Saturday 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৭



সূর্যের শক্তির উৎস

আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে আছে সূর্য যা একটি প্রকান্ড আকারের গ্যাসপিন্ড। এই পিন্ড থেকে অনবরত শক্তি নির্গত হচ্ছে। সূর্য জ্বলছে কীভাবে বা সূর্য থেকে কীভাবে আলো ও তাপ পাই, সূর্য নিজে এত শক্তি কোত্থেকে পায় তা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শুরু সেই অনেক কাল আগে থেকে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ও তথ্য এবং পরীক্ষালব্ধ জ্ঞান যখন বাড়তে শুরু করেছে, সূর্যের শক্তির উৎস সম্পর্কেও বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও প্রমাণ দেয়া শুরু হয়েছে।
            নিউক্লিয়ার ফিউশান (nuclear fusion) প্রক্রিয়ায় সূর্যের শক্তি উৎপন্ন হয়। সূর্যকে একটি হাইড্রোজেন বোমার সাথে তুলনা করা যায়। ১৯০৪ সালে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড সর্বপ্রথম ধারণা দেন যে সূর্যের শক্তি আসে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে। তার মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকোয়ারেল পদার্থের তেজষ্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছেন।
            সূর্যসহ সব নক্ষত্র নিজের শক্তি নিজে তৈরি করে। নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমেই এই শক্তি উৎপন্ন হয়। নিউক্লিয়ার ফিউশনে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণু যোগ হয়ে একটা হিলিয়াম পরমাণুর সৃষ্টি হয় এবং কিছু শক্তির সৃষ্টি হয়। এরকম কোটি কোটি হাইড্রোজেন পরমাণু একই সঙ্গে হিলিয়াম পরমাণুতে রূপান্তরিত হয় বলে একই সাথে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় সূর্যে। এই শক্তিগুলোই বিকিরণের মাধ্যমে সূর্য থেকে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। যা আমাদের পৃথিবীতেও এসে পৌঁছায়। প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে যে শক্তি নির্গত হয় তা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে তা দিয়ে পৃথিবী এক হাজার বছর চলতে পারবে।
              
সুর্যের চার ভাগের তিন ভাগ হলো হাইড্রোজেন। তিন ধাপে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় সূর্যের শক্তি উৎপন্ন হয়। পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো নিচে দেয়া হলো।



চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদনের প্রথম ধাপ

প্রথম ধাপ: দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (প্রোটন) (1H) মিশে গিয়ে একটি ডিউটেরিয়াম (2H) নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। এই মিথষ্ক্রিয়ার ফলে একটি নিউট্রিনো এবং একটি পজিট্রন (পজিটিভ ইলেকট্রন) বের হয়ে আসে।  পজিট্রনটি সাথে সাথে একটি ইলেকট্রনের সাথে মিশে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। (এই মিথষ্ক্রিয়াকে এনাইহিলেশান বলে)। ইলেকট্রন-পজিট্রন মিশে গিয়ে পদার্থ শক্তিতে পরিণত হয়। দুটো গামা ফোটন আকারে শক্তি বেরিয়ে আসে এখান থেকে। ফোটনকে আলোর কণা হিসেবে ধরা হয়।

দ্বিতীয় ধাপ: ডিউটেরিয়াম নিউক্লিয়াস (2H) আরেকটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের (1H) সাথে মিশে হালকা হিলিয়াম (3He) তৈরি করে। গামা রশ্মি হিসেবে শক্তি নির্গত হয়। 

চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদনের দ্বিতীয় ধাপ


তৃতীয় ধাপ: সবশেষে দুটো হালকা হিলিয়াম (3He) নিউক্লিয়াসের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। ফলে একটা ভারী হিলিয়াম (4He) পাওয়া যায় এবং আর দুটো প্রোটন বা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস তৈরি হয়।


চিত্র: সূর্যের শক্তি উৎপাদন প্রক্রিয়ার তৃতীয় ধাপ


এই দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (প্রোটন) আবার প্রথম ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন করে আবারো দুটো প্রোটন নির্গত করে। এভাবে পর্যায়ক্রমিক বিক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। প্রতিবার বিক্রিয়ায় সূর্যের 0.7% ভর শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
            প্রতি সেকেন্ডে সূর্য ৫০০ মিলিয়ন মেট্রিক টন হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করে। ফিউশন পদ্ধতিতে প্রতি সেকেন্ডে ৫ মিলিয়ন টন অন্যান্য বস্তু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। তার মানে প্রতি বছর ১৫৭,৬৮০,০০০,০০০,০০০ মেট্রিক টন বস্তু শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। প্রতি সেকেন্ডে ১০২৭ ওয়াট শক্তি উৎপন্ন হয়। এই শক্তির এক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বা ১০১৮ ওয়াট (এক লক্ষ কোটি মেগাওয়াট) আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়। এই শক্তিতে বাংলাদেশের কতদিন চলবে হিসেব করে দেখো। বাংলাদেশে দৈনিক কত মেগাওয়াট বিদ্যুত-শক্তি লাগে জেনে নিয়ে সহজেই এই হিসেবটি তোমরা করতে পারো।


সূর্যের রাসায়নিক উপাদান

সূর্যে যে সমস্ত মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তাদের পরিমাণ ও শতকরা হিসাবের একটি তালিকা নিচে দেয়া হলো।

মৌল
ভরের শতকরা হার
(%)
মোট পরিমাণের শতকরা হার (%)
হাইড্রোজেন
73.46
92.1
হিলিয়াম
28.85
7.8
অক্সিজেন
0.77



0.1
কার্বন
0.29
লোহা
0.16
নিয়ন
0.12
নাইট্রোজেন
0.09
সিলিকন
0.07
ম্যাগনেসিয়াম
0.05



সূর্যের দরকারি মান

নিচের সারণিতে সূর্যের কিছু দরকারি মান দেয়া হলো। (সূর্যমামা বলেছেন এগুলো মুখস্থ করার কোন দরকার নেই। যখনই যে মান লাগবে বই খুলে সারণি থেকে দেখে নিলেই হবে। সত্যিকারের বিজ্ঞান শিখতে গেলে বড় বড় সংখ্যা বা ধ্রুবকের মান মুখস্থ করার দরকার পড়ে না। তবে মানগুলোর তাৎপর্য বুঝতে হবে।)

বৈশিষ্ট্য
বৈজ্ঞানিক মান
প্রচলিত মান
পৃথিবী থেকে দূরত্ব
149.6 x 106 km
প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার
ব্যাস
1,392,530 km
প্রায় চৌদ্দ লক্ষ কিলোমিটার
আয়তন
1.41 x 1018 m3
পৃথিবীর আয়তনের প্রায় তের লক্ষ গুণ
ভর
1.9891 x 1030 kg
প্রায় ২০০ কোটি কোটি কোটি কোটি কিলোগ্রাম
পুরো সূর্য থেকে বিকিরণ
3.83 x 1023 kW
৩৮৩ কোটি কোটি কোটি কিলোওয়াট
ফটোস্ফিয়ার থেকে বিকিরণ
6.29 x 104 kW/m2
প্রতি বর্গমিটারে ৬৩ মেগাওয়াট
পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে বিকিরণ এসে পৌঁছায়
1368 W/m2
প্রতি বর্গমিটারে ১৩৬৮ ওয়াট

________________

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts