শত শত আবিষ্কার
উদ্ভাবন কৃতিত্বের সাক্ষী হতে হতে ক্যাম্পাসের “ঈগল” পাবটিও কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির
মতোই বিখ্যাত হয়ে গেছে। পাবের দেয়ালে লাগানো ফলকটি এমনই একটি ঘটনার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
৭২ বছর আগে ১৯৫৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লাঞ্চটাইমে ভরাপাবে ঢুকে ফ্রানসিস ক্রিক ও জেমস
ওয়াটসন ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা জীবনের রহস্য “ডি এন এ”-র গঠন আবিষ্কার করেছেন। ঈগল
পাবের দেয়ালে লাগানো এই ফলকটির ছবি তুলতে গিয়ে আমার বেশ ভালো লেগেছে এটুকু দেখে যে
রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনসহ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের অবদানকেও স্বীকার করা হয়েছে – যা জেমস
ওয়াটসন নিজে কখনও করেননি।
ডিএনএ’র গঠন
আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ফ্রানসিস ক্রিক, মরিস উইলকিন্স এবং
জেমস ওয়াটসন। ফ্রানসিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিন্স মারা গেছেন ২০০৪ সালে। এই ত্রয়ীর তৃতীয়
জন জেমস ওয়াটসন মারা গেছেন ৬ নভেম্বর।
৯৭ বছরের দীর্ঘ
জীবন পেয়েছেন জেমস ওয়াটসন।
১৯২৮ সালের
৬ ইপ্রিল আমেরিকার শিকাগো শহরে তাঁর জন্ম। মাত্র ১৫ বছর বয়সে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হয়েছিলেন বিশেষ স্কলারশিপ নিয়ে। ১৯ বছর বয়সে প্রাণিবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৫০
সালে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রাণিবিজ্ঞানে পিএইচডি। ১৯৫১ সালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস
ল্যাবে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ শুরু করেন ফ্রান্সিস ক্রিকের সাথে। ১৯৫৩ সালে মাত্র পঁচিশ
বছর বয়সে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করেন।
ডিএনএ’র গঠন
সংক্রান্ত গবেষণা করছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনও। ১৯৫২ সালে রোজালিন্ড ডিএনএর এক্স-রে
করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএন-এর গঠন ‘ডাবল হিলিক্স’
আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। মরিস উইলকিন্স এক্স-রে ডাটা সংগ্রহ করেছিলেন। জেমস ওয়াটসন
মরিসের গবেষণার স্বীকৃতি দিলেও রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের গবেষণার স্বীকৃতি দেয়া তো দূরের
কথা, তাঁর অনুমতি ছাড়াই তাঁর করা এক্স-রে চিত্র ব্যবহার করে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করে
ফলাও করে তা প্রচার করেছেন। রোজালিন্ডের বৈজ্ঞানিক অবদানের স্বীকৃতি নোবেল পুরষ্কার
কমিটি দিতো কি না তা এখন বলা সম্ভব নয়। কারণ ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে
নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার চার বছর আগে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন মারা যান।
নোবেল পুরষ্কার
পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন জেমস ওয়াটসন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭৬
পর্যন্ত ওয়াটজন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞানের প্রফেসর ছিলেন। ১৯৬৮ সালে
নিউইয়র্কের কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরির পরিচালকের দায়িত্ব নেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে
মলিকিউলার জেনেটিক্স এবং ক্যান্সার গবেষণায় ব্যাপক ভূমিকা রাখে এই প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৪
থেকে ২০০৩ পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৩ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত তিনি
এই প্রতিষ্ঠানের চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত
তিনি এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী এবং সম্মানিত সদস্য ছিলেন। কিন্তু ২০১৯
সালে তাঁর বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব এবং মন্তব্যের কারণে তাঁকে এই প্রতিষ্ঠানের সব পদ থেকে
অপসারণ করা হয় এবং তাঁকে দেয়া সব সম্মান প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
নোবেল পুরষ্কার
পেলেই যে কেউ মহামানব হয়ে যান না – তার অন্যতম প্রমাণ জেমস ওয়াটসন। বিজ্ঞান ও গবেষণায়
তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। জিনোম প্রজেক্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। জিন সংক্রান্ত গবেষণার
কপিরাইটের বিরোধী ছিলেন তিনি – ফলে জিন-গবেষণা কোন বড় কোম্পানির সম্পত্তি হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু সব ভালো
কাজ কালিমালিপ্ত হয়ে গেছে তাঁর নারীবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর
বৈজ্ঞানিক স্মৃতিচারণ গ্রন্থ “ডাবল হিলিক্স”-এ তিনি রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের বিজ্ঞান
গবেষণাকে স্বীকৃতি দেননি তো বটেই, বরং অনেক অপমানজনক মন্তব্য করেছেন তাঁর সম্পর্কে।
রোজালিন্ড ফ্যাশনেবল জামাকাপড় পরতেন না, লিপস্টিক ব্যবহার করতেন না, মেয়েলি কমনীয়তা
ছিল না এসবই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর বইতে – কিন্তু একবারও উল্লেখ করেননি যে রোজালিন্ডের
এক্স-রে চিত্র ব্যবহার না করতে পারলে তাঁদের পক্ষে ডিএনএর গঠন আবিষ্কার করা এত সহজ
হতো না।
বিজ্ঞানের জগতে
মেয়েদের অংশগ্রহণ বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নিষিদ্ধ ছিল। পুরুষরা মেয়েদের কমনীয় সঙ্গ যতটা
পছন্দ করে, মেয়েদের বৈজ্ঞানিক সত্ত্বাকে ততটা নয়। কিন্তু শত বাধা সত্ত্বেও বিংশ শতাব্দীর
শেষের দিকে বিজ্ঞানে মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেকটা বেড়েছে। পুরুষদের মনোভাবও ক্রমশ বদলাচ্ছে।
প্রকাশ্য নারীবিদ্বেষী মনোভাব, বর্ণবিদ্বেষ চুপচাপ মেনে নেয়ার সংস্কৃতি বদলে গেছে।
কিন্তু জেমস ওয়াটসনের ভেতর তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি।
তিনি তাঁর নারীবিদ্বেষ
প্রকাশ করেই চলেছেন। ডিএনএ পরিবর্তন করে সব মেয়েদের “সুন্দরী” করে ফেলার পক্ষপাতী তিনি।
তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানে মেয়েরা যত বেশি আসবে ছেলেরা ততই উৎসাহ পাবে, তাতে ছেলেদের
কাজের উন্নতি হবে। কিন্তু মেয়েদের মানসিক উন্নতি সেভাবে হবে না।
মানুষের শারীরিক
গঠন নিয়েও তিনি আজেবাজে কথা বলতেন। তাঁর মতে পাতলা মানুষ স্বভাবগতভাবে অসুখী, তাই কর্মক্ষেত্রে
বেশি দক্ষতা দেখাতে পারে। আর মোটা মানুষ এমনিতেই সুখি, তাই কাজের ক্ষেত্রে তেমন দক্ষ
নয়। তাই মোটা লোকদের চাকরি দেয়া উচিত নয়।
জেমস ওয়াটসনের
সবচেয়ে জঘন্য মানসিকতার পরিচয় ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি তাঁর মনোভাব। তিনি সরাসরি বলেছেন
কৃষ্ণাঙ্গদের আই-কিউ কম – কারণ তাদের ডিএনএ। অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক
অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কোন উন্নয়নই তাদের সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটাতে পারবে না – কারণ তাদের
ডিএনএর গঠনই এরকম।
সভ্যতার প্রশংসাজনক
দিক হলো – সভ্য সমাজ এধরনের অসভ্য মনোভাব সহ্য করে না। নোবেলজয়ী মানুষও যদি অসভ্য মনোভাব
পোষণ করে – তাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস সভ্য সমাজে আছে। জেমস ওয়াটসনকেও তাঁর মনোভাবের
দায় নিতে হয়েছে। বিজ্ঞানীসমাজ তাঁর মনোভাবের নিন্দা জানিয়েছে। তিনি চাকরি হারিয়েছেন।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে ২০১৪ সালে তিনি তাঁর নোবেল পদক নিলামে তোলেন। আলিশের উসমানভ
নামে এক রাশিয়ান প্রায় ৪৮ লাখ ডলার দিয়ে তাঁর নোবেল পদক কিনে নেন।
জেমস ওয়াটসন
মারা গেছেন। ইতিহাস তাঁর উঁচু কাজের স্বীকৃতি যেমন দেবে, তাঁর নীচু কাজের নিন্দাও তেমন
করবে। ইতিহাস কাউকে ছাড় দেয় না, বিজ্ঞানের ইতিহাস তো আরো নির্মম।
কয়েক শব্দে
যদি জেমস ওয়াটসনকে বর্ণনা করতে হয়, আমি বলবো বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি অসাধারণ, কিন্তু
মানুষ হিসেবে একজন অসহ্য বর্ণবাদী নারীবিদ্বেষী পুরুষ।
বিদায় জেমস
ওয়াটসন।



No comments:
Post a Comment