Saturday 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৬

সূর্যের গঠন

এই যে এত বড় সূর্য, তার গঠন কীরকম? সূর্য কী দিয়ে তৈরি, সূর্যে কী কী আছে তা পৃথিবী থেকে সরাসরি বলা সম্ভব নয়। টেলিস্কোপের সাহায্যে সূর্যের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা করে, তথ্য ও তত্ত্বের সমন্বয়ে মানুষ নিশ্চিত হয়েছে যে সূর্য প্রধানত তিন স্তরের গ্যাস দিয়ে তৈরি।
            নিচের ছবিতে সূর্যের একটি প্রস্থচ্ছেদের চিত্র দেয়া হলো তোমাদের বোঝার সুবিধার্থে। সূর্যের ভেতরে রয়েছে গ্যাসের অনেকগুলো স্তর। যদিও একটা থেকে আরেকটার মধ্যে তেমন নির্দিষ্ট করে কোন বিভাজন নেই, তবুও প্রত্যেকটি স্তরের আলাদা আলাদা কাজ আছে।


চিত্র: সূর্যের প্রস্থচ্ছেদ


সূর্যের প্রধানত দুটো অংশ। ভেতরের অংশ এবং বাইরের অংশ। ভেতরের অংশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। সবচেয়ে কেন্দ্রে (core) আছে মূল পিন্ড। তাকে ঘিরে আছে রেডিয়েটিভ জোন (radiative zone) বা বিকিরণ অঞ্চল। বিকিরণ অঞ্চলকে ঘিরে আছে কনভেকশান জোন (convection zone) বা পরিচলন অঞ্চল।
            বাইরের অংশে আছে গ্যাসের তিনটি স্তর। এই অংশকে সূর্যের আবহাওয়ামণ্ডল বলে ধরে নেয়া যায়। এই অংশের সবচেয়ে ভেতরের স্তর হলো ফটোস্ফিয়ার (photosphere) বা আলোকমণ্ডল যা পরিচলন অঞ্চলকে ঘিরে থাকে। আলোকমণ্ডলকে ঘিরে আছে ক্রোমোস্ফিয়ার (chromosphere) বা বর্ণমণ্ডল। আর সবচেয়ে বাইরের স্তর হলো কোরোনা (corona) বা কিরীট যা সূর্যের উপরিতল।

চিত্র: সূর্যের গঠন


সূর্যের কেন্দ্র

সূর্যের কেন্দ্র হলো সবচেয়ে উত্তপ্ত অংশ। তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের আয়তনের এক চতুর্থাংশ বা শতকরা পঁচিশ ভাগ জুড়ে এই কেন্দ্র। খুবই ঘন উত্তপ্ত গ্যাস এখানে। ফলে কেন্দ্র খুব ভারী হয়। আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ হলেও ভরের প্রায় শতকরা পঞ্চাশ ভাগ এই কেন্দ্রে। সূর্যের সব শক্তিই আসে এই কেন্দ্র থেকে। সূর্যের কেন্দ্র বা কোর হলো একমাত্র এলাকা যেখানে সূর্যের শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তি কীভাবে উৎপন্ন হয় তা একটু পরেই বলছি।


সূর্যের বিকিরণ অঞ্চল



চিত্র: সূর্যের বিকিরণ অঞ্চল থেকে ভেদ করে আলো আসছে পৃথিবীর দিকে

কেন্দ্রের বাইরের স্তর হলো রেডিয়েটিভ জোন বা বিকিরণ অঞ্চল। এই অঞ্চল গামা রশ্মিতে পূর্ণ। সূর্যের এক তৃতীয়াংশ আয়তন নিয়ে এই অঞ্চল। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় ৫০ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের কেন্দ্রে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা এই অঞ্চল দিয়ে বাইরে যায়। শক্তি রশ্মি বা তরঙ্গ আকারে প্রবাহিত হয়। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বা তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের আকারে শক্তিগুলো যায়। ঘন গ্যাসের সাথে মিথষ্ক্রিয়ার ফলে শক্তি প্রবাহের হার এখানে খুবই ধীরে হয়। ৩০ হাজার বছর থেকে এক লাখ বছর লেগে যায় সূর্যের শক্তির এই অঞ্চল ত্যাগ করতে।
            গামা রশ্মি আকারে উৎপন্ন শক্তিগুলো এখানে ঘুরপাক খেতে খেতে লম্বা তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট দৃশ্যমান আলোতে পরিণত হয়। (আমরা গামা রশ্মি দেখতে পাই না। কিন্তু যে আলো দেখতে পাই তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য গামা রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি)। কিন্তু তারপর মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে আসতে শক্তির লাগে মাত্র কয়েক মিনিট (আট মিনিট ২৬ সেকেন্ড)।


সূর্যের পরিচলন অঞ্চল

চিত্র: সূর্যের পরিচলন অঞ্চল

বিকিরণ অঞ্চলের পরের স্তর হলো কনভেকশান জোন বা পরিচলন অঞ্চল। এই অঞ্চলে সূর্যের তাপমাত্রার কিছুটা উঠানামার কারণে আগুনের ঢেউ থাকে। তাপমাত্রা এখানে গড়ে প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শতকরা ৫০ ভাগেরও বেশি আয়তন নিয়ে এই অঞ্চল। এখানে শক্তি সঞ্চালিত হয় প্লাজমার পরিচলনের মাধ্যমে। পাত্রে পানি ফুটতে দিলে যেভাবে গরম পানি উপরের দিকে উঠে এসে ঠান্ডা পানির অণু নিচে নেমে আসে সেভাবে। এই অঞ্চলে শক্তি সঞ্চালন ঘটে অনেক দ্রুত। এই অঞ্চল থেকে শক্তি সঞ্চালিত হয়ে ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমন্ডলে আসতে সপ্তাহ খানেক সময় লাগে।

সূর্যের আলোকমণ্ডল

চিত্র: সূর্যের আলোকমণ্ডল

সূর্য যেহেতু কঠিন বস্তু নয় - গ্যাসের পিন্ড, তাই সূর্যের কোন কঠিন আবরণ নেই। যে আবরণটি আছে তা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পুরু গ্যাসের স্তর। এই স্তরটিই হলো ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমণ্ডল যেটাকেই মূলত আমরা দেখি যখন সূর্যের দিকে তাকাই। আলোকমণ্ডল থেকে সূর্যের শক্তি আলোর আকারে বেরিয়ে আসে। এখানকার তাপমাত্রা গড়ে এগারো হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। সূর্যের বাইরের দিকে এর তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
            আলোকমণ্ডল খুবই স্বচ্ছ। এর মধ্য দিয়ে সূর্যের শক্তি তাপ ও আলোর আকারে ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে। সূর্যের দিকে তাকালে সূর্যকে যে ফুটন্ত গ্যাসপিন্ডের মত মনে হয় তার কারণ ফটোস্ফিয়ারের ভেতর দিয়ে আমরা সূর্যের পরিচলন অঞ্চলকে দেখতে পাই।

সূর্যের বর্ণমণ্ডল

চিত্র: সূর্যের বর্ণমণ্ডল


আলোকমন্ডলের বাইরের স্তরের নাম হলো ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল। এই স্তর সূর্যের আবহাওয়ামন্ডলের ভেতরের স্তর। শুধুমাত্র পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় এই স্তরের দেখা পাওয়া যায়। এই স্তরের তাপমাত্রাও প্রায় ১১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পুরুত্ব প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে আলোকমণ্ডল থেকে শুরু করে মহাশূন্যের দিকে ৫০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে এই অঞ্চল। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে প্লাজমার ঢেউ কোরোনা বা কিরীটে উঠছে নামছে অবিরত। শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে তা দেখা যায় পৃথিবী থেকেই।


সূর্যের কিরীট

 
চিত্র: সূর্যের কিরীট


ল্যাটিন শব্দ 'কোরোনা' ইংরেজি শব্দ ক্রাউন (crown) অর্থাৎ মুকুট বা কিরীটের সমতুল্য। জ্বলন্ত কোন চাকতির চারপাশে একটি বৃত্তের জন্য এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়। চাঁদ সূর্য এসবের ক্ষেত্রে এই শব্দটা প্রযোজ্য। কারণ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যকে সেরকম দেখায়।
            সূর্যের সবচেয়ে বাইরের স্তর হলো কোরোনা বা কিরীট। সূর্যের আবহাওয়ামন্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তর এই কোরোনা। ক্রোমোস্ফিয়ারের মতো এটাও শুধুমাত্র পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায়। এর তাপমাত্রা প্রায় ১৭ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে শুরু হয়ে মহাশূন্যের মধ্যে প্রায় এক কোটি কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই কিরীট। এখানে খুব সামান্য পরিমাণ প্লাজমা আছে। এর বাইরের অংশ প্রায়ই সৌরঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায়। 
___________

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts