিরোনামের মতোই চিন্তাশীল।

সবমিলিয়ে চমৎকার এক বইপড়ার অনুভূতি দিলো মুহম্মদ নিজামের ‘ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ’।


Tuesday, 10 June 2025

চার প্রজন্মের বেকেরেল: প্রতিপ্রভা ও তেজস্ক্রিয়তা

 


 ১৮৯৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক বছরে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অনেকগুলি যুগান্তকারী মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে। জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী উইলহেল্‌ম রন্টজেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করলেন – তার সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেলেও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা বিপদে পড়ে গেলেন। কারণ তাঁরা তখনো জানেন না পদার্থবিজ্ঞানের কোন্‌ তত্ত্বের সাহায্যে এক্স-রে উৎপন্ন হবার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে।

সেই সময় তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত ধীর। ইলেকট্রনই আবিষ্কৃত হয়নি তখনো – ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তো দূরের কথা। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের খবর তখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে পৌঁছানোর প্রধান উপায় ছিল ডাকবিভাগ। এক্স-রে আবিষ্কারক রন্টজেন তাঁর স্ত্রী আনার হাতের একটি এক্স-রে প্লেট তৈরি করলেন ১৮৯৫ সালের ২২ ডিসেম্বর। সেটাই ছিল কোন মানবশরীরের প্রথম এক্স-রে। এই এক্স-রে প্লেটের কপি রন্টজেন পাঠিয়েছিলেন বার্লিন, ভিয়েনা, প্যারিস, হামবুর্গ, ম্যানচেস্টার এবং স্ট্রাসবুর্গে তাঁর বিজ্ঞানী-বন্ধুদের কাছে। প্যারিসের পার্সেল এসেছিল ফরাসি গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি পয়েনকারের কাছে।  

 

A hand x-ray of a handAI-generated content may be incorrect.
প্রথম এক্স-রে

 

পয়েনকারে ছিলেন ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য। ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি বিজ্ঞান একাডেমির নিয়মিত সভায় উপস্থিত অন্যান্য ফরাসি বিজ্ঞানীদেরকে রন্টজেনের পাঠানো এক্স-রে প্লেট দেখতে দিলেন পয়েনকারে। বিজ্ঞান একাডেমির অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। তিনি এক্স-রে প্লেটটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করলেন, “ডিসচার্জ টিউবের কোন্‌ পাশ থেকে এক্স-রে বের হয়েছে এখানে?” পয়েনকারে উত্তর দিলেন, “মনে হচ্ছে নেগেটিভ ইলেকট্রোডের বিপরীত দিকের কাচ যেখান থেকে প্রতিপ্রভা (ফসফরেসেন্স) উৎপন্ন হচ্ছে – সেখান থেকেই এক্স-রে বের হচ্ছে।“ [১]

প্রতিপ্রভা কীভাবে উৎপন্ন হয় তা ভালোভাবেই জানেন হেনরি বেকেরেল। তখনকার সময়ে প্রতিপ্রভ পদার্থ এবং প্রতিপ্রভা উৎপাদনের বিজ্ঞানে বংশানুক্রমিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন তিনি – যার শুরু হয়েছিল তাঁর পিতামহ এন্টনি-সিজার বেকেরেলের হাতে।

প্যারিসে রয়েল গার্ডেন অব মেডিসিনাল প্ল্যান্টস – ঔষধী গাছের বাগান তৈরি হয়েছিল ১৬৪০ সালে। পরবর্তী এক শ বছরের মধ্যে এই বাগানের আয়তন এবং গাছের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয় এবং সেটাকে কেন্দ্র করে একটি গবেষণা-জাদুঘর স্থাপিত হয়। ১৭৯৩ সালে ফ্রান্সের এই গবেষণা-জাদুঘর ছিল বিশাল আয়োজনের একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেন্দ্র। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বারোটি বৈজ্ঞানিক পদ ‘সায়েন্টিফিক চেয়ার’ তৈরি করে ফ্রান্সের প্রধান বিজ্ঞানীদের নিয়োগ করা হয় গবেষণার নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় ১৮৩৮ সালে সৃষ্টি হয় ‘চেয়ার অব ফিজিক্স’। প্রধান পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ পান এন্টনি-সিজার বেকেরেল।

এন্টনি-সিজারের জন্ম ১৭৮৮ সালে প্যারিসের অভিজাত পরিবারে। এন্টনি-সিজারের পিতামহ ছিলেন ফ্রান্সের রাজার লেফটেন্যান্ট। বড় পদ পদবি মানুষকে ক্ষমতার পাশাপাশি আভিজাত্যও এনে দেয়। ১৮ বছর বয়সে এন্টনি-সিজারের সুযোগ হয় ‘ইকুল পলিটেকনিক’-এ ভর্তি হবার। রাষ্ট্রীয় কারিগরী বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্যই এই পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট তৈরি করা হয়েছিল। লেফটেন্যান্টের নাতি হবার সুযোগে এন্টনি-সিজার সেই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে মিলিটারি-ইঞ্জিনিয়ার হবার সুযোগ পান। কিন্তু প্রকৌশলবিদ্যার প্রতি তাঁর যতটা আকর্ষণ ছিল – সামরিকবিদ্যা্র প্রতি ততটা ছিল না। তাই প্রকৌশলবিদ্যা সম্পন্ন করার পর তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে মিলিটারি সার্ভিস থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর শুরু হয় তাঁর স্বাধীন গবেষণা। ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৯ সাল পর্যন্ত নিরলস গবেষণা করেছেন তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে। ১৮২৯ সালে তিনি ফ্রান্সের একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলোশিপ পান। ১৮৩৭ সালে পেয়েছেন রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল। ১৮৩৮ সালে তিনি একাডেমি অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একই বছর তিনি গবেষণা-জাদুঘরের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান রিসার্চ প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। প্রফেসরদের বাসা ছিল জাদুঘর কমপ্লেক্সের কাছে ঔষধী বাগানের ভেতরেই। নিজের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য সেখানকার কিছু অব্যবহৃত ঘর এবং জায়গা নিয়ে একটি সাময়িক গবেষণাগার স্থাপন করেন। সেদিন তিনি ভাবতেই পারেননি যে এই সাময়িক গবেষণাগারেই গবেষণা করবেন তাঁর পরের আরো তিন প্রজন্ম পরবর্তী একশ বছর ধরে। অবসর গ্রহণের কোন বাধ্যবাধকতা না থাকায় এন্টনি-সিজার নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত গবেষণায় সক্রিয় ছিলেন এবং পাঁচ শতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। [২]

এন্টনি-সিজার বেকেরেলের পুত্র এডমন্ড বেকেরেলের জন্ম ১৮২০ সালে। তিনিও বাবার মতোই ইকুল পলিটেকনিক থেকে ইঞ্জিনিয়ার হন ১৮৩৮ সালে। মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হবার পর তিনি অনায়াসেই যেকোনো বড় সরকারি পদে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে তাঁর বাবার সহকারি হিসেবে যোগ দেন ১৮৩৯ সালে। সেই সময় প্রফেসররা তাঁদের সহকারি হিসেবে নিজেদের পছন্দের যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারতেন। এন্টনি-সিজার তাঁর নিজের ছেলেকেই গবেষণা-সহকারির পদে নিয়োগ দিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পথ খুলে দিয়েছিলেন। এডমন্ড বেকেরেল কঠোর পরিশ্রমী বিজ্ঞানী ছিলেন। তাঁর বাবার সাথে যৌথভাবে তিনি অনেকগুলি বই এবং গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৮৫২ সালে এডমন্ড প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন ফ্রান্সের ন্যাশনাল কনজারভেটরি অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্‌ট ইন্সটিটিউটে। এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছিল বিভিন্ন কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলির কলকব্জা এবং ব্যবহার-প্রণালী জনগনের কাছে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে। পরে সেটাকে একটি পূর্ণাঙ্গ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হয়। এখানে তাঁর সহকারি ছিলেন বিজ্ঞানী গ্যাস্টন প্লান্টে। গ্যাসটন পরবর্তীতে লেড ব্যাটারি উদ্ভাবন করেছিলেন।

১৮৬৩ সালে এডমন্ড বেকেরেল ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন এবং ক্রমে ১৮৮০ সালে একাডেমির প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তখনো তাঁর বাবা বেঁচেছিলেন এবং বিজ্ঞান একাডেমিতে তাঁর প্রভাব ছিল সীমাহীন। ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত বাবা-ছেলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছে একাডেমির ফিজিক্স সেকশান। ১৮৭৮ সালে এডমন্ডের বাবা এন্টনি-সিজারের মৃত্যু হলে জাদুঘর-গবেষণাগারের ফিজিক্স চেয়ারে দায়িত্ব এসে পড়ে ছেলে এডমন্ডের হাতে। এডমন্ড বেকেরেল গবেষণা করেছেন আলোর বৈদ্যুতিক, রাসায়নিক এবং মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাব সম্পর্কে। আলোর বর্ণালীতত্ত্বের গবেষণার অগ্রদূত ছিলেন এডমন্ড বেকেরেল। সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি সম্পর্কে অনেক গবেষণা করেছেন তিনি। তাঁর ছেলে হেনরি বেকেরেলের মধ্যে প্রতিপ্রভা পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। [৩]

এডমন্ড বেকেরেলের ছেলে হেনরি বেকেরেলের জন্ম ১৮৫২ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাদুঘর-গবেষণাগারের প্রফেসরস কোয়ার্টারে। সেই কোয়ার্টারে তখন তাঁর পূর্ববর্তী দুই প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞানী পিতামহ এন্টনি-সিজার এবং পিতা এডমন্ড বাস করছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠেছেন হেনরি বেকেরেল। পড়াশোনাও করেছেন পিতা-পিতামহের পথে – ইকুল পলিটেকনিকে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর ১৮৭৭ সালে যোগ দিয়েছেন ফরাসি সরকারের গণপূর্ত বিভাগে। সেই বছর তিনি বিয়ে করেছিলেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানীর কন্যা লুসি জো মেরিকে। পিতা-পিতামহের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে স্বতন্ত্রভাবে সুখের সংসার পেতেছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিয়ের এক বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান জিন-কে জন্ম দেবার কিছুদিন পরই লুসির মৃত্যু হয়। শিশু সন্তানকে নিয়ে হেনরি ফিরে আসেন তাঁর মা-বাবার বাড়িতে – প্রফেসরস কোয়ার্টারে।

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে এডমন্ড বেকেরেল নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে সেখানে তাঁর ছেলে হেনরি বেকেরেলকে নিয়োগ দেন। পরিপূর্ণ গবেষক হবার ইচ্ছেয় তিনি সরকারি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পদ ছেড়ে দিয়ে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে পিতা-পিতামহের পথ অনুসরণ করলেন হেনরি বেকেরেল। প্রতিপ্রভ ও অনুপ্রভ পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করতে খুবই আনন্দ পেতে শুরু করেছেন তিনি। তখনো সব গবেষণা পরীক্ষণলব্ধ ফলাফল নির্ভর। এই ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় ভিত্তির জন্য খুব বেশি নির্ভরযোগ্য সূত্র তখনো আবিষ্কৃত হয়নি।

১৮৪৫ সালে মাইকেল ফ্যারাডে আবিষ্কার করেছিলেন আলোর পোলারাইজেশান। হেনরি বেকেরেল আলোর এই ধর্ম নিয়ে খুঁটিনাটি গবেষণা করলেন ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১ পর্যন্ত। পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আলোর পোলারাইজেশান কীরকম হয় তা মাপার জন্য বিশাল এক যন্ত্র তৈরি করলেন হেনরি বেকেরেল। এ সংক্রান্ত পরীক্ষণগুলি থেকে তিনি দুই ধরনের গবেষণাক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করলেন – ভূতত্ত্ব এবং চৌম্বকতত্ত্ব। ১৮৮৩ সাল থেকে তাঁর গবেষণা কেন্দ্রীভূত হয় বিভিন্ন মাধ্যম এবং কেলাসে অবলোহিত রশ্মির শোষণ এবং নির্গমনের ফলে উদ্ভূত আলোর প্রভাব – প্রতিপ্রভা এবং অনুপ্রভা রহস্যে। আলোর শোষণের গবেষণার উপর তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন ১৮৮৮ সালে। ১৮৮৯ সালে তিনি ফ্রেন্স সায়েন্স একাডেমির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৮৯০ সালে তিনি আবার বিয়ে করেন। ১৮৯১ সালে তাঁর পিতা এডমন্ড বেকেরেলের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পিতার পদ – ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিক্স চেয়ার পান। এই পদের পাশাপাশি ১৮৯৫ সালে তিনি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ফিজিক্সের প্রফেসর পদেও যোগ দেন। ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির খুবই প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন হেনরি বেকেরেল। এই একাডেমির নিয়মিত মিটিং-এই তিনি ১৮৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি প্রথম দেখেন রন্টজেনের পাঠানো এক্স-রে প্লেট এবং প্রতিপ্রভা সংক্রান্ত গবেষণায় নিজের বিশ্বাসের কারণেই ধরে নিয়েছিলেন প্রতিপ্রভারই অন্যরকম একটি ঘটনা এক্স-রের উৎপত্তি। পয়েনকারের সাথে তাঁর কথোপকথন থেকে এটা বোঝা যায়।  

হেনরি পয়েনকারে এবং হেনরি বেকেরেল দুজনেরই ধারণা ছিল ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড টিউবের কাচের গায়ে ধাক্কা দেয়ার ফলে লুমিনেসেন্স বা প্রতিপ্রভা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকেই এক্স-রে উৎপন্ন হয়েছে। বেকেরেল ভাবলেন এক্স-রে আর প্রতিপ্রভার সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণের জন্য পরদিনই গবেষণা শুরু করলেন হেনরি বেকেরেল। তাঁর পিতা, পিতামহ তাঁর জন্য রেখে গেছেন খুবই গোছানো এবং সেইসময়ের সব সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ গবেষণাগার। প্রতিপ্রভ পদার্থের অনেক রকমের কেলাস মজুদ ছিল তাঁর গবেষণাগারে। তিনি সেগুলি নিয়ে একের পর এক পরীক্ষণ শুরু করলেন।

তাঁর পরীক্ষণ পদ্ধতি ছিল খুবই সহজ। একটি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে মোটা কালো কাগজে ঢেকে তার উপর প্রতিপ্রভ পদার্থের লবণের কৃস্টাল রেখে তাতে সরাসরি সূর্যের আলো প্রবেশ করানো। মোটা কালো কাগজ সূর্যের আলো থেকে ফটোগ্রাফিক প্লেটকে রক্ষা করবে। কিন্তু যখন সূর্যের আলোর সাথে প্রতিপ্রভ কৃস্টালের মিথষ্ক্রিয়ায় প্রতিপ্রভা তৈরি হবে। সেই প্রতিপ্রভায় যদি এক্স-রে উৎপন্ন হয় – তা কালো কাগজ ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটের রাসায়নিকের সাথে বিক্রিয়া করবে। সেই বিক্রিয়ার ফলাফল ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করার পর সরাসরি দেখা যাবে। জিংক সালফেড, ক্যালসিয়াম সালফেড ইত্যাদি সব ক্রিস্টালই এক্স-রে তৈরি করতে ব্যর্থ হলো। কিন্তু হেনরি বেকেরেল আশা করছেন ইউরেনিয়াম সালফেটের লবণ থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যেতে পারে। পনের বছর আগে তিনি ইউরেনিয়াম লবণ প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সেগুলি তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়ে গেছেন তাঁর বন্ধু বিজ্ঞানী গাব্রিয়েল লিপম্যান, যিনি রঙিন ছবি উৎপাদন করার গবেষণা করছিলেন।

হেনরি বেকেরেল লিপম্যানের কাছ থেকে তাঁর ইউরেনিয়াম সল্ট ফেরত নিয়ে এসে পরীক্ষণের জন্য তৈরি হলেন। কালো কাগজে ঢাকা ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর ইউরেনিয়াম এবং পটাশিয়ামের ডাবল সালফেট কৃস্টাল রাখা হলো। একটি কৃস্টাল এবং কালো কাগজের মাঝখানে একটি ধাতব পয়সা রেখে সূর্যের আলোতে রেখে দেয়া হলো কয়েক ঘন্টার জন্য। এরপর তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেট প্রসেস করে দেখলেন খুব সামান্য একটু আলোর রেখা দেখা গেছে ফটোগ্রাফিক প্লেটে – পয়সার ছায়ার চারপাশে এবং কৃস্টালের চারপাশে। এক্স-রে তৈরি হলে তো তা পয়সা ভেদ করে ফটোগ্রাফিক প্লেটে পয়সার এক্স-রে তৈরি হতো। কৃস্টালের উপর সূর্যের আলো পড়ে তাপ উৎপন্ন হয়ে যদি কৃস্টালের কোন বাষ্প তৈরি হয় – তা ফটোগ্রাফিক প্লেটে প্রভাব ফেলতে পারে। সেটা কাটানোর জন্য পাতলা কাচ দিয়ে কৃস্টাল ঢেকে দেয়া হলো। এই ফলাফল  ১৮৯৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সায়েন্স একাডেমির মিটিং-এ উপস্থাপন করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু তাতে নিশ্চিত করে এক্স-রে উৎপন্ন হবার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না। আরো পরীক্ষণ দরকার। একাডেমির পরবর্তী মিটিং ২ মার্চ। তার আগেই তাঁকে ফলাফল পেতে হবে।

কিন্ত বাধ সাধলো প্যারিসের আকাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। কৃস্টালে ফেলার মতো যথেষ্ট সূর্যরশ্মি নেই কোথাও। ঝাপসা আলোয় কিছুক্ষণ ফেলে রাখার পর সবকিছু গুটিয়ে একটি ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখতে বাধ্য হলেন হেনরি বেকেরেল। ২৭-২৮ তারিখেও সূর্যের মুখ দেখা গেল না। ১৮৯৬ সাল ছিল লিপইয়ার। বেকেরেল আশা করছিলেন অন্তত ২৯ তারিখে হলেও কিছু রোদ পাওয়া যাবে। কিন্তু না – সেই আশার গুড়েও বালি। এদিকে ২ তারিখের মিটিং-এ কিছু ফলাফল তো দেখাতে হবে। তাই মার্চের এক তারিখ ড্রয়ার খুলে ফটোগ্রাফিক ফিল্মের প্লেট ডেভেলপ করলেন হেনরি বেকেরেল। কিন্তু অবাক হয়ে গেলেন ফলাফল দেখে। ফটোগ্রাফিক প্লেটে ক্রিস্টালের দাগ স্পষ্ট। যেখানে প্রতিপ্রভাই তৈরি হয়নি, সেখানে এই দাগ এলো কীভাবে? ইউরেনিয়াম সল্ট থেকে কি নিজে নিজেই কোন অজানা রশ্মি বের হচ্ছে? পদার্থের অজানা এক নতুন ধর্ম আবিষ্কৃত হলো সেদিন – যার নাম দেয়া হয়েছিল বেকেরেল রশ্মি।

পরবর্তী কয়েক বছরে মেরি কুরি এবং পিয়ের কুরি এই অজানা ধর্মের গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ পোলোনিয়াম এবং রেডিয়াম। মেরি কুরি পদার্থের এই নতুন ধর্মের নাম দিলেন রেডিও-অ্যাকটিভিটি। এরপর একে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানের জগতে ঘটে গেছে বিপুল বিপ্লব – যা বিংশ শতাব্দীকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। সেটা আরেকদিনের গল্প।

নোবেল পুরষ্কারের জন্য হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করা শুরু হয়েছিল ১৯০১ থেকেই। ১৯০১ সালে তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন ফ্রান্সের বিখ্যাত রসায়নবিদ মারসেলিন বারথেলো। ১৯০২ এবং ১৯০৩ সালেও মারসেলিন হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। মারসেলিন ছাড়াও ১৯০২ সালে আরো দুজন বিজ্ঞানী - ফরাসি গণিতবিদ গ্যাসটন ডারবোক্স এবং জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী এমিল ওয়ারবুর্গ হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন নোবেল পুরষ্কারের জন্য। ১৯০৩ সালে মারসেলিন ও গ্যাসটন ছাড়াও আরো চারজন বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেলের নাম প্রস্তাব করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য। তাঁরা ছিলেন – রয়েল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সের সদস্য চার্লস বুকার্ড ও ইলিউটের মাসকার্ট, পদার্থবিজ্ঞানী গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান ও হেনরি পয়েনকারে। ১৯০৩ সালে মেরি এবং পিয়ের কুরির সাথে যৌথভাবে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার অর্জন করেছিলেন হেনরি বেকেরেল। [৪]

 হেনরি বেকেরেল ১৯০৩ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর শুধুমাত্র একজনের নামই নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাব করেছিলেন – তিনি ছিলেন গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান। ১৯০৮ সালে গ্যাব্রিয়েল লিপম্যান পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, কিন্তু হেনরি বেকেরেল তা দেখে যেতে পারেননি। পুরষ্কার ঘোষণার কয়েক মাস আগে, ১৯০৮ সালের ২৫ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।

হেনরি বেকেরেলের ছেলে জিন বেকেরেলের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৮ সালে। তিনিও তাঁর পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের পদাঙ্ক অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞানী হয়েছেন। ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর বাবা হেনরি বেকেরেলের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। ১৯৪২ সালে তিনি গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন যেখানে কাজ করেছেন তাঁর পূর্ববর্তী তিন প্রজন্ম। ১৯৪৬ সালে তিনি ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর কোন সন্তান ছিল না। তাই তাঁর মৃত্যুর সাথে শেষ হয় চার প্রজন্মের পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা।


হেনরি, জিন ও এডমন্ড বেকেরেল

 

তথ্যসূত্র

১। রেডিওলজিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ভল্যুম ৮, ২০১৫, পৃ ১-৩।

২। রেডিয়েশান প্রটেকশান ডোসিমেট্রি, ভল্যুম ৬৮, সংখ্যা ১/২, ১৯৯৬, পৃ ৩-১০।

৩। মেডিক্যাল ফিজিক্স, ভল্যুম ২২, সংখ্যা ১১, নভেম্বর ১৯৯৫, পৃ ১৮৬৯ – ১৮৭৫।

৪। Nobelprize.org

______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত










Latest Post

মুহম্মদ নিজাম-এর 'বেগানা পুষ্প'

  বেগানা পুষ্প পড়তে শুরু করার আগেই চোখে পড়ে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” – যেখানে লেখা আছে “অতীব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, মারাত্মকভাবে ১৮+, অনুগ্রহপূর্বক...

Popular Posts