Saturday 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৩



সূর্য ওঠার আগে

মহাবিশ্বের উদ্ভব কীভাবে হয়েছে সে ব্যাপারে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এখন অনেকখানি নিশ্চিত। অবশ্য পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া সেদিনই সম্ভব হবে যেদিন পরীক্ষাগারে মহাবিশ্বের একটি নমুনা তৈরি করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীরা সে ব্যাপারেও অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সেই প্রসঙ্গে আমরা অন্যসময় আলোচনা করবো। এখন দেখা যাক সূর্যের উৎপত্তির আগে কী ছিল। সোজা কথায় সূর্য ওঠার আগে কী ছিল মহাবিশ্বে। তোমরা আবার ভাবছো না তো যে সূর্য ওঠার আগে রাত ছিল? হতে পারে। অনন্ত দীর্ঘ রাত। কারণ সূর্য বা নক্ষত্রগুলো মহাবিশ্বের আলোর উৎস, ওগুলো যখন ছিল না তখন আলোক ছিল না, ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিঃসীম শূন্যতা।
            বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব অনুসারে আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ শত কোটি (চৌদ্দ বিলিয়ন) বছর আগে মহাশূন্যে প্রচন্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে। বিস্ফোরণের আগে কোন পদার্থেরই কোন অস্তিত্ব ছিল না। সবকিছুই ছিল একটা প্রচন্ড শক্তির মিশ্রণ। যেখানে প্রকৃতির সবগুলো মৌলিক বল - মহাকর্ষ বল, সবল নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল সব মিলেমিশে একাকার হয়ে ছিল। বিস্ফোরণের পরপর প্রচন্ড উত্তপ্ত মহাবিশ্ব তাপ বিকিরণ করতে করতে দ্রুত ঠান্ডা হতে থাকে। নিচের ছবিটা দেখলে বুঝতে পারবে।


চিত্র: মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও সময়ের পরিবর্তন
            
ছবির উপরের দিকের অক্ষে সেকেন্ডের এককে সময়ের স্কেল দেয়া আছে যা ক্রমশ বাড়ছে, আর নিচের দিকের অক্ষে ইলেকট্রন-ভোল্টের এককে শক্তির স্কেল দেয়া আছে যা সময়ের সাথে ক্রমশ কমছে।
            ইলেকট্রন ভোল্ট (eV) হলো শক্তির একটা প্রচলিত একক যা মাপা হয় একটা ইলেকট্রনের এক ভোল্ট পরিমাণ বিভব বা বৈদ্যুতিক চাপ সহ্য করতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তার ভিত্তিতে।
            মহাবিস্ফোরণের তিন মিনিটের মধ্যেই শক্তি কমে গিয়ে ১০১৯ GeV বা ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০ এক লক্ষ কোটি কোটি বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট থেকে মাত্র এক মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টে নেমে আসে।      এখানে যে GeV, MeV, keV  ইত্যাদি একক ব্যবহার করা হয়েছে তা কি তোমরা বুঝতে পারছো? বিজ্ঞানের এককের এই মাত্রাগুলো জেনে রাখলে বিজ্ঞান বুঝতে অনেক সহজ হবে। নিচের তালিকায় একটা হিসাব দেয়া হলো তোমাদের বুঝার সুবিধার জন্য।

একক
প্রতীক
মান
 দশমিক মান
অটো
a
১০-১৮
0.000000000000000001
ফেমটো
f
১০-১৫
0.000000000000001
পিকো
p
১০-১২
0.000000000001
ন্যানো
n
১০-৯
0.000000001
মাইক্রো
m
১০-৬
0.000001
মিলি
m
১০-৩
0.001
কিলো
k
১০
1000
মেগা
M
১০
1000000
গিগা
G
১০
1000000000
টেরা
T
১০১২
1000000000000
পিটা
P
১০১৫
1000000000000000
এক্সা
E
১০১৮
1000000000000000000


মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং ঘটার খুবই কম সময় পর্যন্ত (১০-৪৩ সেকেন্ড) মহাবিশ্বে ঘন পদার্থ ও প্রতি-পদার্থ (অ্যান্টি-মেটার), মহাকর্ষ, কোয়ার্ক, অ্যান্টি-কোয়ার্ক সব মিলেমিশে ছিল। তারপর সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল আলাদা হয়ে যায়। অ্যান্টি-মেটার, কোয়ার্ক, অ্যান্টি-কোয়ার্ক ইত্যাদি সম্পর্কে আরেকদিন বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে। আপাতত মনে রাখো যে এগুলো পদার্থ ও শক্তির খুবই মৌলিক উপাদান। কোয়ার্ক হলো এখনো পর্যন্ত জানা সবচেয়ে মৌলিক উপাদান যা পদার্থের নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন ভাঙলে পাওয়া যায়।
             মহাবিশ্বের বয়স যখন মাত্র এক লক্ষ ভাগের এক সেকেন্ড, তখনই দুর্বল নিউক্লিয়ার বল আলাদা হয়ে কোয়ার্ক ও বোসন কণার আলাদা অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। বোসন কণার নাম দেয়া হয়েছে আমাদের বিজ্ঞানী প্রফেসর সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম অনুসারে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় ১৯২৪ সালে বোসন কণা আবিষ্কার করেন। বোসন কণা যে বৈজ্ঞানিক নিয়ম মেনে চলে তাকে আইনস্টাইন ও সত্যেন বসুর যৌথ নাম অনুসারে বলা হয় বোস-আইনস্টাইন নিয়ম।
            মহাবিশ্বের বয়স মাত্র তিন মিনিট হওয়ার আগেই মহাবিশ্বের চারটি মৌলিক বল - মহাকর্ষ বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, সবল নিউক্লিয়ার বল ও তড়িৎচৌম্বক বল আলাদা হয়ে যায়। তখন এই বলগুলোর সাথে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি গঠিত হয়ে মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। তারপর হালকা মৌলিক পদার্থগুলো গঠিত হতে শুরু করে। সবচেয়ে হালকা মৌলিক পদার্থ হাইড্রোজেন গঠিত হয়। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হলো একটি প্রোটন। তারপর দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে গঠিত হলো হিলিয়াম। এভাবে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত গঠিত হতে থাকলো আরো সব মৌলিক পদার্থ।
            মহাবিশ্বের বয়স এক হাজার বছর থেকে এক শ' কোটি বছর হতে হতে মহাকাশ গঠিত হয়ে গেলো। সেই মহাকাশে বিশাল বিশাল গ্যালাক্সি। পরবর্তী কয়েক শ' কোটি বছর ধরে খুবই ধীর প্রক্রিয়ায় গঠিত হলো নক্ষত্রপুঞ্জ। রাতের আকাশে খালি চোখেও আমরা অসংখ্য নক্ষত্র বা তারা দেখি। ওগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই আমাদের সূর্যের চেয়ে আয়তনে বড়। কিন্তু অনেক বেশি দূরে বলে এত ছোট দেখায়। গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অসংখ্য নক্ষত্রের জন্মের সাথে আমাদের সূর্যেরও জন্ম হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৪৭০ কোটি বছর আগে।
            চলো এবার দেখি অনেক তারার ভীড়ে আমাদের নিজস্ব তারা - সূর্যের বিশেষত্ব কী এবং কীভাবে তার জন্ম হলো।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts