Saturday, 18 October 2025

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

 



যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগত থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশা, নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রতি প্রবল আগ্রহ। অনেক সময়েই দেখা যায় তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলাফল যেসব জার্নালে প্রকাশিত হয়, এবং যে বৈজ্ঞানিক ভাষায় সেসব লেখা হয় – তা থাকে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে। ফলে এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অনেকসময়ই অজ্ঞাত থেকে যায়। বৈজ্ঞানিক ভাষাকে সাধারণ ভাষায় রূপান্তর করে বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকদের কাছে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি। যেসব দেশে বিজ্ঞানপত্রিকার চাহিদা বেশি, সেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত। সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হবার লক্ষ্যে শৈশব কৈশোর থেকে প্রস্তুত হতে থাকে। বলা যায়, কোন দেশের বিজ্ঞানচর্চার ভিত তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে প্রধান ভূমিকা রাখে বিজ্ঞানপত্রিকাগুলি। আমাদের দেশে গত নয় বছর ধরে সেই ভূমিকা রেখে চলেছে মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানচিন্তার দশম বর্ষপূর্তিতে বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশনার সাথে যাঁরা যুক্ত, লেখক এবং পাঠক সবাইকে জানাই অভিনন্দন।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামী দুটো বিজ্ঞান সাময়িকীর নাম উল্লেখ করতে হলে – প্রায় সবাই একমত হয়ে বলবেন ‘সায়েন্স’ এবং ‘ন্যাচার’-এর কথা। ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ন্যাচার’ যাত্রা শুরু করেছিল ১৮৬৯ সালে। আর আমেরিকান বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ শুরু হয়েছে ১৮৮০ সাল থেকে। সেই থেকে প্রতি সপ্তাহে এই সাময়িকী দুটো প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবং প্রতিটি সংখ্যায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই সাময়িকী দুটোর যে-কোনো একটিতে কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারলে বিজ্ঞানীদের গৌরব বেড়ে যায় তরতর করে। এই জার্নাল দুটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো – এখানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জটিল প্রক্রিয়া এবং ফলাফল যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি সাধারণ পাঠকদের বোঝার জন্য পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান-প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। সেজন্যই বিজ্ঞানীসমাজে তো বটেই, সাধারণ পাঠক সমাজেও এই সাময়িকী দুটোর গুরুত্ব অসীম।

জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ের ম্যাগাজিনের নাম বলতে গেলে প্রথমেই আসে সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর নাম। ১৮৪৫ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ম্যাগাজিন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ফলাফল বিজ্ঞানসাময়িকীতে প্রকাশিত হলে বা কোন গবেষণাগারে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেলে তা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য আকারে প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ। একই আদলে যুক্তরাজ্যের ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ প্রকাশিত হয়ে আসছে ১৯৫৬ সাল থেকে। সে তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার দশ বছর – সবে মাত্র যাত্রা শুরু হবার সমতুল্য।

জনসংখ্যার অনুপাতে আমেরিকা ও ইওরোপে যত সংখ্যক বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশিত হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞান সাময়িকী নেই বললেই চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের সমাজ খুবই বিজ্ঞানবিমুখ সমাজ। এর পেছনে আর্থসামাজিক কারণ যেমন রয়েছে – খুব প্রকটভাবে আছে রাজনৈতিক কারণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর। সেখানে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনের কৌশল শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয় বেশি। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যত সংখ্যক বিজ্ঞানশিক্ষার্থী আছে – তার সংখ্যা অনেক দেশের মোট শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানী তৈরি হয় খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যবর্তী ফাঁক পূরণ করতে পারে বিজ্ঞান সাময়িকী। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা চেষ্টা করে যাচ্ছে সেব্যাপারে কীভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করা যায়।

আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা নিয়মিত বিজ্ঞান পড়ান, এবং কেউ কেউ যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান-লেখকের সংখ্যা খুবই কম, সম্ভবত পাঠকের সংখ্যাও । যেটুকু পড়াতে হবে – তার বাইরে নিজেরাও নতুন কিছু জানার জন্য কতটুকু পড়াশোনা করেন তা আমার জানা নেই। তবে খুবই ভালো হতো – যদি তাঁরাও নিয়মিত বিজ্ঞানচর্চা করতেন, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করতেন।

বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত লেখা প্রকাশের পাশাপাশি সারাদেশে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেক প্রকল্প চালু রেখেছে। নানা বিষয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজনে সক্রিয় সহযোগিতা করছে। এসবের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যে তৈরি করতে পারছে তাতে বোঝা যায় যে বিজ্ঞানচিন্তা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

বিজ্ঞানচিন্তার হাত ধরে আমাদের সমাজ আরো অনেক বিজ্ঞানপ্রেমী, বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা।

--------

বিজ্ঞানচিন্তার অনলাইনে প্রকাশিত:

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

Sunday, 28 September 2025

তেজস্ক্রিয় সুপারহিরো: কল্পনা ও বিজ্ঞান

 




নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর রবার্ট ব্রুস ব্যানারকে আমরা অনেকেই চিনি। তাঁর চেয়েও বেশি চিনি তাঁর দ্বিতীয় সত্ত্বা হাল্ক-কে যিনি রেগে গেলে মানুষ থেকে প্রচন্ড শক্তিশালী ‘দৈত্য’ হয়ে ওঠেন এবং সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলেন। দুটো চরিত্রই কাল্পনিক; একটুখানি বিজ্ঞানের সাথে অনেকখানি কল্পনার মিশেলে তৈরি। এরকম আরো অনেক সুপারহিরো-সুপারভিলেনের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে কমিক বইতে, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় টেলিভিশনে।

কার্টুনের মাধ্যমে গল্প বলার নতুন ধারা কমিক বইয়ের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৯৭ সালে “দ্য ইয়েলো কিড ইন ম্যাকফ্যাডেন্স ফ্ল্যাটস”প্রকাশের মাধ্যমে। কল্পবিজ্ঞানের প্রথম সুপারহিরো সুপারম্যান। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যালাইড পাব্লিকেশান্স থেকে প্রকাশিত ‘অ্যাকশান কমিক্স’-এর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছিল সুপারম্যানের যাত্রা।

সেইসময় পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নভোযান প্রস্তুত করছিলেন মহাকাশে অভিযান শুরু করার লক্ষ্যে। তারই প্রতিফলন ঘটছিলো অ্যাকশান কমিক্সের চরিত্রগুলোতে। সুপারম্যানের জন্ম ক্রিপটন নামক এক কাল্পনিক গ্রহে – যে গ্রহ লাল নক্ষত্র রাও-এর চারপাশে ঘুরে। ক্রিপটনের বিজ্ঞানী দম্পতি জর-এল এবং লারা-এল যখন দেখলেন তাঁদের গ্রহ ক্রিপটন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে – তখন তাঁরা ছোট্ট একটি মহাকাশযান তৈরি করে তাঁদের একমাত্র সন্তান ক্যাল-এলকে সেখানে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্রিপটন গ্রহ ধ্বংস হয়ে যায়। কাল-এল নানারকম মহাকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছায় পৃথিবী নামক গ্রহে। এখানেই কাল-এল পেয়ে যায় প্রচন্ড শক্তি, প্রচন্ড গতি, উড়ার ক্ষমতা, এক্স-রের মতো দৃষ্টিক্ষমতা। হয়ে ওঠে আমাদের সুপারম্যান।

সুপারম্যানের জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন সুপারহিরো – সুপারভিলেন। ব্যাটম্যান, জোকার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ওয়ান্ডার ওম্যান, সুপারগার্ল, স্পাইডারম্যান, হাল্ক, থর, এক্স-ম্যান, আয়রন-ম্যান – সবাই শারীরিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী – প্রচলিত প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অনেক নিয়মই এদের ক্ষেত্রে খাটে না। এরা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করতে পারে, নিউটনের গতির সূত্র কিংবা শক্তির সংরক্ষণশীলতার ক্ষমতা নেই এদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ কিংবা সার্বিক কোন আইনই এরা মানে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক টানেলিং কিংবা এন্টেঙ্গেলমেন্ট-এর অসম্ভবকে এরা বাস্তবেই কাজে লাগাচ্ছে অবলীলায়। বাস্তব বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে কল্পনার এই চরিত্রগুলো।

সুপারহিরোদের অনেকের ভেতরের অফুরন্ত শক্তির উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প তৈরি করতে গিয়ে বিকিরণ বিজ্ঞানের অপব্যবহার করা হয়েছে সবক্ষেত্রেই। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

(১) দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক: আমেরিকার একটি সরকারি গবেষণাগারের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী ব্রুস ব্যানার ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। খুবই দায়িত্বশীল মানবিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে একটি ‘গামা বোমা’ তৈরি করছিলেন। বোমা তৈরির পর ওটার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় তিনি দেখতে পেলেন বিপদসীমার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়েছে একজন তরুণ। রিক জোন্স নামের এই তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ব্রুস ব্যানার। তেজস্ক্রিয় গামা রশ্মির প্রভাবে তার শরীরের কোষ এবং স্নায়ুকোষের ডিএনএ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যে – যদি তিনি কোনোভাবে রেগে যান – তাহলে তাঁর শরীরের সবগুলি পেশী এমনভাবে ফুলে উঠে যে তিনি প্রচন্ড শক্তিশালী সবুজ দৈত্য – হাল্ক-এ রূপান্তরিত হয়ে যান। রাগ যত বাড়তে থাকে তাঁর বিধ্বংসী ক্ষমতাও তত বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞানের বাস্তবতার সাথে এই গল্প মেলাতে গেলে সমস্যা হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে শরীরের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটতে পারে এটা সত্য। বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে শরীরের সবগুলি ডিএনএর গঠন ভেঙে গিয়ে বেশিরভাগ কোষ মরে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বিকিরণের ফলে ওরকম দৈত্যে পরিণত হওয়ার মধ্যে কোনো প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞান নেই।

(২) স্পাইডারম্যান: স্কুলছাত্র পিটার পার্কার গিয়েছিল একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি প্রদর্শনীতে একটি মাকড়শা হঠাৎ তেজস্ক্রিয় কণার প্রবাহের মাঝখানে চলে আসে এবং নিজেই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই মাকড়শাটি পিটার পার্কারকে কামড় দেয়ার সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় মাকড়শার পরিবর্তিত ডিএনএ পিটার পার্কারের শরীরে প্রবেশ করে। তাতে পিটার পার্কারের ভেতর প্রচন্ড শক্তির সঞ্চার হয়। তীব্র দৈত্যাকার মাকড়শার মতো সে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে, জাল তৈরি করে সেখানে ঝুলে থাকতে পারে – ইত্যাদি।

এই গল্পেও বিজ্ঞানের মারাত্মক অপব্যবহার করা হয়েছে। মারাত্মক বিষধর মাকড়শার কামড়ে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে – কিন্তু মানুষ মাকড়শায় পরিণত হতে পারে না।

(৩) রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান: চায়নিজ নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী চেন লু নিজেকে জীবন্ত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরে পরিণত করার লক্ষ্যে গবেষণাগারে নিজের উপর পরিকল্পিতভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটান। প্রচুর নিউক্লিয়ার বিকিরণ শোষণ করে নিজেই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয়তার উৎসে পরিণত হন এবং হয়ে ওঠেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। যখন খুশি তিনি নিজের শরীর থেকে রেডিয়েশান নির্গমন করে যাকে খুশি ধ্বংস করে দিতে পারেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। আবার অন্য কোন উৎস থেকে রেডিয়েশান নির্গত হলে তা  শোষণও করতে পারেন।

এই গল্পের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যে কীরকম অতিরঞ্জন তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। একটি ছোটখাট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর তৈরি করতেও যে পরিমাণ জটিল অবকাঠামো তৈরি করতে হয়, তার সবকিছু একজন মানুষের শরীরের ভেতরই হয়ে যাবে?

(৪) ডক্টর ম্যানহ্যাটন – পদার্থবিজ্ঞানী জন ওস্টারম্যান একটি বিপজ্জনক গবেষণা করার সময় দুর্ঘটনাবশত শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে আটকা পড়েন। তাতে তাঁর সম্পূর্ণ শরীর বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেলেও তিনি মারা যাননি। কয়েক মাস পর দেখা যায় তাঁর শরীরের সবগুলি কোষ আস্তে আস্তে আবার পুনর্গঠিত হয়ে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন নীল জেলির মতো দেখতে ‘ডক্টর ম্যানহাটন’-এ পরিণত হন যিনি ভর, শক্তি এবং সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এখানেও বাড়াবাড়ি রকমের অতিরঞ্জিত করা হয়েছে পদার্থ ও শক্তির রূপান্তরের পদার্থবিজ্ঞানকে। পারমাণবিক বিক্রিয়ার কোন সূত্র দিয়েই এই রূপান্তর বাস্তবে সম্ভব নয়।

(৫) ফায়ারস্টর্ম – ডিসি কমিক্‌স-এর ফায়ারস্টর্মকে নিউক্লিয়ার ফিউশানের সাথে তুলনা করা হয়। গল্পে পদার্থবিজ্ঞানী মার্টিন স্টেইন এবং তার ছাত্র রনি রেমন্ড নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে একটি বিস্ফোরণের ফলে দুজন একসাথে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হয় ফায়ারস্টর্ম – যেখান থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি পাওয়া যায়।

এখানেও যে বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি রকমের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুজন মানুষের এক হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশান রিঅ্যাক্টর হয়ে যাওয়া অসম্ভব। 

(৬) ক্যাপ্টেন অ্যাটম – গল্পের ন্যাথানিয়েল অ্যাডম ছিলেন সামরিক বিজ্ঞানী। ভয়াবহ এক নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে তিনি মারা যান। কিন্তু দেখা যায় অনেক বছর পর তিনি ধাতব মানুষ রূপে আবির্ভূত হন যিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে শক্তি আহরণ করতে পারেন।

এখানে কোয়ান্টাম ফিল্ডের শক্তি ও পরমাণুর জটিল তত্ত্বের অপব্যবহার করে এমন এক  জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে ধাতব পদার্থেরও প্রাণ আছে।

(৭) দ্য লিডার – মার্ভেল কমিকস এর গল্পের স্যামুয়েল স্টার্নস ছিলেন একজন ঝাড়ুদার। রেডিয়েশান ল্যাবরেটরি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার বদলে তাঁর মগজের কোষের পরিবর্তন হয়। তিনি হয়ে যান অতিবুদ্ধিমান। বুদ্ধি দিয়ে তিনি হাল্ককে পরাজিত করতে চান।

 এখানেও তেজস্ক্রিয়তার ধর্মকে বিকৃত করা হয়েছে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মস্তিষ্কের কোষের বুদ্ধিমত্তা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাস্তবে অসম্ভব।

(৮) নিউক্লিয়ার ম্যান – সুপারম্যান সিরিজের চতুর্থ সিজনে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের এমন অপব্যবহার করা হয়েছে যে আঁৎকে উঠতে হয়। গল্পে দেখানো হয়েছে – সুপারম্যানের ডিএনএ নিয়ে তা নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগ করে সূর্যের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সূর্যের সৌরশক্তির সাথে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ম্যান – যার ভেতর সুপারম্যানের সব গুণাবলি এবং শক্তি পাওয়া যায়। সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্রচন্ড শক্তিশালী হয় নিউক্লিয়ার ম্যান।

সূর্য থেকে মানুষের সৃষ্টির কথা কিছু প্রাচীন লোকগাথায় পাওয়া গেলেও বাস্তবে সেটা যে অসম্ভব তা সবাই জানে।

দেখা যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞানের সবগুলি সুপারহিরোই কোনো না কোনো ভাবে রেডিয়েশানের দ্বারা প্রভাবিত। এই চরিত্রগুলির প্রায় সবগুলিই সৃষ্টি হয়েছে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতার ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে। জাপানের হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহরের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা যে ধ্বংসযুগের সূচনা করেছে তারই পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এসব সুপারহিরো-সুপারভিলেনদের ওপর।

সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন – নিউক্লিয়ার শক্তির ধ্বংসাত্মক পরিণতি বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলি যেরকম যুদ্ধে মেতে ওঠে – তারই রূপক প্রতিফলন দেখানো হয়েছে এখানে কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে।

সামাজিক উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শক্তি, ধর্ম এবং ক্ষমতাকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে যে সুপারহিরো এবং সুপারভিলেনের চরিত্রগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে -তার মূল উদ্দেশ্য বিনোদন। কিন্তু এই বিনোদন পরোক্ষভাবে নিউক্লিয়ার শক্তি এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করছে।

সবগুলি চরিত্রেই দেখানো হয়েছে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে শরীরের কোষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে অদ্ভূত ক্ষমতার উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ দৈত্যের শক্তি প্রাপ্ত হচ্ছে, উড়ার ক্ষমতা অর্জন করছে, শরীর থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি বের করে দিচ্ছে, কিংবা চোখ দিয়ে এক্স-রে নির্গমন করে সেই এক্স-রে দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে।

কল্পবিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানের যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে এসব কাহিনিতে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সত্যিকারের বিজ্ঞান তাহলে কী?

বিকিরণ হলো শক্তির প্রবাহ। বিকিরণ প্রধানত দু’ধরনের হতে পারে – কণা প্রবাহের মাধ্যমে এবং তরঙ্গ প্রবাহের মাধ্যমে। ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা – এরকম কণা যখন তাদের স্থিতিশীল শক্তিস্তরে থাকার জন্য যেটুকু শক্তির দরকার হয় তার চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তখন অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে সেই অতিরিক্ত শক্তির প্রভাবে পদার্থের আয়নাইজেশান বা আয়নায়ন ঘটায়। এরপরও যেটুকু শক্তি বাকি থাকে তা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের আকারে বিকীর্ণ হয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি কোনো তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে তার কম্পাঙ্কের উপর। কম্পাঙ্ক যত বেশি, শক্তিও তত বেশি। কম্পাঙ্ক যত বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত ছোট। দৃশ্যমান আলোর সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হলো বেগুনি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো ছোট হলে হয় অতিবেগুনি। অতিবেগুনি রশ্মির চেয়েও ছোট হলো এক্স এবং গামা রশ্মি। এক্স-রে তৈরি হয় পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির কক্ষপথ থেকে। গামা রশ্মি নির্গত হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে – প্রোটন কিংবা নিউট্রনের শক্তিস্তরের উত্তেজনা থেকে। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গামা রশ্মি নির্গমন করে।

এক্স-রে কিংবা গামা-রে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে – তাদের কতটুকু আমাদের শরীর শোষণ করবে, কতটুকু বের করে দেবে তা নির্ভর করে এক্স-রে বা গামা-রে’র শক্তির উপর। এক্স-রে কিংবা গামা-রে শোষণ করার ফলে কোন প্রাণির শরীর কিংবা কোনো পদার্থই দীর্ঘ সময়ের জন্য তেজস্ক্রিয় বা রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে না। মানুষ নিজে তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়বে শুধুমাত্র তখনই – যখন কোন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয়। সে হিসেবে মানুষের শরীর থেকে কিছুটা বিকিরণ নির্গমন করে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে তা সূর্যের আলোর বিকিরণের মাত্রা থেকেও কম।

এবার দেখা যাক – বিকিরণের প্রভাবে শরীরে কী কী ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত বিকিরণ শরীরে প্রবেশ করলে জীবকোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ আছে তার বন্ধন ভেঙে যেতে পারে। কম পরিমাণে ভাঙলে ডিএনএগুলি নিজেদের মেরামত করে ফেলতে পারে। কিন্তু বেশি ভেঙে গেলে কোষ মরে যায়। খুব বেশি কোষ একসাথে মরে গেলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়, অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়। শরীরের বেশিরভাগ কোষ দ্রুত মরে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কিছুতেই নিজে নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন হয়ে উঠতে পারে না।

কোষের ডিএনএ গুলির বন্ধন যদি ভেঙে যায়, শরীরের স্বয়ংক্রিয় মেরামত পদ্ধতির মাধ্যমে শরীর সেই ভগ্নবন্ধন জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করে। সেই জোড়া লাগাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু উলটোপালটা ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় তাতে ডিএনএ-র ত্রুটি নিয়ে কোষ বিভাজন ঘটে। ফলে ক্যান্সার কোষের উৎপত্তি হতে পারে। বিকিরণের প্রভাবে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা এখান থেকেই তৈরি হয়। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে কোনোভাবেই ‘হাল্ক’ বা ‘স্পাইডারম্যান’ হবার সম্ভাবনা নেই। মস্তিষ্কের কোষ যদি অতিরিক্ত বিকিরণ শোষণ করে – নিউরনের মৃত্যু ঘটে। মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কিন্তু উলটোটা হবার সম্ভাবনা নেই – অর্থাৎ বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কখনও হঠাৎ বোকা থেকে অতিবুদ্ধিমান হয়ে উঠবে না।

কল্পনার সুপারহিরোদের কার্যক্ষমতাকে আমরা যতক্ষণ রূপকথার গল্পের জায়গায় রেখে দেবো ততক্ষণ কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তাকে বিজ্ঞানের জায়গায় রাখতে গেলে আশা করি ভাবনাচিন্তা করে রাখবেন।

 

তথ্যসূত্র

১। বেরি ফিৎজারাল্ড, ফিজিক্স এডুকেশন, সংখ্যা ৫৪, ০১৫০১৯ (২০১৯)।

২। মার্ক ব্রেইক, দ্য সায়েন্স অব সুপারহিরোস, রেসহর্স পাবলিশিং, নিউইয়র্ক, ২০১৮।

৩। জেমস কাকালিওস, দ্য ফিজিক্স অব সুপারহিরোস, গোথাম বুকস, নিউইয়র্ক, ২০০৯।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত






Tuesday, 9 September 2025

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

 



যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন।

পৃথিবীর সব দেশে ক্যান্সার রোগীর বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থা আছে। তবুও অনেক দেশে অনেক মানুষ ক্যান্সার রোগে মারা যায় – রোগ শনাক্ত হবার আগেই। তাদের সংখ্যা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা – ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র এই এক বছরেই সাতানব্বই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যান্সারে [১]।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যায়। দেখা যাচ্ছে মানুষ যত দীর্ঘজীবী হচ্ছে, বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বছরে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ হারে বাড়বে, আর ক্যান্সারে মৃত্যু হবে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর। ২০৪০ সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়ে যাবে। তখন বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে, আর দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার রোগি মারা যাবে। ২০৫০ সালে এই হার আরো বাড়বে। বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হবে – আর মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে শতকরা পঞ্চাশেরও বেশি। তার মানে প্রতি দুই জন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজন মারা যাবে। এই সংখ্যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখে চড় মারার মতোই অপমানজনক।

এক সময় মনে করা হতো ক্যান্সার ধনীদের রোগ। গত শতাব্দীর পরিসংখ্যান থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র কোন দেশের ক্যান্সার রোগীর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার রোগীর শতকরা হার অনেক বেশি। তার একটি প্রধান কারণ ছিল – আফ্রিকার জনগণের গড় আয়ু ছিল অস্ট্রেলিয়ার জনগণের গড় আয়ুর চেয়ে অনেক কম। ফলে ক্যান্সার হবার গড় বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই আফ্রিকার মানুষ অন্য কোন নিরাময়যোগ্য রোগে মারা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুফল এবং পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখন ক্যান্সার আর শুধুমাত্র বড়লোকের রোগ নয়।

কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। ক্যান্সার রোগের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর এবং ব্যয়বহুল বলে ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে ধনীদেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার দরিদ্রদেশের ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক কম।

২০২২ সালে বাংলাদেশে নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার। আর একই বছর ক্যান্সারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ সতের হাজার মানুষ। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করার ব্যাপারে নানারকম অসুবিধা আছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে খুবই নাজুক। অনেক রোগীই ক্যান্সারে মারা যান ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগেই, অথবা একেবারে শেষ পর্যায়ে শনাক্ত হওয়ার পর। তাই বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর বার্ষিক মৃত্যুর হার সত্তর শতাংশেরও বেশি।

ক্যান্সার রোগের যে কোনো চিকিৎসা নেই – তা নয়। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সুস্থও হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে – এই রোগ হবার মূল কারণ এখনো অজানা। সেজন্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করারও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। মূল কারণ অজানা বলেই – ক্যান্সারের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ভীতি যেমন রয়েছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে নিত্যই প্রচারিত হচ্ছে নানারকম মতামত। যে মতামতের বেশিরভাগই এখনো অমীমাংসিত।

ক্যান্সার রোগের মূল কারণ শনাক্ত করা না গেলেও ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যেটুকু বলা যায় – সেটুকু হলো – ক্যান্সার কোনো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। ক্যান্সার হলো কোষঘটিত রোগ। স্বাভাবিক কোষ শরীরের ভেতর ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও কোনো স্বাভাবিক কোষ কখন ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হবে তা বলা যায় না। ক্যান্সার কোষের রূপান্তর বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমান করা গেলেও – কেন এই রূপান্তর ঘটে তা এখনো অজানা।

কোষের কর্মপদ্ধতি লেখা থাকে তার ডিএনএ-তে। দেখা যায় স্বাভাবিক কোষ এবং ক্যান্সার কোষের ডিএনএ-তে পার্থক্য থাকে। কোষের ডিএনএ-র অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কোষের কাজকর্ম অস্বাভাবিক হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। ক্যান্সার কোষ তখন দেহের স্বাভাবিক জৈবনির্দেশ মেনে চলে না। একটি স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজনের পর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক মৃত্যুনির্দেশিকা মেনে চলে না। তাই ক্যান্সার কোষকে যেকোনো উপায়ে মেরে ফেলাই হলো ক্যান্সার চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

ক্যান্সার চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশান প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। কীভাবে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার কোষযুক্ত টিউমারে পাঠানো হবে – তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি। 

বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীকে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়। ক্যামোথেরাপিতে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষে পাঠানো হয়। যদি সার্জারি করে ক্যান্সার টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয় – তাহলে সার্জারি করা হয়। অর্ধেকের কাছাকাছি রোগীকে শরীরের বাইরে থেকে রেডিয়েশান দেয়া হয় – যাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ক্যান্সার নির্মূল করার ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার কোষগুলির স্বাভাবিক কোষের সাথে মিলেমিশে থাকার কারণে। সবগুলি ক্যান্সার কোষকে একসাথে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না – কারণ তাতে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা স্বাভাবিক কোষগুলিও ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরের স্বাভাবিক কোষ যদি অতিমাত্রায় ধ্বংস হয়ে যায় – তাহলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে রোগীর হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি এমনভাবে দেয়া হয় – যেন ক্যান্সার কোষগুলি ধ্বংস হয়, কিন্তু স্বাভাবিক কোষগুলির কার্যক্রম অটুট থাকে [২]।

রেডিয়েশানের ক্ষতিকর দিক থেকে স্বাভাবিক কোষগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যান্সার কোষ ও স্বাভাবিক কোষের কিছু জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়। যেমন স্বাভাবিক কোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে সারিয়ে তুলতে পারে যদি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়। প্রচলিত রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে তাই একসাথে অধিক মাত্রায় রেডিয়েশান প্রয়োগ করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় পরপর কম মাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হয়। একবার রেডিয়েশান দেয়ার পর থেকে আরেকবার রেডিয়েশান দেয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় (সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা) – সেই সময়ে ক্যান্সার কোষের সাথে যেসব স্বাভাবিক কোষ রেডিয়েশানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – তারা নিজেদের সুস্থ করে নিতে পারে (ডিএনএ সংশোধন)। ক্যান্সার কোষগুলির সাধারণত সেই ক্ষমতা থাকে না।

ক্যান্সার কোষগুলিতে সাধারণত অক্সিজেন প্রবাহের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক কোষগুলির চেয়ে কম। অক্সিজেন প্রবাহ কম থাকলে রেডিয়েশানের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হাইপোক্সিক বা কম অক্সিজেনযুক্ত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে গেলে যে মাত্রার রেডিয়েশান দিতে হবে – সেই মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষগুলি অনেক বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বলে রেডিয়েশানের মাত্রা কম রাখতে হয়। ফলে রোগীর চিকিৎসা করতে হয় দীর্ঘদিন এবং খরচ ও ভোগান্তিও বেড়ে যায়।

রেডিওথেরাপিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও তেমন কোন যুগান্তকারী পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি নামে এক নতুন ধরনের অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্বাভাবিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা [৩,৪]।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি এমন একটি প্রযুক্তি যা অতিস্বল্প সময়ে (মিলিসেকেন্ডের মধ্যে) অতি উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন (সেকেন্ডে চল্লিশ গ্রের অধিক) শরীরে প্রয়োগ করে। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে মাত্র কয়েক গ্রে রেডিয়েশান দিতে যেখানে কয়েক মিনিট সময় লাগে,  সেখানে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে নির্ধারিত ডোজ প্রয়োগ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই দ্রুতগতির অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি কমিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্ন হলো -  কীভাবে? যেখানে খুব কম মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান স্বাভাবিক কোষ কীভাবে সহ্য করবে?

ইঁদুর ও শূকরের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এটি কার্যকরভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং স্বাভাবিক কোষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের উপর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিত কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ পরীক্ষা করে দেখছেন ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।

অতি অল্প সময়ে অতিমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন সেটা হলো অক্সিজেন হ্রাস তত্ত্ব বা অক্সিজেন ডিপ্লেশান হাইপোথিসিস। 

প্রচলিত কম মাত্রার রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশান জৈবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে। কোষে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্ষতিকর পার-অক্সাইডে পরিণত হয় যা ডিএনএর ক্ষতি করে। কোষে উপস্থিত অক্সিজেন ডিএনএর এই ক্ষতিকে স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে – ফলে কোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কোষে যদি অক্সিজেন কম থাকে বা না থাকে, এই ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলি ডিএনএর স্থায়ী কোন ক্ষতি করতে পারে না। ফলে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই অস্থায়ী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, ডিএনএ নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায়।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন দেয়া হয়। এই উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বিপুল পরিমাণে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে, যা মুহূর্তেই চারপাশের অক্সিজেন খরচ করে ফেলে। অক্সিজেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যায় যে কোষগুলিতে সাময়িকভাবে অক্সিজেনস্বল্পতা বা হাইপোক্সিয়া তৈরি হয়। এতে স্বাভাবিক কোষে পারঅক্সাইড কম তৈরি হয় এবং ডিএনএ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু টিউমার কোষ সাধারণত আগে থেকেই কিছুটা হাইপোক্সিক থাকে, তাই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির এই অক্সিজেন কমিয়ে ফেলার প্রভাবে তারা খুব একটা প্রভাবিত হয় না।

ইঁদুরসহ অন্যান্য কিছু প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনে পথ এখনো অনেক বাকি। কারণ বিভিন্ন কোষে অক্সিজেনের শোষণ করার ক্ষমতা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। মানুষের কোষের সাথে রেডিয়েশান যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে, অন্যান্য প্রাণির কোষের সাথে সেই মিথষ্ক্রিয়া হুবহু এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন কোষের রেডিয়েশান সংবেদনশীলতাও ভিন্ন। তাই অক্সিজেন হ্রাসের এই তত্ত্ব এখনো সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাছাড়া এই তত্ত্ব প্রমাণিত হলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করতে গেলে এখনো বেশি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এত উচ্চ হারে রেডিয়েশান প্রয়োগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে লিনিয়ার এক্সিলারেটর ব্যবহার করা হয় – তা দিয়ে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো – এত উচ্চ হারের রেডিয়েশান মাপার মতো বিশ্বাসযোগ্য ডোসিমিটার এখনো তৈরি হয়নি। ডোসিমিটার ছাড়া কোনো রোগীকেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশান দেয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত খরচ হিসেবে ধরলে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রচলিত রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসা আবারো ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।

এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্যান্সার শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে হয় (যেমন: মস্তিষ্ক, ফুসফুস)। গবেষণা সফল হলে এটি দ্রুত সময়ে, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, কার্যকর চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

 

তথ্যসূত্র

১। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি, ক্যান্সার টু ডে, ২০২৪।

২। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ঢাকা ২০২৩।

৩। ফ্রনটিয়ার্স ইন অনকোলজি, ভল্যুম ৯, আর্টিক্যাল ১৫৬৩, জানুয়ারি ২০২০।

৪। অনকোলজি লেটারস, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ৬০২, ২০২৪।

________________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Wednesday, 20 August 2025

মুহম্মদ নিজাম-এর 'বেগানা পুষ্প'

 




বেগানা পুষ্প পড়তে শুরু করার আগেই চোখে পড়ে “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ” – যেখানে লেখা আছে “অতীব ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল, মারাত্মকভাবে ১৮+, অনুগ্রহপূর্বক প্রাপ্ত বয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠকের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থটি দূরে সরিয়ে রাখুন। অজাগর মন ও মগজের কুপ্রভাব থেকে বেগানা উপাখ্যানের স্বাস্থ্য রক্ষায় যত্নবান হোন। আদেশক্রমে, কর্তৃপক্ষ।“

ব্যাপারটি যে ভীষণ নতুন - তা নয়। শতাব্দী আগে আঠারো পেরিয়েছি। আমার নিজস্ব আঠারোর আগেই কত ধরনের ১৮+ মার্কা বই পড়ে ফেলেছিলাম – সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি ১৮+ বিজ্ঞাপিত যেসব বই যেসব “নিষিদ্ধ” আশায় হস্তগত করে দ্রুত গিলে ফেলেছিলাম তাদের বেশিরভাগের বিজ্ঞাপনই সার, ভেতরে সারবস্তু কিছুই নেই। বেগানা পুষ্পের ক্ষেত্রে প্রশ্ন বয়সের নয়, প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বলা হয়েছে প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সুপাঠক যেন বেগানা পুষ্পের স্পর্শ না পায়। প্রাপ্তবয়স্ক না-পাঠকের সংজ্ঞা কী? তাদের স্পর্শ থেকে এই গ্রন্থ দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব কার?

যাই হোক – এই লাইনগুলি বইয়ের শুরুতে ছাপিয়ে দেয়ার তাগিদ লেখকের না প্রকাশকের জানি না। সৃজনশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে লেখকের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে তাঁর গল্প তিনি কীভাবে বলবেন, কতটুকু বলবেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কী কী করবে – গল্পের কাঠামোর ভেতর থেকে কীভাবে বেড়ে উঠবে, কীভাবে প্রথা ভাঙবে – সবই লেখকের হাতে। সৃজনশীল লেখকদের ক্ষমতা তাঁর সৃজনশীলতার কারণেই ঈর্ষণীয়। মুহম্মদ নিজামের সৃজনক্ষমতা ঈর্ষণীয়।

“বেগানা পুষ্প”র নায়ক জীবন আহমেদ। জীবনের গল্প জীবনের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন লেখক মুহম্মদ নিজাম। উত্তম পুরুষে লেখা গল্পের সুবিধে হলো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীতার পাশাপাশি মনে মগজে কী চলছে তার শৈল্পিক বর্ণনার সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধাটি অসুবিধাও বটে। কারণ উত্তম পুরুষে বলা গল্পের দৃষ্টি একমুখি হয়। সবার মনের কথা খুলে বলার স্বাধীনতা তখন লেখকের থাকে না। বেগানা পুষ্পও সে হিসেবে শুধুমাত্র জীবনের দৃষ্টিতে দেখা একপাক্ষিক বিবরণ। বিথীর অন্তর্দহন কিংবা আনুষঙ্গিক মিথষ্ক্রিয়ার বিবরণও জীবন যতটুকু দিয়েছে ততটুকুই।

বেগানা পুষ্প প্রেমের উপন্যাস। ম্যাটম্যাটে মধ্যবিত্ত সংস্কারে আবদ্ধ জলে-নামবো-চুল-ভেজাবো-না ধরনের প্রেম নয়। উদ্দাম শরীরী প্রেম। শরীর বিনিময়ের বিশদ বিবরণ আছে বলেই হয়তো গল্প শুরুর আগে সেই ১৮+ এর আদিখ্যেতা। যদিও লেখক এখানে প্রেমের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের ব্যবধান বর্ণনা করেছেন এভাবে – “প্রেম হল মধ্যবিত্তের পূজার থালা কিংবা ছেলেবেলায় মেলায় হারিয়ে যাওয়া জমজ ভাই। সে যখন এই জিনিসের সাক্ষাৎ পায়, আবেগে আবেশে দিশেহারা হয়ে যায়। আর ভোগবাদী বড়লোকেরা কুরবানীর পশুর মতো যত্ন করে ঘরে তোলে, আয়োজন করে জবাই দেয়। এরপর তেলে হলুদে আদায় লবঙ্গে মরিচে মাখামাখি করে কষিয়ে জ্বালানি দেয়, রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করে।“ [পৃ ৩৯-৪০]।

ছোট ক্যানভাসে রঙের আধিক্য ঘটলে, কিংবা তুলির আঁচড় মাত্রাতিরিক্ত বেশি হয়ে গেলে মাঝে মাঝে বাস্তব পরাবাস্তবের সীমানা ঘুচে যায়, বেগানা পুষ্পেও সেরকম ঘটেছে। ইতিহাস দর্শন সমাজ এবং সমাজের মানুষ সব যেভাবে তালগোল পাকিয়ে থাকে – তার সবকিছুই কিছু কিছু আঁকতে চেয়েছেন লেখক এখানে।

জীবন লেখক হবার স্বপ্ন দ্যাখে, আবার এক সময় লন্ডন যাবার চেষ্টাও করে। কিন্তু বিথীর শরীর বেয়ে প্রেমে পড়ে যাবার পর সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। বিথী যখন জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় – তখন বর্তমানকে অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার কৌশল চমৎকার।

জীবনের ভাবনার মধ্য দিয়ে লেখক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে নিয়েছেন। যেমন, “ভিড়ের ভেতর ভ্রান্তি থাকে, জ্ঞান থাকে যৎসামান্য। নীলক্ষেতের কোন একটা বইয়ের দোকানের কোণায় পড়ে থাকা “তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী” কিংবা “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা” বইয়ে যে পরিমাণ সত্যবদ্ধ ঘটনা রয়েছে, সমগ্র ঢাকা শহরের যাবতীয় জনমানুষের ভিড়ে একযুগ ঘুরেফিরেও এইটুকু সত্য কেউ আহরণ করতে পারবে না।“ [পৃ ৬২]

পুরুষের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে জীবনের পর্যবেক্ষণ নির্মম: “একটা পুরুষ একটা পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট এবং বিকৃত আচরণ করার ক্ষমতা রাখে। এই পৃথিবীর মেয়েরাই শুধু সেই দৃশ্যগুলোর সাক্ষী থাকে। পুরুষ জাতির পরম সৌভাগ্য যে, প্রিয়তম নারী জাতি সীমাহীন গ্লানি কিংবা অতলান্ত ভালোবাসা দিয়ে পুরুষ জাতির এই কদর্য দিকটা সভ্য মানুষের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে রাখে।“ [পৃ ৬৭]

পুরুষ মানুষ প্রেমিকার জন্য কাউকে খুনও করতে পারে। এটা দেখা গেল জীবনের বেলায়। আজমল বিথীকে নিয়ে বাজে প্রস্তাব করায়, জীবন ও বিথীর গোপন মিলনের দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টার কারণে ঠান্ডা মাথায় প্ল্যান করে আজমলকে খুন করে জীবন। তবে এটা কি শুধুমাত্র বিথীর সম্মান বাঁচাতে, নাকি নিজেরও – এটা পরিষ্কার হয় না। তবে আজমলকে ঠান্ডা মাথায় খুন করার পরও জীবন কীভাবে এতটা স্বাভাবিক থাকে – এটাই আশ্চর্যের। পাঠক হবার এখানেই আনন্দ যে –  একজন খুনি কিংবা ধর্ষকও যদি নিজে কথা বলে - পাঠকের কাছে সবকিছুই অবলীলায় বলে ফেলে – লজ্জা কিংবা ভয় না করেই। 

বইটির ছাপা এবং বাঁধাই বেশ উন্নত। বানান ভুল মাত্র কয়েকটি। নীলা হারুনের প্রচ্ছদ সুন্দর। তবে প্রকাশনীর নাম “নয়েস” – শুনতে কেমন যেন লাগে।

মুহম্মদ নিজাম একটি ভালো গল্প বলেছেন। ভালোভাবেই বলেছেন।


Wednesday, 13 August 2025

ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার – রসায়নের মহানায়ক

 



পৃথিবীতে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৫৯ কোটি। তাঁদের মধ্যে পনেরো কোটির বেশি মানুষকে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয়। এই ইনসুলিন নেয়া মানুষগুলির মধ্যে কতজন এই ছবির মানুষটিকে চিনেন আমি জানি না। এই মানুষটির নাম ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার। ইনসুলিনে অ্যামিনো অ্যাসিডের নিখুঁত সিকোয়েন্সিং আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তারই ফলশ্রুতিতে গবেষণাগারে ইনসুলিন তৈরি করা সম্ভব হয়েছে যা বর্তমানে রোগীরা ব্যবহার করছে। তার আগে ইনসুলিন সংগ্রহ করতে হতো গরু ও শুকরের অগ্নাশয় থেকে। 

এই মানুষটিকে রসায়নের মহানায়ক বললেও খুব কম বলা হয়। একটি নোবেল পুরষ্কার পেলেই কেউ কেউ যেখানে বিরাট রাজা হয়ে যান, সেখানে এই মানুষটি দুইবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন রসায়নবিজ্ঞানে। ১৯৫৮ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ইনসুলিনের গঠন আবিষ্কার করার জন্য। এরপর ১৯৮০ সালে আবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং-এর জন্য। তাঁরই আবিষ্কৃত পদ্ধতি অনুসরণ করে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের শনাক্তকরণ পদ্ধতি – যেই ডাটা থেকে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে ভাইরাসের টিকা। 

রসায়নের এই মহানায়কের বিজ্ঞান-কাহিনি বিশাল। কিন্তু মানুষ হিসেবে তিনি এতটাই মাটির মানুষ ছিলেন যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শুধুমাত্র “স্যার” ডাক শুনতে হবে বলে। অথচ কোন কোন দেশে “স্যার” বলে সম্বোধন না করলে অনেকে রেগে যান বলে শুনেছি।  উচ্চপদস্থ নারী-পুরুষ সবাইকে “স্যার” ডাকার বাধ্যতামূলক আইনও নাকি তৈরি করা হয়েছিল কোন একটি দেশে। 

নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গার অকপটে বলেছেন, “আমি পড়াশোনায় কখনো ব্রিলিয়্যান্ট ছিলাম না। ছাত্রজীবনে কখনো কোন স্কলারশিপ পাইনি। আমার বাবার টাকা না থাকলে আমি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগই হয়তো পেতাম না।“ 

এই মানুষটি ৬৫ বছর বয়স পূর্ণ করার সাথে সাথে গবেষণার আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র থাকা অবস্থাতেই অবসর গ্রহণ করে বাকিটা জীবন (তিনি ৯৫ বছর বেঁচেছিলেন) বাড়ির নিভৃতে বাগান করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। অবসর গ্রহণ সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন সেটাও অনন্য। তিনি বলেছেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন আমার কর্মক্ষমতা কমে যাবে, তখন ভুল করতে শুরু করবো, সাফল্যের  চেয়ে ব্যর্থতার পরিমাণ বাড়তে শুরু করবে। তখন আমার কাজের ব্যর্থতার সমালোচনা করার যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও আমার এতদিনের খ্যাতির কারণে হয়তো অনেকে সংকোচ বা ভদ্রতাবশত আমার সমালোচনা করবে না। আমি সেটা চাই না। আমি শুধু শুধু চেয়ার দখল করে থাকার চেয়ে অনেক ভালো যদি আমি আমার চেয়ারটি যথাসময়ে খালি করে দিই – যেখানে নতুন কেউ এসে তাদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে পারবে।

১৩ আগস্ট ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গারের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মহানায়ক।


Monday, 4 August 2025

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি: আমাদের মহাজাগতিক ঠিকানা

 



যে পৃথিবীতে আমাদের বসবাস সে পৃথিবীতে আমাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ঠিকানা আছে। আধুনিক স্যাটেলাইটের কল্যাণে জিপিএস আমাদের অবস্থান (লোকেশান) মুহূর্তেই খুঁজে দেয়। কিন্তু পৃথিবীর বাইরে এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়?

প্ল্যানেট আর্থ – পৃথিবী নামের এই গ্রহটি আমাদের কাছে যতই অনন্য হোক না কেন – মহাবিশ্বে গ্রহের আনুমানিক সংখ্যা এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১০২৪)। এদের প্রত্যেকেই তাদের নিজস্ব নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে। পৃথিবী গ্রহের আছে তার নিজস্ব সৌরজগৎ। এরকম কোটি কোটি কোটি নক্ষত্রজগত আছে মহাবিশ্বে। এই নক্ষত্রগুলির আবার আছে নিজস্ব ছায়াপথ বা গ্যালাক্সি – যেখানে নক্ষত্রগুলি জোটবদ্ধ হয়ে থাকে। মহাবিশ্বে আনুমানিক দুই লক্ষ কোটি (দুই ট্রিলিয়ন) গ্যালাক্সি আছে। আমাদের সৌরজগৎ যে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত – তার নাম মিল্কিওয়ে। এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে অবস্থিত নক্ষত্রের সংখ্যা হতে পারে দশ হাজার কোটি থেকে চল্লিশ হাজার কোটি। এতগুলি সূর্যের ভীড়ে আমাদের সৌরজগৎ-এর নাক্ষত্রিক ঠিকানা বিজ্ঞানীরা নির্ণয় করেছেন কয়েক শ বছরের নিরলস জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা্র মাধ্যমে।

আজ আমরা  মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমাদের পৃথিবীর ঠিকানা বলতে পারি এভাবে: দৃশ্যমান মহাবিশ্বে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সৌরজগতে আমরা থাকি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি ছোট বড় আরো চুয়ান্নটি গ্যালাক্সি মিলে একটি গ্যালাক্সি-পাড়া বা লোকাল গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এই পাড়ায় আমাদের গ্যালাক্সি থেকে সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সি হলো ক্যানিস মেজর ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি – যা ছোট একটি গ্যালাক্সি। পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের এই গ্যালাক্সিকে আমাদের গ্যালাক্সি আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে (মাধ্যাকর্ষণের টানে কাছে নিয়ে আসছে)। আমাদের গ্যালাক্সি পাড়ার সবচেয়ে বড় গ্যালাক্সির নাম অ্যান্ড্রোমিডা। এই অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি এত বিশাল এবং এত উজ্জ্বল যে আমাদের কাছ থেকে পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী থেকে আমরা খালি চোখেও এই গ্যালাক্সির নক্ষত্রমন্ডলী দেখতে পাই। তবে আমাদের জন্য বিপদ এই যে আগামী চার শ কোটি থেকে পাঁচ শ কোটি বছরের মধ্যে  অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে গিলে খাবে – অর্থাৎ মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি মিশে যাবে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির সাথে। আরো বিশাল সেই মহা-গ্যালাক্সির নাম হবে মিল্কোমিডা।

কিন্তু এতসব আমরা জানলাম কীভাবে? আমাদের গ্যালাক্সির নামই বা কেন হলো মিল্কিওয়ে?


পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের উদ্ভব যখন হয়েছে ততদিনে মহাবিশ্বের বয়স হয়ে গেছে প্রায় এক হাজার কোটি বছর। আর মানুষের উদ্ভব হয়েছে মাত্র পঁচিশ লক্ষ বছর আগে। তাই আদিমানুষ আকাশের দিকে চোখ তুলেই দেখতে পেয়েছে দিনের বেলা সূর্য আলো দিচ্ছে, আর সূর্য ডোবার পর লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র রাতের অন্ধকারে মিটমিট করছে। মানুষের অদম্য কৌতুহল আর অনুসন্ধিৎসা থেকে জন্ম নিয়েছে মহাকাশবিজ্ঞান – পর্যবেক্ষণই যার প্রধান অবলম্বন। প্রকৃতিনির্ভর অসহায় আদিমানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রচন্ড ভয় পেতো। সেই ভয় থেকে জন্ম নিয়েছে ভক্তি এবং নানারকমের দেবদেবীর কল্পকাহিনি। আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত নক্ষত্র-ছড়ানো ছায়াপথ দেখতে দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ কল্পনা করে নিয়েছে বিভিন্ন কাহিনি।

ভারতীয় কাহিনিতে আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা। প্রাচীন মুনিঋষিরা ধারণা করে নিয়েছিলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত যে নক্ষত্রমন্ডলি দেখা যায় তা আসলে স্বর্গে বয়ে চলা নাক্ষত্রিক নদী। গঙ্গা নদীর সাথে মিলিয়ে এর নাম রাখা হয় আকাশগঙ্গা। এই আকাশগঙ্গার সাথে মিল্কিওয়ে নামের সরাসরি কোন শাব্দিক সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং গ্রিক এবং রোমান গল্পে সরাসরি ‘মিল্কিওয়ে’ শব্দটির উৎস পাওয়া যায়।

 গ্রিকদের গল্পে আছে – দেবতা জিউস আল্কমেনা নামে এক মানবীর প্রেমে পড়ে। জিউস ও আল্কমেনার একটি সন্তান হয়, যার নাম হারকিউলিস। হারকিউলিসের মা যেহেতু দেবতা নন, তাই হারকিউলিস জন্মসূত্রে অমরত্ব পাননি। জিউস জানেন হারকিউলিসকে যদি কোন দেবীর বুকের দুধ খাওয়ানো যায়, তাহলে হারকিউলিস অমরত্ব লাভ করবে। দেবী হেরা ছিলেন জিউসের স্ত্রী। হারকিউলিস যেহেতু হেরার সন্তান নয়, হেরা স্বাভাবিকভাবে হারকিউলিসকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াবেন না। তাই জিউস একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। একদিন হেরা যখন ঘুমাচ্ছিলেন, জিউস ছোট্ট হারকিউলিসকে হেরার বুকে দিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙার পর হেরা যখন দেখলেন শিশু হারকিউলিস তার বুকের দুধ পান করছে – দ্রুত হারকিউলিসকে বুক থেকে সরিয়ে দিলেন। এই সময় হেরার বুক থেকে দুধ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে তৈরি হয়েছে “গ্যালাক্সিয়াস কাইক্লস” যার ইংরেজি অনুবাদ মিল্কি ওয়ে। রোমানদের গল্পও প্রায় একই রকম। এসব গল্প খ্রিস্টজন্মের অনেক বছর আগের। এরপর বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়ে গেলেও আমাদের গ্যালাক্সির নাম সেই প্রাচীন মিল্কিওয়েই রয়ে গেছে।

 

যতদিন পর্যন্ত খালিচোখে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে, গ্যালাক্সি সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জানার পরিধি বিস্তার লাভ করেছে খুবই ধীর প্রক্রিয়ায়। পৌরাণিক কাহিনি বিশ্বাস করে কেউ কেউ এই ছায়াপথকে দুধের নদী বললেও – মানুষ ক্রমেই বুঝতে পেরেছে এর সাথে প্রাকৃতিক কোন ঘটনার যোগাযোগ আছে। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল মত দিয়েছিলেন এই ছায়াপথ হলো নক্ষত্র থেকে জ্বলন্ত বাষ্পের নিঃসরণ। এরপর প্রায় দেড় হাজার বছর পর্যন্ত এরকম গ্রিক ধারণাই প্রচলিত ছিল।

কিন্তু নবম শতাব্দী থেকে এই ধারণার বদলে বাস্তবধর্মী বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রাধান্য পেতে শুরু করে। নবম শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-আব্বাস আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে খাতির আল-ফারগানি তাঁর “কিতাব ফি আল-হারাকাত আল-সামাইয়া ওয়া জাওয়ামি ইল্‌ম আল-নুজুম” [ইলিমেন্টস অব অ্যাস্ট্রোনমি] বইতে পৃথিবীর ব্যাস, পৃথিবী থেকে সূর্য ও চাঁদের দূরত্ব পরিমাপের পাশাপাশি ছায়াপথ সম্পর্কেও কিছু নতুন ধারণা দেন। তিনি মিল্কিওয়েকে আকাশের একটি বিশেষ অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেন যা ছিল গ্রিকদের কাল্পনিক ধারণা থেকে অনেকটাই বাস্তবের কাছাকাছি [১]।

দশম শতাব্দীতে গ্যালাক্সি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণার আরো উন্নতি হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামি জ্যোতির্বিদদের হাত ধরে। ইরানের জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু আল-হুসাইন আবদুর রহমান ইবনে উমর আল-সুফি ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা তাঁর “কিতাব আল-কাওয়াকিব আল-তাবিদ আল-মুসাওয়ার” [দ্য বুক অব ফিক্সড স্টারস] বইতে ৪৮টি তারামন্ডলের বর্ণনা দেন। মিল্কিওয়ে ছাড়াও আমাদের আকাশ থেকে আরো উজ্জ্বল যে অন্য ছায়াপথ “অ্যান্ড্রোমিডা” দেখা যায় – তার প্রথম বৈজ্ঞানিক বর্ণনা দিয়েছেন তিনি এই বইতে। অ্যান্ড্রোমিডা নামটি দেয়া হয়েছে গ্রিক পুরানের রাজকন্যা অ্যান্ড্রোমিডার নাম অনুসারে। সেই সময় অবশ্য মনে করা হতো অ্যান্ড্রোমিডা মিল্কিওয়েরই অংশ। বিজ্ঞানী আল-সুফিই সর্বপ্রথম অ্যান্ড্রোমিডার প্রথম বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ বর্ণনা করেন।

সেই সময়কার আরেক বিজ্ঞানী আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাসান ইবনে আল-হাইথাম, যিনি আলজাহিন নামে পরিচিত ছিলেন এবং যাঁকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক মনে করা হতো, টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১০১১-১২ সালে রচিত তাঁর বিখ্যাত “কিতাব আল-মানাজির” [দ্য বুক অব অপটিকস]-এ তিনিই সর্বপ্রথম সম্ভাবনা প্রকাশ করেন যে মিল্কিওয়ে ছায়াপথ হতে পারে অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি – যা দূরত্বের কারণে একটি আলোক রেখার মতো দেখায়। টেলিস্কোপ আবিষ্কৃত হবার পাঁচ শ বছরেরও আগে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলি বলেছিলেন – পরবর্তীতে আমরা তা সত্য বলে প্রমাণিত হতে দেখেছি। দ্বাদশ শতকে স্পেনের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ আবু আল-ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদও মিল্কিওয়েকে অনেকগুলি নক্ষত্রের সমষ্টি বলে অনুমান করেছেন যা পরবর্তীতে আশ্চর্যজনকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর আকাশ পর্যবেক্ষণ নতুন মাত্রায় উন্নীত হলো। আমরা সবাই জানি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম আকাশের দিকে টেলিস্কোপ তাক করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে গ্যালিলিওরও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহার করেছিলেন বৃটিশ বিজ্ঞানী লিওনার্ড ডিগেস ১৫৫১ সালে [২]। তাঁর পুত্র থমাস ডিগেসও ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৫৫৯ সালে লিওনার্ড ডিগেসের মৃত্যু হলে থমাস ডিগেস তাঁর বাবার অসমাপ্ত গবেষণা চালিয়ে নেন। ১৫৭১ সালে তিনি তাঁর বাবার লেখা একটি বই প্রকাশ করেন যাতে টেলিস্কোপ তৈরি এবং ব্যবহারের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই বইতে মহাবিশ্বের অসীমতা এবং অসংখ্য নক্ষত্রমন্ডলী গুচ্ছাকারে ছায়াপথ তৈরি করার সম্ভাবনার কথা বর্ণিত হয়েছে। সে হিসেবে বলা চলে মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য নক্ষত্রের সম্মিলন তা টেলিস্কোপের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করে প্রকাশ করেছিলেন থমাস ডিগেস - গ্যালিলিওরও অনেক বছর আগে।  

১৬১০ সালে ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী গ্যালিলিও তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ তাক করলেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়া মিল্কিওয়ের দিকে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন খালি চোখে আবছা মেঘের মতো যা দেখা যায় – তাতে রয়েছে অসংখ্য নক্ষত্র। এত বেশি নক্ষত্র সেখানে যে তার সীমিত শক্তির টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের সংখ্যা গণনা করা ছিল অসম্ভব [৩]। তবে গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণ থেকে মিল্কিওয়ে সম্পর্কে প্রচলিত যে ধারণা ছিল তা ভেঙে যায়। মিল্কিওয়ে যে অসংখ্য তারার সমষ্টি সেই ধারণা বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করতে শুরু করেন।

কিন্তু মিল্কিওয়ের আকার, আয়তন, গতি ইত্যাদি নিরুপনের কাজ শুরু হয় আরো প্রায় দেড়শো বছর পর। ইংরেজ দার্শনিক থমাস রাইট ১৭৫০ সালে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তত্ত্বীয় ধারণা দেন তাঁর ‘এন অরিজিনাল থিওরি অর নিউ হাইপোথিসিস অব দ্য ইউনিভার্স’ বইতে। তিনি মনে করেন মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলি চাকতির মতো দুটো স্তরে সজ্জিত। সেখানে আমাদের সূর্যের অবস্থানও তিনি প্রায়-সঠিকভাবে অনুমান করেন – যা চাকতির কেন্দ্র থেকে দূরে কিনারার একটি প্রান্তে অবস্থিত। গ্যালিলিওর পরে আরো অনেকে মিল্কিওয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন টেলিস্কোপের সাহায্যে। মিল্কিওয়ের কিনারায় ছোপ ছোপ মেঘের মতো উজ্জ্বল যে বস্তু দেখা যায় তাকে গ্যালিলিও নেবুলা বা নক্ষত্র তৈরির কারখানা হিসেবে ধারণা দিয়েছিলেন। থমাস রাইট ধারণা দিলেন যে ওগুলি মিল্কিওয়ে থেকে বিচ্ছিন্ন, হতে পারে অন্য কোন নক্ষত্রমন্ডলির অংশ। সমসাময়িক সুইডিশ দার্শনিক ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ, জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট, সুইস-জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী জোহান হেনরিক ল্যামবার্ট প্রমুখ মিল্কিওয়ের নক্ষত্র সম্পর্কে থমাস রাইটের ধারণাকে সমর্থন দেন [৪]। কিন্তু এর সবগুলি ছিল পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক দার্শনিক অনুমান।

মিল্কিওয়ের নক্ষত্রগুলির অবস্থান এবং উজ্জ্বলতার বৈজ্ঞানিক পরিমাপ শুরু করেন স্যার উইলিয়াম হারশেল ১৭৮০ সালে। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী অনেকগুলি উন্নতমানের টেলিস্কোপ তৈরি করেন এবং সেগুলি দিয়ে নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ করে ১৭৮১ সালে সৌরজগতের দূরবর্তী গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। মিল্কিওয়ের বিভিন্ন দিক থেকে নক্ষত্রগুলির অবস্থান নির্ণয় করে তিনি মিল্কিওয়ের একটি ম্যাপ তৈরি করেন। ১৭৮৫ সালে ফিলোসফিক্যাল ট্রানজেকশানে প্রকাশিত [সংখ্যা ৭৫, পৃ ২১৩-২৬৬] মিল্কিওয়ের ম্যাপ থেকে দেখা যায়, হারশেল আমাদের সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করেছেন মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে। মিল্কিওয়ের দৈর্ঘ্য তিনি নির্ণয় করেছেন সেখানে অবস্থিত নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ৮০০ গুণ, আর প্রস্থ হিসেব করেছেন নক্ষত্রগুলির গড় দূরত্বের ১৫০ গুণ। হারশেল ধরে নিয়েছিলেন মিল্কিওয়ের প্রতি একক আয়তনে সমান সংখ্যক নক্ষত্র আছে।  তাঁর হিসেব থেকে মিল্কিওয়ের সত্যিকারের আয়তন নির্ণয় করার কোন উপায় ছিল না, কারণ পৃথিবী থেকে কোন নক্ষত্রেরই সঠিক দূরত্ব তখনো নির্ণয় করা যায়নি। মিল্কিওয়ের আকার আকৃতির সঠিক পরিমাপের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

 



উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপ (১৭৮৫)


১৮৪৭ সালে রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী অটো স্ট্রুভ প্রমাণ দিলেন যে মিল্কি ওয়ের সব জায়গায় সমান সংখ্যক নক্ষত্র নেই। অর্থাৎ উইলিয়াম হারশেল যে মিল্কিওয়ের নক্ষত্রের ঘনত্ব সমান বলে ধারণা করেছিলেন তা সঠিক ছিল না। তাহলে উইলিয়াম হারশেলের মিল্কি ওয়ের ম্যাপের আকৃতি ঠিক থাকলেও তার ভেতর আমাদের সূর্যের অবস্থান সঠিক নয়। ততদিনে পৃথিবী থেকে সূর্য এবং সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহের দূরত্ব নির্ণয় করা হয়ে গেছে। তার ভিত্তিতে অটো স্ট্রুভ মিল্কিওয়ের আকার নির্ণয় করলেন। তিনি দেখালেন চ্যাপ্টা চাকতির মতো মিল্কিওয়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দূরত্ব কমপক্ষে তেরো হাজার আলোকবর্ষ। অর্থাৎ মিল্কিওয়ের এক প্রান্তের একটি নক্ষত্রের আলো অন্য প্রান্তের নক্ষত্রে পৌঁছাতে তেরো হাজার বছর সময় লাগবে। বর্তমানে আমরা জানি মিল্কিওয়ের আকার এর চেয়ে আরো অনেক অনেক বড়। সে কথায় আমরা আসবো একটু পর।

 

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই টেলিস্কোপের শক্তি এবং ব্যাপ্তি দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি অবজারভেটরি বা মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির সঠিক আকার ও আয়তন সম্পর্কে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে যাঁর হাত দিয়ে – তাঁর নাম হারলো শাপলি, মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির উদীয়মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী।

জ্যোতির্বিজ্ঞানী হবার কোন লক্ষ্যই ছিল না হারলো শাপলির। আমেরিকার মিসৌরি রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রামে তাঁর জন্ম ১৮৮৫ সালে। ছোট্ট এক রুমের একটি স্কুলে তাঁর প্রাইমারি স্কুলের পড়াশোনা। ষোল বছর বয়সে ক্যানসাসের ডেইলি সান পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য কিছু টাকাপয়সা জমানোর পর তিনি সাংবাদিকতা পড়ার জন্য গেলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু গিয়ে দেখেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ তখনো খোলা হয়নি। অন্য রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করার সঙ্গতি তার ছিল না। তাই ঠিক করলেন মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ের  ভর্তি্র ক্যাটালগে প্রথম যে বিভাগের নাম পাবেন সেই বিভাগেই ভর্তি হয়ে যাবেন। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো বিষয়ে ভর্তি হওয়া যেতো। ক্যাটালগের প্রথম নামটি ছিল আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের। হারলো শাপলি ‘আর্কিওলজি’ শব্দটি উচ্চারণ করতে না পেরে পরের নামে গেলেন। পরের নামটি ছিল অ্যাস্ট্রোনমি। শাপলি অ্যাস্ট্রোনমি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে গেলেন  [৫]। এরপর দ্রুত ইতিহাস তৈরি করলেন তিনি। ১৯১০ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি গেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেলের তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করলেন শাপলি। ১৯১৪ সালে পিএইচডি শেষ করার পর পোস্টডক্টরেট ফেলো হিসেবে কাজ পেলেন ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরিতে। সেখানকার ১.৫২ মিটার ব্যাসের শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি দিনরাত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে মিল্কি ওয়ের সঠিক আকার নির্ণয় করেন। যদিও পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে শাপলির পরিমাপে কিছুটা ভুল ছিল, তবুও সেই ১৯১৮ সালে মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির এত বিস্তারিত পরিমাপ জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। হারলো শাপলি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। [পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের সূর্য মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে ছাব্বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।]

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির যে আকার শাপলি নির্ণয় করেছিলেন তার আয়তন এত বেশি ছিল যে তিনিসহ আরো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সেই সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে মিল্কিওয়েই একমাত্র গ্যালাক্সি যা পুরো মহাবিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে। কিন্তু অনেকের কাছেই এটা অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। ক্যালিফোর্নিয়ার লিক অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেবার কারটিস এবং তাঁর দল তাঁদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দাবি করলেন – মিল্কি ওয়ে মহাবিশ্বের একটি গ্যালাক্সি, একমাত্র গ্যালাক্সি নয়। মহাবিশ্ব আরো অনেক বড়, যেখানে মিল্কিওয়ের মতো আরো হাজার হাজার গ্যালাক্সি আছে।

এই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্কের আয়োজন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি ‘দ্য গ্রেট ডিবেট’ নামে খ্যাতিলাভ করেছে। ১৯২০ সালের ২৬ এপ্রিল এই বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয় আমেরিকার ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। প্রচলিত তর্ক-বিতর্ক এটি ছিল না। এটি ছিল মূলত বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন। হারলো শাপলি মিল্কিওয়েই পুরো মহাবিশ্ব – এই মতের পক্ষে তাঁর তথ্য-উপাত্ত এবং যুক্তি উপস্থাপন করেন চল্লিশ মিনিট। এরপর হেবার কারটিস উপস্থাপন করেন তাঁর তথ্য-উপাত্ত যেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝান যে মিল্কিওয়ে ছাড়াও আরো অনেক গ্যালাক্সি আছে মহাবিশ্বে। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। উপস্থিত বিজ্ঞানীদের ভোটে কারটিসের যুক্তি জয়লাভ করে।

অবশ্য পরবর্তী চার বছরের মধ্যে এডউইন হাবল প্রমাণ করে দেন যে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ের অংশ নয়, বরং মিল্কি ওয়ে থেকে পচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরের আলাদা আরেকটি গ্যালাক্সি।

 

পৃথিবীর মানমন্দির থেকে টেলিস্কোপের সাহায্যে নক্ষত্রের আলো পর্যবেক্ষণ করে আলোর তীব্রতার সাথে দূরত্বের বিপরীত বর্গের সূত্র প্রয়োগ করে নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় মহাজাগতিক ধুলিকণা যা নক্ষত্রের আলোর তীব্রতা কমিয়ে দেয়। ধুলিকণার কারণে প্রায়ই হিসেবে গন্ডগোল হয়ে যায়। সেই গন্ডগোল মিটে গেল রেডিও টেলিস্কোপ উদ্ভাবনের পর থেকে। ধুলিকণা বেতার তরঙ্গের ওপর খুব বেশি প্রভাব খাটাতে পারে না। ফলে জ্যোতির্বিদ্যার পরিমাপ অনেক সহজ এবং সঠিক হয়ে ওঠেছে। পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর পর থেকে মহাবিশ্বের অসংখ্য গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সি মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছু সঠিকভাবে জানি।

 

মিল্কিওয়ের আকার আকৃতি

আমরা যেহেতু মিল্কিওয়ের ভেতরে থাকি, সেহেতু দূর থেকে মিল্কিওয়েকে পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি সম্ভব হতো, যদি আমরা মিল্কিওয়ের উপর থেকে মিল্কিওয়েকে দেখতে পেতাম, তাহলে মিল্কিওয়েকে মনে হতো রাতের বেলা আলো ঝলমলে এক শহরের মতো যেখানে বিশ হাজার কোটি সূর্য আলো ছড়াচ্ছে। এই সূর্যগুলির ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে আন্তনাক্ষত্রিক ধুলো ও গ্যাসের মেঘ – যেগুলি থেকে ভবিষ্যতে আরো নক্ষত্র তৈরি হবে। এক পাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে একটি চ্যাপ্টা চাকতির মতো লাগবে যার মাঝখানে বেশ উঁচু। চাকতির চারপাশে ঘিরে রয়েছে বিশাল গ্যাসের গোলক – যার নাম গ্যালাক্টিক হ্যালো।

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চাকতির কেন্দ্রে ফুলে ওঠা জায়গার ব্যাস প্রায় তিন হাজার আলোকবর্ষ। এর ভেতর আছে প্রায় এক হাজারটি নক্ষত্র – যাদের আনুমানিক ভর এক হাজার সূর্যের ভরের সমান। চাকতির সমতল অংশ থেকে কেন্দ্রের এই ঢিবির উচ্চতা প্রায় ১৮০০ আলোকবর্ষ। সমতল অংশে চাকতির পুরুত্ব প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ। কেন্দ্র থেকে চাকতির ব্যাসার্ধ প্রায় পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ। পুরো চাকতিকে ঘিরে অদৃশ্য হাইড্রোজেন গ্যাসের স্তর, কেন্দ্র থেকে যার ব্যাসার্ধ আশি হাজার আলোকবর্ষ।

পুরো চাকতিটি রয়েছে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ ব্যাসার্ধের একটি গোলকের ভেতর। এই গোলকটির নাম স্টেলার হেলো। ধরে নেয়া হয় এই পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব পর্যন্ত মিল্কিওয়ের মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে। এর বাইরে যদি কোন নক্ষত্র পাওয়া যায় – তা অন্য কোন গ্যালাক্সির বলে ধরে নেয়া হয়।


মিল্কিওয়ের বিভিন্ন অংশ


হ্যালো

মিল্কিওয়ের হ্যালো অংশটি খুব রহস্যময়। এই গ্যাসীয় গোলকের ভেতর প্রায় দুই শ উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ আছে যারা খুবই কাছাকাছি থেকে গুচ্ছ তৈরি করেছে। এদের একেকটি গুচ্ছের ব্যাস মাত্র কয়েকশ আলোকবর্ষ। এই দুরত্বের ভেতরই লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র গাদাগাদি করে খুবই প্রতিসমভাবে একে অপরকে আকর্ষণ করে আছে। এই ‘গ্লোবিউলার ক্লাস্টার’ গুলি নিঁখুত গোলকাকার। গ্যালাক্সির সবচেয়ে বয়স্ক নক্ষত্রগুলিই থাকে এসব গুচ্ছে। চাকতির নক্ষত্রগুলির বয়স যদি এক হাজার কোটি বছর হয়, গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের নক্ষত্রগুলির বয়স তেরো শ কোটি বছর।

গ্যালাক্টিক হ্যালোর গ্লোবিউলার ক্লাস্টারগুলি উজ্জ্বল হলেও বাকি অংশ খুবই অন্ধকার। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন গ্লোবিউলার ক্লাস্টারের সূর্যগুলির ভর আর হ্যালোর মোট ভরের তুলনায় খুবই সামান্য। তাহলে বাকি অন্ধকার স্থানে কি লুকিয়ে আছে ডার্ক ম্যাটার? এই রহস্যের সমাধান এখনো পাওয়া যায়নি।

 

চাকতি

একপাশ থেকে দেখলে মিল্কিওয়েকে যেমন একটি সাদাসিধে চাকতির মতো লাগে, আসলে কিন্তু এটি সোজা একটি চাকতি নয়। এর চারটি প্যাঁচানো বাহু আছে। কেন্দ্রের উঁচু ঢিবির কাছাকাছি দুটো প্রধান বাহু পারসিয়াস আর্ম ও স্যাজিটারিয়াস আর্ম। তৃতীয় বাহুর নাম সেনটোরাস আর্ম এবং চতুর্থ বাহু – আউটার আর্ম।

পারসিয়াস বাহু মিল্কিওয়ের বেশ প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বাহু যেখানে রয়েছে অনেকগুলি নীহারিকা বা নেবুলা যেখানে নতুন নক্ষত্রের জন্ম হয়। এখানে নক্ষত্রের ঘনত্ব চাকতির নক্ষত্রের ঘনত্বের চেয়ে বেশি। এই বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ষাট হাজার আলোকবর্ষ, কিন্তু সে তুলনায় প্রস্থ খুবই কম, মাত্র তিন-চার হাজার আলোকবর্ষ। এখানেই আছে ব্রিলিয়েন্ট স্টার ফাই ক্যাসিওপিয়া – যা আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় দুই লক্ষ গুণ উজ্জ্বল। এই বাহুতেই আছে ক্র্যাব নেবুলা সুপারনোভা।

মিল্কিওয়ের প্রধান বাহু স্যাজিটারিয়াস আর্ম। এর দৈর্ঘ্য দশ থেকে পনের আলোকবর্ষ, প্রস্থ তিন থেকে চার আলোকবর্ষ। ঈগল, ওমেগা, ট্রিফিড, ল্যাগুন নেবুলা এই বাহুতে অবস্থিত। এই বাহুতে একাধিক ব্ল্যাকহোলের সন্ধান পাওয়া গেছে। ষোলটি সূর্যের ভরের সমান ব্ল্যাকহোল সিগনাস এক্স-১ মিল্কিওয়ের এই বাহুতে অবস্থিত।

পারসিয়াস ও স্যাজিটারিয়াস বাহুর মাঝখানে আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের বাহু আছে – যার নাম অরিয়ন বাহু বা অরিয়ন স্পার। এই অরিয়ন স্পারের আগার দিকে আমাদের সূর্যের বাড়ি। এই সৌরজগতের ছোট্ট গ্রহ পৃথিবীতে আমাদের বাস।  এই বাহুতে আছে রিং নেবুলা, অরিয়ন নেবুলা, বাটারফ্লাই ক্লাস্টার, টলেমি ক্লাস্টার ইত্যাদি।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রে যে উঁচু ঢিবি আছে সেটাই আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র বা গ্যালাকটিক সেন্টার। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটাই গ্যালাক্সি রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে কেন্দ্রের নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ভেরি লার্জ রেডিও-টেলিস্কোপের মাধ্যমে জানা গেছে এর কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান গ্যাস চক্রাকারে ঘুরছে। ১৯৯৭ সালে মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের কাছাকাছি নক্ষত্রগুলোর অস্বাভাবিক দ্রুত ঘূর্ণন বেগ পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন মিল্কিওয়ের এই কেন্দ্রে আছে ২৫ লক্ষ সূর্যের ভর সম্পন্ন বিশাল ব্ল্যাকহোল স্যাজিটারিয়াস এ স্টার। কেন্দ্র থেকে মাত্র দশ আলোকবর্ষ দূরে উত্তপ্ত গ্যাসের মেঘ – স্যাজিটারিয়াস এ কমপ্লেক্স।

মিল্কিওয়ের কেন্দ্রের এক শ আলোকবর্ষ ব্যাসের মধ্যে যে চৌম্বকক্ষেত্র পাওয়া গেছে তার তীব্রতা মিল্কিওয়ের অন্যান্য জায়গার চোউম্বকক্ষেত্রের তীব্রতার চেয়ে প্রায় হাজার গুণ বেশি। এই চৌম্বকক্ষেত্রের সঠিক উৎস এখনো অজানা।

 

ভর ও অন্যান্য বৈশিষ্ট

মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি একটি স্পাইরাল গ্যালাক্সি। এর উজ্জ্বলতা ১৪০০ কোটি সূর্যের উজ্জ্বলতার সমান। ডার্ক ম্যাটারসহ এর মোট ভর এক লক্ষ কোটি সূর্যের ভরের সমান, যার মধ্যে নক্ষত্রের ভর বিশ হাজার কোটি সূর্যের ভর, মোট গ্যাসের ভর – দুই হাজার কোটি সূর্যের ভর, ধূলিকণার ভর – বিশ কোটি সূর্যের ভরের সমান। গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে আমাদের সূর্যের একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে বাইশ কোটী বছর।

 

মিল্কিওয়ে সম্পর্কে আমাদের এখনো অনেক বিষয় জানার বাকি। অতি সম্প্রতি (১১ মার্চ ২০২৫) আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা ‘স্পেকট্রো-ফটোমিটার ফর দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ইউনিভার্স, ইপক অব রি-আয়নাইজেশান আন্ড আইসেস এক্সপ্লোরার (SPHEREx) মিশন চালু করেছে। এই স্যাটেলাইট ১১ মার্চ ২০২৫ মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। ১ মে থেকে এই স্যাটেলাইট কাজ শুরু করেছে। আগামী দুই বছর ধরে মহাকাশে মহাবিশ্বের পঁয়তাল্লিশ কোটিরও বেশি গ্যালাক্সির তথ্য সংগ্রহ করবে এই স্যাটেলাইট। পাশাপাশি আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিরও দশ কোটিরও বেশি নক্ষত্রের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে জানার চেষ্টা করবে মহাবিশ্বের উদ্ভব হবার আসল রহস্য কী। প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য যেসব উপাদানের দরকার, মিল্কিওয়ের অন্যান্য নক্ষত্রের জগতের অন্য কোন গ্রহে তা পাওয়া যায় কি না তাও অনুসন্ধান করে দেখবে এই মিশন [৬]। সেসব তথ্য থেকে মিল্কিওয়ের অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। 

 

তথ্যসূত্র

১। জিম আল-খলিলি, দ্য হাউজ অব উইজডম হাউ অ্যারাবিক সায়েন্স সেইভড অ্যানসিয়েন্ট নলেজ অ্যান্ড গেইভ আজ দ্য রেনেসান্স, দ্য পেঙ্গুইন প্রেস, নিউইয়র্ক, ২০১১।

২। জন গ্রিবিন, গ্যালাক্সি অ্যা ভেরি শর্ট ইনট্রোডাকশান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮।

৩। গাইলস স্পারো, ফিফটি আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড টু নো অ্যাস্ট্রোনমি,কুয়েরকাস, লন্ডন, ২০১৬।

৪।  ফ্রাঙ্কোইস কমবিস ও জেমস লেকিস, ‘দ্য মিল্কি ওয়ে স্ট্রাকচার, ডায়নামিক্স, ফরমেশান আন্ড ইভ্যুলিউশান’, কারেন্ট ন্যাচারাল সায়েন্সেস, প্যারিস, ২০১৬।

৫। জে পি ম্যাকইভয়, দ্য ইউনিভার্স ফ্রম এনসিয়েন্ট ব্যাবিলন টু দ্য বিগ ব্যাং, রবিনসন, লন্ডন, ২০১০।

৬। https://www.jpl.nasa.gov/missions/spherex/

_______________

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত











Thursday, 17 July 2025

যদি বিজ্ঞানী হতে চাও


[এই লেখায় আমি বাংলাদেশের কিশোর ও তরুণ বিজ্ঞানপ্রেমীদের সাথে বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। এই কথাগুলি হয়তো তাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞানচর্চায় কাজে লাগবে। যে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আমি এই কথাগুলি বলছি তারা বয়সে আমার কনিষ্ঠ, তাই তাদের তুমি করে সম্বোধন করছি।]

তুমি যখন এই লেখাটি পড়ছো, আমি ধরে নিচ্ছি তুমি বিজ্ঞান ভালোবাসো, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করো। ভবিষ্যতে তুমি কী হবে, তোমার পেশা কী হবে, কীভাবে কাটবে তোমার দিনরাত সে সম্পর্কে এখনই তুমি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছো না। কেউই পারে না। কিন্তু তুমি নিশ্চয় স্বপ্ন দেখছো কিছু একটা হবার। এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তুমি এমনভাবে লেখাপড়া করছো – যেন এই লেখাপড়াটা তোমার স্বপ্ন সফল করে তোলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, লেখক, বিসিএস ক্যাডার, পুলিশ, রাজনীতিবিদ – যা-ই তুমি হও না কেন, তুমি যেহেতু বিজ্ঞান ভালোবাসো, বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে ভালোবাসো – বিজ্ঞানী হবার প্রাথমিক দুটো শর্ত তুমি ইতোমধ্যেই পূরণ করে ফেলেছো।

তবে বিজ্ঞানকে শুধুমাত্র ভালোবাসলেই বিজ্ঞানী হওয়া যায় না। তার জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে হয়। বিজ্ঞান অত্যন্ত জটিল বিষয়, বিজ্ঞানের পথ বড় কঠিন পথ। তুমি হয়তো খেয়াল করেছো বিজ্ঞানচিন্তার পাতায় বিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয় আমরা সহজভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। সেগুলি পড়ার সময় তোমার মনে হতে পারে এ-তো সহজ জিনিস। হ্যাঁ, ঠিকমতো বুঝতে পারলে বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি খুবই সহজ। কিন্তু সেই তত্ত্বগুলি আবিষ্কার করেছেন যেসব বিজ্ঞানী – তাঁদের আবিষ্কারের পথ অত সহজ নয়। তুমি যখন বিজ্ঞানের কোন একটা বিষয় – যা সহজভাবে তোমার বোধগম্য আকারে লেখা হয়েছে – পড়ার পর বেশ বুঝতে পারছো, তোমার ভালো লাগছে, বিজ্ঞানের প্রতি তোমার ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে – সেটা হলো ব্যবহারকারির দৃষ্টিতে বিজ্ঞান, ইংরেজিতে যাকে বলে ইউজার লেভেল সায়েন্স। এই পর্যায়ে বিজ্ঞানের প্রতি তোমার যে ভালো লাগা তৈরি হয়েছে, বিজ্ঞানী হতে গেলে তাকে আরো অনেক বছর ধরে অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে।  তুমি যদি স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হও, ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের গবেষক হতে চাও, বিজ্ঞানী হতে চাও – তোমাকে শুধুমাত্র ভালোবাসলেই হবে না – বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার কঠিন পথটিকেও আপন করে নিতে হবে।

ধরা যাক, তুমি বিজ্ঞানের কঠিন পথ পেরিয়ে বিজ্ঞানের গবেষণা করতে করতে বিজ্ঞানী হতে চাও। কিন্তু কীভাবে বুঝবে কোন্‌ পথটি তোমার জন্য সঠিক পথ? কোন্‌ পথে গেলে তুমি তোমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন সহজ সঠিক উপায় নেই। কিন্তু তোমার যদি বিজ্ঞানের জগৎ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ধারণা থাকে এবং এই জগতে প্রবেশ করার পূর্বপ্রস্তুতি থাকে – তাহলে তুমি নিজেই বুঝতে পারবে কোন্‌ পথে হাঁটতে তোমার ভালোও লাগছে, আবার লক্ষ্যেও পৌঁছাতে পারছো।

ইউনেসকোর ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিসটিক্‌স এ প্রকাশিত পরিসংখ্যান [১] থেকে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর মোট বিজ্ঞানীর সংখ্যা আনুমানিক প্রায় ৮৮ লক্ষ। এখানে আমাদের জেনে রাখতে হবে বিজ্ঞানী আমরা কাদেরকে বলছি। বিজ্ঞান বিষয়ে যারা পড়াশোনা শেষ করেছেন তাদের সবাই কিন্তু বিজ্ঞানী নন। পৃথিবীর মোট এক কোটি সাতাশ লক্ষ এমবিবিএস ডাক্তার এবং দুই কোটি সত্তর লক্ষ বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার – যারা তাঁদের রুটিনমাফিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন তাঁদেরও সবাই কিন্তু বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞান শিক্ষকদের মধ্যেও যাঁরা শুধুমাত্র ক্লাসরুমে পড়াচ্ছেন বা প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করছেন – তাঁরাও বিজ্ঞানী নন। বিজ্ঞানী তাঁরাই – যারা বিজ্ঞান বিষয়ে নিয়মিত গবেষণা করছেন, বিজ্ঞানের নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করছেন, বিজ্ঞান গবেষণা যাঁদের নিয়মিত কর্মজীবনের অংশ। বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় কর্মরত যে কেউই বিজ্ঞানী হতে পারেন যদি তিনি নিয়মিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন।

জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানী আছেন ইসরায়েলে। সেখানে প্রতি দশ লক্ষ জনসাধারণের মধ্যে প্রায় সাড়ে নয় হাজার বিজ্ঞানী। তার ঠিক পরেই আছে দক্ষিণ কোরিয়া (প্রতি মিলিয়নে সাড়ে আট হাজার বিজ্ঞানী।) জাপানে বিজ্ঞানীর সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে সাত হাজার। আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ায় বিজ্ঞানীর সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে প্রায় সাড়ে চার হাজার। চীনে প্রতি মিলিয়নে আনুমানিক দুই হাজার। ভারতে প্রতি মিলিয়নে মাত্র তিন শ জন। আমাদের বাংলাদেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা আরো অনেক কম, প্রতি মিলিয়নে মাত্র একশ জন। সতের কোটি জনসাধারণের এই দেশে বিজ্ঞানীর সংখ্যা মাত্র সতের হাজার। দশ হাজার মানুষের বিপরীতে আমাদের দেশে আছেন মাত্র একজন বিজ্ঞানী।

এই সীমাহীন বৈষম্যের কারণ কী? বৈজ্ঞানিক উন্নয়নে বাৎসরিক বাজেটের কী পরিমাণ বরাদ্দ করা হয় সেটা অবশ্যই একটি বড় ফ্যাক্টর। বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য ইসরায়েলে বাৎসরিক বাজেটের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ বরাদ্দ করা হয়। সেটা আমেরিকায় ২.৮৪ শতাংশ, জার্মানিতে ৩.১ শতাংশ, জাপানে ৩.২৬ শতাংশ, চীনে ২.১৯ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪.৫৩ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ১.৮৭ শতাংশ, ভারতে ০.৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশে বার্ষিক বাজেটে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট থাকে না বললেই চলে। যা থাকে তাও চলে যায় বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের পেছনে।

শুধুমাত্র বাজেট বরাদ্দ কম থাকার কারণেই যে আমাদের বিজ্ঞান গবেষণা পিছিয়ে আছে তা নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই রয়ে গেছে বিজ্ঞানী তৈরি হবার সবচেয়ে বড় বাধা। মনে করো তুমি এখন ক্লাস নাইনে পড়ছো, পদার্থবিজ্ঞান তোমার ভালো লাগে, ভবিষ্যতে তুমি পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাও। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানী কীভাবে হতে হয় সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই। তোমার স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা তোমাকে হয়তো কখনোই বলেননি যে পদার্থবিজ্ঞানী হতে গেলে তোমাকে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।

আমাদের বাংলাদেশে সত্যিকারের বিজ্ঞানজগত সম্পর্কে জানা কিংবা ধারণা লাভ করার তেমন কোনো সহজ উপায় নেই যেখান থেকে তুমি পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারবে। তোমাদের স্কুলের বিজ্ঞান বইতে যেসব বিষয় লেখা আছে, তোমাদের শিক্ষকরা তোমাদের বাধ্য করে সেসব যেভাবে লেখা আছে সেভাবে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য। তোমরাও বাধ্য হয়ে তাই করো – নইলে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার লক্ষ্যে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি তোমরা কোচিংও করো যেখানে শেখানো হয় পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর কীভাবে লিখলে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়া যাবে। বিজ্ঞান শাখায় এসএসসি ও  এইচএসসিতে তোমরা বাধ্যতামূলকভাবে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, তথ্যপ্রযুক্তি, গণিত, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় পড়ে থাকো। পড়ার চাপ এত বেশি থাকে যে এই বিষয়গুলির প্রতি তোমাদের ভালোবাসা জন্মানোর কোন সুযোগই তৈরি হয় না। বরং একটু এদিক-ওদিক হলেই নম্বর কম পাওয়ার ভয় থেকে তৈরি হয় প্রচন্ড স্নায়ুচাপ। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় তোমাদের ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি।

যারা ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়, তারা ডাক্তার হয়ে হাসপাতাল-চেম্বার করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দেয়। অনেকেই এফসিপিএস, এমডি, এমআরসিপি ইত্যাদি আরো উচ্চতর ডাক্তারি ডিগ্রি পাস করে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের সত্যিকারের গবেষণা করার সুযোগ, সময় এবং ইচ্ছে খুব কম ডাক্তারেরই থাকে।

যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ পায়, তাদের হাতেকলমে প্রকৌশল বিদ্যা শেখার সুযোগ হয়। কিন্তু সিলেবাসের বাইরে তাদের গবেষণা এবং উদ্ভাবনেরও কিছু সুযোগ থাকে। কিন্তু পাস করে বের হবার পর কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক ইঞ্জিনিয়ারই ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরিবর্তে বিসিএস পাস করে প্রশাসক হবার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়। আমাদের দেশে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর কলকারখানা খুব একটা নেই। ফলে আমাদের দেশের সব ইঞ্জিনিয়ারের উপযুক্ত কাজ করার সুযোগ থাকে না। তাই অনেকেই বিদেশে চলে যায়। বিদেশী কোন ডিগ্রি নিয়ে বিদেশেই থেকে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিজ্ঞানী হবার সুযোগ পায়।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের পর যারা বাকি থাকে – তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের যেকোনো শাখায় অনার্স ক্লাসে ভর্তি হয়। কোন্‌ বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হবে সেটা ঠিক করতে গিয়েও অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার আগে তো তোমরা জানতেই পারো না কোন্‌ বিভাগে কী পড়ানো হয়, কোন্‌ বিষয়ে পাস করলে ভবিষ্যতে কী কী করা যাবে। কিংবা তুমি যদি ভবিষ্যতে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাও – স্কুল থেকেই তোমার কী কী বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আমাদের দেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কম। তাই তোমাদের তেমন কোন সুযোগই থাকে না সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের সাথে কথা বলার বা তাদের কাজকর্ম কাছ থেকে দেখার। আমাদের দেশে কোনো বৈজ্ঞানিক জাদুঘরও নেই – যেখানে গিয়ে তোমরা বিজ্ঞান শিখতে পারবে।

কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশে, যেখানে বিজ্ঞানীর সংখ্যা অনেক বেশি – সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মতো নয়। পৃথিবীর সব উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপদ্ধতি এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে বিজ্ঞান শিক্ষার্থী থেকে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার সবগুলি ধাপে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকে। আমেরিকার কথা ধরা যাক। সেখানে স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য একেবারে নিচের ক্লাস থেকেই বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞান প্রকল্প প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। সারা দেশ থেকে বাছাই করা সেরা প্রকল্পগুলির মাধ্যমে বিজ্ঞানের প্রতি যাদের আগ্রহ আছে তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। একেবারে প্রাইমারি স্কুলে থাকতেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় যেসব বিজ্ঞানী কাজ করছেন – তাদেরকে মাঝে মাঝে স্কুলে নিয়ে এস পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে নিয়ে যাওয়া হয় গবেষণাগারে – সেখানে তারা নিজের চোখে দেখতে পারে কীভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়, কীভাবে বিজ্ঞানীরা কাজ করেন। হাইস্কুলের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সত্যিকারের বিজ্ঞান-প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ দেয়া হয়। নাসার মতো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ থাকে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা করার সময় থেকেই শুরু হয় সত্যিকারের বিজ্ঞান গবেষণা। শুধুমাত্র বই পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার উপরই সব গুরুত্ব সেখানে দেয়া হয় না। যারা শুধুমাত্র চাকরি করে টাকা উপার্জন করার জন্য উদ্দেশ্যে ভর্তি হয়, তাদের কোর্স আর গবেষণা করতে যারা আগ্রহী তাদের কোর্স আলাদা। উন্নত দেশে বিজ্ঞানী তৈরি করার সুব্যবস্থা আছে।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাজগৎ এবং কর্মজগৎ যে অবস্থায় আছে, সেখান থেকে বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা দুঃসাধ্য বটে, তবে অসাধ্য নয়। তুমি যদি সত্যিকারের বিজ্ঞানী হতে চাও, তাহলে আমাদের দেশ থেকেও বিজ্ঞানী হওয়া সম্ভব। তারজন্য তোমাকে সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে স্কুল-কলেজ থেকেই। তুমি যদি ডাক্তার হও- চিকিৎসাবিজ্ঞানী হতে তোমার কোনো বাধা নেই। বরং আমাদের দেশে রোগ এবং রোগীর সংখ্যা এত বেশি যে তোমার যদি গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকে – তুমি অনেক বেশি সুযোগ পাবে এখানে চিকিৎসাবিজ্ঞানী হবার। তুমি যদি ইঞ্জিনিয়ার হও এবং নতুন উদ্ভাবনের প্রতি আগ্রহ থাকে – তাহলে তুমি আমাদের দেশের অনেক কারিগরী সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারবে। আর যদি তুমি মৌলিক বিজ্ঞান – পদার্থবিজ্ঞন, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের যে কোনো শাখায় গবেষণা করতে চাও – তাহলেও অনেক অনেক কিছু করা সম্ভব।

বিজ্ঞানের যেকোনো শাখাতেই যদি তোমার গবেষণা করার ইচ্ছে থাকে – তাহলে একটা বিষয় তোমাকে সবসময় মনে রাখতে হবে। সেটা হলো – বিজ্ঞান গবেষণায় কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। সেখানে কোনো ধরনের জোড়াতালি চলে না, কোনো ধরনের প্রতারণা বা মিথ্যার স্থান নেই। বিজ্ঞান গবেষণার ফলাফল একটুও এদিক-ওদিক করার সুযোগ নেই। যদি কেউ করে – সেটা কারো না কারো কাছে ধরা পড়বেই। বিজ্ঞান গবেষণা সর্বজনীন। অর্থাৎ বাংলাদেশে বসে কোনো গবেষণার যে ফল তুমি পাবে, পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় একই বৈজ্ঞানিক পরিবেশে একই ফলাফল পাবে। বিজ্ঞানের গবেষণায় ভুল করলে ভুল স্বীকার করার মধ্যে কোনো ভয় বা লজ্জা নেই। ভুল করতে করতেই বিজ্ঞানীরা শিখতে থাকে।

বিজ্ঞানী হবার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো প্রশ্ন করতে শেখা। বিজ্ঞানে বিনাপ্রশ্নে কোনো কিছুই মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানীর কাজ হলো অজানাকে জানা। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, তার ফলাফল কী হবে তা আগে থেকে জানেন না। এই অজানাকে জানার আগ্রহই তাঁদের বিজ্ঞানী করে তোলে।

তাহলে তুমি কীভাবে এগোবে? বিজ্ঞানের যা-কিছু পড়বে – অবশ্যই ভালোভাবে বুঝতে হবে। শুধু নিজে বুঝলে হবে না, অন্যকেও বোঝানোর দক্ষতা অর্জন করতে হবে। তুমি যদি নিজে কোনো কিছু বোঝো, তুমি দেখবে অন্য কাউকে যদি সেটা নিজের মতো করে বোঝাতে পারো – তাহলে তোমার নিজের কাছেও ব্যাপারটি আরো অনেক পরিষ্কার হয়ে যাবে। তুমি যে বিষয়ে বিজ্ঞানী হতে চাও- সেই বিষয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তোমার আগ্রহের কথা জানাও। শিক্ষকরা আগ্রহী শিক্ষার্থী পেলে ভীষণ আনন্দিত হবেন। দরকার হলে নিজের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলো। কোনো বিষয়ে ভর্তি হবার আগে সেই বিভাগের শিক্ষকদের সাথে কথা বলা সম্ভব না হলে, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলো। তোমার যদি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকে – ইন্টারনেট থেকে এখন সব ধরনের গবেষণা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া যায়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অলিম্পিয়াডসহ আরো অনেক প্রতিযোগিতা হয়। সেগুলিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করো। বিজ্ঞান বোঝার ক্ষেত্রে নিজের দুর্বলতা কোথায় সেটা খুঁজে বের করো। কোনো কিছু না বুঝলে তাতে লজ্জার কিছু নেই। বরং না বুঝে মুখস্থ করার চেয়ে কী বুঝতে পারছো না সেটা বের করতে পারাটা অনেক বেশি দরকারি। বিশ্বমানের বিজ্ঞানীদের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ হয়তো আমাদের নেই, কিন্তু তাঁদের বৈজ্ঞানিক জীবন নিয়ে লেখা বইগুলি যদি পড়ো – তাহলেও জানতে পারবে তাঁরা কীভাবে গবেষণা করতেন।


আইরিন কুরি - কিশোর বয়সেই বিজ্ঞানগবেষণা শুরু করেছিলেন তাঁর মা মেরি কুরির সাহচর্যে

আগামী এক দশকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক গবেষণার সুযোগ তৈরি হবে। পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সমস্যার সমাধানে অনেক নতুন গবেষণা উন্মুক্ত হবে। মহাকাশ গবেষণায় ব্যাপক পরিবর্তন হবে। বায়োটেকনোলজি আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করার বিশাল সুযোগ তৈরি হবে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার সাথে খাপ-খাইয়ে চলার প্রযুক্তির গবেষণার অসীম সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। ন্যানোমেডিসিন আর ন্যানোটেকনোলজি, প্রাণ রসায়ন এবং নতুন ওষুধ উদ্ভাবন – এরকম হাজার হাজার প্রকল্পে লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞানীর দরকার আমাদের দেশে। যদি বিজ্ঞানী হতে চাও – নিজেকে তৈরি করতে থাকো, তুমি সফল হবেই।


তথ্যসূত্র

১। ইউনেস্কো সায়েন্স রিপোর্ট, প্যারিস, ২০২১।

-----------------------

মাসিক বিজ্ঞানচিন্তার শততম সংখ্যায় প্রকাশিত







Latest Post

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

  যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগত থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভ...

Popular Posts