Saturday 22 January 2022

স্বপ্নলোকের চাবি - পর্ব ৫৬

 



#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৬


নিউটন, ফ্যারাডে, আইনস্টাইন শ্রোডিঙ্গার ডি-ব্রগলি – এরকম অসংখ্য নাম এবং তাদের সমীকরণ মুখস্থ করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার সময় আমার প্রায়ই মনে হয় এঁরা কেউই আমাদের আপন মানুষ নন। এঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ভাসাভাসা যতটুকু তথ্য আমরা জেনেছি তাতে এঁদের কাউকেই আমাদের কাছের মানুষ বলে মনে হয় না। পদার্থবিজ্ঞানে এঁদের অত্যন্ত দরকারি সব আবিষ্কারের কারণেই এই পৃথিবী এমন আধুনিক হতে পেরেছে – একথা সত্য। কিন্তু সেই আধুনিকতায় আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই। বুঝে না বুঝে যে কোনোভাবে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লেখার প্রস্তুতি নিয়েই আমাদের দায় শেষ। নিজের বিভাগের প্রতি, নিজের পঠিত বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মানোর জন্য চোখের সামনে একেবারে নিজেদের মানুষ থাকতে হয় – যাঁদের দেখে আমরা অনুপ্রেরণা পাবো। সেরকম উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে একেবারেই যে নেই তা নয়, কিন্তু কেন যেন আমাদের স্যার-ম্যাডামরা সেসব উদাহরণ আমাদের ক্লাসে তুলে ধরেননি। শুধুমাত্র ক্লাসরুমেই তো স্যার-ম্যাডামদের সাথে আমাদের সরাসরি সংযোগ ঘটার সুযোগ ঘটে। আড়াই হাজার বছর আগের সক্রেটিসের যুগের শিক্ষাব্যবস্থার মতো করে তো আর কেউ শেখাবেন না এ যুগে। সেটা আমরা আশাও করি না। কিন্তু ক্লাসে এসে আমাদের কাছের মানুষদের কথা বুঝি একবারও বলতে নেই? বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স আমরা পড়েছি সত্যেন বসু কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে এই আবিষ্কার করেছিলেন তা না জেনেই। সিলেবাসে নেই বলেই হয়তো স্যাররা আবিষ্কারের পেছনের ইতিহাসটুকু উল্লেখ করেননি। কিন্তু সিলেবাসের বাইরের সেই কথাগুলি যদি বলতেন তাহলে হয়তো আমাদের আরো নিজের মনে হতো বিষয়টাকে। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে স্ট্রং নিউক্লিয়ার ফোর্স ও উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স পড়ার সময় যদি আমরা জানতাম যে উইক নিউক্লিয়ার ফোর্স আর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স যে একই রকম ফোর্স তা আবিষ্কার করেছেন যে তিনজন বিজ্ঞানী তাঁদের একজন হলেন আমাদের একেবারে নিজস্ব বিজ্ঞানী আবদুস সালাম, তাহলে হয়তো আরো আপন মনে হতো এই বিষয়টাকেও। যদি জানতাম যে আবদুস সালামকে অনার্স মাস্টার্স পড়ার সময় কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের মতোই কিংবা আমাদের চেয়েও বেশি – আমাদের উৎসাহ বাড়তো বৈ কি। ১৯৮৮ সালে এই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন – সেটা নিয়েও কোন আলোচনা আমাদের ক্লাসে করেননি কেউ। আমাদের এই ডিপার্টমেন্ট যে বাংলাদেশের সেরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ হিসেবে গড়ে উঠেছিল প্রফেসর এখলাস উদ্দীন আহমদ-এর চেষ্টা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমে সেটাও আমরা সেভাবে জানতে পারিনি। আমাদের অনার্স কোর্সের সিলেবাস সেই ১৯৬৯ সালে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের সিলেবাস অনুসরণে তৈরি করেছিলেন প্রফেসর এখলাস উদ্দীন আহমদ। এই ইম্পেরিয়েল কলেজের প্রফেসর ছিলেন আবদুস সালাম। এসব জানলে হয়তো আমাদের সিলেবাসভীতির পাশাপাশি কিছুটা প্রীতিও জন্মাতে পারতো। 

ক’দিন থেকে এই কথাগুলি মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এখলাস উদ্দীন স্মরণে ডিপার্টমেন্টের একটা অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা করতে গিয়ে। এখলাসস্যার মারা গেছেন ১৯৮৪ সালের ২০ আগস্ট। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ – আট বছর কি খুব বেশি সময়? স্যার মারা যাবার দুই বছর পরেই আমরা ডিপার্টমেন্টে ক্লাস করতে শুরু করেছি। অথচ এই ডিপার্টমেন্টকে একটা উন্নতমানের ডিপার্টমেন্টে পরিণত করে তোলার জন্য এখলাসস্যারের যে অবিরাম চেষ্টা ছিল – সেই কথাটুকু আমরা সেভাবে জানতে পারিনি। একথা ঠিক যে প্রতিবছর আগস্টের ২০ তারিখ – বা তার কাছাকাছি সময়ে অধ্যাপক এখলাস উদ্দীন স্মারক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে কিছু আলোচনা হয়, আনুষ্ঠানিক গুণকীর্তন করা হয় – তারপর সব শেষ। পরের বছর আবার সবকিছুর পুনরাবৃত্তি। 

গতবছর তিনদিনব্যাপী এখলাস উদ্দীন স্মারকবক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রামাণিকস্যার ‘রিলিজিয়াস অ্যান্ড সায়েন্টিফিক ভিউজ অব দ্য ইউনিভার্স’ শীর্ষক বক্তৃতা দিতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলেন। দ্বিতীয় দিনের পর বক্তৃতামালা বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। এবছর চেয়ারম্যান সোবহানস্যারের কড়া হুকুম – গতবছরের মতো কিছু হওয়া চলবে না। এবার দু’ঘন্টার মধ্যেই সবকিছু শেষ করতে হবে। হামিদাবানুম্যাডাম আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন অনুষ্ঠানটির গ্রন্থনা এবং উপস্থাপনা করার জন্য। ১৯৮৬ সালে এখলাস উদ্দীন স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ম্যাডাম বইটির একটি কপি আমাকে দিয়েছেন। ইচ্ছে থাকলে একজন অধ্যাপক কত সীমিত সুযোগের মধ্যেও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য কত কিছু যে করতে পারেন – তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ প্রফেসর এখলাস উদ্দীন আহমদ। 

১৯৬৮-৬৯ সালে শামসুল হক, এখলাস উদ্দীন আহমদ, হামিদা বানু, সরিৎ কুমার সাহা, এবং সাখাওয়াত হোসেন – এই পাঁচজন প্রফেসরকে নিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। হামিদা বানুম্যাডাম এবং এস কে সাহাস্যার এখনো আমাদের ডিপার্টমেন্টে আছেন – এটা আমাদের গর্বের বিষয়। এখলাসস্যার আমাদের ডিপার্টমেন্টকে গড়ে তোলার পাশাপাশি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলায় সচেষ্ট ছিলেন। সরকার ফরেস্ট্রি ইন্সটিটিউট ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলেছিল। এখলাসস্যার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সবাইকে যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে ফরেস্ট্রির জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। তাঁর চেষ্টাতেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ইন্সটিটিউট অব ফরেস্ট্রি। সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটলো। পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল কক্সবাজার বা শহরের কোথাও এই ইন্সটিটিউট হবে। এখলাসস্যারের চেষ্টায় আমাদের ক্যাম্পাসেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট। 

আমাদের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির এই ভবনটি তৈরি হয়েছে এখলাসস্যারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। দিনরাত পরিশ্রম করে তিনি এর ভীত থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্মাণ-ধাপ তদারক করেছেন তাঁর অন্যান্য শত ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও। আক্ষরিক অর্থেই বলা চলে সায়েন্স ফ্যাকাল্টির প্রতিটি ইটেই আছে এখলাসস্যারের ছোঁয়া। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা গেছে – দেয়াল গাঁথার আগে এখলাসস্যার নিশ্চিত করেছেন যেন প্রতিটি ইট পানিতে ভেজানো হয়। এসব কাজে তিনি প্রায়ই নিজে হাত লাগাতেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সন্তানদের পড়াশোনার সুবিধার্থে এখলাসস্যারের একান্ত চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ। উপযুক্ত অধ্যক্ষ খুঁজে পাওয়ার আগপর্যন্ত নিজেই অবৈতনিক অধ্যক্ষের কাজ করেছেন এই প্রতিষ্ঠানে। এই কর্মযোগী মানুষটার পরিচয় যদি আরো আগে পেতাম – তাহলে কাজের প্রতি ভালোবাসার ভিতটা আরো শক্ত হতো। 

এখলাসস্যারের অকালমৃত্যুর পর সবকিছু কেমন যেন স্থবির হয়ে যায়। শুধুমাত্র একজন কর্মবীর হলে যা হয়। আমাদের কর্মসংস্কৃতিই সম্ভবত এরকম। যখন কেউ একজন প্রচুর কাজ করেন, আমরা তাঁর সামনে তাঁর কাজের প্রশংসা করি, আড়ালে সমালোচনা করি, কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই তাঁর কাঁধে কাঁধ মিলাই। তাই আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় কর্মবীররা খুবই একা। তাঁদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের শুরু করা কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার মতো নির্ভরযোগ্য কেউ থাকে না। 

এখলাসস্যারের মৃত্যুর পর হামিদাবানুম্যাডাম যেন এখলাসস্যারের অসমাপ্ত কাজের হাল ধরতে না পারেন – সেজন্য যত ধরনের ষড়যন্ত্র করা যায় সবই করেছে ছাত্রশিবির এবং তাদের দোসররা। ম্যাডামের নামে কুৎসা রটিয়েছে তারা। এখলাসস্যার ও হামিদাবানুম্যাডামের দাম্পত্যজীবন সম্পর্কেও নানারকম মিথ্যা কথা ছড়িয়েছে তারা। ওরা এখনো থামেনি। 

জামায়াত-শিবিরের নেটওয়ার্ক কত শক্তিশালী এবং ভয়ানক তা জানতে কারো বাকি নেই। তারা এখন ফ্রিডম পার্টির সাথে মিলে সারাদেশে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমন্বয় কমিটির নেতাদের হত্যা করতে শুরু করেছে। ১৮ জুলাই ঢাকায় সমন্বয় কমিটির মিটিং-এ গুলি চালিয়ে দু’জনকে হত্যা করেছে, আহত করেছে প্রায় শতাধিক মানুষকে। জুলাইয়ের ৩১ তারিখ খুন হয়েছেন খুলনার সিপিবির প্রবীণ নেতা রতন সেন। ১৪ আগস্ট খুন হয়েছে খুলনার ছাত্রলীগ কর্মী শিপুল। ১৭ আগস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন রাশেদ খান মেনন। ২০ আগস্ট এর প্রতিবাদে সারাদেশে হরতাল ডাকা হয়েছে। 

এখলাসস্যারের স্মারক অনুষ্ঠানটি ২০ আগস্ট হবার কথা ছিল। হরতালের কারণে পিছিয়ে ২৫ তারিখে করা হলো। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির নতুন ডিন নির্বাচিত হয়েছেন পরিসংখ্যানের সুলতান আহমদস্যার। তাঁকে প্রধান অতিথি করা হলো। স্মারক গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ পড়ার জন্য আমাদের রুমাকে রাজি করিয়েছিলাম। রুমা খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। আমাদের মতো অকারণে হাসি-তামাশা সে কখনোই করে না। এখলাসস্যারের স্মারক অনুষ্ঠান ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠান বলেই সে রাজি হয়েছে। তার পড়ার ভঙ্গি চমৎকার, উচ্চারণ নিখুঁত, আর কন্ঠস্বর আশ্চর্য সুন্দর। ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমাদের প্রেমাঙ্কর আর পরের ব্যাচের রানা এখলাসস্যার সম্পর্কে বললো। রানা তার নামের ব্যাপারে খুবই যত্নবান। সে আমাকে বার বার অনুরোধ করেছে যেন তার নাম - আহমেদ ওবায়দুস সাত্তার ভুঁইয়া - উচ্চারণে যেন কোন ভুল না করি। নুরুল মোস্তফাস্যার ছিলেন এখলাসস্যারের সরাসরি ছাত্র। তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করলেন। এস কে সাহাস্যার এখলাসস্যারের সাথে শুরু থেকে কাজ করেছেন ডিপার্টমেন্টে। তিনি সেই সময়ের অনেক কথা বললেন যেগুলি শুনে বার বার মনে হচ্ছিল – আহা, এখলাসস্যারের ছাত্র হতে পারলাম না। ডেপুটি রেজিস্ট্রার জনাব আবু হেনা মোহাম্মদ মোহসীন বললেন প্রশাসনিক কাজে এখলাসস্যার কী পরিমাণ দক্ষ ছিলেন তা অভাবনীয়। 

সব বক্তাই একমত হয়ে দাবি জানালেন এখলাসস্যারের হাতেগড়া বিজ্ঞান ভবনের নাম ‘এখলাস উদ্দীন বিজ্ঞান ভবন’ রাখা হোক এবং ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে ‘এখলাস উদ্দীন চেয়ার’ স্থাপন করা হোক। এই দাবি কতদিনে পূরণ হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না জানি না। 

স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্য – প্রক্রিয়াগত বিশ্লেষণ’। বক্তা প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরি। কোন স্ক্রিপ্ট ছাড়াই এক ঘন্টার একটা বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা যে এত নিখুঁতভাবে দেয়া যায় তা নিজের চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হতো। শফিক হায়দারস্যারের বক্তৃতা আগে শুনিনি কখনো। প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক হয়েও পদার্থবিজ্ঞানের অনেক বিষয় – বিশেষ করে বস্তুতরঙ্গ, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনিশ্চয়তা ইত্যাদির কী সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। 

ডিপার্টমেন্টে যদি নিয়মিত সেমিনার বক্তৃতার আয়োজন করা হতো – কতো ভালো হতো। মাঝে মাঝে গৎবাঁধা ক্লাস লেকচারের চেয়ে সেমিনার লেকচার অনেক বেশি কার্যকরী। 

অনুষ্ঠান শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে ক্যাফেটরিয়ার সামনে আসতেই ঠুসঠাস শুরু হয়ে গেল। বন্দুক-যুদ্ধ। সারাদেশে এখন বিভিন্ন ফ্যাক্টরে বন্দুক-যুদ্ধ হচ্ছে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। শুরুতে প্রাণভয়ে ক্যাফেটরিয়ার ভেতরে ঢুকে গেলাম এক দৌড়ে। খবর পেতে দেরি হয় না। আজ লেগেছে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে। কীসের আধিপত্য নিয়ে লেগেছে জানি না। তারা এখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায়। তাদের হাতে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট। লাভের অংশ কিংবা আধিপত্যের ভাগাভাগি নিয়ে মারপিট চলছে। 

পরদিন এখলাসস্যারের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে চকবাজারে বিজ্ঞানপরিষদের অনুষ্ঠানে গেলাম। জামাল নজরুল ইসলামস্যার ও প্রামাণিকস্যার এখানে অতিথি হয়ে এসেছেন। প্রামাণিকস্যার আমাকে জামাল নজরুল ইসলামস্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জামাল নজরুল ইসলামস্যারের সাথে কথা বলার সময় একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। মনে হলো এত বড় একজন বিজ্ঞানী – অথচ কত সহজভাবে কথা বলেন। শফিক হায়দারস্যারও এসেছেন। তিনি ‘বস্তুতরঙ্গ ও জীবজগত’ সম্পর্কে বক্তৃতা দিলেন। আমরা যে পরিচিত মানুষের পদশব্দ চিনতে পারি – তা বস্তুতরঙ্গের সহজ এবং সরাসরি উদাহরণ। জীববিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহার প্রথম করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। সেই ব্যবহার এখন অনেক নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছে। সেইসব ক্ষেত্রের দিকে আগ্রহ অনুভব করছি। অথচ আর দু’মাস পরেই আমার যেসব বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হবে সেগুলিকে বিষবৎ লাগছে। 

মেসে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। ফতেয়াবাদে বাস থেকে নেমে এটুকু হেঁটে আসতে কাকভেজা হয়ে গেছি। রুমে ঢুকে জামাকাপড় বদলে শোবার আয়োজন করতে মিনিট পনেরো লাগলো। মুরাদপুরের একটা রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছি, নইলে এত রাতে আবার রান্না করতে হতো। রাত প্রায় এগারোটা বাজে। একটা লম্বা ঘুম দরকার। 

বিছানায় শোবার প্রায় সাথে সাথেই দরজায় ধুপধাপ শব্দ। এত রাতে আবার কে এলো! 

- কে?

- আমি সেলিম। দরজা খোল। 

সেলিমভাই, এত রাতে! দরজা খুললাম।

কাঁধে ব্যাগ, উস্কোখুস্কো চুল, এলোমেলো পোশাক। কেমন যেন অস্থির সেলিমভাই। 

“কী হয়েছে আপনার?”

“আজ তোমার রুমে ঘুমাবো আমি।“ 

পরের কয়েক মিনিটে অতি সংক্ষেপে সেলিমভাই জানালেন কী হয়েছে। তিনি হল থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। শিবির এবং ছাত্রদল কিছুদিন ছাত্রলীগের এই নেতার প্রতি অনাক্রমণ চুক্তি করেছিল। কিন্তু এখন ছাত্রদলের অন্য একটি গ্রুপের সাথে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশানে মিলছে না। ফলে হল থেকে গলাধাক্কা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতার যদি এই অবস্থা হয়! 

ক্লান্ত আর অপমানিত সেলিমভাই বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, কিংবা ঘুমের মতো করে পড়েছিলেন। পরদিন সকালে তিনি অন্য কোথাও চলে যাবেন বলেছিলেন। কিন্তু পরের দশ দিন তিনি আর কোথাও যাননি। দিনের বেলা বের হলেও রাতে ফিরে এসেছেন। হয়তো উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলেন। 

আমি পড়াশোনা করার চেষ্টা করছি যতটুকু পারি। এক রাতে সেলিমভাই বিছানায় শুয়ে পা নাড়াতে নাড়াতে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে শুধু ভালো ছাত্র হয়ে খুব একটা লাভ নেই?”

“এটা কেন বলছেন ভাইয়া?”

“বলছি এই কারণে, তুমি যদি স্বপ্ন-টপ্ন দেখতে শুরু করো – তা বন্ধ করার জন্য। শেষে স্বপ্নভঙ্গ হলে কষ্ট পাবে।“

এরপর সেলিমভাই দুটো উদাহরণ দিলেন। জয়নাল এবং কবিরের। ছদ্মনামও হতে পারে। জয়নাল ইসলামের ইতিহাসের আর কবির পরিসংখ্যানের। দুজন একই রুমে কটেজে থাকতেন। জয়নাল তেমন সিরিয়াস ছিলেন না পড়াশোনায়। বেশির ভাগ সময় বাড়িতে থাকতেন। পরীক্ষার মাসখানেক আগে এসে এর ওর কাছ থেকে নোট জোগাড় করে পরীক্ষা দিতেন। আর কবিরের সারাবছর লেখাপড়া আর লেখাপড়া। কবির পরিসংখ্যানে অনার্স মাস্টার্স দুটোতেই ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। আর জয়নাল ইসলামিক হিস্ট্রিতে কোন রকমে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছেন। শেষে কী হলো? জয়নাল এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর কবির দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি না পেয়ে একটা ব্যাংকে ঢুকেছেন। 

“এই গল্প আমাকে কেন বললেন সেলিমভাই?”

“না, এমনিতেই। নাথিং সিরিয়াস। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার অবস্থা কবিরের মতো হবে।“ 

আমি টেবিল থেকে মুখ ফিরিয়ে সেলিমভাইয়ের মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু দূরের চৌকিতে চিৎশোয়া মুখ দেখা গেল না। কেবল দেখলাম তার পা দুটো একটার উপর আরেকটা উঠে রাজকীয় ভঙ্গিতে নড়ছে। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts