Thursday 6 January 2022

নিউটনের জীবন ও বিজ্ঞান

 


সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে অনেক বৈজ্ঞানিক ধারণা। পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে যার হাত দিয়ে – তাঁর নাম আইজাক নিউটন। আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটন সম্পর্কে বলেছিলেন – প্রকৃতি তাঁর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির রহস্য নিউটনের মতো করে আর কেউ এতটা উন্মোচন করতে পারেননি। নিউটনের হাত দিয়েই আমরা পেয়েছি আলো এবং বর্ণের সম্পর্ক, মাধ্যাকর্ষণ ও মহাকর্ষ বলের গাণিতিক সূত্র, গতির সূত্র। জ্যোতির্বিজ্ঞানে নিউটনের গতিবিদ্যা প্রয়োগ করার পর বিগত কয়েক হাজার বছরের চেয়েও বেশি অগ্রগতি হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। গণিতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখা ক্যালকুলাসের উৎপত্তি ও বিকাশের অন্যতম নায়ক ছিলেন আইজাক নিউটন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাগুলির একটি হলো নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা’ – যেখান থেকে আমরা পেয়েছি চিরায়ত বলবিজ্ঞান (যাকে আমরা নিউটনিয় বলবিজ্ঞান বলি), গ্রহ-নক্ষত্রগুলির মধ্যে মহাকর্ষ বলের সূত্র এবং মহাবিশ্বের গতির গাণিতিক অবকাঠামো।

আইজাক নিউটনের জন্ম ১৬৪২ সালের ক্রিস্টমাসের দিন অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার থেকে সাত মাইল দক্ষিণে কোল্‌সটারওয়ার্থ গ্রামের ‘উল্‌সথর্প’ নামের এক বিশাল ফার্ম হাউজে। সেই সময় ইউরোপের সব জায়গায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়ে গেলেও ইংল্যান্ডে ১৭০০ সাল পর্যন্ত গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয়নি। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ থেকে দশ দিন পিছিয়ে ছিল ইংল্যান্ডের জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। সে হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউটনের জন্ম তারিখ হয় ৪ জানুয়ারি ১৬৪৩। তারিখের হিসেবে এই গন্ডগোলটা অবশ্য নিউটনের জীবনে কোন প্রভাব ফেলেনি।

কেমব্রিজ থেকে প্রায় ৬০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের এই গ্রামটি তুলনামূলকভাবে নতুন। নিউটনের পূর্বপুরুষরা এখানে এসেছিলেন ১৫০০ সালের দিকে। নিউটন তখন কোন নির্দিষ্ট পরিবারের পদবি ছিল না। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় নতুন শহরের গোড়াপত্তন হচ্ছিলো সেই সময়। নতুন শহরে এসে অনেকেই তখন নিউটন পদবি গ্রহণ করেছিলেন। নিউ-টাউন থেকে নিউটন শব্দটির উৎপত্তি।

নিউটনের দাদা রবার্ট নিউটন জন্মেছিলেন আনুমানিক ১৫৭০ সালে। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি কিছু কৃষিজমির মালিক হয়েছিলেন। ১৬০৬ সালে রবার্ট নিউটনের পুত্র আইজাক নিউটনের জন্ম হয়। পরিবারে তখনো লেখাপড়ার কোন চল ছিল না। পিতা-পুত্র দু’জনই নিরক্ষর। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে রবার্ট ক্রমে ক্রমে আরো অনেক জমির মালিক হন এবং ১৬২৩ সালে উল্‌সথ্রপের ‘লর্ড অব দি ম্যানর’ হয়ে গেলেন। জমিজমাসহ বিশাল বাড়ির মালিক হয়ে লর্ড হয়ে নিউটন পরিবারের অর্থনৈতিক সম্মান অনেক বেড়ে গেল। এবার রবার্ট নিউটন ঠিক করলেন শিক্ষিত ভদ্রলোকের পরিবারে ছেলের বিয়ে দিয়ে পরিবারের সামাজিক সম্মান বাড়াবেন। ১৬৩৯ সালে জেমস আয়াসকাফের কন্যা হ্যানা আয়াসকফের সঙ্গে আইজাক নিউটনের বাগদান সম্পন্ন হয়। কিন্তু রবার্ট নিউটনের শরীর ভালো যাচ্ছিল না বলে বিয়ে পিছিয়ে দিতে হয়। ১৬৪১ সালে রবার্ট মারা যান। তার মাস ছয়েক পর ১৬৪২ সালের শুরুর দিকে হ্যানা ও আইজাকের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের ছয়-সাত মাস পরেই হঠাৎ মৃত্যু হয় আইজাক নিউটনের। হ্যানা তখন সন্তানসম্ভবা। ১৬৪২ সালের ২৫ ডিসেম্বর হ্যানা খুব রোগা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। এই সন্তান তার বাবাকে কোনদিন দেখেনি। সন্তানের বাবার নাম অনুসারেই তার নাম রাখা হলো আইজাক নিউটন।

সময় হবার আগেই জন্ম নেয়া রুগ্ন শিশুটিকে অনেক যত্নে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনেন হ্যানা। কিন্তু তিনি খুবই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্না। তিনি জানেন এত বড় ফার্ম তিনি একা সামলাতে পারবেন না। সব দেখাশোনা করার জন্য শক্ত অভিভাবক দরকার। ১৬৪৫ সালে হ্যানা ৬৩ বছর বয়সী প্রভাবশালী রেভারেন্ড বারনাবাস স্মিথকে বিয়ে করে নর্থ উইথামে চলে যান।

হ্যানা তাঁর তিন বছর বয়সী শিশু আইজাক নিউটনকে রেখে যান তাঁর মা-বাবার কাছে। নানা-নানীর কাছে আদর-যত্নের অভাব না থাকলেও মাতৃস্নেহের অভাবে এবং সৎ-বাবার প্রতি আক্রোশে খুবই বদরাগী শিশু হিসেবে বড় হতে থাকে আইজাক। তার কোন বন্ধু ছিল না। একা একা বড় হতে থাকে সে।

হ্যানার ভাই উইলিয়াম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছিলেন। তাদের পরিবার শিক্ষিত পরিবার। আইজাক নিউটনকে লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা করা হলো। কিন্তু তাও বেশ দেরিতে। বারো বছর বয়সে নিউটনকে বাড়ি থেকে সাত মাইল দূরে গ্রান্থাম গ্রামের কিং স্কুলে ভর্তি করানো হয়। ক্লার্ক নামের একজন ফার্মাসিস্টের বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকটা যন্ত্রের মতো সেখানে বাস করে নিউটন। স্কুলেও নিউটনের কোন বন্ধু হয়নি। সে কারো সাথেই মেশে না। লেখাপড়া নিজে নিজেই করে। হাতের কাজে বেশ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে ইতোমধ্যে।

এদিকে ১৬৫৬ সালে নিউটনের মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যু হয়। দুইটি কন্যা একটি পুত্রসন্তান নিয়ে নিউটনের বাবার ফার্মেই ফিরে আসেন হ্যানা। দ্বিতীয় স্বামীর বিষয়সম্পত্তির মালিকও হন তিনি। ফার্ম আরো বড় হয়। তাঁর মনে হলো বড় ছেলে নিউটনকে নিজের কাছে এনে ফার্মের কাজে লাগিয়ে দেবেন। ১৬৫৮ সালে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিউটনকে ফার্মে নিয়ে আসেন তিনি। নিউটন ফার্মের কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারে না। মায়ের কাছে এলেও মায়ের প্রতি কোন টান অনুভব করা তো দূরের কথা বরং আক্রোশে জ্বলতে থাকেন তিনি। নিউটনের মামার পরামর্শে নিউটনকে আবার স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে থেকে সে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি হতে থাকে।

১৬৬১ সালে ১৯ বছর বয়সে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন নিউটন। তার সহপাঠীরা সবাই বয়সে তার চেয়ে তিন চার বছরের ছোট। ট্রিনিটি কলেজের বেতন আর হোস্টেলের ফি মেটানোর জন্য নিউটনকে একটা অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ দেয়া হয়। তার বদলে তাকে সিনিয়র ছাত্রদের ফাইফরমাশ খাটতে হয়। স্কলারশিপ পেলে এধরনের কোন কাজ করতে হয় না। নিউটন চেষ্টা করলেন ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় ভালো করে সেকেন্ড ইয়ারে একটা স্কলারশিপ জোগাড় করার। কিন্তু নিউটন সিলেবাসের পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো পড়াশোনা করছিলেন। সেইসময় ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও আর কেপলারের নতুন তত্ত্বগুলি পড়ানো শুরু হয়ে গেলেও কেমব্রিজের পড়াশোনা তখনো এরিস্টোটলের পৃথিবীকেন্দ্রিক পদার্থবিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছিল। নিউটন নিজে নিজে নতুন তত্ত্বগুলি পড়তে শুরু করেছিলেন। ফলে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় জ্যামিতিতে ফেল করলেন। তখন কেমব্রিজের শিক্ষকরা ভাবতেও পারেননি যে এই জ্যামিতিতে ফেল করা ছেলেটাই কয়েক বছরের মধ্যে মহাবিশ্বের নতুন জ্যামিতি সৃষ্টি করবেন।

১৬৬৫ সালে ইংল্যান্ডে বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রায় ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় প্লেগে। স্কুল-কলেজ সব বন্ধ হয়ে যায় দুই বছরের জন্য। ১৬৬৫-৬৬ – এই দুই বছর নিউটন তাদের উল্‌সথর্পের ফার্মে কাটান। এই দুই বছরের নিভৃতবাসের সময় তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর যুগান্তকারী সূত্রগুলি। তিনি আবিষ্কার করেন – ক্যালকুলাস, আলোর প্রকৃতি, মহাকর্ষ সূত্র। গ্যালিলিও এবং কেপলারের প্রকাশিত গবেষণার উপর বিস্তারিত কাজ করেন তিনি। এই দুই বছরে তিনি যতকিছু আবিষ্কার করেছেন – সেগুলিই পরবর্তী দুই শ বছর ধরে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠে এবং গবেষণায়। কিন্তু এসব আবিষ্কারের কথা  অপ্রকাশিতই ছিল পরবর্তী বাইশ বছর। ১৬৮৭ সালে প্রিন্সিপিয়া প্রকাশিত হবার পরেই সবাই জানতে পারে নিউটনের আবিষ্কার সম্পর্কে।

১৬৬৭ সালে আবার কেমব্রিজে ফিরলেন নিউটন – অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে। এবার একটা স্কলারশিপ পেলেন তিনি। ১৬৬৩ সালে কেমব্রিজে লুকাসিয়ান প্রফেসর পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। পার্লামেন্ট মেম্বার হেনরি লুকাস এই পদের জন্য তদ্বির করেছেন এবং ১৬৬৪ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদের সূচনা করেন। প্রথম লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পেলেন আইজাক ব্যারো। ব্যারো নিউটনকে খুবই পছন্দ করতেন। আইজাক ব্যারোর সংস্পর্শে এবং সহায়তায় আইজাক নিউটন কেমব্রিজে স্থায়ী পদ লাভ করেন। ইতোমধ্যে তিনি ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেছেন। সেই সময় কেমব্রিজে ভর্তি হলেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর ডিগ্রি দিয়ে দেয়া হতো। আইজাক ব্যারো ট্রিনিটি কলেজের মাস্টার এবং রাজকীয় পদে অভিষিক্ত হবার পর লুকাসিয়ান প্রফেসরের পদটা নিউটনকে দিয়ে দেন। আইজাক নিউটন ১৬৬৯ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে যোগ দেন। পরবর্তী ৩৩ বছর তিনি সেই পদে কাজ করেছেন।

লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে নিউটন প্রথম লেকচার দেন ট্রিনিটি কলেজে ১৬৭০ সালের জানুয়ারিতে। মাত্র কয়েকজন ছাত্র আগ্রহী ছিলেন তাঁর লেকচার শোনার ব্যাপারে। নিউটন তখন আলোকবিদ্যা সম্পর্কে গবেষণা করছেন। লুকাসিয়ান লেকচারে তিনি সেসব তত্ত্বই আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কোন ছাত্রই আগ্রহী হয়নি তার লেকচারে। প্রথম লেকচারে কয়েকজন উপস্থিত থাকলেও দ্বিতীয় লেকচারে কেউ উপস্থিত হয়নি। নিউটন খালি থিয়েটারেই লেকচার দিলেন। পরবর্তী সতেরো বছর ধরে নিউটন লুকাসিয়ান লেকচার দিয়েছেন খালি থিয়েটারে। প্রফেসর হিসেবে বড়ই অবহেলিত ছিলেন আইজাক নিউটন। তাঁর অধ্যাপক জীবনে মাত্র তিন জন ছাত্র তাঁর কাছে পড়তে এসেছিল। ছাত্র হিসেবে তারা কেউই তেমন কোন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। নিউটনের আলোক-সংক্রান্ত গবেষণাগুলি তিনি প্রকাশ করেন ‘অপটিক্‌স’ বইতে – তিরিশ বছর পর ১৭০৪ সালে।

নিউটন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি তৈরিতে দক্ষ ছিলেন। আলোকের পরীক্ষার জন্য দরকারি যন্ত্রপাতি তিনি নিজেই তৈরি করতেন। আলোক-যন্ত্রপাতি তৈরি করতে করতে তিনি একটি শক্তিশালী রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ তৈরি করেন। এই টেলিস্কোপের কথা রয়েল সোসাইটিতে জানাজানি হয়ে যায়। বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েলের নেতৃত্বে রয়েল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৬৬০ সালে। রয়েল সোসাইটির আগ্রহে নিউটন তাঁর টেলিস্কোপের একটি মডেল রয়েল সোসাইটিতে পাঠান। পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানে নিউটনের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। ১৬৭২ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ লাভ করেন নিউটন। রয়েল সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী নিউটনকে একটি বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিতে হলো। সেখানে তিনি অপ্‌টিকস সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করলেন।

১৬৬৫/৬৬ সালে প্লেগের সময় ফার্মে বসে নিউটন আবিষ্কার করেছিলেন আলোর কণাতত্ত্ব। প্রিজমের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো প্রবেশ করিয়ে তিনি দেখেছেন প্রিজমের ভেতর দিয়ে বের হবার সময় আলো বিভিন্ন বর্ণে আলাদা আলাদা ভাবে বেগুনি, নীল, আকাশী, সবুজ, হলুদ, কমলা, ও লাল – এভাবে রঙধনুর রঙে প্রতিসৃত হয়ে বের হয়। আরেকটি প্রিজমের ভেতর দিয়ে এই বর্ণালী প্রবেশ করিয়ে দেখা গেল যে প্রিজমের অন্যদিকে সবগুলি রঙ একসাথে মিলে সাদা রঙের আলো বের হচ্ছে। আমরা কীভাবে রঙ দেখি তার পদার্থবৈজ্ঞানিক উত্তর পাওয়া গেল। আমরা যখন লাল দেখি – তখন লাল ছাড়া বাকি সব রঙ শোষিত হয়। আর যখন সাদা দেখি – তখন সব রঙের মিশ্রণ দেখি, কালো মানে সব রঙেরই শোষণ।

কিন্তু নিউটনের গবেষণায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না রবার্ট হুক। তিনি দাবি করেন নিউটন তাঁর মডেল অনুসরণ করে এই যন্ত্র বানিয়েছেন, সুতরাং মূল কৃতিত্ব নিউটনের নয়। ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্‌স দাবি করলেন নিউটন তাঁর তত্ত্ব নিয়েই কাজ করছেন। নিউটন ক্রমশ বিরোধে জড়িয়ে পড়তে শুরু করলেন। এই বিরোধ চলতেই থাকলো পরবর্তী এক দশক ধরে।

১৬৭৯ সালে নিউটনের মা মারা যান। নিউটন একেবারেই একা হয়ে গেলেন। ছোটবেলায় মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে সমগ্র নারীজাতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল নিউটনের। সারাজীবন তিনি নারীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলেছেন।

১৬৮৪ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিউটনের সাথে দেখা করেন। হ্যালি নিউটনকে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর গবেষণাকর্ম প্রকাশ করার জন্য। ১৬৮৪ থেকে ১৬৮৬ সাল পর্যন্ত দিনরাত পরিশ্রম করে নিউটন তাঁর যুগান্তকারী বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করেন। ১৮৮৬ সালের জুন মাসে তিনি রয়েল সোসাইটিতে উপস্থাপন করেন ‘ফিলোসপিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথাম্যাথিকা’। পরের বছর তিন খন্ডে এই বই প্রকাশিত হয়। তিনি ইচ্ছে করেই বইটাতে অনেক বেশি গাণিতিক সূত্র দিয়ে ভর্তি করে ফেলেন যেন খুব বেশি মানুষ এই বই পড়ে বুঝতে না পারেন। তাঁর ধারণা ছিল – কেউ কিছু বুঝতে না পারলে সমালোচনাও করতে পারবে না। তিনি মানুষের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না।  

১৬৮০ সাল থেকে ট্রিনিটি কলেজে ভীষণ অর্থাভাব দেখা দেয়। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠার জন্য ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে ১৬৮৭ সালে আট জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। নিউটন ছিলেন সেই কমিটির অন্যতম সদস্য।

১৬৮৯ সালে নিউটন পার্লামেন্টের সদস্য মনোনীত হন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে। এক বছর তিনি পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন। কিন্তু কথিত আছে এই এক বছরে তিনি একটি মাত্র বাক্য বলেছিলেন পার্লামেন্টে – সেটা হলো একজন সহকারিকে ডেকে বলেছিলেন – ‘জানালাটা খুলে দাও’।

১৬৯৩ সালে নিউটনের প্রচন্ড মানসিক সমস্যা দেয়। প্রায় চার মাস তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভোগেন। এরপর তিনি সুস্থ হলেও আর কোনদিন কোন মৌলিক গবেষণা করেননি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে ছিলেন ১৭০২ সাল পর্যন্ত।

১৬৯৬ সালে নিউটন ইংল্যান্ডের জাতীয় টাকশাল ‘রয়েল মিন্ট’-এ গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ দেন। এরপর ১৭২৭ সাল পর্যন্ত আমৃত্যু তিনি এখানেই ছিলেন। পদোন্নতি হতে হতে তিনি ‘মাস্টার অব দি মিন্ট’ হয়েছিলেন। টাকা জাল করা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিউটনের দক্ষ ব্যবস্থাপনায়।

রবার্ট হুকের সাথে বিরোধ চললেও ১৭০৩ সালে বরার্ট হুকের মৃত্যুর পর নিউটন রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি রাজনৈতিক এবং অন্যান্যভাবে প্রভাব খাটানোতে খুব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৭০৩ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রেখেছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কখনো কোন প্রেস-কনফারেন্স বা ঘোষণাপত্র পাঠ করেননি। জনসমাবেশে কিছু বলতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না।

১৭০৫ সালে নিউটন নাইটহুড লাভ করেন। তাঁর আগে আর কোন বিজ্ঞানী এই সম্মান পাননি।

নিউটন খুবই বদমেজাজী মানুষ ছিলেন। তাঁকে কখনো হাসতে দেখা যায়নি। নিজের সমালোচনা একটুও সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলেন না। যাদেরকে বন্ধু মনে করতেন, তারাও যদি তাঁর পক্ষে কথা না বলতেন, তাহলে তাদের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিতেন।

নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাথিকা পদার্থবিজ্ঞানে সর্বকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী রচনাগুলির একটি তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রচনা প্রকাশ করে বিখ্যাত হবার পরেই তিনি প্রধান রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী – ‘অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল’ জন ফ্ল্যামস্টিডের সাথে ঝগড়া লাগালেন। ফ্ল্যামস্টিডের সাথে নিউটনের খুবই ভালো বন্ধুত্ব ছিল। প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানের যেসব ডাটা উপাত্ত দরকার হয়েছিল – তার সবগুলিই তিনি পেয়েছিলেন ফ্ল্যামস্টিডের কাছ থেকে। কিন্তু নিউটন অপ্রকাশিত ডাটা চাইলে ফ্ল্যামস্টিড ডাটা দিতে অস্বীকার করলে নিউটনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তিনি কোন কিছুতেই না শুনতে পছন্দ করতেন না। নিউটন নিজের প্রভাব খাটিয়ে রয়েল অবজারভেটরির পরিচালনা পরিষদের কর্তা হয়ে গেলেন এবং ডাটা দিতে বাধ্য করলেন। শুধু ডাটা পেয়েই সন্তুষ্ট হলেন না নিউটন। তিনি ফ্ল্যামস্টিডের নাম-নিশানা মুছে দিতে চাইলেন। ফ্ল্যামস্টিড যে ডাটা সংগ্রহ করেছিলেন তার সবগুলি বাজেয়াপ্ত করা হলো। ফ্ল্যামস্টিড যেসব গবেষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য রেডি হচ্ছিলেন – সেগুলিকে ফ্ল্যামস্টিডের শত্রু এডমন্ড হ্যালি’র নামে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ফ্ল্যামস্টিডও ছেড়ে দেবার মানুষ নন। তিনি কোর্টে মামলা করলেন এবং দ্রুত কোর্ট অর্ডার পেলেন নিজের কাজের পক্ষে। ফ্ল্যামস্টিডের রচনা হ্যালির নামে প্রকাশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েও নিউটন দমে গেলেন না। তিনি তাঁর প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণ থেকে ফ্ল্যামস্টিডের সবগুলি রেফারেন্স মুছে দিলেন।  

নিউটন অত্যন্ত প্রতিশোধ-পরায়ন মানুষ ছিলেন। জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজের সাথে ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব নিয়ে বিরোধে সাংঘাতিকভাবে রেগে যান নিউটন। নিউটন আর লিবনিজ দু’জনই আলাদা আলাদাভাবে গণিতের এই নতুন শাখাটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু নিউটন লিবনিজের আগেই এই কাজ করলেও – প্রকাশ করেছেন আরো অনেকদিন পর। কিন্তু লিবনিজ প্রকাশ করেছেন নিউটনের আগে। ক্যালকুলাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব কাকে বেশি দেয়া হবে – এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। লিবনিজের সমর্থনে একদল বিজ্ঞানী লিখলে, নিউটনের পক্ষে লিখছেন আরেকদল।  নিউটনের বন্ধু সংখ্যা কম হলেও তিনি অন্যপথ নিলেন। নিজেই নিজের পক্ষ সমর্থন করে লিখে তা বন্ধুদের নামে প্রকাশ করতে শুরু করলেন। এভাবে নিয়মিত লিবনিজ-বিরোধী চিঠি প্রকাশিত হতে থাকলে লিবনিজ এই ব্যাপারটার একটা স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রয়েল সোসাইটির কাছেই বিচার দিলেন। কিন্তু লিবনিজ ভুলটা করলেন সেখানেই। নিউটন নিজেই তখন রয়েল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তিনি ‘নিরপেক্ষ’ তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলে নিজের বন্ধুদের দিয়ে একটা কমিটি গঠন করলেন। তাতেও শান্তি নেই তাঁর। নিজেই কমিটির রিপোর্ট লিখলেন এবং রয়েল সোসাইটিকে দিয়ে তা প্রকাশ করালেন। সেই রিপোর্টে লিবনিজকে সরাসরি দায়ি করা হয় নিউটনের কাজ চুরি করেছেন বলে। তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে এই রিপোর্টের পক্ষে অনেক সুনাম করে বেনামে একটা চিঠিও প্রকাশ করলেন রয়েল সোসাইটির জার্নালে। ১৭১৬ সালে লিবনিজের মৃত্যুর পর নির্লজ্জভাবে আনন্দ প্রকাশ করেছেন নিউটন।

১৭২৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ বারের মত রয়েল সোসাইটির মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেছেন নিউটন। তার এক মাস পরে ১৭২৭ সালের ২০ মার্চ ৮৪ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁকে রাজকীয় সম্মান দিয়ে ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে-তে সমাহিত করা হয়।

তথ্যসূত্র: ১। স্টিফেন হকিং – ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম; ২। আইওয়ান জেমস – রিমার্কেবল ফিজিসিস্ট; ৩। পিটার মুর – সায়েন্স; ৪। স্টিভ পার্কার – আইজাক নিউটন অ্যান্ড গ্র্যাভিটি; ৫। লয়েড মর্টজ অ্যান্ড জেফারসন ওয়েভার – দ্য স্টোরি অব ফিজিক্স; ৬। জন গ্রিবিন – দ্য সায়েন্টিস্টস। 

___________________

বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২১ সংখ্যায় প্রকাশিত







No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts