Saturday 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ২




সূর্য সম্পর্কে ধারণার বিবর্তন

পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষের মনে সূর্য সম্পর্কে এক ধরনের ভয় মেশানো সংস্কার দেখা যায়। অনেক ধর্মেও দেখা যায় সূর্যকে দেবতা বলে মানা হচ্ছে। তার কারণ কী জানো? প্রকৃতির অনেক বিবর্তন বা ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে মানুষের যখন উদ্ভব হয়েছে ততদিনে পৃথিবীটা মানুষের বাসযোগ্য হয়ে গেছে। গাছপালা ফলমূল পশুপাখি ইত্যাদি মানুষের অনেক আগেই পৃথিবীতে এসেছে। তাই পৃথিবীতে আবির্ভাবের পর পরই প্রকৃতির মাঝে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
            মানুষ উপরের দিকে চোখ তুলে দেখলো নীল আকাশ, মাঝে মাঝে সাদা-কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আর বড় থালার মতো একটা জ্বলজ্বলে আগুনের পিন্ড আকাশ থেকে আলো দিচ্ছে। অবশ্য তখন মানুষ থালা কী জিনিস জানতো না। আগুন কী জিনিস তাও জানতো না। মানুষ দেখলো আকাশে থালাটি থাকলে চারদিক আলোকিত হচ্ছে। আর একটা সময় পরে থালাটি একদিকে হারিয়ে যাচ্ছে। তখন নিকষ কালো অন্ধকার। প্রকৃতিকে দেখতে দেখতে মানুষ অনেক কিছু জেনে ফেললো। মানুষ এই জ্বলজ্বলে থালাটির নাম দিলো সূর্য। অবশ্য বাংলায় আমরা যাকে সূর্য বলছি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন নাম আছে এর। সূর্য যেদিকে উঠে সেই দিকটাকে পূর্বদিক বলে ধরে নিয়ে যেদিকে অস্ত যায় সেই দিককে পশ্চিম দিক বিবেচনা করা হলো। তারপর উত্তর দক্ষিণ সহ আমাদের আরো সব দিকের হিসেব করা হলো। দিনের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীপৃষ্ঠের সাথে সূর্যের অবস্থান বিবেচনা করে সময় মাপার ব্যবস্থা হলো।
            আগুন জ্বালানো শেখার আগপর্যন্ত মানুষ শুধু দিনের আলোতেই কাজ করতে পারতো। সূর্যের অনুপস্থিতিতে যখন সবদিক অন্ধকার হয়ে যায় তখন মানুষ ভয় পেয়ে সূর্যকে দেবতা বলে ডাকতে শুরু করলো। সূর্যদেবের প্রার্থনা শুরু করলো যেন অন্ধকার দূর করে দেয়। যখন রাতের শেষে সূর্য উঠে তখন মানুষের অন্ধকারের ভয়ও কেটে যায়। এভাবে দিন-রাত্রির জ্ঞান হবার পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের সংস্কার চালু হয়ে গেলো সূর্যের নামে যা এখনো বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে বর্তমান।
            মানুষ বেঁচে থাকার জন্য শিকার করা শিখলো, আগুন জ্বালাতে শিখলো। আর অজানাকে জানার ইচ্ছে তৈরি হলো মানুষের মনে। সেই ইচ্ছে থেকেই আসলে সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের শুরু। মানুষ শুরুতে অনেক রকমের ধারণা করতে শিখলো। পরে সেই ধারণার সত্যতা বা অসত্যতা প্রমাণের মাধ্যমে অজানাকে জানতে শুরু করলো।
            পৃথিবী থেকে মহাশূন্যের দিকে তাকালে আমাদের দৃষ্টিসীমা যেখানে থেমে যায় সেটাকেই যে আমরা আকাশ বলছি। সেই ধারণাও আমরা পেয়েছি আকাশ দেখতে শুরু করার অনেক অনেক বছর পরে। আগে মানুষ আকাশকে মনে করতো পৃথিবীর ছাদ। মানুষ ভাবতো সেখানেই দেবতাদের বাস। তাই তোমরা দেখবে এখনো বিভিন্ন ধর্মে যে স্বর্গ-নরক বেহেশ্‌ত-দোজখ ইত্যাদির ধারণা দেয়া হয় তার সবকিছুই আকাশের উপরে রয়েছে বলে বলা হয়। অবশ্য বিজ্ঞানীরা আকাশে এত অভিযান চালিয়েও সেসবের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।
            আকাশ, তারা, সূর্য, গ্রহ, চাঁদ ইত্যাদি দেখতে দেখতে মানুষ আবিষ্কার করলো যে প্রকৃতির মধ্যে সবকিছুই একটা ধারাবাহিক ছন্দ মেনে চলে। প্রতিদিনই সূর্য পূর্ব আকাশে দেখা দিয়ে আস্তে আস্তে পশ্চিম আকাশের দিকে গিয়ে এক সময় হারিয়ে যায়।
            যখন পূর্বাকাশে সূর্য ওঠে তখন তার রঙ থাকে টকটকে লাল, তারপর আস্তে আস্তে হলুদ হয়, তারপর উজ্জ্বল হতে হতে দুপুরে এমন সাদা হয় যে তার দিকে সরাসরি তাকাতে গেলে চোখে যন্ত্রণা হয়। বেশিক্ষণ তাকানোই যায় না। তখন তাপমাত্রাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। আবার সন্ধ্যায় সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে তখন যেন আস্তে আস্তে সকালের রঙ ধারণ করে সূর্য।
            সূর্যের এই রঙ পরিবর্তনেও ছন্দ খুঁজে পেলো মানুষ। আবার ঋতুপরিবর্তনে দেখলো বছরের কোন সময়ে খুব বৃষ্টি হচ্ছে - তখন দিনের বেলাতেও সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না, অথচ রাতের অন্ধকারও নয়। মেঘের আড়ালে যে সূর্য লুকায় তাও মানুষ প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে বের করলো।
            যতই নতুন নতুন জ্ঞানে জ্ঞানী হচ্ছে মানুষ ততই প্রকৃতির একেকটা রহস্যের উন্মোচন ঘটছে। সূর্য সম্পর্কে কত ধরনের ধারণা যে মানুষের ছিল সে সব দেখলে তোমাদের এখন হাসি পাবে। যেমন পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে দেখা যায় সূর্যদেব মানুষের মতো আচরণ করে। সূর্যের সন্তানের দেখাও পাওয়া যায় সেসব গ্রন্থে। রামায়ণে আছে সূর্যকে উঠতে না দিয়ে রাতের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর উদ্দেশ্যে একটা হনুমান নাকি সূর্যকে তার বগলের নিচে রেখে দেয় অনেকক্ষণ। তোমরা এখন জানো যে বাস্তব সূর্যের সাথে এরকম কল্পনা কতটাই হাস্যকর।
            কিন্তু অজ্ঞানতা মানুষকে ভীত করে তোলে। ফলে মানুষ ভয় পেয়ে অনেক অবাস্তব জিনিসই বিশ্বাস করে ফেলে। যেমন চীন দেশের অনেকেই এখনো বিশ্বাস করে যে সূর্যগ্রহণ হবার মূলে আছে একটি ড্রাগন। ড্রাগনটি খুব রাগ করে সূর্যকে গিলে ফেলে। ফলে সূর্যগ্রহণ হয়। তারপর রাগ মিটে গেলে আবার উগরে দেয়। তখন গ্রহণ কেটে যায়।  
                গ্রিক দার্শনিকেরা সূর্য সম্পর্কে নানারকম তত্ত্ব দিতে শুরু করেন খ্রিস্টের জন্মের অনেক বছর আগে থেকে। পৃথিবী থেকেই চাঁদ তারা সবকিছু দেখা যায়। তখনো কিন্তু খালি চোখেই আকাশের দিকে তাকিয়ে গ্রহ নক্ষত্রদের বোঝার চেষ্টা করতে হতো। ফলে বেশির ভাগ তত্ত্বই ছিল অনুমানভিত্তিক।
            প্রাচীন দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন গ্রিক বিজ্ঞানী থ্যালিস। খ্রিস্টজন্মের ৫৮৫ বছর আগের সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করে। প্রকৃতি যে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে সে ব্যাপারে জানার জন্য থেলিস মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পাইথাগোরাস, (যাঁর জ্যামিতিক্ক সূত্র আমরা জানি: সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের বর্গ ত্রিভুজের অন্য দুই বাহুর বর্গের যোগফলের সমান), সূর্য, পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোর পারস্পরিক অবস্থান এঁকে মহাবিশ্বের একটা চিত্র দিয়েছিলেন। নিচে চিত্রটি দেয়া হলো।


চিত্র: পাইথাগোরাসের মহাবিশ্ব


পাইথাগোরাসের মতে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে আগুন। এই আগুন কিন্তু সূর্যের আগুন নয়। কোত্থেকে এই আগুন এলো তার কোন ব্যাখ্যা নেই। এই আগুন থেকে পৃথিবীকে নাকি রক্ষা করছে বিপরীত-পৃথিবী বা প্রতি-পৃথিবী নামে আরেকটি পৃথিবী যা আগুনের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরছে। তখন ঘুরছে বললেই মনে করা হতো বৃত্তাকারে ঘুরছে। তারপর এই প্রতি-পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে চাঁদ। চাঁদের চারপাশে ঘুরছে সূর্য। সূর্যের চারপাশে ঘুরছে আরো সব নক্ষত্র বা তারা।
            তারপর প্লেটো তাঁর রিপাবলিক বইতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটা ধারণা দেন যা অনেকটা আমরা খালি চোখে যেভাবে দেখি সেরকম। প্লেটোর মহাবিশ্বের কেন্দ্রে আছে আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে চাঁদ। চাঁদের চারপাশে ঘুরছে সূর্য। সূর্যের চারপাশে ঘুরছে পর পর পাঁচটি গ্রহ। গ্রহগুলোর চারপাশে ঘুরছে অন্যান্য তারাগুলো। প্লেটোর মহাবিশ্বের ধারণা তখন প্রায় সবাই মেনে নেয়। সেই সময় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সঠিকভাবে মাপার প্রথম উপায় বের করেন গ্রিক দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ সালে। কিন্তু তখনো মানুষ মনে করতো সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে।


চিত্র: প্লেটোর মহাবিশ্ব


আরেকজন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টার্কাস খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ সালে প্রচার করেছিলেন সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলো ঘুরছে। কিন্তু অনেক বছর পর্যন্ত তাঁর মতবাদে কেউ সাড়া দেয়নি। অ্যারিস্টার্কাস পৃথিবী যে চব্বিশ ঘন্টায় নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসে, যার ফলে দিন ও রাত হয়, তা বলেছিলেন সেই সময়। অ্যারিস্টার্কাস চাঁদ ও সূর্যের আয়তন ও পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্ব মাপার চেষ্টা করেন।
            আলেক্সান্দ্রিয়ার টলেমি (আনুমানিক ১০০ থেকে ১৭০ খ্রিস্টাব্দ) জ্যোতির্বিদ্যায় গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর পারস্পরিক গতির একটা জটিল ধারণার প্রবর্তন করেন যা প্রায় দেড় হাজার বছর টিকেছিল। টলেমির মতে পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চারপাশে ঘুরছে সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রগুলো। তবে প্রত্যেকেই নিজের অক্ষেও ঘুরছে অবিরাম। নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতেই তারা পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। নিজের অক্ষপথে ঘোরার ব্যাপারটা টলেমির আগে এভাবে আর কেউ বলেননি।
            টলেমির ধারণার ভিত্তিতে প্রকৃতির অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা শুরু হয়ে যায়। পৃথিবীতে সুর্যের প্রভাবে যে ঋতু পরিবর্তন হয় তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। পৃথিবী-কেন্দ্রিক ধারণা বা পৃথিবীর চারপাশেই সবকিছু ঘুরছে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সংস্কার-কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় গুরুদের অনেক ক্ষমতাশালী করে তোলে। ফলে নতুন চিন্তা নতুন গবেষণা অনেকক্ষেত্রেই বাধা পায়। দেড় হাজার বছর ধরে টলেমির ধারণার বিরুদ্ধে নতুন কোন ধারণা পাওয়া যায়নি।


চিত্র: টলেমির মহাবিশ্বের ঘূর্ণন
           
১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে নিকোলাস কোপার্নিকাস ধারণা দেন যে সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবী ঘুরে। কোপার্নিকাসের কথায় সেদিন কেউ কান দেননি। অবশ্য কোপার্নিকাসের তত্ত্ব অনেক বেশি জটিল ছিল এবং আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের তখনো জন্মই হয়নি। ফলে কোপার্নিকাস খুব বেশি প্রমাণ দেখাতে পারেননি তাঁর তত্ত্বের সপক্ষে। তাছাড়া ধর্মীয় নেতাদের চোখরাঙানি তো ছিলই।
            গ্রিকদের মতো রোমানরাও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এগিয়ে আসেন। তবে রোমান গির্জার পাদ্রীরা অনেক বেশি গোঁড়া সংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেন। ১৫৪৮ সালে ইতালিতে জন্মেছিলেন জিওদার্নো ব্রুনো। গির্জার পাদ্রীদের তত্ত্বাবধানে বড় হলেও ব্রুনো ছিলেন সংস্কারমুক্ত চিন্তার পক্ষে। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীসহ আরো সব গ্রহরা ঘুরে বেড়ায়, খুবই যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় ব্রুনোর কাছে। তিনি নিবিড়ভাবে আকাশ দেখতে শুরু করেন। তিনি বুঝতে পারেন যে সূর্যই হলো পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস। সূর্যকে কেন্দ্র করেই পৃথিবীর ঘূর্ণন। সৌরজগতের মতো আরো অনেক নক্ষত্র-জগত আছে যেখানে আছে আরো সব গ্রহ। পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। এরকম আরো অনেক গ্রহ হয়তো আবিষ্কৃত হবে। প্রাকৃতিক ভাবেই এসব গ্রহ-নক্ষত্রের উদ্ভব হয়েছে এবং প্রাকৃতিকভাবেই এরা সব একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।
            ব্রুনোর এসব কথা শুনে পাদ্রিরা ক্ষেপে গেলো। সবকিছু যদি নিজে নিজেই হয়ে যায় তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকা কী? উত্তর স্বাভাবিক - মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোন ভূমিকাই নেই। এরকম হলে পাদ্রিদের ক্ষমতা আর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে টানাটানি দেখা দেবে। সুতরাং তারা ব্রুনোকে বন্দি করলো। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে রেখে নিজেদের মতো একটা বিচার করে ব্রুনোকে মৃত্যুদন্ড দিলো। ১৬০০ সালে পাদ্রিরা ব্রুনোকে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মেরে ফেললো।
            কিন্তু তাতে কি পৃথিবী থেমে গেলো? না। ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদ কেপলার প্রমাণ করলেন যে গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরে না, বরং উপবৃত্তাকারে ঘুরে। তার মানে সূর্যকে কেন্দ্র করেই ঘুরছে আমাদের পৃথিবী! এ যে কোপার্নিকাসের ধারণার সমর্থন, ব্রুনোর ধারণার সমর্থন। হ্যাঁ, তাই। তখনো কিন্তু খালি চোখে আকাশ দেখে দেখে এবং গাণিতিক ও জ্যামিতিক হিসেব করেই সব ধারণা ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে।
            তারপর ১৬১০ সালে গ্যালিলিও যখন টেলিস্কোপ তৈরি করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলোর দিকে চোখ রাখলেন সবকিছু দ্রুত পরিষ্কার হয়ে গেলো। গ্যালিলিও সৌরজগতের অনেক তথ্য আবিষ্কার করেন যা পুরো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণাকেই নতুন করে ঢেলে সাজায়। দূরবীণ যন্ত্রের উন্নতির সাথে সাথে সূর্যকে অনেক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ এসে গেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির ধারক গির্জা ও পাদ্রিরা গ্যালিলিওকেও ছেড়ে দেয়নি। পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে এই সত্য কথাটি প্রচার করার অপরাধে গ্যালিলিওর বিচার হয়। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর ধরে কারাগারে বন্দি অবস্থায় অত্যাচার করা হয় গ্যালিলিওকে। গ্যালিলিও শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন যে তিনি যা বলছেন তা ভুল, পাদ্রিরা যা বলছে তাই সত্য। অবশ্য এখন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গির্জা ও পাদ্রিরা গ্যালিলিওর ওপর যে অত্যাচার করেছিল তার জন্য ক্ষমা চেয়েছে কয়েক বছর আগে।
            আজ এটা প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য যে সূর্যকে কেন্দ্র করে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে সূর্যের সব গ্রহগুলো, পৃথিবী যাদের একটি। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে সূর্যের নিবিড় পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। সূর্য সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য আমরা অনেক বিস্তারিতভাবে জানতে পারছি মাত্র গত শতাব্দী থেকে। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে নিউক্লিয়ার ফিউশান ও নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশান সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানলাভের পর আমরা সূর্যের শক্তির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছি। নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র, কুলম্বের চার্জের সূত্র, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্র, নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক তত্ত্ব সব মিলিয়ে আমরা এখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি।
            আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র আছে। আছে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট (satellite), রেডিও টেলিস্কোপ অবজারভেটরি (radio-telescope observatory) ইত্যাদি নানারকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। আজ আমরা গ্রহ উপগ্রহগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছি শক্তিশালী টেলিস্কোপের সাহায্যে। গ্রহ-উপগ্রহগুলোতে ক্যামেরাসহ নানারকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা স্বয়ংক্রিয় রোবট পাঠিয়ে আমরা নিয়ে আসছি অনেক অজানা তথ্য। মহাবিশ্বের অনেক অজানা তথ্যই আজ মানুষের জানার সীমানায়। আজ আমরা সূর্য সম্পর্কে অনেক কিছুই জানি। চলো এবার সূর্যের আধুনিক তথ্য ও উপাত্তের দিকে তাকাই।

No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts