#স্বপ্নলোকের_চাবি_৫৫
“ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে আমার অঙ্গ যায়
জ্বলিয়া রে…”
বাইরে বৃষ্টির শব্দ আর বারান্দায় অশোকের গান মিলে এক অপূর্ব
ঐকতান সৃষ্টি হয়েছে। অশোকের গলায় সুর আছে। ভ্রমর রে … বলে কী অনায়াসে তার গলা উঠে যায়
সুরের সিঁড়ির উঁচ্চতম ধাপগুলিতে। অথচ সে নাকি কখনো গান শেখেনি। না শিখেই সে এমন গাইতে
পারে, শিখলে যে কী করতো জানি না। কেমন যেন ঈর্ষা হয় আমার। কান পেতে শুনতে থাকি। খালি
গলায় বিচ্ছেদের গান শুনতে শুনতে কেমন যেন উদাস লাগছিলো।
কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে বিরহের গান শুনতে হয় একাকী।
আনন্দভ্রমণে এসে বিরহের গান আমার সঙ্গীদের অনেকের কাছেই অসহ্য লাগছিলো। তাই অশোক বড়ুয়ার
গানের বিরহজ্বালায় অঙ্গ জ্বলে যাবার বেদনায় একটুও কাতর না হয়ে মানস চক্রবর্তী অর্থাৎ
আমাদের মানসদা চিৎকার করে উঠলো “বন্ধু, জ্বালাইয়া গেলা মনের আগুন নিভাইয়া গেলা না।“
মানসদার গলায় একফোঁটা সুর নেই, এবং সেজন্য কোন লজ্জাও নেই। বেসুরো গলায় চিৎকার করতে
তার একটুও বাধে না। সে যেটা নিয়ে চিৎকার করছে সেটাও ধরতে গেলে বিরহেরই গান – কিন্তু
সে যেভাবে ধরেছে তাতে মনে হচ্ছে ওটা অগ্নিযুগের বিপ্লবী গান। তার সাথে সাথে অন্যরাও
যেভাবে “যালাইয়া” বলে চিৎকার করছে – মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে এখনই আগুন জ্বালিয়ে দেবে।
পান্থনিবাসের বারান্দায় প্রায়-গভীর রাতে বসেছে আমাদের গানের
আসর। কক্সবাজারে এখন অফ-সিজন। এই শ্রাবণে পর্যটকদের সংখ্যা খুবই কম। সে কারণেই হয়তো
পর্যটন কর্পোরেশনের এই হোটেলটার প্রায় পুরোটাই এখন আমাদের দখলে। বড় বড় একেকটা রুমে
আটটি করে বিছানা। ডিপার্টমেন্টের প্রায় সব ছাত্র-ছাত্রী চলে এসেছি আজ এখানে। আমাদের
সাথে এসেছেন অরুনস্যার, হারুনস্যার, শংকরলালস্যার আর হামিদাবানুম্যাডাম। স্যার-ম্যাডামদের
জন্য আরো ভালো রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্যার-ম্যাডামরা নিজেদের রুমে চলে গেছেন একটু
আগে। মেয়েরাও সবাই চলে গেছে যার যার রুমে। আমরা বসে পড়েছি রুমের বাইরে বারান্দার ফ্লোরে।
আগস্ট মাসে যেরকম গরম পড়ার কথা, এখন বৃষ্টি হচ্ছে বলে সেরকম গরম নেই, মশা-মাছিও নেই।
ফাইনাল পরীক্ষা সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরে সরে যেতেই আমাদের
হঠাৎ পাখা গজিয়ে গেল। জানা গেল ঢাকা-সফর শেষে আমাদের কিছু টাকা বেচে গেছে। সুতরাং সেই
টাকা খরচ করে ফেলতে হবে। কীভাবে? শাকিল বললো, “আরেকটা শিক্ষা-সফরে যেতে হবে।“
“মাফ চাই ভাই। আর শিক্ষা-সফরের দরকার নেই। পিকনিক করতে চাও
তো রাজি। ব্যানারে শিক্ষাসফরের বদলে আনন্দভ্রমণ লেখ। অবশ্যই যাবো।“
ব্যানার বদলানো হলো। যা টাকা বেচেছিলো তাতে এক দিনের সফর
হয়। সেটাকে দুদিনের সফর করার জন্য মাথাপিছু দেড়শো টাকা চাঁদা দিতে হলো।
পরীক্ষা নাও পেছাতে পারে এই আশংকায় কিছুদিন বইখাতার সাথে
সম্পর্কটা যথাসম্ভব দৃঢ় করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষা আরো দু’মাস পিছিয়ে গেছে
জানতে পারার পর সেই সম্পর্ক আবার শিথিল হয়ে গেল। এবং সেই শিথিলতা এখনো চলছে।
আগস্টের সাত তারিখ অর্থাৎ আজ সকালে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে
দুইটি বাসভর্তি হয়ে আমরা ইউনিভার্সিটি থেকে কক্সবাজারে চলে এলাম।
সোবহানস্যার এরকম সময়ে আমাদেরকে পিকনিক করার অনুমতি দিতে
চাননি। কিন্তু হামিদাবানুম্যাডামের কারণে শেষপর্যন্ত অনুমতি দিয়েছেন। আমাদের অনেকেই
পরীক্ষার আগে পিকনিকে আপত্তি তুলেছিল। অনেকে আসেওনি। যীশু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে
পারেনি তার বাসায় একটা অনুষ্ঠান থাকার কারণে। কিন্তু এটাই আমাদের ছাত্রজীবনের শেষ পিকনিক।
এরপর আমরা সবাই আবার একসাথে হবার সুযোগ আর নাও পেতে পারি। পরীক্ষার পর কে কোথায় ছিটকে
যাবো তার কোন ঠিক নেই। মনের ভেতর এরকম একটা হারাই-হারাই অনুভূতি কাজ করছে। তাই প্রতিটা
মুহূর্তই খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।
এখানে কোন নির্দিষ্ট প্ল্যান নেই। আগামীকাল সন্ধায় চলে যাবার
আগপর্যন্ত কোন নিয়মের বাধ্যবাধকতা নেই। যার যেরকম খুশি ঘুরে বেড়াতে পারি। বেড়াতে এসে
সময়সূচির বারাবাড়ি রকমের কড়াকড়ি থাকলে কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। এবার তা নেই, তাই বেশ
আরাম লাগছে।
খাওয়াদাওয়ার পর অনেকেই ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের মতো
বের হয়ে গেল। আমরা চললাম সৈকতের দিকে। সমুদ্রসৈকত হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ঝিনুকমার্কেটের
কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম মেয়েরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবাই দলবেঁধে শপিং করতে বের হয়েছে।
কিন্তু মার্কেটে না ঢুকে সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কেন?
না, ঠিক দাঁড়িয়ে নেই, রিক্সা ঠিক করছে।
“কি রে, কই যাস তোরা?” – রিনা আর লিপিকে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস
করলাম।
“জেসমিনের বাসায়।“
“জেসমিনের বাসা এখানে?”
“ঝাউতলার ওদিকে। ওর শ্বশুরবাড়ি।“
“আমাদেরকে ফেলে যাচ্ছিস?”
“যাবি তোরা? এভাবে হাফ-প্যান্ট পরে?“
তাই তো। সমুদ্রে নামার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছি। এভাবে কারো
শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া যায় না।
জেসমিনদের বাসা ঝাউতলার ভেতরে। ওদিকের রাস্তা ছোট, বাস যাবে
না। নইলে বাস নিয়ে যেতে পারতো। এখন রিকশায় যেতে হবে। দশ বারোটা রিকশার দরকার। ততটা
রিকশা একসাথে পাওয়া যাচ্ছে না। যেটা পাওয়া যাচ্ছে সেটাতে দু’জন করে উঠে যাচ্ছে। দিলারা
আর ডল আপা দাঁড়িয়েছিল কাছাকাছি। একটা রিকশা আসতেই দিলারা উঠে বসার পর ডল আপা উঠে বসতেই
হিসসস করে একটা শব্দ হলো। রিকশার পেছনের চাকার হাওয়া বের হয়ে গেল। এরকম পরিস্থিতিতে
‘লাফিং ডিজিজ’ মহামারির রূপ নেয়। প্রদীপ নাথ আর আমি হাসি সামলাতে পারি না সেটা জানা
কথা। কিন্তু লিপি যে হাসতে হাসতে রাস্তায় বসে পড়বে তা চিন্তাও করিনি।
বৃষ্টি একটু থেমেছিল, আবার শুরু হলো। মেঘবৃষ্টি উপেক্ষা করে
সৈকতের দিকে রওনা দিলাম। লোকজন তেমন নেই। ভাটার টানে পানি নেমে গেছে অনেকদূর। ভেজা
বালিতে পা ফেলে হাঁটলাম অনেকদূর। ঝিনুকরা ফুটবল নিয়ে এসেছে।
সমুদ্র তার বিশালত্ব দিয়ে খুব কঠিন ধরনের মানুষকেও উদার করে
দেয় সন্দেহ নেই। নইলে যে অরুনস্যারকে আমরা এত ভয় পাই – তিনি আমাদের সাথে ফুটবল খেলতে
শুরু করেন কীভাবে। অরুনস্যার আমাদের ক্লাস খুব বেশি নেননি। যে ক’টা নিয়েছিলেন – প্রচুর
বকাবকি করেছিলেন। কিন্তু এখন তাঁকে ততটা কড়া মনে হচ্ছে না। শুধুমাত্র ডিপার্টমেন্টে
দেখে স্যার-ম্যাডামদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যায় না।
শুধুমাত্র স্যার-ম্যাডামদের কথা বলছি কেন। শুধুমাত্র ডিপার্টমেন্টে
এবং ক্লাসে দেখে ক্লাসমেটদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও কি পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যায়? ক্লাসে
প্রায় প্রতিদিনই একই ধরনের ঘটনা ঘটে বলে আমরা সবাই পরস্পরের সাথে প্রায় একই ধরনের ব্যবহার
করি। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছাড়া কয়জন সহপাঠীর ব্যক্তিগত জীবনের খবর রাখি আমরা? রাখা তো সম্ভব
নয়। কোনো একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তার হলের রুমমেট যতটুকু জানে, তার প্রেমিক
কিংবা প্রেমিকাও ততটুকু হয়তো জানে না। ভালোবাসার বিশেষ মানুষের সাথে দেখা করার সময়টাকে
আকর্ষণীয় করে তোলার একটা সযত্ন প্রয়াস থাকে। সেখানে কিছুটা হলেও কৃত্রিমতা থাকে, মন
জয় করার জন্য কিছুটা হলেও অভিনয় থাকে।
বন্ধুদের সাথে পিকনিকে গেলে বিভিন্ন ঘটনার সাথে, বিভিন্ন
মানুষের সাথে তাদের ব্যবহারের ভেতর দিয়ে বোঝা যায় তাদের ব্যক্তিত্বের স্বরূপ।
সন্ধ্যাবেলা শপিং-এ যাবার জন্য একটা বাস ঠিক করে রাখা হয়েছিল।
পৌনে আটটার দিকে সেটাতে উঠে বসলাম। সম্ভবত আটটায় বাস ছাড়ার কথা। তখনো মিনিট দশেক বাকি।
অনেকেই আসেনি তখনো। কিন্তু হারুন হঠাৎ ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া লাগিয়ে দিলো। ঘটনাটি আমার
চোখের সামনে না ঘটলে আমি বিশ্বাস করতে চাইতাম না যে আমার একজন সহপাঠী একজন বাস-চালকের
সাথে এতটা দুর্ব্যবহার করতে পারে। হারুন বাসে উঠেই অর্ডার করলো, “হেই ড্রাইভার, গাড়ি
স্টার্ট দাও।“ ড্রাইভার চুপচাপ বসে আছেন দেখে হারুন রেগে গেলো। “হেই, কথা কানে যায়
না? স্টার্ট দিতে বললাম না?”
“শাকিলসাহেব আসুক আগে।“
“হু ইজ শাকিল?” তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো হারুন। মুহূর্তেই ড্রাইভারকে
তুই-তোকারি শুরু করলো সে। “তোকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। ইডিয়ট!” আমরা বাসে যারা ছিলাম
সবাই হতভম্ব হয়ে গেলাম। একজন বয়স্ক ড্রাইভারকে কোন কারণ ছাড়াই এভাবে বকাবকি করার কারণ
কী? শাকিল এই গাড়ি ঠিক করেছে। ড্রাইভার তো শাকিল ছাড়া আর কাউকে চেনেন না। আমার খুবই
লজ্জা লাগছিলো। ড্রাইভার বাস থেকে নেমে দূরে গিয়ে তাঁর সহকারির সাথে কথা বলছেন।
ফারুক, প্রদীপ নাথ আর আমি নেমে ড্রাইভারের কাছে গেলাম। ভাষার
একটা নিজস্ব শক্তি আছে। ভাষার ব্যবহারের উপর নির্ভর করে এই শক্তি। আর যে কোন অঞ্চলে
সেই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আলাদা একটা কদর আছে। ড্রাইভারের সাথে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক
ভাষায় কথা বলে অনেক দুঃখপ্রকাশ করে তার অপমান দূর করার চেষ্টা করলাম। শাকিল আসার পর
বাস ছাড়লো।
হারুনকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল সে কেন এমন করছে। ঢাকায় গিয়েও
সে অমলকে মেরেছিল, বাজে গালাগালি করেছিল। এখানে এসেও এরকম করছে। আরো অনেক সহপাঠীর সাথেও
সে খারাপ ব্যবহার করেছে। প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস তার জেলার মানুষ। সেও বিএনপি
করে – সেই কারণেই কি? নাকি এবারের পিকনিক কমিটিতে তাকে রাখা হয়নি সেই কারণে!
রাতের খাবারের পর হোটেলে এসে স্যার-ম্যাডামরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা
বললেন আমাদের সাথে। হারুণস্যার ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছেন ১৯৯০ সালে। দেড় বছর হয়ে গেলেও
আমাদের ব্যাচের কোন ক্লাস তিনি নেননি এখনো। পাস করেই যোগ দিয়েছেন। পূর্ব-পরিচিত হলে
আমরা তাঁকে হারুনভাই বলতে পারতাম। কিন্তু তাতে কি তিনি রেগে যেতেন? শুনেছি অনেকে নাকি
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হবার সাথে সাথেই তার বন্ধুদের কাছ থেকেও ‘স্যার’ ডাক আশা করেন।
গানের আসর শেষ হয়ে এলো। মানস চক্রবর্তীর গলার তেজ কমে এসেছে।
সারাদিনে কম শক্তিক্ষয় হয়নি।
পরদিন সূর্য উঠার আগেই বিচে চলে গেলাম। এই বিচ থেকে সূর্যোদয়
দেখা যায় না। গতকাল মেঘের কারণে সূর্যাস্তও দেখা যায়নি। আজ মেঘ না থাকলে সূর্যাস্ত
দেখে তারপর রওনা দেবো এরকম প্ল্যান আছে।
ভোরবেলা অনেকেই চলে এসেছে। পানিতে নেমে গেলাম সবাই। হামিদাবানুম্যাডাম
এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। এমন রাশভারী ম্যাডামকেও দেখলাম পানিতে নেমে শিশুদের মতো
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে। যীশু না আসাতে তার ক্যামেরাও আসেনি। কিন্তু অনেকের হাতে হাতে ক্যামেরা।
প্রচুর ছবি ওঠানো হলো, বিশেষ করে ম্যাডামের ছবি। কিন্তু এই ছবিগুলিকে যে একটা গোষ্ঠী
ম্যাডামের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে তা তখন ধারণাও করতে পারিনি।
সকালে নাস্তা করার পর একটা জিপ ভাড়া করে হিমছড়িতে গেলাম রিনা,
সুপর্ণা, দিলীপ, প্রদীপ নাথ, রাহুল, মোছাদ্দেক, ঝিনুকসহ আরো অনেকে মিলে। ওখান থেকে
ফিরে দুপুরের খাবার খেতে খেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু
বৃষ্টি না হলেও আকাশে অনেক মেঘ। মেঘগুলি সূর্যাস্তের রঙে একটু রঙিন হলো – এছাড়া সূর্যাস্তের
আর কোন আভাস দেখতে পেলাম না। সহপাঠীদের সাথে মিলে একসাথে শেষ সূর্যাস্ত দেখাটা হলো
না।
দুটো গাড়ি একই সাথে রওনা দিলো। আমাদের গাড়ি আগে। রাস্তা খালি
পেলেই গাড়ির গতি কেন অকারণে বাড়িয়ে দেয়া হয় জানি না। বর্ষাকালের ভেজা রাস্তা, তার উপর
বৃষ্টি হচ্ছে। কেমন যেন ভয় লাগতে শুরু করে। সবার সামনের সিটে বসেছেন অরুনস্যার আর হারুনস্যার।
শংকরলালস্যার আর হামিদাবানু ম্যাডাম কক্সবাজারে রয়ে গেছেন। কক্সবাজারে পোস্টার দেখেছি
গণফোরামের মিটিং আছে। ডক্টর কামাল হোসেন সম্প্রতি গণফোরাম গঠন করেছেন আওয়ামী লীগ থেকে
বের হয়ে এসে। কমিউনিস্ট পার্টির সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক যোগ দিয়েছেন তাঁর সাথে। হামিদাবানু
ম্যাডাম গণফোরামে যোগ দিয়েছেন কিনা জানি না, তবে তাদের জনসভায় ম্যাডামের ভাষণ দেয়ার
কথা আছে।
অরুনস্যার আর হারুনস্যারকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করতেই
স্যাররা একের পর এক গান গাইতে শুরু করেছেন। অরুনস্যার রাশিয়ান গান গাইলেন। সুযোগ পেলেই
আমরা স্যার-ম্যাডামদেরকে গান গাইতে বলি কেন? গান যদি তাঁরা না-ও জানেন, তবুও আমরা জোর
করি। কারণটা কী? হতে পারে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের চেয়ে আমরা গানকে উপভোগ করি বেশি। নাকি
গান উপভোগ করাটা সহজ? আসলেই কি? আমার তো মনে হয়, অনেক বছর পড়াশোনা করলে যে কারো পক্ষেই
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বোঝা সম্ভব। কিন্তু যার গলায় সুর নেই, তার পক্ষে কি অনেক বছর চেষ্টা
করলেও গান শেখা সম্ভব?
এতসব চিন্তা করার মাঝখানেই হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল রাস্তার মাঝখানে।
কোন্ জায়গা এটা? রাস্তার দুপাশে ঘন বন। রামুর পরে চিরিঙ্গা পার হয়ে এসেছি মাত্র। এখানে
মাঝেমাঝে ডাকাতি হয় শুনেছি। ঘটনা কী? গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। এই গাড়ি যাবে না। সবাইকে
নামতে হবে। আমাদের পেছনের গাড়ি এলো আরো আধঘন্টা পর। ওইটাতে গাদাগাদি করে উঠলাম সবাই।
ভয়ে ভয়ে ছিলাম এতগুলি মানুষ নিয়ে গাড়ির চাকা না বাস্ট হয়ে
যায় – দিলারা আর ডল আপার রিক্সার মতো। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। কিন্তু পটিয়ার কয়েক
কিলোমিটার আগে চক্রশালা অতিক্রম করার পরপরই গাড়ির হেডলাইট নিভে গেল। আরাকান রোডে অন্ধকারে
হেডলাইট ছাড়া গাড়ি চালানো মানে যে কোন সময় অন্য গাড়ি এসে ধাক্কা দেয়ার সম্ভাবনা। অনেক
ধুকে ধুকে আস্তে আস্তে পটিয়া এসে একটা মেকানিক্যাল শপ থেকে হেড লাইট ঠিক করিয়ে শহরে
আসতে আসতে রাত একটা বেজে গেল। ক্যাম্পাসে যেতে আরো চল্লিশ মিনিট।
ক’দিন পরে ডিপার্টমেন্টে দিলারাকে দিয়ে হামিদাবানুম্যাডাম
খবর পাঠালেন দেখা করার জন্য। গেলাম তাঁর অফিসে। ম্যাডাম বললেন, “তোমার কাছে কি কক্সবাজারের
কোন ছবি আছে? সেখানে আমার যদি কোন ছবি থাকে সেগুলি আমাকে একটু দিও তো।“
জানলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ডানপন্থী শিক্ষকরা একজোট হয়েছেন হামিদাবানুম্যাডামের
বিরুদ্ধে। তাঁদের অভিযোগ – ম্যাডাম নাকি কক্সবাজারে গিয়ে ছাত্রদের সাথে ‘অশালীন’ পোশাকে
সমুদ্রে নেমেছেন!
কতটা জঘন্য মানসিকতার মানুষ হলে এরকম কথা বলতে পারেন কোন
বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক। ম্যাডাম পুরো সালোয়ার-কামিজ-ওড়না পরে সমুদ্রে নেমেছিলেন তাঁর
সন্তানের মতো ছেলে-মেয়েদের সাথে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আমাদের ভেতর থেকে কে সরবরাহ
করেছে ম্যাডামের ছবি? ম্যাডামের কাছাকাছি থেকে ম্যাডামের ছবি তুলে সরবরাহ করার বিশেষ
দায়িত্ব নিয়ে কে এসেছিল আমাদের সাথে?
No comments:
Post a Comment